#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
আচমকা এত রক্ত দেখে প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় অন্বিতা। পাশ থেকে একটা টিস্যু নিয়ে হাতটা চেপে ধরে। ভাবে, অল্প কেটেছে, ঠিক হয়ে যাবে এমনিতেই। কিন্তু এই রক্ত পড়া থামার নাম নেয় না আর। কতক্ষণ আর টিস্যু চেপে রাখা যায়! টিস্যুও রক্তে লাল হয়ে উঠেছে ইতমধ্যেই। সে হাতখানা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালায়।
মাহির তার কাজে ব্যস্ত। তাও তার তীক্ষ্ণ, গভীর দৃষ্টি থেকে অন্বিতা রেহাই পায় না। সে ঠিকই অন্বিতার হাত নিয়ে অস্থিরতা ঠাহর করতে পারে। জিজ্ঞেস করে,
‘এনি প্রবলেম, মিস অন্বিতা?’
অন্বিতা সম্বিত হলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘না না, স্যার, সব ঠিক আছে।’
‘হাতে কী হয়েছে আপনার?’
অন্বিতা হাতটা পেছন দিকে নিয়ে বলল,
‘কই, কিছু না তো।’
মাহির এগিয়ে আসে তার দিকে। বলে,
‘হাতটা দেখি তো।’
অন্বিতা মাথা নুইয়ে বলে,
‘কিছু হয়নি।’
‘হাতটা সামনে আনুন।’
অন্বিতার হাতের রহস্য উদঘাটন করতে একজন ডাক্তার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দেখে, অন্বিতার হাত বেয়ে রক্ত মেঝেতে পড়ছে। সে আঁতকে উঠে বলে,
‘স্যার, উনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে।’
সঙ্গে সঙ্গে মাহির অন্বিতার হাত ধরে সামনে আনে। তার রক্তাক্ত হাত দেখে পিলে চমকে উঠে মাহিরের। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
‘হাত কাটল কী করে?’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘স্ক্যাল্পেল’টা দিয়ে।’
‘সেকি! এতক্ষণ ধরে বলছিলে না কেন?’
অন্বিতা হাতটা সরিয়ে নিল। আশেপাশে চেয়ে দেখল, তাদের দিকে সবাই অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে। সে ঢোক গিলে বলল,
‘তেমন কিছু না, সামান্য কেটেছে শুধু।’
মাহির ধমক দিয়ে বলল,
‘সামান্য কাটলে কি এত রক্ত বের হতো? ঐদিকে বসো গিয়ে, আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।’
‘আমি নিজে নিজে পারব।’
‘তোমাকে যেটা বলা হয়েছে তুমি সেটা করো।’
মাহিরের রাগি গলার স্বরে অন্বিতা আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মাহির ড্রেসিং এর সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তার সামনে আসে। অন্বিতার কাটা হাতটা যত্ন করে ড্রেসিং করে দেয়। বাকি ইন্টার্ন ডাক্তাররা এখনো পূর্বের ন্যায় বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। একজন সিনিয়র ডাক্তারের তাঁর এমপ্লয়ি’র প্রতি এতটা উদ্বিগ্ন হওয়াটা খুব একটা মানায় না। তাদের এমন অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে অন্বিতা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। হাতটা বারবার সরিয়ে নিতে চেয়েও মাহিরের জন্য পারছে না। তাই ক্ষীণ সুরে বলল,
‘সবাই দেখছে, স্যার।’
‘তো?’
বরাবরের মতোই উদাসীন, হেলদোলহীন মাহির। অন্বিতা বলল,
‘সবাই খারাপ ভাববে।’
মাহির চোখ তুলে তাকাল। দুই ভ্রু এর মাঝে তিনখানা ভাঁজ। বলল,
‘এখানে খারাপ ভাবার মতো কী করছি আমি?’
‘এই ড্রেসিং’টা একজন নার্সও করাতে পারত, অযথা আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন?’
‘আমি উপস্থিত থাকতে নার্সকে দিয়ে ড্রেসিং করানোর কোনো মানে হয় না।’
অন্বিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝাল, সে এই লোকটার সাথে কথা বলে আর পারছে না। ড্রেসিং শেষ করে উপস্থিত বাকি সব ডাক্তারদের দিকে তাকাল মাহির। তার হাতে এখনো অন্বিতার বেন্ডেজ করা হাত। অন্বিতা এখনো তা সরাতে ব্যর্থ। মাহির বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন সবাই?’
সবাই অপ্রস্তুত হলো এমন প্রশ্ন শুনে। অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার মিথ্যে ভান করল। তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসল মাহির। বলল,
‘থাক, আর কষ্ট করতে হবে না। আপনাদের চিন্তার অবসান ঘটায়; শি ইস মাই ফিয়ন্সি, আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে।’
কোটর থেকে যেন বেরিয়ে পড়বে কতগুলো চোখ। তমা নামের মেয়েটার দুঃখে চোখে জল জমল। বাকি সবাইও অবাক হয়েছে বেশ। অন্বিতা চেয়ে আছে বিরক্তির চোখে। এই মানুষটা সবসময় ভুল সময়ে ভুল কথা বলে।
মাহির জিজ্ঞেস করল,
‘আর কিছু বলার আছে আপনাদের?’
সবাই মাথা নাড়িয়ে “না” করল।
‘বেশ, নিজেদের কাজে মনোযোগ দিন তবে।’
সবাই যার যার কাজে মনোযোগ দিল আবার। অন্বিতা তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। তমা নামের মেয়েটা তার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এত বড়ো কথাটা এতদিন বলোনি কেন, হ্যাঁ? আমি আরো তোমার ফিয়ন্সিকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে গিয়েছি।’
অন্বিতা অল্প হেসে বলল,
‘আজ থেকে তা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও, তাহলেই তো হয়।’
মেয়েটা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
_____________
‘মাথার সেলাই’টা খোলার পরেও তো যেতে পারতাম, এই ডাক্তারের এত তাড়া কেন?’
অয়ন অমিতের ঔষধপত্রগুলো গোছাতে গোছাতে বলল,
‘তোর হাসপাতালে থাকার এত ইচ্ছে কেন?’
অমিত ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কেন, তোর ইচ্ছে নেই?’
‘অবশ্যই না।’
‘শোন, জীবনের কোনো সুযোগকে হাতছাড়া করতে নেই। হতেও পারে আমার এই এক্সিডেন্ট অনেক বড়ো একটা বদল ঘটিয়ে ফেলবে।’
অয়ন বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘তেমন কিছুই হবে না। তুই অযথাই আশা ধরে বসে আছিস।’
‘একবার চেষ্টা করতে দোষের কী?’
‘বারবার সেই একই কথা বলছিস। তুই তো এখন আর অবুঝ নোস।’
অমিত নাক ফুলাল। রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ধুর, তোর সাথে কথা বলে কোনো মজাই নেই। যা তো একবার অন্বিতাকে ডেকে নিয়ে আয়, যাওয়ার আগে একবার ওর সাথে ভালো করে কথা বলে নেই।’
অয়ন উল্টো রাগ করে বলল,
‘পারব না।’
‘যা না, এমন করিস কেন?’
‘বললাম না, পারব না।’
এরই মাঝে দরজায় নক হলো। ওপাশ থেকে একজন বলল,
‘আসব?’
অমিত খুশি হয়ে বলল,
‘দেখেছিস, আমাকে কত বোঝে। আমি বলার সাথে সাথেই চলে এসেছে।’
অয়ন চোখ মুখ শক্ত করে চাইল। অমিত হেসে বলল,
‘আসুন।’
অন্বিতা ভেতরে এল। বলল,
‘শরীর ঠিক আছে আপনার?’
‘না, মানে খুব একটা না। তবে হাসপাতাল থেকে আজই রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে।’
অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,
‘ডাক্তার আপনাকে দেখেননি?’
‘জি, দেখে গিয়েই রিলিজ দিয়েছেন।’
‘আপনার শরীর ঠিক লাগছে না, সেটা ডাক্তারকে বলেছেন?’
‘না, সেটা তো বলিনি। ভেবেছি ডাক্তার এমনিতেই হয়তো বুঝবেন।’
‘আচ্ছা আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলব।’
অমিত প্রসন্ন সুরে বলল,
‘ঠিক আছে।’
অন্বিতা ফিরে আসতে নিলেই অয়ন জিজ্ঞেস করল,
‘হাত কাটল কী করে?’
ফিরে চাইল অন্বিতা। মৃদু হেসে বলল,
‘ঐ বেখেয়ালি ভাবে কাজ করতে গিয়ে স্ক্যাল্পেল দিয়ে কেটে গিয়েছে।’
অমিত বলল,
‘একটু সাবধানে কাজ করবেন।’
‘আচ্ছা।’
অন্বিতা চলে এল। অয়ন চোখ রাঙিয়ে অমিতের দিকে চেয়ে বলল,
‘এত মিথ্যে না বললেও পারতি।’
‘মিথ্যে কোনটা বললাম? শরীর তো আমার এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি।’
অয়ন আর কথা না বাড়িয়ে সোফায় বসে পড়ল। এই ছেলেকে আর কিছু বলেও লাভ নেই। অমিত ঠোঁট উল্টে ঢং করে বলল,
‘তোর জায়গায় অন্যকেউ থাকলে এতক্ষণে আমাকে ধরে চুমু খেত।’
‘আমি তো আর তোর মতো গে না।’
‘শা*, জীবনেও নিজের ভালোটা বুঝবি না।’
‘অন্যের ক্ষতি করে নিজের ভালোতে কোনো লাভ নেই।’
‘লাভ আছে। তুই বোকা, তাই বুঝিস না।’
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘তোকে আমি বোঝাতে পারব না।’
‘বোঝাতে হবে না, আমি বুঝি সব।’
চলবে….