একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৫৯

0
25

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৯।

সন্ধ্যার ইতি টেনে আকাশ কালো হতেই বাগানের বাতিগুলো জ্বলে উঠে। চারদিক হয়ে উঠে হলুদ্রাভ। ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে যায় সে বাগানের শেষ প্রান্তে। মাথায় কাপড় টেনে সেখানেই দাঁড়ায়। তাকিয়ে রয় নিশ্চুপ। হাতে একটা ফোন নিয়ে তখন ছুটে আসে তারা।

‘মনি, তুমি এখানে? বন্ধু তোমায় কবে থেকে কল করছে।’

ঘুরে তাকায় আভা। ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে।

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘কখন ফিরবে?’

‘একটু পর।’

‘তাড়াতাড়ি এসো। তোমার মেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। ওকে আর সামলানো যাচ্ছে না।’

‘আরেকটু কষ্ট করুন। চলে আসছি।’

একটু থামল। অয়ন জিজ্ঞেস করল,

‘অন্বিতার কবরের সামনে তুমি?’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘যখনই সেখানে দাঁড়াও তখনই তোমার কন্ঠস্বর বদলে যায়। সেজন্যই আমি তোমাকে সেখানে যেতে দেই না।’

‘আমি আপনার মতো পাথর নই, অয়ন। আমার মন আছে।’

মলিন হাসল অয়ন। বলল,

‘পাথর হয়ে ভালো থাকা গেলে, অসুবিধা কীসের?’

আভা পাল্টা কিছু বলতে নিয়েও থেমে যায়। পাশেই তারা দাঁড়িয়ে। ছোট্ট মেয়েটার সামনে এতকিছু বলা ঠিক হবে না, ও কী ভাবতে কী ভাববে। তাই সে শুধু বলল,

‘আচ্ছা, অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে।’

ফোন কাটল অয়ন। মেয়ের কাছে গেল। হাতের ফোনটা তাকে দিয়ে বলল,

‘আম্মু, তুমি গেইম খেল। মা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।’

তার সাত বছরের মেয়ে রাবা খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল। বাবার হাত থেকে ফোন নিয়ে গেইমে মনোযোগ দিল সে। অয়ন গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। সুধাংশু শূণ্য উন্মুক্ত অন্তরীক্ষ। মেঘের বিচরণ বোঝা মুশকিল। মৃদু মন্দ সমীরণ আছে যদিও, তাতেও তেমন উচ্ছ্বাস নেই। অন্বিতা নেই আজ ষোল’টা বছর। অথচ এই এক যুগেরও বেশি সময় পর এসেও অন্বিতার মুখটা এখনও ঘোলাটে হয়নি। বরং এখনও চোখ বুঝলে দৃশ্যপটে তার জ্বলজ্বল করে অন্বিতার হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী। জ্বলজ্বল করে কাফনের কাপড় মুড়ানোর পর সেই শুভ্র মুখখানা। যদিও দূর থেকে তা কেবন একবার’ই দেখেছিল। তবে ঐ ক্ষীণ সময়ের নগণ্য দেখা আজও পীড়া দেয় তাকে। সেই পীড়ার ভয়েই সে কখনও অন্বিতার কবর দেখতে যায়নি। এই ষোল বছরে আভা কম জোর করেনি তাকে, তবে অয়ন মনের ভয়ে হার মেনে তার সিদ্ধান্তেই অটল ছিল। সেসব ভেবে অতি সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। ভেতর থেকে রাবা বলে উঠে,

‘বাবা, আমার খিদে পেয়েছে।’

মুচকি হেসে রুমে আসে অয়ন। বলে,

‘তুমি বসো। বাবা তোমার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

___________

আভার এক হাত তারা জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘মা’কে খুব মিস করো, তাই না?’

আভা বাঁধ ভাঙা কান্না দমিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, খুব।’

‘বন্ধুও কি মিস করে?’

আভা ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলল। বলল,

‘হু, করে।’

‘তবে বন্ধু কেন মা’র কবর দেখতে আসে না?’

‘আমি তো জানি না, তারা। তুমি বরং এই প্রশ্নটা তোমার বন্ধুকে করো, তিনিই উত্তর দিতে পারবেন।’

তারা হেসে মাথা নাড়াল। বলল,

‘আচ্ছা, করব।’

সিতুল দূর থেকে ডাকল তাদের,

‘তারা, তোমাদের সবাই ডাকছেন। এসো।’

নাস্তা সেরে সবাই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শশী বসার ঘরে এল। দেখল তাইভিদ ছেলের সাথে ঘোর আলোচনায় বসেছে। সেও বসল পাশে। জিজ্ঞেস করল,

‘কী নিয়ে কথা বলছো দুজন?’

তাকে দেখেই বাপ বেটা মুখে তালা দিল। তাহমির উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘মা, আমি আমার জুতোগুলো পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছিলাম, দেখেছ?’

শশী বেশ বুঝল, প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমার সাথে একদম চালাকি করবে না। বাপ বেটা কী নিয়ে আলোচনা করছিলে বলো আমায়।’

‘বাবা বলছিল আরেকটা বিয়ে করবে। মেয়েও না-কি পছন্দ করা আছে, সেটাই বলছিল আমাকে।’

তাইভিদ আঁতকে উঠে বলে,

‘বেয়াদব ছেলে, তবে রে…’

তাইভিদ তেড়ে আসার আগেই তাহমির পালায়। শশী কপাল কুঁচকে বলে,

‘তোমার আশকারাতেই ছেলেটা বাঁদর হচ্ছে।’

‘ঠিকই বলেছ, একেবারে মায়ের মতো।’

শশী চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘মায়ের দোষ দিবে না একদম। আদরে বাঁদর বানিয়ে এখন সামলাতে না পেরে আমার দোষ, না? বাড়ি চলো একবার, বাপ বেটাকে একসাথে শায়েস্তা করব।’

শাসিয়ে টাসিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল শশী। তাইভিদ বসে বসে হাসল। মেয়েটার এই রাগ, শাসানো, চোখ রাঙানো দেখলে তার ভীষণ প্রেম প্রেম পায়। মনে হয় যেন যৌবন তার আবার ফিরে আসছে।

_____________

‘ভাবি, সবসময় টাকা কেন দিতে হবে?’

আসিয়া বেগম মৃদু সুরে বললেন,

‘আমি দিই না, মাহির দেয়।’

‘কেন, ভাবি? আমি তো গায়ে খেটে যতটুকু টাকা রোজগার করি তাতে আমার আর আমার মেয়ের হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত টাকা আমার লাগবে না।’

‘এটা মাহির তোমায় খুশি হয়ে পুরস্কার দেয়, সম্মানস্বরূপ। এই যেমন আমাকেই দেখো না; অন্বিতা চলে যাওয়ার আজ এত বছর, আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও সে চোখের আঁড়াল হতে দেয়নি। কত বলেছি, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকলে লোকে মন্দ বলবে, কিন্তু কে শুনে কার কথা। সেই জোর করে রেখে দিয়েছে আমাকে, মায়ের মতো করে আগলে রাখছে। বুঝলে তো, আমার অন্বিতার কপাল ছিল সোনা দিয়ে মুড়ানো কিন্তু মৃত্যু এসে এক লহমায় তছনছ করে দেয় সব।’

তিনি রুদ্ধশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের কথা ভাবলেই নিশ্বাস আটকে আসে উনার। নাতনিটার মুখ চেয়ে শুধু প্রতিদিন একটু একটু করে বেঁচে থাকেন। নয়তো কবেই মেয়ের কাছে চলে যেতেন..

হালিমা বেগমের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন,

‘আমার শ্বশুরবাড়ির তরফের তেমন কেউ নেই। তোমার সাথে সম্পর্কটাও বেশ দূরের। তাও এখানে এলে তুমি আপ্যায়নের কোনো কমতি রাখো না। তুমি এখানে আছো বলে, আমার মেয়েটাকে এখানে রেখে আমি একটু নিশ্বাস নেওয়ার শক্তি পাই। তুমি আর তোমার মেয়ের অমায়িক ব্যবহারের বরবার’ই মাহির ভীষণ প্রশংসা করে।’

হালিমা বেগম আপ্লুত হয়ে বললেন,

‘কী যে বলেন না, ভাবি। আপনার মেয়ের জামাইয়ের মতো মানুষ হয় না-কি। আমার মেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন, মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করেছেন, চিকিৎসার প্রয়োজন তো আরো আগেই মিটিয়ে দিয়েছেন। উপরন্তু, প্রতিবার যাওয়ার সময় এতগুলো করে টাকা দিয়ে যান, আমাদের তো ভাগ্য যে আমরা আপনাদের জন্য কিছু করতে পারছি।’

‘আচ্ছা, ভালো থেকো তবে। আর কোনো অসুবিধা হলে অবশ্যই জানাবে।’

হালিমা বেগম ইতস্তত সুরে বললেন,

‘ভাবি, একটা কথা ছিল।’

‘কী কথা, বলো?’

আমতা আমতা করছেন তিনি। কী করে বলবেন বুঝতে পারছেন না। যদি আবার অনধিকার চর্চা হয়ে যায়। আসিয়া বেগম তাকে অভয় দিয়ে বললেন,

‘ভয় পেও না, বলো।’

‘ভাবি, মাহির বাবা কি এভাবেই থাকবেন? না মানে, এখন তো গায়ে শক্তি আছে বলে একাই সব সামলাতে পারেন কিন্তু শেষ বয়সে এসে তো কাউকে না কাউকে প্রয়োজন হতে পারে। তখন তো একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আর কেউই পাশে থাকে না। আমি আসলে উনার কথা চিন্তা করেই বলছিলাম, আপনি ভুল বুঝবেন না।’

‘না না, ভুল বুঝব কেন? মাহিরের বিয়ে নিয়ে ওকে সবাই জোর করেছে। ওর দাদু নাতির দুশ্চিন্তায় শেষে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন, তাও মন গলল না মাহিরের। ছেলেটার ভালোবাসা সব একজনের জন্য’ই ঢেলে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের কথা ওর সামনে কেউ মুখেও নিতে পারে না। সবাই বলে বলে ক্লান্ত হয়ে এখন ক্ষান্ত হয়েছে। ও না চাইলে আমরা তো আর জোর করতে পারি না।’

‘তা ঠিক। আজকালকার যুগে এমন পুরুষ আছে না-কি! তারা তো বউ মরলে চল্লিশ পেরুনোর আগেই বিয়ের জন্য আঁইঢাঁই শুরু করে। সেখানে মাহির বাবা সব পুরুষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অন্বিতা মা সত্যিই কপাল করে এক পুরুষ পেয়েছে। দেখবেন, জান্নাতে আবার একসাথে থাকবে দুজন।’

‘দোয়া করো, তাই যেন হয়। তাদের অপূর্ণ, অসমাপ্ত ভালোবাসা যেন আখিরাতে গিয়ে পূর্ণতা পায়।’

‘অনেক দোয়া করি।’

বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল সবাই। সিতুল পিছু পিছু একেবারে পাকা রাস্তা অবধি এল। প্রতিবার’ই এমন করে। যতক্ষণ গাড়ির লাল লাইট’টা চোখে পড়ে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সে। একটু পরপর আঁচলে নাক, চোখ মুছে। তারার জন্য মন খারাপ হয় তার, তারার বাবার জন্যও হয়। তবে আজ থেকে আর হবে না। মনকে বুঝিয়েছে সে। তারার বাবা শুধুই তারার মায়ের, সে কোনোভাবেই এই নির্মল চমৎকার ভালোবাসায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

চলবে….