একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৬১ এবং শেষ পর্ব

0
30

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬১। (অন্তিম পর্ব)

সেদিনের এক ষোড়শী মেয়ের কথায় অয়নের প্রাপ্ত বয়স্ক মনের বিদঘুটে যুদ্ধ নিষ্পন্ন হয়। পরের সপ্তাহ অন্তেই স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে সে অন্বিতার কবর দেখতে যায়। আভা খুশি হয় ভীষণ। পুরোটা সময় অয়নকে দেখে নিষ্পলক। অয়নের নিস্তেজ চাহনি। অন্বিতার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ঘন্টা খানিক। তারপর মোনাজাত ধরে, মেয়েটার জন্য জান্নাত চায়।

সাত বছরের মেয়ে রাবা, নতুন জায়গায় এসে ছিল ভীষণ উত্তেজিত। তবে কবরের সামনে এসে থমকায় সে। এই জিনিসটার সাথে তার প্রথম পরিচয়। মায়ের আঁচল টেনে জিজ্ঞেস করে,

‘মা, এটা কী?’

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আভা বলে,

‘এটা মাটির ঘর, মা। আমাদের সবার শেষ এবং একমাত্র বাসস্থান।’

ছোট মেয়েটা অপলক চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘ঘর? এখানে কি কেউ থাকে?’

‘হ্যাঁ, থাকে তো। তোমার অন্বিতা মনি থাকে। তারা আপুর মা।’

হতভম্ব হলো মেয়েটা। অবাক হয়ে বলল,

‘তারা আপুর মা মাটির ভেতর কী করে থাকে, মা? উনার কষ্ট হয় না?’

আভা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘না, মা। কষ্ট হয় না। এখানে একদিন আমাদের সবাইকে থাকতে হবে।’

মা’কে জড়িয়ে ধরল রাবা। বলল,

‘না মা, আমি এখানে থাকব না। আমি তোমার আর বাবার সাথে আমার রুমেই থাকব।’

আভা মলিন হাসে। অবুঝ মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

_________

তারার আজ দারুণ খুশি। সে ছুটে এল বাবার রুমে। মাহির তখন লেপটপে কাজে ব্যস্ত। তারা বাবার পাশে বসল। বলল,

‘বাবা, একটা চমৎকার সংবাদ আছে।’

লেপটপ সরিয়ে মেয়ের হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে চাইল মাহির। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল এক লহমায়। আদর করে বলল,

‘কী সংবাদ, মামনি?’

‘জানো, বন্ধু আজ মা’র কবর দেখতে গ্রামে গিয়েছিল।’

অবাক হলো মাহির। এত বছর পর অয়ন গিয়েছে তবে। সে জিজ্ঞেস করল,

‘কে বলল তোমায়?’

‘মনি কল দিয়ে বলেছে আমাকে। আমি আজ ভীষণ খুশি।’

মেয়ের খুশি দেখে মাহিরও প্রসন্ন বোধ করল। অয়ন আর অন্বিতার কথা আভা’ই বলেছিল তারাকে। যেদিন তারা প্রথম অন্বিতার ডায়েরিটা পড়েছিল সেদিন। মাহির বারণ করেনি। কাউকে ভালোবাসা তো আর অন্যায়ের কিছু না। অন্বিতার প্রতি অয়নের ভালোবাসায় এক সময় মাহিরের ঈর্ষা থাকলেও এখন আর নেই। সে তারার মাথায় হাত রেখে বলে,

‘আমিও খুব খুশি হয়েছি, মা।’

‘যাই, কথাটা ফুপি আর নানুকেও জানিয়ে আসি।’

এই বলে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। মাহির মেয়ের দিকে চেয়ে নির্মল হাসল। এই ছোট্ট মেয়েটাই তো তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। তার প্রাণ ভোমরা।

__________________

দিবাবসু তার বাক্স পুটলি বেঁধে বাড়ি ফিরেছে। সেই দুঃখে কাতর হয়েছে ভূমিলোক। নেমেছে ঘোর অমাবস্যা। চারদিকে চিকচিকে অন্ধকার। বাইরে জ্বলছে কৃত্রিম বাতি। গেইটের কাছটা বেশ আলোকিত। বাগানেও তাই। শশীর রুমে বসে টিভি দেখছে তারা। পাশেই শশী আর জিনিয়া বেগম। এই সময় তাদের তিন জনের প্রিয় এক প্রোগ্রাম দেয়। তারার যদিও এসবে খুব একটা আগ্রহ নেই, তবে একদিন হুট করে জিনিয়া বেগম সেই প্রোগ্রামের এক মেয়েকে দেখিয়ে বলেন, তাকে না-কি অন্বিতার মতো লাগে। এরপর থেকে তারা আর সেই প্রোগ্রাম দেখা বন্ধ করেনি। অবশ্য তারার কাছে ঐ মেয়েকে কোনো অর্থেই তার মায়ের মতো লাগে না, তাও দেখে সে। হয়তো মনে খানিক শান্তি পায়।

এর ফাঁকেই তাহমিরকে সে মেসেজ পাঠায়,

‘হয়েছে?’

চট করে উত্তর আসে,

‘আর পাঁচ মিনিট।’

‘জলদি কর। প্রোগ্রাম কিন্তু শেষ হওয়ার পথে।’

প্রোগ্রাম শেষ হলো। শশী উঠল বিছানা ছেড়ে। তারাকে বলল,

‘তুই বোস, আমি তোর জন্য মিল্কশেক বানিয়ে আনি।’

তারা চট করে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

‘না না, আমি এখন কিছু খাব না।’

‘কেন? কিছুই তো নাস্তা করলি না।’

‘আহা! ফুপি, তুমি বসো। টিভি দেখো। আমি খাব না কিছু।’

‘আচ্ছা বেশ। তাহমিরকে জিজ্ঞেস করে আসি তবে।’

শশী যেতে নিলেই তারা পথ আটকায়। কিছু বলার আগেই ফোনে মেসেজ আসে,

‘কমপ্লিট।’

মুচকি হেসে পথ ছেড়ে দাঁড়ায় তারা। বলে,

‘হ্যাঁ, যাও।’

তারার ব্যবহারে খানিকটা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে সেখান থেকে চলে আসে শশী। তবে বসার ঘর অবধি এসেই পা জোড়া থেমে যায় তার। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়। অমনি পেছন থেকে তারা ছুটে এসে একসাথে সবাই বলে উঠে,

‘শুভ জন্মদিন।’

শশীর রা নেই। তার জন্মদিন না-কি? সে তো ভুলে বসেছিল বেমালুম। এসব নিয়েই এতদিন বাপ ছেলের মধ্যে গোপন আলোচনা চলছিল? হাসে সে। কী সাংঘাতিক কান্ড! বুড়ো বয়সে এমন জন্মদিন মানায়? শশী এগিয়ে যায়। তাহমিরের কান মলে দিয়ে বলে,

‘ওরে দুষ্টু ছেলে, আমার আঁড়ালে এত কিছু।’

চোখ মুখ খিঁচে তাহমির বলে,

‘মা, লাগছে তো। সারপ্রাইজ’টা ভালো লাগেনি?’

ছেলের কান ছেড়ে কপালে চুমু খায় শশী। আপ্লুত সুরে বলে,

‘ভীষণ ভালো লেগেছে, বাবা।’

তাইভিদ চট করে বলে বসে,

‘ছেলের সাথে তো আমিও ছিলাম। তাহলে আমাকেও..’

শশী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই থেমে যায় তাইভিদ। কী বলছিল ভাবতেই জিভ কাটে সে। বোকার মতো হেসে বলে,

‘তারা মা, তোমার বাবা আর নানুকে ডেকে নিয়ে এসো। আমরা সবাই একসাথে কেক কাটব।’

সবার উপস্থিতিতে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে শশী। সবাইকে কেক খাইয়ে দেয়। আনন্দ করে। মন ভরে তৃপ্তির শ্বাস টানে। এটাই তার পরিবার, ভেবে মনে আনন্দের জোয়ার বয়। মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এখানেই আছে সে, তার পরিবার। মাহির যেতে দেয়নি তাদের। রেখে দিয়েছে। মাহির একা হয়ে যাবে ভেবে শশীও কোনোদিন জোর দেখায়নি। আর সেই সুবাদে এখানে তার এক চমৎকার পরিবার গড়ে উঠেছে। এখনও মাঝে মাঝে নিজের অন্যায়ের কথা তার মনে পড়ে, এখনও অনুতপ্ত হয়। অন্বিতার কাছে ক্ষমা চায়, ক্ষমা চায় সৃষ্টিকর্তার কাছে। যদি অন্বিতার উছিলায় সৃষ্টিকর্তা তাকে আরেকটা সুযোগ না দিত, তবে এত সুন্দর পরিবার পাওয়ার সৌভাগ্য তার কখনোই হতো না।

_____________

মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে বসল আভা। অয়ন এখনও বারান্দায় কী করছে কে জানে। আভা শম্বুক গতিতে এগিয়ে যায়। অয়নের পাশে দাঁড়ায় গিয়ে। অয়ন জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমাওনি?’

‘না।’

‘রাবা ঘুমিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

অয়ন পাশ ফিরে চাইল। ম্রিয়মান আলোয় দেখল আভার ফর্সা মুখখানা। আভার মুখের গঠন বদলায়নি। সেই এক যুগ আগের মতোই রয়ে গিয়েছে- সুশ্রী, নিরুপম সুন্দর। মৃগনয়নাতে এখনও উপচে পড়ে মায়া। আভা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তার এই সুগভীর দুই চোখ তার’ই স্বাক্ষী। কিন্তু অয়ন, সে আদতে আভাকে ভালোবাসতে পেরেছে তো? অয়ন ঢোক গিলল। অন্বিতা মারা যাওয়ার পর আভার হাত সে শক্ত করে ধরেছিল; বলেছিল, ছাড়বে না। ছাড়েনি। বরং জড়িয়েছিল পবিত্র সম্পর্কে। পূর্ণতা পেয়েছিল এক ছোট্ট পুতুলের আগমনের মধ্য দিয়ে। তাও আজকাল হুট করেই যখন মনকে প্রশ্ন করে, সে কি আদতে আভাকে ভালোবাসতে পেরেছে কি-না, উত্তর দিতে গিয়ে থমকায় সে। বড্ড দ্বিধায় পড়ে। এখনও তা। সে আভার দু হাত আগলে ধরে বলে,

‘আমি তোমাকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা দিতে পারিনি, আভা। আমি দুঃখিত।’

অয়নের কথায় বিস্মিত হলো আভা। আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতোই তাদের একটা সাজানো গুছানো সংসার থাকার পরেও কীসের একটা কমতি যেন ঠিকই ছিল। যদিও আভা সেটা কখনও আমলে নিতে চায়নি; কিন্ত এইটুকু বুঝতে পেরেছিল, প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে অয়ন এখনও সেই যন্ত্রণায় কাতর। তবে আভা তার সেসব ভাবনা কখনও অয়নের সামনে প্রকাশ করেনি। অয়নকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে, সেই ঢের। উপরন্তু, তার ভালোবাসার জলন্ত প্রমাণ তাদের মেয়ে তো আছেই, আর কী লাগবে। অয়নও নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ ছিল এই ব্যাপারে। আজ হঠাৎ কী হলো, সেই ভেবেই অবাক আভা।

অয়ন নিজ থেকেই ফের বলল,

‘অন্বিতার কবর দেখে আমি শান্তি পেয়েছি। মন থেকে এক বিশাল বোঝা নেমেছে। মন হালকা হয়েছে। শান্তিতে দু দন্ড কথা বলতে পারছি এখন।’

আভা মলিন হেসে বলল,

‘অন্বিতার ভীষণ সৌভাগ্য। সে দুই পুরুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা পেয়েছে।’

আভার কথা শুনে স্তম্ভিত হলো অয়ন। অন্বিতা দুই পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছে, আর আভা? আভা কিছুই পায়নি। সে বিচলিত হলো। আভাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

‘আমায় ক্ষমা করো, আভা। দুর্ভাগ্য আমার, যে তোমার এই নির্মল ভালোবাসায় দূরত্ব টেনে দিয়েছিলাম। নিজের মনের যুদ্ধে আজ আমি জয়ী। মনকে বোঝাতে সক্ষম। আজ আর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি তোমায় ভালোবাসি, আভা।’

টুপ করে জল গড়াল গাল বেয়ে। এই একটা স্বীকারোক্তি শুনতে এক যুগেরও বেশি অপেক্ষা, কত শত নির্ঘুম রাত, চোখের নির্নিমেষ জলধারা, আজ সফল সব। সে দু হাতে অয়নকে জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘মনে হচ্ছে, আমার বেঁচে থাকা আজ সার্থক। আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, অয়ন। ভীষণ।’

অয়ন ভালোবাসায় আগলে নেয় তাকে। প্রথমবার জৈবিক টানে সান্নিধ্যে গেলেও আজ গিয়েছে ভালোবাসার অভিনিবেশে। নিমিষেই জড়িয়ে নিয়েছে আভাকে। পণ করেছে, আভার এতদিনের সমুদয় দুঃখ, কষ্ট, অভিমান না গোঁজা অবধি এই ভালোবাসার নিষ্পাদন সে ঘটাবে না। তাতে যদি আরো কয়েক যুগও পেরিয়ে যায়, তাও সই।

_________

রাতে মাহিরের ঘুম হয়না। ঘড়িতে তিনটা। রুমে ঘুমবাতি জ্বলছে। আর জ্বলছে এক জোড়া নিরেট শূন্য চোখ। ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে দেখছে, নিজের প্রিয়তমাকে। কী অনবদ্য হাসি তার ওষ্ঠ কোণে। তাদের বিয়ের ছবি। রাত হলেই গ্যালারি ঘেটে অন্বিতার এসব ছবি দেখা মাহিরের পুরোনো অভ্যাস। আর এভাবেই রাত কাটে তার। সকাল হয়, ব্যস্ত জীবনে দৌড়ে বেড়ায়। তারপর আবার রাত হয়, আর আবারও এই ছবিতে করে মনোনিবেশ। এই তো এভাবেই ষোল’টা বছর কাটিয়েছে। এভাবেই কাটাবে বাকি জীবন। তাও এই মেয়েকে দেখার সাধ তার মিটবে না কভু। ফোনের স্ক্রিনে ঠোঁট বুলায় মাহির। বাচ্চাদের মতো করে বলে,

‘তোমার অপূর্ণতা আমার ভালোবাসার ভীত আরো মজবুত করেছে, অন্বি। পুরো পৃথিবী ধ্বংস হলেও এই ভীত নড়বে না। ভেবো না, তোমার দূরত্বে আমি কুন্ঠিত। কারোর অপেক্ষায় রজনী ক্ষান্তের সুখ তুমি কী বুঝবে? আমার অনুপস্থিতি তোমাকে নিস্পৃহতা দেয় কি-না জানা নেই। তবে বিশ্বাস করো, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে একটু একটু করে মৃত্যু দিচ্ছে। তাও দেখো, আমি দিব্যি ভালো আছি। তা না থেকে উপায় আছে? তোমার নয়নতারার যে আমি ছাড়া কেউ নেই। তার জন্য না হয় আর কয়টা দিন এভাবেই অভিনয় করলাম। তবে তুমি ভালো থেকো। আর আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি আসব, অবশ্যই আসব। এক পূর্ণচন্দ্র তিথিতে আমাদের আবার দেখা হবে। আমাদের অপ্রেমের গল্পটা প্রেমের হবে সেদিন। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করো কিন্তু।’

সমাপ্ত।