একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৩৩+৩৪

0
25

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।

চারদিকটা কপাল কুঁচকে দেখল শশী। মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

‘তোমার ভাতিজার কী এক পছন্দ! বাড়ি-ঘর দেখেছ?’

নাক ছিটকান জিনিয়া বেগম। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

‘কম তো বোঝানো হয়নি? না বুঝলে আর কী করার?’

শশী আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে বলল,

‘বুঝো না, ঐ মেয়ে জাদু করেছে। নয়তো ওর মতো মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে না-কি মাহিরের বউ হওয়ার।’

এই বলে সে সোফায় বসে থাকা মাহিরের দিকে তাকায়। শুভ্র রাঙা এক পাঞ্জাবী গায়ে সে। পাঞ্জাবীতে ভারী সুতার কাজ। মাথায় সাদা টুপি। মুখে প্রসন্ন হাসি। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার খুশি চোখে মুখে যেন উপচে পড়ছে তার। ধারাল চিবুকে ছোট দাড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শশী তাকাল তার ঠোঁটের দিকে। বড্ড আফসোস হলো তার। একজন পুরুষ মানুষের ঠোঁট এত সুন্দর কেন? আর এই সুন্দর ঠোঁটের ছোঁয়া সে কেন পেল না? কী এমন কমতি আছে তার? শশীর চোখ মুখ দৃঢ় হয়ে আসে। সব হয়েছে ঐ অন্বিতার জন্য। এতকিছু করেও অন্বিতাকে মাহিরের জীবন থেকে সরানো গেল না। এসব ভাবলেই এখন রাগে গা রি রি করে তার।

কাজী সাহেব সহ আরো তিন চারজন ভদ্রলোক অন্বিতার রুমে গেলেন। মাঝে একটা চাদর ধরা হলো। অন্বিতার পাশে আভা। কাজী সাহেব নিকাহ নামা পড়ে “কবুল” বলতে বললেন। অন্বিতার শরীর কাঁপছে। হৃদস্পন্দন বেড়েছে। বুকের ধরাস ধরাস শব্দ যেন আভাও টের পাচ্ছে। সে এক হাতে অন্বিতার হাত যুগল আগলে ধরে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘ভয় পাস না। একটা চমৎকার ভবিষ্যতের সূচনা ঘটতে চলেছে।’

অন্বিতা ভয় পাচ্ছে না ঠিক, তবে সারা শরীরে অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। মাথার উপর ফ্যান থাকা স্বত্ত্বেও ঘামছে সে। আভা টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে সেই স্বেদজল। ওপাশ থেকে কাজী সাহেবের গলার স্বর এল। তিনি ক্রমাগত “কবুল” বলতে বলছেন। অন্বিতার খালাও পাশে ছিলেন তার। তিনিও অন্বিতাকে অভয় দিলেন। সিক্ত অন্বিতার অক্ষিযুগল। কান্না গলার কাছটাই আটকে আছে। ভালোবাসার মানুষকে পেতে চলেছে এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে? তাও সেই চমৎকার সত্যটুকু স্বীকার করতে কেন এত জড়তা, এত দ্বিধা। সে ঢোক গিলল পরপর কয়েকটা। একবার তাকাল আভার দিকে আরেকবার খালার দিকে। বেদনাবিধু স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘মা কোথায়, খালামনি?’

খালামনি উত্তর দিলেন,

‘আপা আছেন। তুমি কবুল’টা বলে দাও। উনারা অপেক্ষা করছেন তো।’

অন্বিতা ধাতস্ত করল নিজেকে। মনের অস্থিরতা কমানোর মেকি চেষ্টা চালাল খানিক। একবার চোখ বুজল, অক্ষিপটে ভেসে উঠল মাহিরের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা। তার প্রেম নিবেদনের মুহুর্তটা। কী চমৎকার করে সেদিন বলেছিল, “আমি তোমায় ভালোবাসি, অন্বি। ভীষণ ভালোবাসি।”

চোখ খুলল সে। ভয়, অস্থিরতা, জড়তা, ক্লেশ সব আস্ফালন করে সে বলে উঠল,

‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’

তারপর আরো দুই বার। ততক্ষণাৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল খুশির আমেজ। এতক্ষণ নিরুত্তাপ হয়ে বসে ছিল মাহির। অন্য রুমে থাকলেও কান সজাগ ছিল তার। পাশের রুম থেকে হৈ হৈ শব্দ আসতেই হাসল সে। চিত্ত জুড়ে বয়ে গেল উন্মাদনা। অবশেষে তার প্রিয়তমাকে সে পেল তার স্ত্রী হিসেবে।

অন্বিতার রুম ছেড়ে সবাই বেরিয়ে যেতেই আসিয়া বেগম সেখানে এলেন। তাকে দেখা মাত্রই অন্বিতা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাঁকে। কেঁদে ফেলল। বাধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল মা আর মেয়ে। তাদের দেখে আভা আর অন্বিতার চোখও ভিজে উঠল যেন। অন্বিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার খেয়াল রাখবে কে, মা? তুমি এখানে একা একা কী করে থাকবে?’

অন্বিতাকে ছেড়ে তার মুখ আগলে ধরলেন আসিয়া বেগম। কান্না দমিয়ে রেখে প্রসন্ন গলায় বললেন,

‘তুই কি একেবারের জন্য চলে যাচ্ছিস না-কি? যখন ইচ্ছে এখানে চলে আসবি। আর আমারও যখন ইচ্ছে হবে তোর কাছে চলে যাব। তাই একদম এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবি না।’

‘আমি চলে গেলে তুমি কিন্তু ঠিক মতো ঔষধ খাবে। অনিয়ম করবে না একদম।’

নাক টেনে বলল অন্বিতা। কন্ঠে উপচে পড়ছে মা’কে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। আসিয়া বেগম তার গালে হাত বুলিয়ে বললেন,

‘সব ঠিক মতো করব। তুই কোনো চিন্তা করিস না। শুধু নিজের জীবন আর সংসারটাকে সুন্দর ভাবে সামলে নিস, তাহলেই হবে।’

‘দোয়া করো, মা।’

আসিয়া বেগম তার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

‘মায়ের দোয়া সবসময় তোমার পাশে আছে।’

_______________

আভা অন্বিতাকে নিয়ে বসার ঘরে এল। মাহির তার মামার সাথে কথা বলছিল তখন। অন্বিতার আগমন অচিরাৎ কম্পন ধরাল তার চিত্তে। বাড়ির বড়োরা আছে বলে ঠিক মতো চেয়েও থাকতে পারছে না। মামা হেসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘অন্বিতা মা’কে এখানে এনে বসাও।’

মাহিরের পাশের জায়গাটা ছাড়লেন তিনি। আভা অন্বিতাকে মাহিরের পাশে বসাল। অপর পাশের একটা সোফায় জিনিয়া বেগম আর শশী বসা। দুজনেই বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছেন। যেন পৃথিবীর তিক্ত এক সত্যকে নিজ চোখে দেখছেন তারা। তাদের এহেন মুখ দেখে মিটিমিটি হাসছে তাইভিদ। শশী নাক মুখ কুঁচকে অন্বিতাকে আপাদমস্তক পরখ করল। গায়ে লাল টুকটুকি বেনারসী দেখে বিড়বিড় করে বলল,

‘একটা শাড়ির পেছনেই বোধ হয় সব টাকা খরচ করে ফেলেছে।’

তারপর তাকাল মুখের দিকে। তার চোখে আহামরি কোনো সৌন্দর্য ঠেকল না। ঐ তো কাজলে ভাসা চোখ আর লাল আভার ঠোঁট। কী আছে এতে? মাহিরের মন এইটুকুতেই ভরে গেল? ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলল সে। কাষ্ঠ হেসে মনে মনে ভাবল, এই ক্ষীণ রূপের আমেজ মজে গেলেই মাহিরের মনও উঠে যাবে। তখন অবহেলা, অবলীলায় জর্জরিত অন্বিতাকে দেখে মনে বড্ড প্রশান্তি আসবে তার।

জিনিয়া বেগম রোষপূর্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়েকে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘অন্বিতার হাতে দেখ, আমার মায়ের বনেদী বালা। কত দামী এগুলো জানিস? ভেবেছিলাম তোর হাতে দেখব। তা আর হলো না।’

রাগে গলার স্বর কাঁপছে তার। শশী বালাগুলো একবার দেখে বলল,

‘নানু মারা যাওয়ার পর তুমি নিয়ে নিতে পারোনি? তাহলেই তো আজ এগুলো অন্যকারোর হাতে যেত না।’

জিনিয়া বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

‘আমি কি আর জানতাম না-কি, এই বালা এই মেয়ের হাতে উঠবে। জানলে তো কবেই সেগুলো হাতিয়ে নিতাম।’

অন্বিতার খালা এসে বললেন,

‘আপনারা এবার খেতে চলে আসুন। আভা, সবাইকে নিয়ে ডাইনিং-এ এসো।’

অন্বিতা একবার চোখ তুলে আশাপাশটা দেখল। তারপর ইতস্তত সুরে তার খালাকে বলল,

‘খালামনি, আরো দুজন মেহমান আসার কথা ছিল। উনারা বোধ হয় এখনও আসেননি। আমরা একটু উনাদের জন্য অপেক্ষা করি?’

বাইরের কেউ আসবে বলে খালা জানতেন না। তাই অবাক হলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কারা আসবেন, অন্বিতা?’

‘আমাদের প্রতিবেশী দুজন। আমি উনাদের দাওয়াত দিয়েছিলাম।’

‘আপা জানেন?’

‘জি। আমি মা’কে বলেছি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে মাহির’রা বসে যাক। উনারা আসলে না হয় পরে বসবেন।’

মাহির প্রসন্ন গলায় বলল,

‘সমস্যা নেই, খালামনি। উনারা আসলে আমরা বরং একসাথেই বসব।’

‘আপনারা কি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন?’

দরজায় কারোর গলার স্বর পেয়ে সেদিকে তাকায় সবাই। আর কেউ চিনতে না পারলেও মাহির অন্বিতার চিনতে বেগ পোহাতে হয়নি। অন্বিতার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। মাহির অবাক হয়নি, সে যেন এমনটাই আশা করেছিল। অন্বিতা হেসে বলল,

‘জি, আপনাদের’ই অপেক্ষায় ছিলাম। ভেতরে আসুন।’

অমিত ভেতরে আসার পূর্বে একবার পেছনে চেয়ে বলল,

‘আয়, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

তার পেছন পেছন শম্বুক গতিতে আরো একজনের আগমন ঘটে। শশী ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,

‘এরা কারা?’

জিনিয়া বেগম বিরক্তির সুরে বললেন,

‘তা আমি কী করে বলব?’

অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। বলল,

‘পরিচয় করিয়ে দেই, উনারা আমাদের প্রতিবেশী। উনি অমিত আর উনি অয়ন।’

চলবে…..

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।

অয়নের চোখে মুখে জড়তা প্রকট। অদ্ভুত অস্বস্তি শরীর চেপে ধরেছে তার। অমিত হেসে খেলে সবার সাথে কথা বললেও সে নিশ্চুপ, নির্বাক। তার সবথেকে প্রিয় মানুষের অপ্রিয় সত্যটা চোখে চেয়ে দেখতে পারছে না সে। মাহিরের পাশেই অন্বিতা। এক লাল টুকটুকে বউ। তার প্রফুল্ল গলার স্বর বলে দিচ্ছে, সে আজ দারুণ খুশি। অয়নের দৃষ্টি জমিনে। অন্বিতার গলার স্বর কানে বাজছে তার। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস। মনে মনে আওড়ায়,

‘তার না হওয়া মানুষটা ভালো থাকুক আজীবন।’

খালামনি এলেন। বললেন,

‘অন্বিতা, এবার সবার খেতে বসে যাওয়া উচিত। সময় হয়েছে বেশ।’

অন্বিতা সম্মতি জানিয়ে বলল,

‘জি জি, সবাই ডাইনিং রুমে আসুন।’

নতুন বউ সে, উঠে চঞ্চল চিত্তে খাতিরদারি তাকে আজ মানাবে না। তবে আভা সামলে নিল সবটা। সে সবাইকে নিয়ে ডাইনিং-এ বসাল। অন্বিতা বসতে না চাইলেও মাহিরের পাশে জোর করে বসানো হলো তাকে। অয়ন, অমিত একপাশে। অয়নের মাথা এখনও নামানো। অমিত ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ঠিক আছিস?’

অয়ন চোখ উঠিয়ে একবার দেখল তাকে। উত্তর দিল না কোনো। তাদের পাশেই বসেছে তাইভিদ। তার ঠিক বরাবর শশী। আচনক সেদিকে চোখ যেতেই দেখে, মেয়েটা রোষপূর্ণ চোখে তাকে দেখছে। তাইভিদ তা দেখে হাসে। ভ্রু নাচিয়ে আরো বেশি ঘেটে দেয় তাকে। শশী এবার চোয়াল শক্ত করে। তাইভিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। আভা, খালামনি আর আসিয়া বেগম সবাইকে সব খাবার বেড়ে দেন। জিনিয়া বেগম মুখ ভার করে বসে বসে পর্যবেক্ষণ করেন সব। পাশেই শশীকে নির্লিপ্ত সুরে বলেন,

‘খাবার যে করেছে দেখ, এর থেকে বেশি আইটেম তো আমাদের রোজ বেলায় থাকে। আর তাঁরা এই কয়টা আইটেম দিয়ে বিয়ের আয়োজন করেছে।’

শশী বিরক্তির সুরে বলল,

‘ওসব বাদ দাও, মা। আমি তো দেখছি অন্যকিছু।’

জিনিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,

‘কী?’

‘অন্বিতাদের প্রতিবেশী দুজন এল যে, তার মধ্যে ঐ ছেলেটাকে দেখো কেমন মনমরা হয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ছ্যাঁকা খেয়ে দেবদাস বনে গিয়েছে বোধ হয়।’

জিনিয়া বেগম একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে অয়নকে দেখে বলল,

‘কই, আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না। হয়তো সে কারোর সাথে খুব একটা মিশে না, তাই এমন চুপচাপ।’

‘তোমার চোখে এসব সূক্ষ্ম বিষয় ধরা পড়বে না এটাই স্বাভাবিক।’

মেয়ের কথায় বিরক্ত হয়ে জিনিয়া বেগম খাবারে মনোযোগ দেন। অন্বিতা না পারতে একটু আধটু খেল। এত মানুষের মাঝে বসে খেতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। আবার তারউপর অয়নের বিধ্বস্ত মুখের দিকে বার কয়েকবার চোখ পড়তেই অস্বস্তির মাত্রা আরো দ্বিগুণ হলো। সে অয়নকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য ডাকেনি। শুধুমাত্র সত্যটুকু সহজ সুন্দর ভাবে মেনে নেওয়ার জন্য ডেকেছে। অথচ ছেলেটা আসার পর থেকেই কেমন গুমোট হয়ে বসে আছে। ঝড় উঠার পূর্বে প্রকৃতি যেমন শান্ত থাকে ঠিক তেমনই শান্ত এখন সে। চোখে মুখে আষাঢ়ী মেঘের ছায়া। সবকিছুই অন্বিতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে অতি সন্তর্পনে। ভবিতব্য বদলানোর ক্ষমতা কারোর’ই যে নেই।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকতেই তাইভিদ মাহিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। স্যারের বিয়ে উপলক্ষে তারও ছুটি পড়েছে। এখন গ্রামে যাবে সে। কাল’ই চলে যেত। থেকেছে শুধু স্যারের বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য।

ফুপি জোরপূর্বক হেসে বললেন,

‘বাবা, আমাদের বোধ হয় এবার বেরুনো উচিত।’

মাহিরের দাদু মাথা নাড়িয়ে বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বেরুনো উচিত। মাহির, অন্বিতার মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসো।’

অন্বিতা খাওয়া দাওয়ার পর ভেতরেই ছিল। আভাকে জানিয়েছিল সেই কাঙ্খিত সত্যটি। অয়ন’ই যে সেই গানওয়ালা ছেলেটি জানা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে উঠে আভা। চোখ মুখ উৎফুল্ল দেখায়। বলে,

‘বলিস কী! ছেলেটা তো মারাত্মক।’

অন্বিতা হাসে। বলে,

‘পছন্দ হয়েছে? প্রেম ট্রেম করবি না-কি?’

আচম্বিত লজ্জায় মূর্ছে যায় আভা। গাল হয়ে উঠে রক্তিম। বলে,

‘ইশ, কী বলিস!’

অন্বিতা দুষ্টুমির সুরে কিছু বলার আগেই খালামনি মাহিরকে নিয়ে সেই রুমে আসেন। মাহিরকে দেখে অন্বিতা স্থির হয়। মাহির কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

‘দাদু বলছিলেন, আমাদের বেরুনো উচিত। তুমি কি তৈরি?’

অন্বিতার মনঃস্তাপ হলো। এখনই সে যেতে চায় না। সে ইতস্তত সুরে মাহিরকে বলল,

‘আরেকটু পরে গেলে হয় না?’

অন্বিতার মনের অবস্থা সম্পর্কে মাহির অবগত। সে বলল,

‘ঠিক আছে। আমি দাদু আর ফুপিকে নাহয় পাঠিয়ে দেই, দাদুর বিশ্রামের প্রয়োজন।’

অন্বিতা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। মাহির বসার ঘরে এসে এই কথাটা বলতেই জিনিয়া বেগম কপাল কুঁচকে ফেলেন।কথাটা তাঁর মোটেও পছন্দ হয়নি। বিয়ে হতে না হতেই ছেলেটা বউয়ের গোলাম হয়ে গিয়েছে। তবে দাদু প্রসন্ন গলায় বললেন,

‘বেশ, তোমরা সন্ধ্যার দিকে চলে যেও। আমরা উঠি তাহলে।’

অন্বিতার মা আর খালামনি এসে তাদের সৌজন্যতার সহিত বিদায় জানালেন। অমিত তখন বলল,

‘আমাদেরও বোধ হয় উঠা উচিত।’

অন্বিতাকে নিয়ে আভা সেই রুমে আসে তখন। অন্বিতা বলে,

‘সেকি! আমার বিয়ের উপহার না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?’

অন্বিতার কথা শুনে সবাই খানিক অবাক হলো। অন্বিতা যেচে পড়ে উপহার চাইছে, এটা তো তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। শশীও থেকে যায়। সে ভ্রু কুঁচকে অন্বিতাকে দেখছে। অন্বিতা এই পর্যায়ে অয়নের দিকে চাইল। বলল,

‘অয়ন, আপনি বলেছিলেন আমার বিয়েতে গান শুনাবেন। তবে এখন গান না শুনিয়ে’ই চলে যেতে চাইছেন যে?’

প্রথমবারের মতো অয়ন অন্বিতার দিকে তাকায়। চোখের নিষ্প্রাণ, নিরুত্তাপ চাহনি। অন্বিতার বধূ মুখখানা দেখে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল তার। দু বছরের এক পাক্ষিক ভালোবাসার যন্ত্রণা বেড়ে আকাশচুম্বী হলো। বুকের ভেতর অনুভব করল এক নিদারুণ শূন্যতা। গলা শুকিয়ে আসতেই ঢোক গিলল সে। কী চমৎকার লাগছে বধূরূপী অন্বিতাকে। নিঃসন্দেহে মাহির একজন সৌভাগ্যবান পুরুষ। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হাসল সে। বলল,

‘অবশ্যই, গান না শুনিয়ে আমি যাব না।’

অন্বিতা হেসে মাহিরের পাশে গিয়ে বসে। আভা বসে শশীর পাশে। অয়ন মাথা নুইয়ে ঘনঘন ঢোক গিলল কয়েকবার। অমিত তাকে দেখছে ফ্যালফ্যাল করে। বন্ধুর পরিশ্রান্ত বদন ছাপিয়ে উঠা বিধ্বস্ত, বিষন্ন অভিব্যক্তি সে ঠিকই ঠাহর করতে পারছে। কাল রাতে সব শুনে বন্ধু বলেছিল,

‘ও অন্যকারোর হয়ে সুখে থাকলে আমার আর কোনো আফসোস থাকবে না। আমি শুধু চাই, পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওর হোক।’

একপাক্ষিক ভালোবাসার কী যন্ত্রণা সেটা অমিত তার বন্ধুকে দেখে জেনেছে। বড্ড চাপা স্বভাবের ছেলেটা। দুই বছর যাবত লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে গিয়েছে অন্বিতাকে। সেই কথা প্রকাশ করার উদ্যম সাহসটুকু কখনও তার হয়নি। রোজ বারান্দায় বসে অন্বিতাকে গান শুনানো যেন তার চমৎকার অভ্যাসগুলোর একটা। তবে অন্বিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনতেই সে অভ্যাসখানা সযত্নে ভেঙে ফেলল সে। এখন আর গান গায় না। সুর আসে না, তাল উঠে না। এভাবে কি গান সম্ভব!

ভীষণ চেষ্টা চালিয়ে একটা গানের সুর গলা অবধি আনল অয়ন। গলাটা হালকা ঝেড়ে গেয়ে উঠল,

“তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা, এক জনমের কাছে আসা
এক জনমের ভালোবাসা, এক জনমের কাছে আসা
একটি চোখের পলক পড়তে লাগে যতক্ষণ
তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন”

থেমে গেল অয়ন। শেষের দিকে একেবারেই সুর ছেড়ে দিয়েছে সে। গলা ধরে এসেছে। কোনোরকমে সবার দিকে চেয়ে একবার হাসল। অন্বিতা চেয়ে আছে নিগূঢ় চোখে। মাহির বিড়বিড় করে বলল,

‘আর গান পেল না।’

চলবে…..