প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২৯

0
114

#প্রিয়_বিকালফুল(২৯)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“জুইয়ের সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমি তার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা স্পষ্ট দেখেছি। আমি বাসায় থাকলে তার খুশির সীমা থাকতো না। চলে যাওয়ার দুদিন আগে থেকে কান্নাকাটি করত। চলে যাওয়ার পর তাকে ফোন করলে প্রায় সপ্তাহখানেক মন খারাপের গল্প শুনতে হতো। আমাকে ছাড়া তার ভালো লাগে না, থাকতে ইচ্ছে করে না, একা একা লাগে কত কথা! আমারও সেম অনুভূতিটা হতো। তারপর সব অনুভূতির ইতি টেনে সে ছুটলো বিলাসিতার পিছনে। তার কাছে ভালোবাসা হলো তুচ্ছ আর নিজেকে ভালো রাখা হলো মুখ্য।”

উৎস থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল,“বিলাসিতা আর প্রতিপত্তির লোভ মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দেয়। সাথে যদি থাকে স্বামীর সাথে দূরত্ব তাহলে তো কোন কথাই নেই। আমি যখন জবে থাকতাম তখন ধীরে ধীরে আমাদের মনের দূরত্বটাও বাড়ে। একদিন আমার বন্ধু কল করে বলল জুইকে একটা লোকের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা গিয়েছে। ভাবলাম হয়তো পরিচিত বা বন্ধু হবে। তাকে সেটা ভেবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম সেও উত্তরে তাই জানিয়েছিল। আমার না কখনো ওকে সন্দেহ হয়নি। ভেবেছিলাম পছন্দ করে, ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছি সে কখনো ঠকাবে না। আমার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে এক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়ালো সে। আমার ওপর কোন একটা কিছুর দোষ তো দিতে হবে তাই কিছুদিন আগে থেকে তার চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। আমার বেতন তো কম ছিল না। আমিও একমাত্র স্ত্রী ভেবেই সব ইচ্ছে-পূরণ করতে থাকি। আসল কথা কি জানো, যখন দেখার বা ধরার কেউ না থাকে তখন শয়তান তার লোমকূপ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অপ*রাধ করায়। দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসা, সমাজ সব ভুলে কেউ কেউ নতুন কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাকে সবকিছুতে ছাড় দেওয়ায় সেটারই সুযোগ নিয়েছিল সে। আমার বলতেও বাঁধে জুই পরোকিয়ায় জড়িয়েছিল। প্রবাসী বা সেনাবাহিনি প্রায় কয়েক ধরণের জবে এমন হয় বলে জুইয়ের সাথে ডিভোর্সের সময় ভেবেছিলাম জবটাই ছেড়ে দেব তারপর ভাবলাম জব তো আমি শুধু আমার জন্য করিনি। তার জন্যও করেছিলাম। ভবিষ্যতে দুজন ভালো থাকব বলেই করেছিলাম আর সে আমার সাথে কী করল! তুমি তার কথা আমাকে আর কখনো জিজ্ঞেস কোরো না, নিতু। তার প্রতি, তার চাওয়ার প্রতি অসম্মান আমার নেই কিন্তু কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসাও নেই। সে তার চাহিদা, মানুষ নিয়ে ভালো থাকুক। আমার এখন তুমি আছো। আছো না?”

নিতু মূলত জুইয়ের ব্যাপারে টুকটাক জানতে চেয়েছিল উৎসের কাছে। সেই জানায় যে এত তিক্ততা মিশে থাকবে কে জানতো!

নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল, “এগারো বছরের বেশি শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। এর চেয়ে বেশি তো আর কখনো অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি বাড়ি ফিরলে, আমার কাছেই ফিরবে আর তোমার ফেরাগুলো হবে নতুন করে নতুনভাবে তোমাকে পাওয়া।”

নিতুর দিকে তাকিয়েই কফিতে চুমুক দিল উৎস। মৃদু গলায় বলল,“কেউ আমাকে এভাবেও ভালোবাসে ভাবতেও অসম্ভব ব্যাপার মনে হয়৷ একটা মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারিনি আমার সাথে এমন হবে।”

“জীবনটা হলো নাহয় একটু সিনেমাটিক। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু অস্বাভাবিক হলে মন্দ কী?”

উৎস ঘড়িতে সময় দেখল। বেশ কিছুক্ষণ আগে তারা দুজনে বের হয়েছে। রেস্টুরেন্টে বসার আগে নিতু বন্যাকে কল করেছিল। মূলত উৎস আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যেই জবের উদ্দেশ্যে চলে যাবে তাই দুজনে একসাথে বন্যার সাথে মিট করতে চাইছিল। বন্যার সাথে দেখা করে তাড়াতাড়ি দুজনের আবার বাসায় ফিরতে হবে। নিতু উৎসকে ঘড়ি দেখতে দেখে বলল,

“কয়টা বাজলো?”
“একটু পর মাগরিবের আজান দেবে। কখন আসবে তোমার বান্ধবী? ”

নিতুকে চিন্তিত দেখালো।
”কী জানি! আরেকবার কল দেই কী বলো?”
“দিয়ে দেখো।”

উৎসের অনুমতি পেয়ে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে বন্যাকে কল দিল নিতু। কল কেটে দিল বন্যা। নিতু ঠোঁট উল্টে ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,

“কেটে দিল।”
“তাহলে হয়তো চলে এসেছে।”
“হতে পারে।”

উৎস কফির মগটা সরিয়ে রেখে বলল,“নিজের ক্যারিয়ার, কাজ এসব নিয়ে কী ভাবছো?”

নিতু ভাবুক দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকালো। সে আসলেই এ ব্যাপারে আর কিছু ভাবেনি। নিতুকে চুপ থাকতে দেখে উৎস বলল,

“তোমার কাজে আমার বাঁধা নেই। তুমি যদি কাজ করতে চাও তবে করবে। অলস বসে না থেকে কাজের মধ্যে থাকলে ভালোও লাগবে।”

নিতু বলল,“ভালো ভালো কিছু কাজ পেলে তবেই করব।”

দুজনের কথার মাঝে বন্যা এসে উপস্থিত হলো। দুজনকে একসাথে দেখে হেসে ফাঁকা চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল,“দুজন একসাথে! আমি তো ভাবিইনি যে একসাথে দুজনের দেখা পাব।”

নিতু হেসে বলল,“দুজনকে একসাথে করতে তোর এত এত বাণী আর দুজনকে একসাথে দেখবি না!? দেখতেই হবে।”
“অবশ্যই। দেখতে চেয়েছিলাম আর দেখেও নিলাম।” বলেই উৎসের সাথে টুকটাক কথা বলা শুরু করল বন্যা।

খাবার অর্ডার দেওয়া হলো। খাওয়া দাওয়া ব্যতীতও তিনজনের দারুণ সময় কাটলো। বন্যা অনুভব করল, দুজনকে একসাথে দেখে তার শান্তি শান্তি লাগছে। সামনে বসা এই মেয়েটাকে সে গত কয়েক বছরে কম ছেলে খুঁজে দেয়নি বিয়ে করার জন্য। কাউকেই সে পছন্দ করে আবার কারও সাথে দেখা বা কথা অবধিও যায়নি। এই উৎসকে নিয়ে তার কত আফসোস ছিল আর এখন! দুজনে এই কয়েক দিনে নিজেদের কত আপন করে নিয়েছে! এদের দেখে বোঝারই উপায় নেই, মাত্র ক’দিন আগেই বিচ্ছেদের খেলায় মত্ত ছিল দুজনে। অভিমান মানুষকে হিং*স্র আর ভালোবাসা মানুষকে হয়তো সত্যিই অন্ধ বানিয়ে দেয়। বন্যা মনে মনে বলে উঠল,

”ভালোবাসায় সারাজীবন একসাথে বেঁচে থাক দুজনে।”
___

আজ রাতে উৎসের রান্না করার কথা। দুজনে বাসায় ফেরার পর উৎস ঠিক করল আজ রাতে সে বিরিয়ানি রান্না করবে। নিতু ফরিনা বেগমের থেকে শুনে এসে জানালো তারা দুজনে বিরিয়ানি নয় মাংস, খিচুড়ি খাবে। এদিকে উৎস বিরিয়ানি ছাড়া অন্যকিছু রান্না করতে নারাজ।

“আমরা যেহেতু খাব সুতরাং তোমাকে আমাদের পছন্দমতো খাবার রান্না করতে হবে। এই কথাই শেষ কথা।” বলে দুই পা তুলে বিছানার ওপর বসলো নিতু।

উৎস দুইহাত বুকে চেপে নিতুর পাশে বসে বলল,“আমাকে আমার পছন্দমতো রান্না করতে না দিলে আমি কিছুই রান্না করব না। ফোনটা হাতে নেব। অনলাইনে খিচুড়ি আর মাংস অর্ডার করব। আধাঘণ্টার মধ্যে বাসায় দিয়ে যাবে। আমার হাতের বিরিয়ানি আর খাওয়া হবে না।”

নিতু উৎসের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। দুই হাত দিয়ে উঁচিয়ে উৎসকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় বলে উঠল, “প্লিজ উত্তেজিত হবেন না।”

নিতুর কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎস। ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বলল,

“আপনি আমাকে উত্তেজিত করছেন।”
নিতু উঠে দাঁড়ালো। কোমরে দুই হাত দিয়ে শুধালো, “এর দায় আসলে কার?”
“নিতু ছাড়া আর কার?”
“শা*স্তি কী হবে?”

“আপনাকে আমার মনের আয়নাঘরে যাবজ্জীবন কারা*ভোগ করতে হবে।” বলেই নিতুর দিকে এগোতে থাকল উৎস।

নিতু পিছিয়ে গেল খানিকটা। চোখ টিপে বলে উঠল,
“মুরুব্বি মুরুব্বি উহুম উহুম।”

উৎস এক ঝটকায় নিতুকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। অনামিকার সাহায্যে মুখটা তুলে বলল,

“ইটস্ মাই টার্ন নাউ।”

নিতু ঠেলে উৎসকে সরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠল,“নাটক কম করো পিও। জলদি গিয়ে বিরিয়ানি রান্না করো।”

উৎস নিতুর চোখে চোখ রেখে বলল,“একটা চুমু দিয়ে দাও। এনার্জি এলেই রান্নাঘরে চলে যাব।”

“আগে রান্না করে খাওয়াও, আমার এনার্জি এলেই চুমু দিয়ে দেব।” বলেই হেসে উঠল নিতু।

উৎস অসহায়ের মতো মুখ করে বললে,“ভাগ্য করে বর পেয়েছিলে একটা।”

নিতু চকিতে বলে উঠল,“ভাগ্য করে কি কেউ চার, পাঁচটা এমন জামাই চায় নাকি?”

“একটাকেই দেখো সামলাতে পারো কি-না।” বলেই নিতুর গলায় মুখ ডুবালো উৎস। নিতু তড়িৎ চোখ বন্ধ করে নিল। ওভাবেই বলে উঠল,

“আদর নয় এখন বিরিয়ানি খাওয়ার ম্যুড আমার।”

#চলবে…..