জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-০৩

0
12

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব: ০৩]

বেলা বাড়তেই বাড়িতে এসে উপস্থিত হচ্ছে আত্মীয়- স্বজনের দল। বাড়ির সামনের বাগান দিয়ে ছোটাছুটি করছে বাচ্চারা। খেলছে বিভিন্ন উদ্ভট সব খেলা। দু তলার করিডোরের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটিই মনোযোগী দৃষ্টিতে উপভোগ করছে উথমী। এই স্বল্প ক্ষণেই যেনো তার ভেতরের সকল বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে প্রশান্তিতে। পেছন থেকে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। মনোযোগ নষ্ট হলো উথমীর। কয়েক সেকেন্ডেই সেই শব্দটা এসে থামলো তার পেছনে। তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরলো সে। দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত মুখশ্রীর। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মিষ্টি হাসলো জেবা। তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,“তুমি দেখছি তৈরি হয়ে গিয়েছো! মাশাআল্লাহ খুব মিষ্টি লাগছে। এবার নিচে চলো দেখি। বড়ো চাচী তোমায় নিয়ে যেতে বলেছেন। সবার সাথে দেখা করেই চলে আসবে। পার্লার থেকে তো আবার লোক আসবে সাজাতে, তাই না?”

নিরবে মাথা নাড়ায় উথমী। জেবার সাথে পা মিলিয়ে ধীর গতিতে হাঁটা ধরে নিচে। এই বিশাল বাড়িটির নাম ‘ফুলকুঞ্জ’। তৈমূরের দাদী ফুল বানুর নাম থেকেই এই ফুলকুঞ্জ নামটির উৎপত্তি। তৈমূরের পিতা তৌহিদুল উদ্দিন পেশায় ছিলেন ব্যারিস্টার। বিদেশের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনেছিলেন ব্যারিস্টারি ডিগ্ৰি। ঢাকার একটি আদালতের কোর্ট রুমেই বসতেন তিনি। থাকতেনও সেখানেই। তবে ভদ্রলোক ছিলেন চরম মা ভক্ত পুরুষ। মায়ের ইচ্ছাতেই বাধ্য ছেলের মতো বিয়ে করেছিলেন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া শাহানাকে। বিয়ের মাস ছয়েক পর যখন স্ত্রীকে সঙ্গে করে তিনি নিয়ে যেতে চাইলেন, তখনি মাঝখানে বাঁধ সাধেন মা ফুল বানু। ফুল বানুর মতে,‘বাড়ির বউয়ের সীমানা বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এদের কাজ শ্বশুর- শাশুড়ির খেদমত করা আর সংসার পরিচালনা করা।’ কিন্তু স্বামী ছাড়া আদৌ কী কোনো সংসার হয়? তবে সেকথাটা তখন কেউ বুঝেও বুঝলো না। এতো শিক্ষিত তৌহিদুল উদ্দিনও তখন মেনে নিলেন মায়ের এই অন্যায় সিদ্ধান্ত।

শাশুড়ির বিভিন্ন অন্যায় নিয়মের কারণেই যৌবনকালে শান্তিতে সংসার করতে পারেননি শাহানা। স্বামীকে তেমনভাবে পাননি কাছে। আর যখন পেয়েছিলেন তখন বয়সের সাথে সাথে ইচ্ছেগুলোরও পরিবর্তন ঘটেছিল। ছেলে-মেয়েরা হয়ে গিয়েছিল প্রাপ্ত বয়স্ক।

এই তিনতলার বিশাল বাড়িটি তৌহিদুল উদ্দিনের নিজের। বাড়ি তৈরির কাজ শেষে বড়ো সাধ করে মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলেন,‘ফুলকুঞ্জ’। বড়ো ভাই বশির উদ্দিনের আবার লেখাপড়ার দৌড় খুবই কম। প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়েছিলেন কিনা তাও সন্দেহ। অল্প বয়সেই অসৎ সঙ্গ পেয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান। কাজকর্মও তেমন একটা করতেন না। ভিটে মাটি বন্ধক দিয়ে সংসার চালাতেন। ফুল বানুর আবার প্রত্যেক সন্তানের জন্যই ছিলো প্রবল নাড়ির টান। তাই তো মৃত্যুর আগে মেজো ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তিন তলা বাড়িটির একতলা লিখিয়ে নিয়েছিলেন বড়ো ছেলের নামে। সেই থেকেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তৃতীয় তলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন বশির উদ্দিন। যদিও তিন মেয়েকে কয়েক বছর আগেই বিয়ে শাদি দিয়ে ল্যাটা চুকিয়ে ফেলেছেন। সে ঘরের নাতি নাতনিরাও এতদিনে প্রাইমারি শেষ করে পা দিয়েছে হাই স্কুলে।

উথমীকে নিয়ে নিচে নেমে এলো জেবা। সবাইকে আড়চোখে দেখে নিয়ে সালাম দিলো উথমী। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো সমস্বরে সালামের উত্তর। গতকালের মতো আজও অন্দরমহলে বেশ কয়েকজন রমণীর ভিড়। কেউ মেঝেতে বসে আছে আবার কেউ বা সোফায়। গতকাল উপস্থিত থাকা দুয়েকজনও আছে তাদের মধ্যে। তবে বাকি মুখগুলো উথমীর নিকট অপরিচিত। বড়ো গিন্নি জয়নব পানের বাটা নিয়ে বসে আছেন পিঁড়িতে। মুখের ভেতরে একটা পান চালান দিয়ে চিবোতে চিবোতে জেবার উদ্দেশ্যে বললেন,“নতুন বউরে এইহানে বসাও দেহি। সবাই তো তার লাইগাই এতক্ষণ ধইরা অপেক্ষা করতাছিল।”

চাচী শাশুড়ির আদেশ মোতাবেক উথমীকে ইশারায় বসতে বললো জেবা। জয়নব এবার তার উদ্দেশ্যে বললেন,“আমারে চিনছো? আমি হইলাম তোমার বড়ো চাচী শাশুড়ি। বুঝছো?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় উথমী। তার এই মাথা নাড়ানোতে মুখশ্রীতে এক দাম্ভিকতা ফোটে ওঠে জয়নবের। কাসার একটি বাটিতে পানের রস ফেলে পুনরায় মুখে আরেকটি পান গুঁজে দিয়ে সকলের সাথে জুড়ে দেন তিনি রসালো সব গল্প। মুহূর্তেই জমজমাট হয়ে ওঠে পরিবেশ। ঝড়ের গতিতে জেবাও এতক্ষণে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে। তবে এই মেয়েটির সাথে কয়েকদিনের পরিচয়ে এতোটুকু অন্তত উথমী ধের বুঝতে পেরেছে যে, জেবা প্রাণোচ্ছ্বল এবং মিশুক একজন নারী। সাথে যথেষ্ট কর্তব্য পরায়ণ। এই যে বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষ্যে কতশত কাজ! সব একা হাতেই তো দায়িত্ব সহকারে সামলাচ্ছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে সকলের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন একজন ভদ্রমহিলা। পোশাক আশাক থেকে শুরু করে সাজসজ্জায় সম্ভ্রান্ত সম্ভ্রান্ত ভাব। বড়ো বড়ো কদম ফেলে এগিয়ে এসেই তিনি বসে পড়লেন উথমীর পাশে থাকা ফাঁকা স্থানে। মুহূর্তেই জয়নবের চোখেমুখে ফোটে উঠলো বিষ্ময়। চতুর্থবারের মতো মুখে আরেকটি পান ঠুসে দিয়ে কৌতূহলী স্বরে শুধালেন,“এ কি তুই! তুই না বলে আইবি না? তইলে?”

ভদ্রমহিলার সহজ জবাব,“ভেবেছিলাম আসবো না। বিয়ে কী কোনো ছোটখাটো ব্যাপার? লোক না জানাক কিন্তু আমরা তো ঘরের মানুষ। দূরে থাকি বলে কী পর ভাববে? সে যাই হোক, মেজো ভাবী পর ভাবতে পারে কিন্তু আমরা ভাবী না। আপনার দেবরের থেকে সব ঘটনা শুনলাম। তার উপর তুরাগ, জেবা, তৈমূর একে একে ফোন করে বারবার আসতে বলে দিয়েছে। কীভাবে আর রাগ করে ঘরে বসে থাকি বলুন তো? তাই চলে এলাম।”

জায়ের কথার বিপরীতে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ান জয়নব। প্রত্যুত্তরে গলার আওয়াজ নামিয়ে বলেন, “মেজো গিন্নির কাজকাম ধইরা লাভ নাই। জেদি মাইয়া মানু। পোলা বিয়া কইরা বউ আনছে। কই তারে সুন্দর কইরা ঘরে তুলবি, সংসারের দায়িত্ব বুঝাইয়া দিবি, তা না কইরা হেয় ঘরে গিয়া ঠমক মাইরা বইয়া রইছে।”

নিরবে জায়ের কথাটা শুনলেন ছোটো গিন্নি করবী।খুব একটা কথা বাড়ালেন না। তৌহিদুল উদ্দিনের ছোটো ভাই মঈনুদ্দিন ছিলেন আর্মির একজন কর্ণেল। যদিও রিটায়ার করেছেন কয়েক বছর হলো। চাকরির স্বার্থে যৌবনকালেই পরিবার থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়েছে উনাকে। একটা সময় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবেই তিনি বসবাস শুরু করেন রাজধানীর একটি বিলাসবহুল শহরে।

করবী পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন নতুন বধূর পানে। ডান হাতের সাহায্যে থুতনিতে ধরে তার মুখটা উপরে তুলে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর ব্যাগ থেকে সোনার এক জোড়া এয়ারিং বের করে উথমীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন,“আমি হচ্ছি তৈমূরের ছোটো চাচী। সম্পর্কে তোমার চাচী শাশুড়ি। বিয়েতে আসতে পারিনি। কেন আসতে পারিনি তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে আন্দাজ করতে পেরেছো? যাক সেসব, তা তোমার নাম কী মা?”

“মিফসা কবীর উথমী।”

তৎক্ষণাৎ জয়নব মুখ বাঁকালেন। বিদ্রুপ করে বলে উঠলেন,“দুনিয়াত এত্ত এত্ত নাম থাকতে পোলাপাইনের নাম এতো কঠিন রাখতে হইবো ক্যান? বাপ-মা বেশি শিক্ষিত হইলে যা হয়।”

পূর্বের ন্যায় এবারো জায়ের কথা এড়িয়ে গেলেন করবী। বরাবরই উনি জায়েদেরকে চরম অপছন্দ করেন। এর মূল কারণ তাদের পরনিন্দা আর খুঁতখুঁতে স্বভাব। সাথে আছে মস্তিষ্ক ভর্তি পুরোনো সব ধ্যান ধারণা। তবে করবী তাদের বিপরীত। কম বয়সে বিয়ে করে স্বামীর ঘরে পা রাখলেও শিক্ষা দিক্ষা ভালোই রপ্ত করেছেন। স্বামী নিজ দায়িত্বে উনাকে মাধ্যমিক পাস করিয়েছেন। তার উপর দীর্ঘ বছর শহরে বসবাস করায় প্রতিবেশী ভাবীদের সাথে বছর দশেক আগে নাম লিখিয়েছিলেন সমাজসেবা থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন সংস্থায়। সেখান থেকেই উনার চিন্তাধারা, চালচলনের যতো উন্নতি। কথাবার্তায়ও শহুরে একটা ভাব।

উথমীর সাথে ভাব জমানোর উদ্দেশ্যে তিনি পুনরায় বললেন,“জেবার থেকে শুনেছি গ্ৰাজুয়েশন শেষ করেছো। তা পরবর্তী পরিকল্পনা কী? আরো লেখাপড়া করবে নাকি চাকরি বাকরি? আমার দুই মেয়ের মধ্যে দুজনেই আবার বড়ো চাকরি করে, বুঝলে? কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে কী ঘরে বসে থাকার জন্য নাকি? আর ছেলেটা আছে মিলিটারিতে। জেবাকেও কত করে বললাম, বসে না থেকে চাকরি বাকরি কিছু একটা করো। কিন্তু না সে তো….”

বাকি কথাটুকু করবীকে শেষ করতে না দিয়েই জয়নব মাঝখানে বিরক্তির সহিত বলে উঠলেন,“চাকরি না করলে কী হইবো? ঠিকই তো তোর কান ভাঙানি শুইনা সংসারডা ভাইঙা দিলো। মায়ের থাইক্কা পোলাডারে আলাদা কইরা দিলো। এহন আবার নতুন বউয়ের কান ভাঙানি দিতে আইছোস? শোনো বউ, চাকরি আর সংসার কক্ষনো এক লগে করা যায় না। এসব কথা কানে নিও না।”

বড়ো গিন্নির এমন অপমানজনক কথায় সাপের মতো ফুঁসে উঠলেন করবী।চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,“আমি কান ভাঙানি দিয়েছি? আমি! এ কথাটা আপনি আমায় এভাবে বলতে পারলেন বড়ো ভাবী? আসলে আপনারা নিজেরা জীবনে কিছু করতে পারেননি বলে অন্যদের ভালোটাও ঠিক দেখতে পারেন না। নিজের মেয়েদেরও তো ঠিকমতো লেখাপড়াটা করতে দেননি। বয়সের দ্বিগুণ লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তাই অন্যরা কিছু করুক তাও চান না। হিংসুটে কোথাকার।”

একদমে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। মুহূর্তেই পরিবেশটা বদলালো। জয়নবের মুখশ্রীতে এবার রাগ সুস্পষ্ট। কথার পিঠে ঝাঁঝালো কোনো জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হলেন তিনি। তবে জবাবটা জিভের ডগায় এসেই আটকে গেলো। উপস্থিত নারীদের মধ্যে একজন উৎসুক কণ্ঠে বলে উঠলো,“আরে! আরে! ওই তো মেজো গিন্নি আসছে।”

আকষ্মিক কথাটায় সকলের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো সিঁড়ির দিকে। সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন আটপৌরে শাড়ি পরিহিত একজন সুশ্রী ভদ্রমহিলা। চোখেমুখে অহংবোধের ছড়াছড়ি। বয়স ষাটের কোঠায় গিয়ে স্থির হলেও দেখে যেনো তা ঠাহর করা দায়। দুয়েক মিনিট বাদে উনার পেছন পেছনই নেমে এসে পাশে দাঁড়ালো একমাত্র কন্যা তিথিয়া।বাকিদের মতো উথমীও তাকিয়ে আছে সেদিক পানে। তিথিয়ার সাথে ভদ্রমহিলাকে দেখতেই চট করে বুঝে ফেললো ইনিই যে তার শাশুড়ি মহাশয়া।

সবাইকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পুত্রবধূর দিকে এগিয়ে এলেন শাহানা। হাতে থাকা গহনার বাক্সটি থেকে বের করলেন বেশ বড়োসড়ো একটি সীতাহার। হারটি অতি দ্রুততার সহিত পরিয়ে দিলেন উথমীর গলায়। বললেন,“এই হার তৈমূর হওয়ার খুশিতে ওর বাবা আমায় দিয়েছিলেন। মানুষটা এখন আর নেই কিন্তু উনার দেওয়া উপহারটা রয়ে গেছে। এখন থেকে এই হার তোমার।”—–কথাটা শেষ করে আশেপাশে আরেকবার দৃষ্টি বুলিয়ে বিদ্রুপ করে বললেন, “তোমার পরনে যেসব গহনা রয়েছে সেসবও কিন্তু আমারই গহনা। তৈমূরের বউয়ের জন্য লকারে তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু মানুষ তো আর সেসব দেখবে না। তারা শুধু দেখবে ফুলকুঞ্জের মেজো গিন্নি ছোটো ছেলের বউকে বরণ না করে দরজায় খিল এঁটেছে।”

মুহূর্তেই উপস্থিত সকলের মুখখানা ছেয়ে গেলো আঁধারে। এতেই যেনো ভেতরে ভেতরে বেশ তৃপ্তি পেলেন শাহানা। একে একে সবাই বিভিন্ন কাজের বাহানায় অন্দরমহল ফাঁকা করে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলো। এখন এখানে থাকা মানেই বিপদ। জয়নবও পানের বাটা হাতে উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে এগোলেন তিন তলার দিকে। শাহানা এবার ছোটো জায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“অনেকটা পথ এসেছো। যাও গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নাও।”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে করবীও বাধ্য নারীর মতো স্থান ত্যাগ করলেন। সবার দিক থেকে দৃষ্টি সরাতেই উথমীর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো দুতলার বিশাল স্তম্ভের পানে। স্তম্ভের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তৈমূর। চোখেমুখে তার প্রশান্তির ছাপ। যা দেখে চট করেই উথমী যা বোঝার বুঝে গেলো। বুঝে গেলো, বিয়ে মানবো না মানবো না বলে গতকাল থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখা শাশুড়ির হুট করে নিচে আগমনের কারণ।

শাশুড়ির নিচে নামার কথা কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই রন্ধনশালা হতে একপ্রকার ছুটে এলো জেবা।হাস্যোজ্জ্বল মুখে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “আপনি এসেছেন আম্মা?”

কথাটা শুনে বড়ো পুত্রবধূর পানে তাকান শাহানা। এই মেয়েটিকে উনার মোটেও পছন্দ নয়। শাহানার ধারণা মতে, উনার বড়ো ছেলে মায়ের ভালোবাসার চাদর থেকে বেরিয়ে বিশাল এই বাড়িটি ত্যাগ করেছে শুধুমাত্র এই মেয়েটির কারণে। এই মেয়েটিই শাহানার থেকে কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে। আবার এ কথাও তিনি মনে প্রাণে মানেন যে, উনার ছোটো ছেলে মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছে এই জেবার কানপড়ায়। নিশ্চয়ই মেয়েটি জাদু জানে! নয়তো অল্প কয়েক বছরে দুটো ছেলেকেই কীভাবে শাহানার অবাধ্য হিসেবে তৈরি করল? আচ্ছা তৈমূরের এই নতুন বউও যদি একই কাজ করে? কী হবে তখন? শেষ সম্বল তৈমূর চলে গেলে কীভাবে একা বাঁচবেন তিনি? ভেবে ভেবে ক্রোধের অনলে দগ্ধ হলেন শাহানা। ভেতরের ভাবমূর্তি ভেতরেই লুকায়িত রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“বৌ ভাতের আয়োজন কতদূর?”

“এই তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আম্মা। আপনার বড়ো ছেলে ওদিকটাই সামলাচ্ছে।”

“তো আর অপেক্ষা কীসের? নতুন বউকে নিয়ে তৈরি করে দাও। তিথিকে দিয়ে বাদ বাকি গহনাগুলোও আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। সুন্দর করে সাজিয়ে দাও গিয়ে।বাইরের মানুষের সামনে তো আর বউকে যেমন তেমন ভাবে নিয়ে যেতে পারি না।”

কথাটা বলে বাঁকা দৃষ্টিতে উথমীর দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন তিনি।
____________

বিছানায় বিভিন্ন সাজসজ্জার জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পার্লার থেকে আসা মেয়ে দুজন সাজাচ্ছে উথমীকে। জেবাও সেখানেই বসে আছে। এ ঘরে এখন তৈমূরের প্রবেশ নিষেধ। বেচারা বেশ কিছুক্ষণ গাইগুই করে অবশেষে নিজের পোশাক নিয়ে অন্যত্র যেতে সক্ষম হয়েছে।

দুই মেয়ের সাহায্যে গহনার বাক্সগুলো এনে রাখলো তিথিয়া। বড়ো বড়ো কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত কণ্ঠে আদেশের সুরে বললো,“এই সবগুলো গহনাই ওকে পরিয়ে দিও।”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো জেবার। বললো,“এতগুলো গহনা পরিয়ে দিবো? কী বলেন আপা? এতো ভার কী ও নিতে পারবে?”

“সেসব আমি জানি না। আম্মা যা বলেছেন তাই তোমায় জানালাম।”

ননদের সাথে কথা বাড়ালো না জেবা। আজকের দিনে কোনো ধরণের ঝামেলাই সে চাইছে না। মা-চাচীদের মতো এ মহিলার স্বভাবটাও তেমন ভালো নয়। কীভাবে অল্পতেই ঝগড়া লাগা যায় সেসবে যেনো ওস্তাদ।

তিথিয়ার দুই মেয়ে। প্রথমজন এবার নবম শ্রেণীর ছাত্রী আর দ্বিতীয়জন চতুর্থ শ্রেণীর। ছোটোটা এতক্ষণে দৌড়ে গিয়ে বসেছে উথমীর পাশে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,“তুমি অনেক সুন্দর নতুন মামী।”

বাচ্চাটির কথায় মুচকি হাসে উথমী। গাল টিপে দিয়ে বললো,“তুমিও সুন্দর। তা নাম কী তোমার?”

তিথিয়া আড়চোখে দেখে দৃশ্যটি। বিরক্ত হয় মেয়ের প্রতি। বড়ো মেয়ের উদ্দেশ্যে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,“ওরি আমি ঘরে যাচ্ছি। মিলিকে নিয়ে তুইও ঘরে আয়। তৈরি হতে হবে।”

মায়ের কথায় সায় জানায় ওরি। তিথিয়া নিজের কথা শেষ করেই কক্ষ ত্যাগ করে। মা-বোনের কথায় চুপসে যায় মিলি। ওরি এগিয়ে আসে। মিলির হাতটা ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দরজার দিকে এগোয়। শাসন করার ভঙ্গিতে চাপা স্বরে বলে,“আসার আগে আম্মু বলেছিল না এখানে এসে চুপ থাকতে? তারপরেও ওদিকে গিয়েছিস কেন?”

সহজেই মেয়েটির কথা শ্রবণাতীত হয় উথমীর। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অবাক হয় সে। এই বাচ্চা মেয়ে দুটিকেও কিনা তার সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে এরা? ভারি অদ্ভুত তো!
_______

বৌ ভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চারিদিকে অসংখ্য মানুষের পদচারণা। উথমীর পরনে বেনারসি শাড়ি, মাথায় মেচিং হিজাব আর গা ভর্তি গহনা। তার পাশেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত তৈমূর দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা অত্যন্ত বিরক্ত। সামনেই একজন ফটোগ্রাফার বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে তাদের ছবি তুলছে। ছবি তোলার এই নির্দেশনা দিয়েছেন ছোটো চাচী করবী। বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে বর কনের ছবি না তুললে কী আর হয়? এমন দিন তো আর বারবার আসে না।

ছবি তুলতে তুলতেই আড়চোখে স্ত্রীর পানে তাকায় তৈমূর। মেয়েটিকে গতকালের মতো আজকেও অসম্ভব সুন্দর লাগছে। যতবার সে এই মেয়েটিকে দেখে ততবারই যেনো মুগ্ধতার এক অতল সমুদ্রে ডুবে যায়। এক ফাঁকে উথমীও শির উঁচিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। তৎক্ষণাৎ ফটোগ্রাফার নিখুঁতভাবে এই সুন্দর দৃশ্যটিও করে নেয় ক্যামেরা বন্দি। কয়েক মিনিট পর সেখানে এসে উপস্থিত হলো উথমীর পরিবার। তারা আসতেই এই ছবি তোলা নামক জুলুম নির্যাতন থেকে নিস্তার পেলো দুজন। এবার যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো তৈমূর। হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে গিয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের সাথে কুশল বিনিময় করল।

পরিবারের সদস্যদের দেখে ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ছেয়ে গেলো উথমীর। গতকালের সেই চরম অভিমান এক লহমায় ভুলে গেলো মেয়েটি। মনে হচ্ছে কত যুগ পর যেনো এই মানুষগুলোর সাথে তার দেখা হলো। উৎস এগিয়ে এলো বোনের কাছে। মাথায় হাত রেখে প্রসন্ন চিত্তে বললো,“আমাদের পরীটাকে কত সুন্দর লাগছে! মাশাআল্লাহ।”

ভাইয়ের কথার বিপরীতে লাজুক হাসলো উথমী। উৎস এবার গলার স্বর নিচু করে শুধালো,“সব ঠিক আছে তো? বাড়ির মানুষগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছে? কেমন তারা? আর তোর শাশুড়ি?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উথমী। জোরপূর্বক হেসে বলে,“তোমরা নিশ্চয়ই না দেখে আর বিয়ে দাওনি তাই না? এখন পরিবারের মানুষ কেমন তা তো কয়েক মাস সংসার করলেই বুঝতে পারবো।”

কিছুটা চুপসে গেলো উৎস। বোনের হাত দুটো ধরে আশ্বস্ত করে বললো,“তৈমূর খুব ভালো ছেলে। তুরাগ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। আবার বেশ কয়েক বছর ধরে সহকর্মীও বটে। সেই থেকেই তৈমূরের সাথে মোটামুটি ধরণের একটা পরিচয়। তুই আমার বোন। বাবার পর তোকে সবচেয়ে বেশি আমি ভালোবাসতাম। সেই আমি নিশ্চয়ই তোকে ভুল কারো হাতে তুলে দিবো না, তাই না? কোনো সমস্যা হলে আমায় জানাবি। আমি আছি তোর পাশে।”

“হু, চিন্তা করো না তুমি। হয়তো একটু সময় লাগবে তবে আমি মানিয়ে নিবো।”

প্রসন্ন হাসলো উৎসব। পরিবারের সবাই একে একে এসে কথা বললো উথমীর সঙ্গে। রায়হান কবীর এবং উৎসকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো তুরাগ। প্রথমে রইজউদ্দিন তারপর বাদবাকি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে পরিচয় করাতে।

ধীরে ধীরে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মোটামুটি খালি হলো স্টেজ। উথমীর কাছে পরিবারের মানুষ বলতে এখন শুধু মা বসা তবে তিনিও ব্যস্ত তার চাচী শাশুড়িদের সঙ্গে কথা বলতে। আর ছোটো বোন ঊষা ব্যস্ত আশপাশটা ঘুরেঘুরে দেখতে।

আজকের দিনটি বিরক্তিকর। এতো এতো মানুষের মধ্যে পুতুলের ন্যায় বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না উথমীর। তবে মুখ ফুটে সে বলতে পারছে না কিছুই। এতো ভারি শাড়ি, চুড়ি পরিহিত অবস্থায় এই গরমের দিনে কী এভাবে এক জায়গায় বসে থাকা যায়? এক স্থানে বসে থাকতে উথমীর একদম ভালো লাগে না। যদিও একসময় মেয়েটা খুব ঘরকুনো স্বভাবের ছিলো তবে সময়ের সাথে সাথে শান্তশিষ্ট মেয়েটাই কতটা বদলে গেছে! কেয়া বেগম আড়চোখে মেয়ের পানে তাকালেন। ফিসফিস করে শুধালেন,“কী হয়েছে? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেনো? অস্বস্তি হচ্ছে?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায় উথমী। দেখতে পায় মায়ের চোখেমুখের ব্যাকুলতা। ভেতরে থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দীর্ঘশ্বাস। সম্পর্কে তারা মা-মেয়ে হলেও দুজনার মধ্যে মনের দিক দিয়ে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। তাই হয়তো এই সামান্য কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারলো না সে। প্রশ্নের বিপরীতে শুধুই দুদিকে মাথা নেড়ে না বোঝালো। মেয়ের মাথা নাড়ানোতেও মুখভঙ্গি বদলালো না কেয়া বেগমের। চট করেই বুঝে গেলেন মেয়ের অবস্থা। আশ্বস্ত করে বললেন,“এইতো আর কিছুক্ষণ তারপর অনুষ্ঠান শেষ হলে ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে ফেলবি। একটু পানি খাবি? পানি খেলে ভালো লাগবে। তুই বোস আমি পানি আনছি।”

কথাটা বলেই বসা থেকে উঠতে নিলেন কেয়া বেগম কিন্তু উনার হাতটি টেনে ধরে উনাকে থামিয়ে দিলো উথমী। মিনমিনে স্বরে বললো,“কোথাও যেতে হবে না তোমায়। এখানেই বসো।”

“যেতে হবে না মানে? তুই বোস একটু। আমি পানি নিয়ে আসি?”

“লাগবে না। তুমি বসো। আমায় নিয়ে তোমার এতো চিন্তা করতে হবে না।”

বিপরীতে কোনো বাক্য অপচয় করলেন না কেয়া বেগম। সহজেই টের পেয়ে গেলেন মেয়ের কথার মধ্যে উপস্থিত অভিমানের ছাপ। সময় গড়ালো। একসময় অনুষ্ঠান চলে এলো শেষের দিকে। খাওয়া দাওয়া করে অনেকেই বিদায় নিয়েছে ইতোমধ্যে। যারা এখনো আছে তারাও বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

বাবা-মা, ভাই-ভাবী, ছোটো বোন বিদায় নিতে এলো উথমীর থেকে। এই সময়টায় এসে আবারো মন খারাপ হলো তার। রায়হান কবীর মেয়েকে আশ্বস্ত করে বললেন,“এখন থেকে এটাই তোর বাড়ি, এই বাড়ির সবাই তোর আপনজন। সবার সাথে মিলেমিশে থাকিস মা। আর মন খারাপ করিস না। তৈমূরের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওকে বলে দিয়েছি কাল পরশুর মধ্যেই যেনো তোকে নিয়ে চলে আসে।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় উথমী। মিহি স্বরে বলে,“হুম, সাবধানে যেও তোমরা।”

স্লান হেসে কন্যার থেকে বিদায় নেন তিনি। তারপর ফুলকুঞ্জের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)