প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৩২

0
34

#প্রিয়_বিকালফুল(৩২)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

বিয়ে বাড়িতে ঘটলো এক বড় অঘটন। বরযাত্রী যাওয়ার আগ মুহূর্তে বাড়ির বউয়েরা সবাই মিলে টুকটাক নাশতার ব্যবস্থা করছিল। মেয়েদের যেহেতু তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে তাই মেয়েরা আগে আগে গোসল শেষ করে তৈরি হয়ে নিতে ব্যস্ত। নিতুও তৈরি হয়েছে। ওদিকে কারও চিৎকার শুনে নিতু এবং মালিহা ছুটে রান্নাঘরের দিকে যায়। মহিলাটি দুজনকে ছুটে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই খালি পায়ে দৌঁড়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে নিতু মেঝেতে পিছলে ধপ করে পড়ে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে গেল মালিহা। সামনে দাঁড়ানো মহিলাটি বলে উঠল,

”আমার হাতে থেকে গরম পানির পাতিল পড়ে গেছে। গরম পানি ছিঁটে হাতে, পায়ে পড়েছে। তোমরা দৌঁড়ে কেন আসতে গেলে? ইশ বউটাকে তোলো তাড়াতাড়ি। পানি এখনো গরম আর কত জোরে পড়ে গেল, ইশ!”

মহিলাটি আফসোস করতে করতে এগিয়ে এলেন। এদিকে নিতু প্রচন্ড জোরে আঘা**ত পাওয়ায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মালিহা পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে দিল নিতুর দিকে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

”উঠে এসো, নিতু৷ খুব জোরে লেগেছে না?”

নিতু চোখ খুললো। জোরপূর্বক হেসে বলল,”তেমন লাগেনি, ভাবি।”
“দেখি উঠে এসো তো। ইশ, ভিজে গেল তো শাড়ি।”

দুজনে মিলে নিতুকে ধরে দাঁড় করালো। দাঁড়া হতেই নিতু বুঝল হাত এবং হাঁটুটা খুব জ্বল*ছে৷ দুইহাত সামনে নিতেই দেখল হাতের তালু লাল হয়ে গেছে। কান্না পেয়ে গেল নিতুর। কোমরেও হালকা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। খুব কষ্টে রান্নাঘরের বাহিরে পা রাখলো সে৷ হাঁটুতে একটু টান পড়লেই ব্যথা লাগছে।

উৎস নিজের ওয়ালেট নিতে নিতুর কাছে আসছিল। ড্রয়িংরুমে দুইজন নিতুকে ধরাধরি করে রুমের দিকে নিয়ে আসছে দেখে আশ্চর্য হলো। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যস্ত গলায় শুধালো,

“কী হয়েছে? ওকে ধরে আনতে হচ্ছে কেন?”

নিতু ছলছল চোখে তাকালো উৎসের দিকে। নিতুর চোখের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে হঠাৎই খচখচ করর উঠল উৎসের। পাশে থেকে মহিলাটি বলে উঠল,

“আপনার বউ পড়ে গেছে, আব্বা। আমার গায়ে গরম পানি ছিটে আসায় চিৎকার দিয়েছিলাম। দৌঁড়ে যাওয়ার সময় পানিতে পিছলে পড়ে গেছে। কোমরে আর পায়ে জোরে লেগেছে।”

উৎস কিছুক্ষণ অসহায় চোখে নিতুর দিকে চেয়ে রইল। তারপরই নরমগলায় বলল,

“কোন রুম ফাঁকা আছে?”

মালিহা হ্যাঁসূচক মাথা নেড়ে বলল,“হ্যাঁ, রিশার রুম ফাঁকা আছে। ও তো ওর রুমে তেমন কাউকে এলাউ করে না। রেডি হওয়ার পর নিজের রুমেই বসে আছে, বিয়েতে যাওয়ার সময় হয়তো লক করে যাবে।”

উৎস নিতুর হাতটা ধরে আলগোছে কোলে তুলে নিল৷ মালিহার পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি হয়তো কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল। আঁচল দিয়ে মুখের কিছু অংশ ঢেকে নিল। ড্রয়িংরুমে আশেপাশে যারা ছিল তারা সবাই উৎস আর নিতুর দিকে চেয়ে রইল। নিতু এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখতেই নিজেরও এই পরিস্থিতিতেও লজ্জা লাগল। অস্পষ্টভাবেই বলে উঠল,

“সবাই দেখছে। ভাবিই ধরে নিয়ে যেত রুম অবধি। আমার সেরকম কিছু হয়নি।”
”চুপ। কোন কথা না। ভাবি রিশাকে একটু বলুন, রুমে যদি কেউ থাকেও তবুও যেন রুমটা খালি করে দেয়। আমি নিতুকে ওখানে নিয়ে আসছি। আর বাহিরে গাড়ি সবার জন্য অপেক্ষা করছে। যাদের যাওয়ার কথা সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।” শেষাক্ত কথাগুলো মালিহাকে উদ্দেশ্য করে বলল উৎস।

নিতুর জন্য রিশার রুমের বিছানা ঠিক করে দিলে উৎস নিতুকে সেখানে শুইয়ে দিল। বউমার এমন দূর্ঘটনার খবর পেয়ে ফরিনা বেগম ছুটে এলেন বাহিরে থেকে। বাড়ির কয়েকজন এগিয়ে আসতেই ছোট রুমটা প্রায় ভরতি হয়ে গেল। উৎস নিতুকে রেখেই রিশার কাছে শুনে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে গিয়েছে।

ফরিনা বেগম নিতুর কাছে বসে অবিন্যস্ত শব্দে শুধালেন,“ ম, মা, কোথায় লেগেছে বল তো? খুব জোরে লেগেছে?”

নিতু দুধারে মাথা নাড়িয়ে বলল,“তেমন লাগেনি। সামান্য লেগেছে সেটা অল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন কেন? আমি তো চুপ করে বসে থাকতে বলেছিলাম।”

ফরিনা বেগমেরও বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। প্রথমে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও সবার জোরাজোরিতে যেতে রাজি হয়েছিলেন। বাহিরে গাড়িতে গিয়ে বসেছিলেনও পরে নিতুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। এই মুহূর্তে নিতুর এমন কথা শুনে তিনি বলে উঠলেন,

“আমার মেয়েটার এমন অবস্থা আর আমি বিয়েতে যাব?”

“হ্যাঁ, যাবে।” উৎসের কথায় সবাই তার দিকেই ফিরে তাকালো।

উৎস এগিয়ে এসে নিতুর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,“আম্মা, তুমি বিয়ে বাড়িতে যাবে। তোমার এই বয়সে একটু আনন্দের সুযোগ পেয়েছ সেটাও উপভোগ করবে না? আর নিতুর জন্য আমি তো আছি। আমার ওপর ভরসা করে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না।”

ফরিনা বেগম কিছু বললেন না শুধু চুপচাপ উৎসের দিকে চেয়ে রইলেন। উৎসের কথায় রিশা সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়েও গেল। উৎসের কথায় ফরিনা বেগমও যেতে বাধ্য হলেন। ছেলের ওপর পুরো ভরসা আছে কিন্তু তবুও নিতুর জন্য দুশ্চিন্তা হওয়া বাদ গেল না। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো উৎস যেতে পারবে না৷ বাড়ির কয়েকজন উৎসকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, তারা নিতুর দেখাশোনা করতে পারবে সে যে যায় কিন্তু উৎস কিছুতেই যেতে রাজি হলো না।

কোথায় কোথায় চো*ট লেগেছে জানতে চাইলে নিতু সেটার জবাব দেওয়ার পূর্বেই বলে উঠল,“আমার তেমন লাগেনি। তুমি শুধু শুধু আমার কথা অতিরিক্ত ভেবে বিয়ে বাড়িতে গেলে না। ”

উৎস নিতুর একদম কাছে এসে বলল। নিতুর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,“বর্তমানে তোমার চেয়ে জরুরি আমার কাছে কিছুই নেই, নিতু। তোমার ব্যথায় সামান্য ‘আহ’ শব্দটাও আমার বুকে বিঁ*ধে দেখানে আমি তোমার চোখের পানি দেখেছি।”

নিতু এক পলকে চেয়ে রইল উৎসের দিকে। শরীরের অসম্ভব ব্য*থায়ও উৎসের কথায় ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো নিতুর।

বরযাত্রী নতুন বউ নিয়ে ফিরল রাত আটটার পর। বাড়িতে হৈ হৈ কান্ড। সবাই নতুন বউকে বরণ করতে এবং নতুন বউকে দেখতে ব্যস্ত। এদিকে নিতু উৎসের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। উৎস খাটে হেলান দিয়ে অর্ধেক শোয়া অবস্থায় আছে। নিতুর ব্য*থা প্রশমনে যা যা করা প্রয়োজন সেটা করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে।

বাহিরে সবার হৈ-হুল্লোড়ে ঘুম ভাঙলো নিতুর। চোখ জ্বল*ছে। মাথাটাও ভারি ভারি লাগছে। একটু নড়তে গিয়েই কোমরের ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল সে। ঘুম ভেঙে গেল উৎসেরও। নিতুকে নড়তে নিষেধ করে নিজে উঠে বসলো আর নিতুকে ধরে তুলে বসালো। কপালে হাত দিয়ে বুঝলো শরীরের ব্য*থায় জ্বর চলে এসেছে নিতুর। চোখ দুটো কেমন লাল লাল হয়ে আছে।

নিতু বলল,“ নতুন বউ এসেছে। আমার গিয়ে দেখা হবে না? কোমরে প্রচন্ড ব্যথা হয়েছে।”

উৎস মুখের ভঙ্গিমা পালটে বলল,“তুমি তো শুধু হাতের তালু আর হাঁটুর কথা বলেছিলে। কোমরের কথা বলোনি তো! এখন বলছো কোমরে প্রচন্ড ব্যথা?”
“আমি বুঝতে পারিনি ব্য*থা হবে।”

“লেগেছে সেটা তো বলতে পারতে৷ আমিও ভেবেছিলাম পায়ে লেগেছে বলেই নড়তে পারছিলে না। রাত বেশি হয়নি। আমি আম্মার সাথে দেখা করে আসছি। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আমাদের।” বলেই উৎস বিছানা ছেড়ে উঠতেই নিতু উৎসের হাতটা ধরে ফেলল। বলল,

”আজকের রাতটা দেখি?”
“এক মিনিটও চুপচাপ আপনার ব্য*থা সহ্য করতে পারব না আমি৷ চুপচাপ বসে থাকুন।”

উৎস বেরিয়ে গেল রুম থেকে। নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মানুষটা যে এক ফোঁটাও কম্প্রোমাইজ করবে না সেটা সে জানতো বলেই তখন কোমরের ব্য*থার কথা বলেনি। ভেবেছিল কমে যাবে কিন্তু নড়তেই পারবে না সেটা কে জানতো!

ফোনকলে কেঁপে উঠল বিছানা। পাশে তাকাতেই নিতু বিছানায় উৎসের ফোন দেখতে পেল। উল্টো হয়ে পড়ে আছে। হাতে নিতেই দেখল অচেনা নম্বর থেকে কল। ভাবুক দৃষ্টিতে ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে রইল সে। প্রয়োজনীয় কোন কল? প্রয়োজনীয় হলে সেভ থাকার কথা নম্বর কিন্তু এটা অপরিচিত নম্বর। এটা ওটা ভাবতে ভাবতে কলটা কে*টে গেল। মুহূর্তের মধ্যে একটা টেক্সট এলো একই নম্বর থেকে। নিতু চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে বিড়বিড় করল,

“উৎস, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি জুই।”

#চলছে…..