#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৭।
পেয়ারা গাছে বসে পা দুলাচ্ছে সিতুল। বারবার উঁকি দিচ্ছে বাগানের পথে। এই রাস্তা দিয়েই তো ডাক্তারবাবুদের আসার কথা। তাহলে এখনও আসছে না কেন? এইদিকে এই তপ্ত রোদে বেচারির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। হাতের পেয়ারাতে একবার কামড় বসাল। তাকাল আশেপাশে। না, কারোর কোনো অস্তিত্ব নেই। অপেক্ষার প্রহরে বিরক্তি এসে লুটোপুটি খেল যেন। নেমে আসার জন্য উদ্যত হতেই তার সামনে এসে দাঁড়াল এক ষোড়শী কন্যা। তাকে দেখে বিরক্তিরা পাখা ঝাপ্টাল। নিমিষেই হাওয়া হলো সব। চনমনে স্বরে সিতুল জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছো, তারা?’
তারা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ভালো। কিন্তু, তুমি গাছে বসে কী করছো?’
সিতুল হেসে তার হাতের পেয়ারা দেখিয়ে বলল,
‘পেয়ারা খাচ্ছিলাম, খাবে?’
মাথা নাড়াল তারা। সিতুল তার কোলের উপর থেকে একটা পেয়ারা তারার দিকে বাড়িয়ে দিল। পেয়ারে নিয়ে তারা বলল,
‘নেমে এসো এবার।’
‘দাঁড়াও, আরো কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে নামছি।’
সিতুল ডালের উপর উঠে দাঁড়াল। গাছের উঁচুতে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়টা পাঁকা পেয়ারা। এক পা উঁচিয়ে সেগুলো ধরতে গেল। তারা সিতুল। বিচলিত হয়ে তারা বলল,
‘সাবধানে, পড়ে যাবে তো।’
সিতুল ওসবে পাত্তা দিল না। গ্রামের মেয়ে সে। গাছগাছালিতে সে বাঁদরের মতো চড়েছে। এসব এখন আর গায়ে লাগে না তার। তবে কথায় আছে আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ভালো না। সিতুলের এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপদ ডাকল। পেয়ারাতে জোরে টান বসাতে গিয়ে পা পিছলে গেল তার। অঘটন ঘটল তাতেই। ধাম করে নিচে পড়ল সে। গাছের ডালপালার সাথে লেগে হাত ছিলে গেল। কোমরেও চোট পেল বেশ। তারা ছুটে এসে ধরল তাকে। উঠানোর চেষ্টা করে বলল,
‘বলেছিলাম, সাবধানে। আমার কথা শুনোনি যে তাই এমন হয়েছে।’
জোরপূর্বক হেসে উঠে দাঁড়াল সিতুল। হাত ঝেড়ে বলল,
‘ও কিছু না। এমন ব্যথা আমি হরহামেশা’ই পাই।’
তারা সিতুলের হাত টেনে বলে,
‘আল্লাহ! কতটা কেটে গিয়েছে।’
সিতুল এবার নিজের হাতের দিকে চাইল। কনুইয়ের দিকটা ছিলে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থা। সে অন্যহাতে জায়গাটা চেপে ধরে বলল,
‘আরে কিছু হয়নি।’
তারা রেগে বলল,
‘হাত দিচ্ছ কেন? জীবাণু লাগবে তো। চলো, বাবা ড্রেসিং করে দিবে।’
সিতুলকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসে তারা। সিতুলের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। শরীরের ব্যথা নয়, মনের অস্থিরতায় দূর্বল সে। বসার ঘরেই বসে আছে সবাই। তারা তাকে সেখানেই নিয়ে এল। বলল,
‘বাবা, দেখো সিতুল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। কত রক্ত পড়ছে, তুমি একটু ড্রেসিং করে দাও তো।’
নিজের বোকামির কথা ফাঁস হতেই ভীষণ লজ্জায় পড়ল সিতুল। মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করে বলল,
‘ন-না, তেমন কিছু হয়নি।’
তারা তাকে ধমক দিয়ে বলল,
‘তুমি একদম চুপ করো। বাবা, তুমি ওর কথা শুনবে না। ও ভীষণ মিথ্যাবাদী।’
সিতুল কাঁদো কাঁদো মুখে তারার দিকে চাইল। মেয়েটা কেন তার বাবার সামনে এভাবে তাকে ছোট করছে। তার মুখ ভার হয়। মাহির চশমাটা চোখে লাগিয়ে সিতুলকে বলল,
‘দেখি, এদিকে এসে বসো।’
মাহির ইশারায় পাশে বসতে বলল তাকে। সিতুলের অন্তঃস্থলে আলোড়ন শুরু হলো। এমনিতেই তাকে দেখলে মনের ভেতর মাদল বাজে, আর আজ পাশে বসলে তো তবলা, হারমোনিয়াম, গিটার সব বাজবে একসাথে। তারা তার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
‘কী হলো, বাবা কী বলছে শুনতে পাচ্ছো না?’
সিতুল ঢোক গিলে। শুনতে পেলেও পা নড়ে না তার। সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকে দেখছে। মাহির বলল,
‘ভয় পাচ্ছো কেন? রক্ত পড়া তো বন্ধ করতে হবে। এদিকে বসো এসে। আর তারা, তুমি হালিমা চাচিকে বলে ফার্স্ট এইড বক্স’টা নিয়ে এসো।’
তারা মাথা নাড়িয়ে ছুটে গেল তার কাজে। অথচ সিতুল এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। যেন পায়ে কেউ তার পেরেক পুঁতে দিয়েছে। আসিয়া বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,
‘কিরে সিতুল, মাহির কী বলছে শুনছিস না? তোর হাত থেকে রক্ত পড়ছে তো।’
মনের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সিতুল পা বাড়াল। শম্বুক গতিতে গিয়ে বসল মাহিরের পাশে। মাহির কিঞ্চিৎ হেসে অভয় দিল তাকে। আলতো করে সিতুলের হাতটা ধরে উপরে তুলল। ব্যস, এইটুকু ছোঁয়াতেই মরে যেতে ইচ্ছে হলো সিতুলের। হৃদপিন্ড এত জোরে শব্দ তুলে লাফাচ্ছে যে, সিতুল ভয় পেল সেই শব্দ মাহির না শুনে ফেলে। মাহির কাটা জায়গাটা ভালোভাবে দেখে বলল,
‘অনেকটা কেটেছে।’
তারার কাছ থেকে সব শুনে বসার ঘরে হালিমা বেগমও এলেন। সিতুল আর মাহিরকে পাশাপাশি দেখে অযাচিত ভয়ে সংকুচিত হলেন তিনি। তারা বাবার দিকে ফার্স্ট এইড বক্সটা বাড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র নিয়ে সিতুলের ড্রেসিং আরম্ভ করে মাহির। সিতুল মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখে তার থেকে দ্বিগুণ বয়সের এক পুরুষকে। লোকটার যে এত বয়স কেউ ক্ষুণাক্ষরেও টের পাবে না। চোখ মুখের গড়ন আর শরীরের বলিষ্ঠ গঠনে এখনও যে কেউ তাকে পঁচিশ বছরের টকবকে যুবক ভেবে ভুল করবে। সিতুলের মনে হয়, তার শরীর খারাপ করছে। এভাবে এত কাছ থেকে মাহিরকে দেখে আরও বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছে সে।
ড্রেসিং শেষ করে মাহির বলল,
‘কয়টা দিন বাঁদরামি একটু কম করবে। নয়তো এক জায়গায় আবারও ব্যথা পেলে ক্ষত কিন্তু আরো গাঢ় হবে।’
মনের বিশাল ক্ষতের কাছে শরীরের এইটুকু ক্ষত তো কিছুই না। তাও সিতুল মাথা নাড়াল। চট করে উঠে এল সেখান থেকে। হালিমা বেগম সবার আঁড়ালে হাত চেপে ধরলেন তার। বললেন,
‘ভেতরে গিয়ে উনাদের খাবারের আয়োজন কর।’
মায়ের আদেশে খানিকটা ভড়কে ভেতরে গেল সিতুল। হালিমা বেগম সবার দিকে চেয়ে হেসে বললেন,
‘আপনারা সবাই হাতমুখ ধুয়ে নিন, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।’
সবাই উঠে যার যার মতো রুমে গেল। তারা টি টেবিলের দিকে চাইল। সিতুলের আনা পেয়ারাগুলো সেখানেই রাখা। তাহমির এসে সেখান থেকে খপ করে একটা পেয়ারা তুলে বলল,
‘তোমার সিতুল আন্টির জন্য যে মায়া আমার জন্য তো তার এক অংশও নেই।’
তারা কপাল কুঁচকে বলল,
‘কারণ, সিতুল আমার বান্ধবী।’
‘তাহলে আমিও তোমার বন্ধু।’
‘মোটেও না।’
তাহমির বিমর্ষ সুরে বলল,
‘কেন? আমাকে বন্ধু ভাবতে অসুবিধা কীসের?’
‘তুই আমার ভাই, আর ভাই’ই থাকবি। বুঝেছিস?’
পেয়ারাগুলো তুলে ভেতরে চলে যায় তারা। তাহমির গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা’টা তার বড়ো বলে সে ছেড়ে দিচ্ছে বারবার, নয়তো কবেই সব চুল টেনে ছিড়ে দিত।
_____________
হাতের ব্যান্ডেজ’টার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে সিতুল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। বাগানে এখন হলুদ্রাভ। গাছ থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। সিতুল কান পেতে শুনল তা। ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
‘তোরা বুঝি আমাকে নিয়েই কথা বলছিস?’
পাখিদের কিচিরমিচির জারি রইল। সিতুল ধরে নিল, হয়তো তার’ই প্রশ্নের উত্তর তা। তাই নিজ থেকেই বলল,
‘ইচ্ছে মতো সমালোচনা কর, তাতে কী? আমার ওসব গায়ে লাগে না। আমি একজনের প্রেমেই দিশেহারা, হাজার সমালোচনার ভিড়েও আমি শুধু তাকেই চাইব।’
‘কাকে চাইবে? কার প্রেমে দিশেহারা তুমি?’
আচম্বিত এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় সিতুল। কন্ঠস্বর চেনা তার। তাই ভয়ে ঢোক গিলে। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। বলে,
‘ক-কেউ না। আমি তো শুধু মজা করে বলছিলাম।’
তারা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সবুজ ঘাসের গালিচায় পা ভাঁজ করে বসল। সিতুলের হাত টেনে বলল,
‘বসো।’
সিতুল বসল তার পাশে। তারা আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
‘শুনো, বাগানে কিছু নয়নতারা গাছ লাগাবে।’
সিতুল মাথা কাত করে বলল,
‘আচ্ছা লাগাব।’
‘নয়নতারা গাছ বাবার খুব প্রিয়। আমার মা’রও।’
সিতুল হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ওহ।’
তারপর আচানক পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠল। দুজনেই চুপটি করে বসে রইল কিছুক্ষণ। সিতুলের অস্বস্তি হচ্ছিল কেন জানি। বলল,
‘চলো, পুকুরঘাটে যাই।’
উত্তরে এল পাল্টা প্রশ্ন,
‘আমার বাবাকে ভালোবাসো?’
চলবে….