একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-২৯+৩০

0
20

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।

‘আসব, স্যার?’

ভেতর থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এল।

‘আসুন।’

তাইভিদ ভেতরে প্রবেশ করে। মাহিরের বিপরীতে চেয়ারে বসা শশীকে একপলক দেখে মাহিরকে জিজ্ঞেস করে,

‘ডাকছিলেন, স্যার?

মাহির অনিমেষ চেয়ে থেকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘উনার সাথে না-কি আপনি খারাপ ব্যবহার করেছেন?’

তাইভিদ হতবাক। শশীর দিকে তাকাল সে। শশীর চোখ মুখ শক্ত। তাইভিদ অপ্রস্তুত সুরে বলল,

‘এসব কী বলছেন, স্যার? আমি উনার সাথে কেন খারাপ ব্যবহার করব?’

শশী চট করে গর্জে উঠল। সরোষে বলল,

‘একদম মিথ্যে বলবেন না। কালকে আর তার আগের দিন আপনি আমার সাথে খারাপ আচরণ করেননি? হুমকি দেননি? বেয়াদব লোক।’

তাইভিদ মেজাজ হারাল। তাকে এভাবে “বেয়াদব” বলার সাহস কেউ আজ অবধি দেখায়নি। শুধুমাত্র স্যারের আত্মীয় বলে এত বড়ো অপবাদ’টা নিখুঁত কৌশলে হজম করে নিল সে। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলল,

‘ম্যাডাম, আপনি মিথ্যে বলবেন না। হুমকি আমি আপনাকে দেয়নি, আপনি দিয়েছেন।’

শশী চটে গিয়ে মাহিরের দিকে চাইল। উত্তেজিত সুরে বলল,

‘দেখেছ, দেখেছ, তোমার সামনেও আমাকে কেমন কথা শুনাচ্ছে।’

‘আমি কথা শুনাচ্ছি না, ম্যাডাম। শুধু সত্যটা বলছি। আপনার সাথে আমি কোনোপ্রকার খারাপ ব্যবহার করিনি। তাও আমার কোনো ব্যবহারে আপনি কষ্ট পেয়ে থাকলে, আমি দুঃখিত।’

শশী রোষানলে জ্বলছে। তার আকাশচুম্বি অযাচিত রাগ প্রশমিত হচ্ছে না। সে সন্তপ্ত সুরে মাহিরকে বলল,

‘তুমি কি কিছু বলবে না, মাহির?’

‘ও ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে। ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করে দাও।’

শেষ করা তো দূরে থাক, শশী উল্টো দ্বিগুণ ভাবে জ্বলে উঠল। এমন প্রতিক্রিয়া দেখাল, যেন ছেলেটা তার মান সম্মান নিয়ে টান দিয়েছে। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাজখাঁই স্বরে বলল,

‘তোমাকে আমার বলাটাই ভুল হয়েছে। আমার কথার কোনো দাম’ই নেই তোমার কাছে। এখন আমার জায়গায় অন্বিতা থাকলে তুমি ঠিকই দাম দিতে। এই ছেলেকে কাজ থেকে বের করে দিতে। অথচ আমি বলে আজ তুমি নীরব। ঠিক আছে, লাগবে না আমার কোনো বিচার। আমি সবার সব খারাপ ব্যবহার সয়ে যেতে পারব।’

এই বলে সে হেঁটে দরজার দিকে যায়। তাইভিদের সামনে এসে এক পল দাঁড়িয়ে তাকে কটমট করে দেখে ফের রওনা দেয় নিজের গন্তব্যে। সে বেরিয়ে যেতেই তাইভিদ নিরুত্তাপ সুরে বলে,

‘স্যার, আমি সত্যিই উনার সাথে কোনোপ্রকার খারাপ আচরণ করিনি। তাও আপনার আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন।’

মাহির তার দিকে চেয়ে প্রসন্ন গলায় বলে,

‘আপনাকে আমি যথেষ্ট বিশ্বাস করি, তাইভিদ। সমস্যা হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে। আংকেল মারা যাওয়ার পর ফুপি একা হাতে ওকে বড়ো করেছে। ও সবার খুব আদরের। তাই এমন অনেক কিছু জেনে বুঝেও শুধুমাত্র ফুপির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ওকে কোনো কিছু বলতে পারি না। আপনি কিছু মনে করবেন না, ওর হয়ে আমি আপনাকে স্যরি বলছি।’

বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে তাইভিদ। ইতস্তত সুরে বলে,

‘না না, স্যার, আপনাকে স্যরি বলতে হবে না। আর উনার কথায় আমি কিছু মনে করিনি।’

মাহির হেসে বলে,

‘আপনি ভীষণ ভালো একজন মানুষ। নিজের ব্যক্তিত্বকে এভাবেই ধরে রাখবেন।’

মাহিরের প্রশংসা পেয়ে তাইভিদের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। এত আনন্দ হয়তো কোনো মেয়ে প্রশংসা করলেও হতো না, যতটা এখন হচ্ছে। সে হেসে বলে,

‘দোয়া করবেন, স্যার।’

‘অবশ্যই।’

‘স্যার, দশটা বেজে গিয়েছে। রোগীদের ডেকে নিব।’

‘ঠিক আছে।’

_______________

কিছু জরুরি ফাইল নিয়ে করিডোরে হেঁটে যাচ্ছিল তাইভিদ। পানি খেয়ে তাকে দেখে এগিয়ে আসে অন্বিতা। অন্বিতাকে দেখে পা থামায় তাইভিদ। জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু লাগবে, ম্যাডাম?’

অন্বিতা নিচু সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘শশী চলে গিয়েছে?’

শশীর কথা মনে আসতেই চোখ মুখ আষাঢ়ী নিকষ আধারে ঢেকে যায় তাইভিদের। মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘জি, চলে গিয়েছে।’

‘কেন এসেছিল, জানেন কিছু?’

তাইভিদ হতাশ সুরে বলে,

‘আর কেন, আমার চাকরি খেতে।’

আচম্বিত হয়ে অন্বিতা বলে উঠে,

‘মানে? কী বলছেন এসব?’

তাইভিদ আদ্যোপান্ত খুলে বলল সব। পুরো বিবরণ শুনে এক লহমায় অন্বিতার মুখের রং পাল্টে গেল। ক্ষুব্ধ গলায় বলল,

‘সবার জীবনে অশান্তি করা’ই বোধ হয় এই মেয়েটার কাজ। আমার জীবনেও যত অশান্তি হয়েছে তার একচ্ছত্র দায়ভার এই মেয়ের। এখন আবার আপনার পেছনে পড়েছে। মাহির আপনাকে বিশ্বাস করেছে তো?’

তাইভিদ নিশ্চিন্ত মনা হয়ে বলে,

‘জি ম্যাডাম, স্যার আমাকে বিশ্বাস করেছেন। ঐ মেয়ের হয়ে তিনিও স্যরিও বলেছেন আমাকে। তবে যতটুকু বুঝলাম, স্যারও উনাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। হয়তো আত্মীয় বলে কোনোরকমে গা বাঁচিয়ে চলছেন।’

‘তা ঠিক বলেছেন। তবে চিন্তা করবেন না, আমাদের বিয়ের পর ঐ বাড়িতে গিয়ে আমি মেয়েটাকে ইচ্ছে মতো টাইট দিব। আমাকে খুব জ্বালিয়েছে।’

তাইভিদ হেসে বলে,

‘তা যা বলেছেন। উনি যার ভাগ্যে আছেন, তার কপালে ভীষণ দুঃখ আছে বটে।’

অন্বিতা হেসে ফেলে। বলে,

‘আচ্ছা, আপনি কাজে যান। আমার আবার ওয়ার্ড ডিউটি পড়েছে।’

তাইভিদ মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, ম্যাডাম।’

ওয়ার্ডে পেশেন্টের অবস্থা রেকর্ড করছে অন্বিতা। একে একে সবার বেডের সামনে গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে আর খাতায় টুকটুক করে তুলছে সব। সবার শেষ যেই বেড’টা সেখানে দাঁড়াতেই দেখল, একটা কিশোরী মেয়ে শোয়া। এত অল্প বয়সে কী হলো মেয়েটার, জানতে চায় মেয়েটার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়সী একজন মহিলার কাছ থেকে। ভদ্রমহিলা জানান, ছোট্ট কিশোরী মেয়েটির বুকে ছিদ্র পেয়েছে ডাক্তাররা। এখন অপারেশন করতে হবে। অন্বিতার মায়া হলো ভীষণ। মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে অন্বিতাকে দেখছে। অন্বিতা মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আসতে নিয়ে কী ভেবে ফিরে দাঁড়ায় আবার। মেয়েটার দিকে পুনরায় তাকায়। মেয়েটা এখনও দেখছে তাকে। সে কি কিছু বলতে চায়? তার দু চোখের চঞ্চলতা তো তাই আওড়াচ্ছে। সে একবার মেয়েটার মায়ের দিকে চাইল। পরে কী ভেবে যেন তাঁকে বলল,

‘আন্টি, আপনি একটু ওর বোতলের পানিটা ফেলে আবার পানি নিয়ে আসুন। ওটা ফিল্টারের পানি না বোধ হয়।’

মহিলাটা বোতল তুলে বলল,

‘একটু আগে নার্স তো ফিল্টারের পানি বলে আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছে।’

‘তাও নিজে দেখে আনাটা সেইফ। আমি আছি এখানে, আপনি যান।’

তিনি পানি আনতে গেলেন। অন্বিতা তখন মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল,

‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’

মেয়েটি মাথা দুলিয়ে মুমূর্ষু সুরে বলল,

‘হ্যাঁ, মায়ের সামনে বলতে পারছিলাম না।’

‘কী বলবে, বলো?’

‘এখানের একজন ওয়ার্ড বয় আছে না, লম্বা দেখতে কালো ছেলেটা, ঐ ছেলেটা ভীষণ বাজে।’

অন্বিতার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। সে জানতে চায়,

‘বাজে মানে? তোমার সাথে কি…’

সে কথা শেষ করার আগেই মেয়েটা ভীত সুরে বলে উঠল,

‘নানান অযুহাতে সে আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করে। মা’কে আমি ভয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু, এসব আর সহ্যও করতে পারছি না। নার্সকে বলেছিলাম, কিন্তু উনি আমার কথাকে খুব একটা আমলে নেননি।’

অন্বিতার দৃষ্টি ক্ষুরধার। সে আশেপাশে চেয়ে দেখল, মেয়েটার বর্ণনা মতো কোনো ওয়ার্ড বয় এখানে আছে কি-না। তখনই দরজা পেরিয়ে একটা ছেলে আসে। মেয়েটা তটস্থ হয়ে বলে,

‘ঐ যে, ঐ ছেলেটা।’

অন্বিতা সেদিকে তাকায়। ছেলেটার দিকে রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে থাকে কয়েক ক্ষণ। তারপর মেয়েটা অভয় দিয়ে বলে,

‘চিন্তা করো না। ওর ব্যবস্থা আমি করব।’

মেয়েটা অনুরোধ জানাল,

‘আমার মা’কে জানাবেন না কিছু। আমাকে নিয়ে এমনিতেই উনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। আর দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই না।’

অন্বিতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘আচ্ছা, বলব না। তুমি বিশ্রাম করো।’

মেয়েটার মা’কে ফিরে আসতে দেখে সে সেখান থেকে উঠে ঐ ওয়ার্ড বয়ের কাছে যায়। তাকে দেখে ওয়ার্ড বয় জিজ্ঞেস করে,

‘ম্যাডাম, কিছু লাগবে?’

অমর্ষ গলায় অন্বিতা জবাব দেয়,

‘মাহির স্যারের কেবিনে আসুন, এক্ষুনি।’

এই বলে সে সেদিকে পা বাড়ায়। ছেলেটা বুঝতে পারল না, তাকে হঠাৎ ডাকা হলো কেন।

চলবে….

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।

কেবিনের বাইরে বর্তমানে রোগীদের লাইন। অন্বিতা তাইভিদকে গিয়ে বলল, সে একটু জরুরি ভাবে মাহিরের সাথে কথা বলতে চায়। তাইভিদ পরের রোগীর সিরিয়াল আসার আগে তাকে যেন সুযোগ করে দেয়। তাইভিদ তাই করল। কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল অন্বিতা। ওয়ার্ড বয়কে দেখল সেখানেই অস্থির বদনে দাঁড়িয়ে আছে। সে গুমোট স্বরে বলল,

‘ভেতরে আসুন।’

অন্বিতার পেছন পেছন সেই ওয়ার্ড বয়ও পদার্পণ করল সেই কেবিনে। তাইভিদ এর কারণ বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইল কেবল। অন্বিতাকে এই সময় দেখে মাহির খানিক অবাক। আবার পাশেই এক ওয়ার্ড বয় দেখে চিন্তিতও হলো সে। জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, অন্বিতা? কোনো সমস্যা?’

অন্বিতা চোখ ঘুরিয়ে একবার ওয়ার্ড বয়কে দেখে নিয়ে মাহিরকে বলল,

‘নয় নাম্বার ওয়ার্ডের একজন পেশেন্টের সাথে এই ছেলে বাজে ব্যবহার করেছে। তাকে খারাপ স্পর্শ করেছে। একটু আগে সেই পেশেন্ট নিজেই আমাকে বলেছে সেটা।’

আঁতকে উঠল ওয়ার্ড বয়। ঢোক গিলে ভীত চোখে তাকাল মাহিরের দিকে। মাহিরের চোয়াল দৃঢ় হলো। চোখের দৃষ্টি হলো শাণিত। বলল,

‘এসব কী? তুমি পেশেন্টকে স্পর্শ করেছ?’

ছেলেটা কেঁপে উঠল বোধ হয়। তার ঠোঁটগুলো কাঁপছে তিরতির করে। কম্পিত সুরে বলল,

‘ননা সস্যার, আসলে ম্যাডামের হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। আমি তো অন্য কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে কোনো পেশেন্টকে স্পর্শ করিনি।’

‘উদ্দেশ্য যেটাই হোক, আপনি স্পর্শ করবেন কেন? আর একটা জিনিস জানেন তো, মেয়েরা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে কোনো স্পর্শটা ভালো আর কোনটা খারাপ। তাই ভুলেও মিথ্যে বলবেন না।’

অন্বিতা সরোষে বাক্য ব্যয় করল। ছেলেটার ভয় বাড়ল এক লহমায়। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছু বলার মতো সৎ সাহসও নেই তার। মাহির কটমট করে চেয়ে বলল,

‘ভুল করে আবার মিথ্যে বলছো? তুমি পেশেন্টকে স্পর্শ করেছ কোন সাহসে? আবার এখানে এসে গলা উঁচু করে সত্য লুকাচ্ছো, এত সাহস হয় কী করে তোমার?’

দমে গেল ছেলেটা। আর্তস্বরে বলল,

‘স্যার, আর হবে না।’

অন্বিতা ক্ষুব্ধ গলায় বলল,

‘উনাকে ক্ষমা করবেন না, মাহির। এই ধরণের ছেলেদের ক্ষমা করাটা শোভা পায় না। উনারা শাস্তির’ই কাম্য।’

মাহির ধাতস্ত করল নিজেকে। আজকে সকাল থেকে একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে যেন। সে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,

‘কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না। এই মাসের বেতন তুমি পেয়ে যাবে। যাও এখন।’

ছেলেটা হু হু করে কেঁদে উঠল। এত তাড়াতাড়ি সে এভাবে হেনস্থা হবে ভাবেনি। সে চট করে ছুটে এসে মাহিরের পায়ে পড়ে। ভেজা সুরে বলে,

‘ক্ষমা করুন, স্যার। আর কখনও এমন হবে না। কাজ থেকে বের করে দিলে আমি মা’কে কী খাওয়াব? স্যার, শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন। ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। দয়া করুন।’

অন্বিতা সন্তপ্ত সুরে বলল,

‘এই কথা আগে মনে ছিল না? মনে খারাপ চিন্তা আসার আগে মায়ের কথা মনে পড়ে না? তখন মনে পড়ে না, মা’কে কী খাওয়াবেন?’

‘ভুল হয়ে গিয়েছে, ম্যাডাম। শয়তানের প্ররোচনায় ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে মাফ করে দিন।’

মাহির ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে বলল,

‘ঠিক আছে, মাফ করব। তবে তুমি আজ থেকে আর ওয়ার্ড বয়ের দায়িত্ব পালন করবে না। তুমি আমার কেবিনের বাইরে বসে রোগীদের টোকেন কাটতে সাহায্য করবে। এছাড়া আর তোমার কোনো কাজ নেই। আর চিন্তা করো না, বেতন তোমার কমবে না। তবে এরপর আর কোনোদিন যদি এমন কোনো কাজের চিন্তা মাথায়ও এনেছ, তাহলে ডিরেক্ট পুলিশের হাতে তুলে দিব। মনে থাকবে তো?’

ছেলেটা সিক্ত চোখে সহসা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘জি স্যার, জি স্যার, মনে থাকবে। আর জীবনেও এমন কিছু করব না।’

‘যাও এখন।’

ছেলেটা হুরমুরিয়ে কেবিন ছাড়ল। সে যেতেই গাঢ় নিশ্বাস ফেলল অন্বিতা। মাহির পূর্ণ মেদুর চোখে তাকাল অন্বিতার দিকে। কোমল স্বরে বলল,

‘তোমার প্রতিটা আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে, অন্বি। সবসময় এভাবেই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, এই সাহস আর শক্তি তোমার চিরস্থায়ী হউক।’

অন্বিতা কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘আর আপনার এই দয়ালু মনটাও যেন চিরস্থায়ী হয়। আপনার বিচারে আমি প্রসন্ন হয়েছি। তবে পরেরবার এমন কিছু করলে কিন্তু অবশ্যই কঠোর হতে হবে।’

মাহির মাথা ঝাঁকাল। অন্বিতা বলল,

‘আসছি তাহলে।’

‘কেন?’

অন্বিতা সরু চোখে চেয়ে বলল,

‘বাইরে বাকি পেশেন্টরা অপেক্ষা করছেন।’

মাহির ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলল। সেই নিশ্বাসের অর্থ বুঝে ঠোঁট চেপে হাসল অন্বিতা। বলল,

‘এত হা হুতাশ করতে হবে না, ডাক্তারসাহেব। আর মাত্র কয়টা দিন। আসছি।’

মাহিরের প্রত্যুত্তর এর অপেক্ষা না করেই অন্বিতা দ্রুত কেবিন ছাড়ল। সে জানে, মাহির উত্তর এখন মোটেও সুবিধাজনক হবে না। বরং গাল, কান আরক্ত করার মতোই কিছু একটা বলে বসবে সে। বাইরে আসতেই দেখল ছেলেটা একটা চেয়ারে বসা। পাশেই তাইভিদ ভ্রু কুঁচকে ছেলেটাকে দেখছে। অন্বিতা তার দিকে চেয়ে বলল,

‘উনাকে একটু নজরে নজরে রাখবেন। আর উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই স্যারকে জানাবেন দ্রুত।’

তাইভিদ মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, ম্যাডাম।’

___________________

রাত্রি আরম্ভ ক্ষণ। চারদিকে ম্রিয়মান অন্ধকার। সে সময় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বদনে বাসায় ফেরে মাহির। প্রধান ফটক পেরিয়ে বসার ঘরে পা রাখতেই দেখে সোফায় দাদু আর ফুপি বসা। সে সৌজন্যতা দেখিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই জিনিয়া বেগম ডাকেন। ফিরে চাইল মাহির। বলল,

‘ফ্রেশ হয়ে আসছি, ফুপি।’

এই বলে সে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। ফিরল পাক্কা বিশ মিনিট পর। সোফায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘কেন ডাকছিলে?’

জিনিয়া বেগমের চোখ মুখ ক্ষেপাটে। রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে আছেন মাহিরের দিকে। মাহির কপাল কুঁচকাল। বলল,

‘কী হলো, কিছু বলছো না কেন?’

‘এই তোমার নীতি, মাহির? আজ শশীর চেয়েও তোমার কাছে তোমার ঐ সহকারী বড়ো হয়ে গেল? ঐ একটা বাইরের ছেলেকে তুমি শশীর চেয়েও বেশি বিশ্বাস করলে?’

এতক্ষণে আসল ঘটনা ঠাহর করতে পেরে কপালের ভাঁজ সোজা করল মাহির। দরাজ গলায় বলল,

‘আমি সত্যটাকেই বিশ্বাস করেছি, ফুপি। এখানে বাইরের বা ভেতরের বলে কেউ নেই। যে সত্য আমি তাকেই বিশ্বাস করব।’

কুপিত স্বরে জিনিয়া বেগম বললেন,

‘ওহ, তোমার চোখে তাহলে আমার মেয়ে মিথ্যেবাদী? শুনেছ, বাবা?’

বৃদ্ধ লোকটি মাথা তুলে তাকালেন এবার। মাহিরের দিকে পরিশ্রান্ত বদনে চেয়ে বললেন,

‘তোমার সহকারী’ই যে সত্য বলছে, তার কী প্রমাণ মাহির? সেও তো মিথ্যে বলতে পারে।’

‘শশীও যে সত্য বলছে তার কোনো প্রমাণ নেই, দাদু। তাই শুধুমাত্র মুখের কথার ভিত্তিতে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’

উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জিনিয়া বেগম। বাজখাঁই স্বরে বললেন,

‘শুনলে শুনলে, বাবা? তোমার আদরের নাতির কথা শুনলে? এই তোমার নাতি তোমার আদর্শে বড়ো হয়েছে? এটা তোমার আদর্শ?’

মাহিরের দাদু লাঠির পর দুই হাত রেখে মাথা নিচু করলেন। এই নাতিকে তিনি বড্ড আদর দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেঅঁ। নিজের শিক্ষায়, আদর্শে বড়ো করেছেন। আজ তার আদর্শে এভাবে আঙ্গুল উঠায় বড্ড কষ্ট পেয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি, মাহির। তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ।’

এই বলে লাঠিটা চেপে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শম্বুক গতিতে হেঁটে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। সোফায় বসে রইল মাহির। জিনিয়া বেগম বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে সেখান থেকে উঠে গেলেন। মাহির প্রলম্বিত শ্বাস টানল। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। মনে হয় যেন এত মানুষ থেকেও তার কেউ নেই।

চলবে…..