#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৫।
ঘড়িতে আট’টা কী নয়’টা বাজে। বাইরে মার্তন্ড মশাই বেজায় ক্ষিপ্ত। আর সেই একইরকম ক্ষিপ্ততা মাহিরের কান্তিমান মুখেও বিরাজমান। বক্ষে প্রেয়সী জড়িয়ে দারুণ এক স্বপ্ন দেখছিল বোধ হয়। সেই চমৎকার স্বপ্নে বা হাত ঢুকায় তার ফোনের রিংটোন। ক্রমাগত বাজছেই সেটা। ঘুমের মাঝেই ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় মারতে। সেটা সম্ভব নয় বিধায় অগত্যাই ফোনটা পাশ থেকে হাতে নিল। পিটপিট করে চেয়ে দেখল স্ক্রিনে তাইভিদের নাম। বিরক্তিতে মুখ থেকে “চ” জাতীয় শব্দ বের হলো। পরক্ষণেই বিরক্তি কেটে গেল দাদুর কথা মনে পড়তেই। দাদুকে তো একা ফেলে এসেছে। কথাটা মনে পড়তেই ফোন রিসিভ করল সঙ্গে সঙ্গে। ওপাশ থেকে তখন ভেসে এল তাইভিদের উদ্বিগ্ন গলার স্বর,
‘স্যার, আমরা নার্সিংহোমে এসেছি। আপনার ফুপি স্ট্রোক করেছেন।’
মাহির আঁতকে উঠে। সশব্দে বলে উঠে,
‘কী?’
আচমকা ঘুম ছুটে অন্বিতার। চোখ কঁচলে মাহিরের দিকে তাকায়। মাহির ততক্ষণে অন্বিতাকে ছেড়ে উঠে বসেছে। জিজ্ঞেস করে,
‘কখন হলো এসব? ফুপি এখন কোথায়?’
‘উনাকে নার্সিংহোমে আনা হয়েছে। আমরা সবাই আছি এখানে। স্যার, আপনি একবার আসুন। আপনার বোনকে সামলানো যাচ্ছে না।’
‘হ্যাঁ, আসছি আমি। আপনি ড. ফারুককে খবর দিয়েছেন?’
‘জি, স্যার। উনি ম্যাডামকে দেখছেন।’
‘আচ্ছা, আপনি থাকুন সেখানে। আমি এক্ষুনি আসছি।’
কল কেটে বিছানা ছাড়ল মাহির। অন্বিতা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, মাহির? তোমাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’
মাহির ব্যাগ খুলে কাপড় বের করতে করতে বলল,
‘ফুপি নাকি স্ট্রোক করেছেন, অন্বি। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
আতঙ্ক দেখা গেল অন্বিতার মুখে। উদ্বিগ্ন ছেয়ে পড়া স্বরে বলল,
‘কখন হলো এমন? এখন ফুপির কী অবস্থা?’
‘কিছু বলতে পারছি না। যেতে হবে আগে।’
মাহির ফ্রেশ হতে ঢুকল দ্রুত। অন্বিতার খারাপ লাগছে। নিশ্চয় কাল নিজের বাবার এমন অবজ্ঞা সহ্য করতে না পেরে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় এমন হয়েছে। আর যাই হোক, সে কারোর খারাপ চায় না। চট করে বিছানা গুছিয়ে মায়ের কাছে গেল সে। মা’কে সব জানিয়ে তাকেও তৈরি হতে হবে।
নার্সিংহোমে পৌঁছেই দেখল বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধ লাঠি চেপে বিষন্ন মুখে বসে আছেন। পাশেই তাইভিদ কী যেন বোঝাচ্ছে তাঁকে। অন্যদিকে এক কোণে মেঝেতে বসে শশী। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় অবস্থা তার। চোখে মুখে অবসাদ। শুষ্ক, শুকনো চোখে সামনের দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। সবাইকে একপলক দেখে নিয়ে সামনে এগোলো মাহির। অন্বিতাও তার পেছন। দাদুর কাছে গেল তারা। মাহিরকে দেখে বৃদ্ধ হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। শক্ত খোলসের ভেতর নরম তুলতুলে মনটা আজ মেয়ের দুঃখে বড্ড জর্জরিত। মাহির এক হাতে দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কেঁদো না, দাদু। ফুপির কিছু হবে না।’
দাদু কান্না বন্ধ করলেন না। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলছেন তিনি। মাহির উৎকন্ঠিত স্বরে বলল,
‘দাদু, শান্ত হও। এমন করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি ফুপিকে দেখছি।’
তাইভিদকে বসিয়ে মাহির জিনিয়া বেগমকে দেখতে গেল। অন্বিতা শম্বুক গতিতে এগিয়ে গেল শশীর দিকে। শশীর শিউরে বসল গিয়ে। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘ফুপি ঠিক হয়ে যাবেন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।’
শশী নিরুত্তাপ। নিষ্পলক, নিষ্প্রাণ চাহনি তার। অন্বিতার কথা আদৌ কানে পৌঁছাচ্ছে কি-না সন্দেহ। অন্বিতা তার বাহুতে হাত রেখে বলল,
‘দাদুর পাশে গিয়ে বসুন। উঠুন, আপু।’
নড়ল না শশী। এখনও ঠিক আগের মতোই। তাকে অনেক বলেও টলাতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্বিতা। মেয়েটার ভেজা পাপড়ি আর ফোলা নাক চোখ’ই বলে দিচ্ছে মায়ের জন্য ঠিক কতটা কাতর সে। বাবা ছাড়া এতিম মেয়েটার হয়তো মা হারানোর একটু বেশিই ভয়। তাই তো সেই ভয় চোখে মুখে কেমন উপচে পড়ছে। শশীকে কিছুক্ষণ পরখ করে উঠে দাঁড়াল অন্বিতা। জিনিয়া বেগমকে দেখার জন্য সেও পা বাড়াল।
দাদু এখন একটু শান্ত। চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। তাইভিদ উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে শশীর কাছে বসে। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ম্যাডাম ঠিক হয়ে যাবেন। মাহির স্যার ভেতরেই আছেন। চিন্তা করবেন না। নিন, পানিটুকু খান।’
শশী মাথা ঘুরিয়ে তাইভিদের দিকে চাইল। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বড্ড মায়া হলো তাইভিদের। শশী কম্পিত সুরে বলল,
‘আমার মা বেঁচে যাবে তো?’
কী যন্ত্রণাদায়ক এক প্রশ্ন! কান্নারা সব দলা পাকিয়ে শশীর গলায় আটকে আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তাইভিদের দিকে। তাইভিদ কথা হারায়। শশীকে কী বলে ভরসা দিবে বুঝতে পারছে না। তাও নিজেকে কোনোপ্রকার ধাতস্ত করে বলল,
‘ইনশাল্লাহ, আল্লাহর উপর ভরসা হারাবেন না।’
ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছনের দেয়ালে মাথা ঠেকাল শশী। অস্ফুট সুরে বলল,
‘আমার মা ছাড়া আপন কেউ নেই। মা’র কিছু হলে আমিও নিঃস্ব হয়ে যাব। তখন আর আমার বেঁচে থাকার কোনো কারণ থাকবে না।’
‘এভাবে বলবেন না। ম্যাডামের কিছু হবে না, ভরসা রাখুন।’
শশী আবারও তাকাল তাইভিদের দিকে। তার নাকটা টকটকে লাল। ঠোঁটগুলো কাঁপছে। চোখ টলমলে পানি। কান্না দমিয়ে বলল,
‘আজ আমার জন্য’ই সব হয়েছে। আমার সুখের কথা ভাবতে গিয়েই এসব করেছে, মা। আমার বুদ্ধিতেই হয়েছে সব। কী জঘন্য আমি। ছি, নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে আমার।’
গাল বেয়ে সহসাই উষ্ণ জল গড়াল। তাইভিদের বেহায়া মনে বড্ড সাধ জাগল, জলটুকু যত্ন করে মুছিয়ে দিতে। কিন্তু পারল না। কেবল আশ্বস্ত করে বলল,
‘নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, সেটাই অনেক। আর আপনার জন্য কিছু হয়নি। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই হয়েছে। তাই এমন করে আর ভাববেন না।’
শশী পুনরায় কিছু বলার আগেই অন্বিতা বেরিয়ে আসে। তাকে দেখে তাইভিদ আর শশী দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। অস্থির হয়ে উঠে শশী। অন্বিতাকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার মা কেমন আছে? ঠিক হয়ে গিয়েছে, না? কথা বলছে? ডাকছে আমাকে?’
শশীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্বিতা তাইভিদের হাতে একটা ছোট্ট শিশি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘যত দ্রুত সম্ভব এই ইনজেকশন’টা খুঁজে আনুন।’
শিশিটা হাতে নিয়েই মাথা ঝাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল তাইভিদ। শশী ভীত স্বরে ফের বলল,
‘কী হলো, তুমি কিছু বলছো না কেন? বলো, মা’র জ্ঞান ফিরেছে?’
ঢোক গিলে অন্বিতা। দাদু চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে অন্বিতার উত্তরের আশায়। অন্বিতা আমতা আমতা করে বলল,
‘হ-হ্যাঁ, ডাক্তার আর মাহির দেখছেন। আপনারা দোয়া করুন।’
এই বলে ভেতরে চলে গেল সে। শশী বুঝতে পারল না কিছু। কতক্ষণ চেয়ে থেকে আবারও কেঁদে উঠল। তার মা ভালো নেই। অন্বিতার কম্পিত স্বর সেটাই বলছে। দাদু লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়ালেন। শ্লতগতিতে এগিয়ে এসে হাত রাখলেন নাতনির মাথায়। কোমল স্বরে বললেন,
‘কাঁদে না, বুবু। আল্লাহ নিশ্চয় চোখ তুলে তাকাবেন।’
শশী ঠোঁট উল্টে অভিমান করে বলল,
‘কাল একটা বার মা’র সাথে কথা বললে কী হতো, নানাভাই? তুমি একবার কথা বললে তো আজ আর এই দিনটা দেখতে হতো না।’
বৃদ্ধ’র গাল বেয়ে জল গড়াল। ভেজা গলায় বললেন,
‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার জন্য’ই আমার মেয়েটা আজ এত কষ্ট পাচ্ছে।’
দাদুর কান্না দেখে শশী তাকে ধরে নিয়ে বসাল। দাদুর হাতের উপর হাত রেখে বলল,
‘তুমিও কাঁদছ? সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে তোমার ডাক্তার নাতি একা কয়জনকে সামলাবে? তুমি না কেঁদে আল্লাহর কাছে তোমার মেয়ের জন্য দোয়া করো।’
দাদু কান্না থামালেন। বললেন,
‘আমাকে একটু নামাজের ঘরে দিয়ে আয়। আমি নামাজ পড়ে মেয়েটার জন্য একটু দোয়া করি।’
শশী তাই করল। দাদুকে ধরে নিয়ে গেল নামাজের রুমে।
চলবে….
#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।
বিভাবসুর ম্রিয়মান জ্যোতি। তার স্বর্ণাভ আভায় চিকচিক করছে শশীর তেল চিটচিটে মুখটা। সকাল থেকে মুখ ধুয়া অবধি হয়নি তার। বিমর্ষ, ক্লান্ত মুখে চেয়ে আছে মায়ের বিধ্বস্ত মুখের দিকে। একদিনেই কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে তার মা। চোখের নিচে কালি পড়েছে গভীর। ঠোঁটে গ্রীষ্মের খরা পড়েছে যেন। অনেকক্ষণ মা’কে দেখে বুক ভার হলো তার। মাহিরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কি কখনোই সুস্থ হবেন না?’
মাহির প্রেসক্রিপশন দেখছিল। শশীর প্রশ্ন শুনে চাইল তার দিকে। তারপর আবার চাইল জিনিয়া বেগমের দিকে। বলল,
‘পরিপূর্ণ সেবা পেলে অবশ্যই হবে।’
শশী পুনরায় কিছু বলল না আর। দাদুর চোখ থেকে সমানে জল পড়ছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদছেন তিনি। অন্বিতা অনেক বুঝিয়েও পারছে না। মেয়ের এই অবস্থার জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করছেন। প্রেসক্রিপশন’টা তাইভিদকে বুঝিয়ে দিয়ে মাহির দাদুর কাছে গেল। তার শিউরে বসে কোমল স্বরে বলল,
‘এমন করলে কী করে হবে, দাদু? উঠো এবার, বাড়ি চলো। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।’
দাদু হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলেন। মাথা নাড়িয়ে কম্পিত সুরে বললেন,
‘না না, কোথাও যাব না আমি। আমি আমার মেয়ের কাছেই থাকব।’
‘জেদ করো না, দাদু। ফুপি এখন বিপদমুক্ত। আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই সুস্থ হবেন তিনি।’
দাদুর ঠোঁট কাঁপছে। বৃ্দ্ধ’র মন মানছে না কিছুতেই। তিনি ভেজা গলায় বললেন,
‘আমার মেয়েটা এভাবে অসাড় হয়ে পড়ে থাকবে আর আমি কিছুই করতে পারব না? বাবা হিসেবে এত অধম আমি।’
মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদুকে ধরে উঠাল। এভাবে এখানে থাকলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। শশীর দিকে চেয়ে বলল,
‘শশী, তুই দাদুকে নিয়ে বাড়ি যা। আমি আর অন্বিতা আছি এখানে।’
শশী নির্লিপ্ত সুরে বলল,
‘আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না।’
শশীর হৃদয়ের জখম মাহির টের পাচ্ছে। তাই নরম গলায় বলল,
‘তোরও ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন। চিন্তা করিস না, ফুপির কাছে আমরা সবাই আছি তো।’
শশী বার কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপ্টে অনুরোধ করল,
‘আমাকে জোর করো না, প্লিজ। আমাকে মায়ের কাছে থাকতে দাও।’
শশীর ব্যাকুলতায় মাহির পরাস্ত হলো। বলল,
‘বেশ, তোকে জোর করব না। তাইভিদ, আপনি বরং দাদুকে নিয়ে বাড়ি যান।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
দাদু আকুতি জানিয়ে বলল,
‘আমি এখানে থাকি না, দাদুভাই? মেয়েটার কাছে থাকলে আমি যে শান্তি পাই।’
‘আবার আসবে তো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে তাইভিদ তোমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে। এখন যাও, আমরা সবাই আছি এখানে।’
দাদুর মন না চাইলেও তাইভিদের সাথে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হলো। দুজন নার্স সর্বক্ষণের জন্য কেবিনে থাকবে। কেবিন থেকে বের হলো মাহির। তার পেছন পেছন এল অন্বিতা। মাহিরের কেবিনে গেল দুজন। গা থেকে এপ্রোন খুলে চেয়ারে রেখে বসল মাহির। বড্ড ক্লান্ত। চেয়ারে গা এলিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস টানল। অন্বিতা বসল বিপরীতে। জিজ্ঞেস করল,
‘মাহির, তোমার কী মনে হয়? ফুপি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন তো?’
ক্ষীণ সুরে মাহির বলল,
‘এখনই ঠিক বলতে পারছি না, অন্বি। স্ট্রোক এর ফলে মাথায় রক্ত ক্ষরণ হয়েছে বেশ, কোনোরকমে বাঁচাতে পারলেও স্নায়ুগুলো দূর্বল হয়ে পড়েছে একেবারে। সেজন্য শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো কাজ করছে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। তবে লেগে থাকতে হবে। সঠিক চিকিৎসা আর সেবা পেলে তা অবশ্যই সম্ভব।’
‘এই নার্সিংহোমে আর কয়দিন রাখবে?’
‘এখান থেকে কাল’ই রিলিজ দেওয়া যাবে। তবে বাড়িতে গেলে শশী একা কুলিয়ে উঠতে পারবে কি-না সেটাই ভাবছি।’
অন্বিতা এক পল ভেবে বলল,
‘একটা কাজ করলে কেমন হয়, প্রথম কিছুদিন নাহয় ফুপি আর শশী আমাদের বাড়িতেই থাকুক। তারপর ফুপির অবস্থা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’
মাহির বিভ্রান্ত চোখে চাইল। অন্বিতার সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,
‘এত দুশ্চিন্তা করো না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উনি তোমার ফুপি, তোমার বাবার বোন। ডাক্তার আর ভাতিজা উভয় হিসেবে উনাকে সুস্থ করাটাই এখন তোমার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
অন্বিতা উত্তরে কিছুটা স্বস্তি পেল মাহির। বলল,
‘তাইভিদকেও তাহলে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলে কেমন হয়? উনি বাসায় থাকলে দাদুকে নিয়েও আমার আর এত চিন্তা করতে হবে না। আর আমরা দুজন নার্সিংহোমে থাকলে ফুপিকেও উনি দেখতে পারবেন।’
‘বেশ তো। তুমি কথা বলে দেখো তাইভিদের সাথে।’
______________
“সঙ্গীত চর্চা” নামের এক কোচিং সেন্টারের এর বাইরে তখন থেকে পায়চারি করছে আভা। একটু পরপর নখে কামড় বসাচ্ছে আবার তাকাচ্ছে গেইটের দিকে। তপনের পতন ঘটেছে বেশ কয়েক পল আগে। অমিতের ভাষ্যমতে এখন’ই তো কাঙ্খিত মানুষের বাহির হবার কথা। কিন্তু সে আসছে না কেন? আভা পা থামাল। এভাবে পায়চারি করতে করতে পা’য়ে ব্যথা ধরেছে তার। গেইটের পাশে উঁচু পাকা জায়গাটাতে এবার বসে পড়ল সে। বিরক্তিতে মুখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। হাত ঘড়িতে চেয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,
‘আর সাত মিনিট অপেক্ষা করব, এর মধ্যে না এলে সোজা ভেতরে।’
পাঁচ মিনিটও শেষ হলো না বোধহয়। এর মাঝেই বেরিয়ে এল মানুষটি। প্রথমে আভা টের’ই পেল না। মানুষটি কয়েক কদম সামনে গিয়ে রিক্সা ডাকতেই টনক নড়ল তার। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল তার সামনে। আচম্বিত তার আগমনে চোখ মুখ কুঁচকে গেল অয়নের। আভাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
আভা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘দেখতে এসেছি।’
অয়ন ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
আভা মাথা চুলকে বলল,
‘না মানে, শিখতে এসেছি।’
অয়ন ঊর্ধ্বশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘কী শিখতে এসেছেন?’
‘গান।’
‘ভেতরে গিয়ে আলাপ করুন।’
এই বলে সে রিক্সা ডাকার জন্য হাত তুলে। আভা অস্থির গলায় বলে,
‘না না, আমি কোচিং এ শিখব না। আপনার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে শিখব।’
হাত নামায় অয়ন। গুমোট স্বরে বলে,
‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে গান শিখাই না। শিখতে হলে কোচিং এ ভর্তি হোন।’
‘এমন করবেন না, প্লিজ। আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
‘বললাম তো, ব্যক্তিগত ভাবে আমি কাউকে গান শিখাই না। আপনি অন্যকারোর সাথে যোগাযোগ করুন।’
‘কিন্তু অন্বিতা তো আমাকে আপনার কথাই বলেছে। ও বলাতেই আমি আপনার কাছে এসেছি, নাহলে তো আসতাম না।’
অয়নের ভ্রু সোজা হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘অন্বিতা বলেছেন আমার কথা?’
‘জি। ওর কথাতেই আমি আপনার কাছে এসেছি।’
অয়ন মুখ ঘুরিয়ে চিন্তায় পড়ল। আভার মুখের উপর না করলে অন্বিতার খারাপ লাগতে পারে। আবার এই আভার হাবভাবও তার সুবিধার ঠেকছে না। কী যে করবে!
কিয়ৎক্ষণ ভেবে অয়ন বলল,
‘ঠিক আছে, আপনার বাবাকে আমার সাথে কথা বলতে বলবেন।’
আভার চঞ্চল মন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ত্বরিত গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘অবশ্যই বলব।’
অয়ন আর অপেক্ষা না করে রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল তাতে। আভা দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়। অয়নের রিক্সা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ সে নড়ল না।
চলবে…..