জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৪+৫

0
8

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৪]

এসির শীতল হাওয়ায় পুরো কক্ষ বরফের ন্যায় ঠান্ডা। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে অনেকক্ষণ হলো ঘরে এসে বসেছে উথমী। শরীরের সব ঘাম যেনো এতক্ষণে শুষে নিয়েছে পরিধেয় শাড়িটি। মাথা থেকে খুলে রাখা হিজাবটি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গহনাগুলোও বিছানার একপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।

মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করছে উথমীর। শরীর এবার বিশ্রাম চাচ্ছে। একদফা ঘুমিয়ে নিলে হয়তো ক্লান্তি, মাথা ব্যথা সব দূর হয়ে যেতো। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এখন সে ঘুমাবে। তাই আবারো বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উথমী। পরিধেয় শাড়িটি বদলানো প্রয়োজন। এতো ভারি শাড়ি পরে কী আর শান্তিতে ঘুমানো যায়? নিজের সঙ্গে করে আনা লাগেজগুলো থেকে পোশাক আশাকসহ কোনো জিনিসপত্রই এখনো বের করে গোছগাছ করা হয়নি তার। নিজের মতো করে সব গোছাতেও তো কিছুটা সময় লাগবে নাকি? ভাবনা বাদ দিয়ে লাগেজ থেকে সে বের করল ঢিলেঢালা সুতির একসেট থ্রী পিছ।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একেক করে শাড়ি থেকে সব সেফটিপিন খুলে রাখলো উথমী। আঁচলটা নামানোর জন্য হাত দিয়ে ধরতেই চাপানো দরজাটা হাট করে খুলে গেলো। ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। এমন ঘটনায় অপ্রস্তুত হলো উথমী। দৃষ্টিগোচর হলো স্বামী নামক মানুষটিকে। তৈমূরও যেনো কিছুটা মিইয়ে গেলো। দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করল,“চেঞ্জ করছিলেন?”

পুনরায় আয়নাতে দৃষ্টি রাখে উথমী। শাড়ির আঁচল কিছুটা নেমে গিয়েছে নিচে। মুহূর্তেই লজ্জায় মিইয়ে গেলো মেয়েটি। দ্রুত হাতে আঁচল ঠিক করে আবারো সেখানে লাগালো সেফটিপিন। শুকনো ঢোক গিলে বললো,“ঘরে প্রবেশ করার আগে যে নক করতে হয় সেসব কী জানেন না? মানছি ঘরটা আপনার কিন্তু এখন তো আমাকেও এ ঘরেই থাকতে হচ্ছে, তাই না?”

কপালে সরু কয়েকটা ভাঁজ পড়ে তৈমূরের। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে কপাল ঘষে উত্তরে বলে,“উমম আমার নয় আমাদের। আপনি আমার হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই ঘর, ঘরের জিনিসপত্র এমনকি স্বয়ং আমিও আপনারই। তাই অনুমতি নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। তাছাড়া আপনার যদি এতোই সমস্যা হয় তাহলে দরজা আটকে নেননি কেনো? পুরো দোষটাই তো আপনার।”

কথাটা বলেই চমৎকার হাসলো তৈমূর। এহেন কথায় হতভম্ব হয়ে গেলো উথমী। লোকটি শুধু গুছিয়ে কথাই নয় সাথে বিপরীত মানুষটিকে কথার জালেও যে চরম ভাবে ফাঁসিয়ে দিতে পারে তা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারলো সে। তৈমূর ব্যালকনির দিকে অগ্ৰসর হলো। যেতে যেতে বলে গেলো,“নির্ভয়ে এবার চেঞ্জ করে নিন। আপনি না ডাকা পর্যন্ত আমি আর ভেতরে আসছি না।”

কয়েক সেকেন্ড লোকটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। পুনরায় পোশাক বদলাতে শুরু করল। সাথে বিড়বিড় করল,“অদ্ভুত পুরুষ!”

বারান্দায় এসে আলো জ্বালিয়ে বেতের চেয়ারটিতে বসলো তৈমূর। বাহিরে মন জুড়ানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আকাশ থেকে চাঁদ, তারারা আজ বিলুপ্ত হয়েছে। কালো মেঘদল দখল করে নিয়েছে স্বচ্ছ আকাশকে। নেত্র যুগল বন্ধ করে প্রাণ ভরে শ্বাস টেনে নিলো তৈমূর। বাড়িটির যে যে ঘরে ব্যালকনি রয়েছে তার মধ্যে সবগুলোতে গ্ৰিল থাকলেও একমাত্র তৈমূরের ব্যালকনিতেই নেই কোনো গ্ৰিল। সে বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী এবং বইপ্রেমী মানুষ। বাড়ির চারিদিকে রাউন্ড করে বাগান হওয়ায় ব্যালকনিতে বসে খুব ভালো করেই উপভোগ করা যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর সময় পেলেই তা উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তৈমূর। কখনো সখনো তার সঙ্গী হয় এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আবার কখনো বা বই। তাই তো বাবাকে বলতেই বাবা গিয়ে পরেরদিনই মিস্ত্রী ডেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের ঘরের বারান্দার গ্ৰিল। তখন সে কীসে পড়ে? উমম নবম দশম শ্রেণীতে হবে হয়তো।

বিশালাকৃতির বারান্দায় জিনিসপত্র বলতে শুধু বেতের দুটো চেয়ার আর মাঝখানে সুন্দর একটি টি টেবিল। টেবিলের উপর পড়ে আছে একটি বই। বিদেশি লেখক এরিখ সেগালের ‘লাভ স্টোরি’ উপন্যাসের বই। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার পরপরই এক কলিগ বইটি উপহারস্বরূপ দিয়েছিল তৈমূরকে। সাথে খোঁচা মেরে বলেছিল বিভিন্ন দুষ্টু মিষ্টি সব কথা।

বইটি এখনো তৈমূরের পড়া হয়নি। কোনো একসময় পড়ার উদ্দেশ্যে সঙ্গে এনে বারান্দায় বসলেও সেই সুযোগটা আর পেয়ে ওঠেনি। অবহেলা, অনাদরে এ কদিন এখানেই পড়ে ছিলো বইটি। তবে এই মুহূর্তে পড়ে দেখার জন্য মনস্থির করল তৈমূর। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে চশমাটা ঠিক করে হাতে তুলে নিলো সেই বই। পরপর দুটো পৃষ্ঠা উল্টাতেই শোনা গেলো স্ত্রীর কণ্ঠস্বর,“বাব্বাহ! লাভ স্টোরি বই? তা আপনি এসব বইও পড়েন? নাকি বই পড়ে রোমান্টিক হওয়ার মিশনে নেমেছেন মহাশয়?”

পড়ার মধ্যে কোনো বাঁধা পড়লে তৈমূরের বিরক্ত লাগে। তবে আজ আর লাগলো না। নতুন নতুন বিয়ের পর কয়েকদিন সঙ্গীনির সবকিছুই ভালো লাগে। তাই হয়তো এই বাঁধা পড়ার পরেও সে বিরক্ত হয়নি। বরং বইটি পূর্বের ন্যায় বন্ধ করে রেখে দিলো টেবিলের উপর। মুচকি হেসে সামনের ফাঁকা চেয়ারটি দেখিয়ে বললো,“বসুন। তা এতো তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করা শেষ?”

উথমী দেখানো চেয়ারটিতে বসতে বসতে উত্তর দিলো,
“হুম, আমার আবার চেঞ্জ করতে অতোটা সময় লাগে না।”

প্রত্যুত্তরে শুধুই মাথা নাড়ালো তৈমূর। স্বল্পভাষী মানুষ হওয়ার দরুন এরপর কী বলা উচিত চট করে বুঝে উঠতে পারলো না। তার রেখে দেওয়া বইটি হাতে তুলে নিলো উথমী। জিজ্ঞেস করল,“তা এই বই পড়ে কতটুকু রোমান্টিক হতে পেরেছেন শুনি? আমিও তবে একটু পড়ে দেখতাম।”

“বউয়ের কাছে রোমান্টিক হতে বই লাগে না। সেটা অটোমেটিক্যালি চলে আসে।”—কথাটা বলেই স্ত্রীর হাত থেকে বইটা নিয়ে নিলো তৈমূর।

ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হলো উথমীর। কৌতূহল নিয়ে শুধালো,
“তাহলে বইটি এলো কোত্থেকে? উড়ে উড়ে? বইয়ের কী ডানা আছে নাকি? কই দেখি।”

“উপহার হিসেবে পেয়েছি।”

“উপহার?”

“হুম, বিয়ের কথা শুনে এক বিবাহিত কলিগ বইটি উপহার দিয়েছিল।”

খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেলো উথমী। যতই নিজের আসল সত্তাকে তুলে ধরতে চাইছে ততবারই যেনো এই লোকটির কথার পিঠে প্রতিহত হতে হচ্ছে তাকে।

বেশ কিছু সময় গড়ালো। দুদিকে চললো পিনপতন নিরবতা। উথমী মনোযোগী দৃষ্টিতে আকাশ দেখছে, অন্ধকার দেখছে, কান পেতে শুনছে নাম না জানা এক পাখির ডাক। তৈমূর নিষ্পলক দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে আছে।মনোযোগ সহকারে মেয়েটিকে দেখছে। কিছু একটা মনে পড়তেই নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,
“মধুচন্দ্রিমা নিয়ে কোনো ইচ্ছে আছে আপনার? কবে এবং কোথায় যেতে চান?”

মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে উথমীর। নিষ্প্রভ হয়ে উত্তর দেয়,“কোথাও না।”

“কোথাও না?”—–কণ্ঠে তার বিষ্ময়।

“উহুম।”

“মেয়েদের তো বিয়ে থেকে শুরু করে প্রথম বাচ্চা পয়দা করা পর্যন্ত কত কি ইচ্ছে থাকে। আর আপনি কোথাও যেতে চান না?”

উত্তর দিলো না উথমী। এড়িয়ে গেলো কথাটা। তৈমূর এবার বিদ্রুপের সুরেই বললো,“আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছেন তখন ইচ্ছে, স্বপ্ন সবই ছিলো বা আছে কিন্তু অন্য কাউকে ঘিরে। তা সেসব কী শুধুই প্রাক্তনের জন্য নাকি তার সাথে সাথেই বিদায় নিয়েছে?”

নড়েচড়ে ওঠে উথমী। বিস্ফোরিত নেত্রে তাকায় সামনে বসা পুরুষটির পানে। লোকটির উৎসুক দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে অপ্রস্তুত ভঙিতে বলে ওঠে,“প্রাক্তন? মা..মানে?”

“মানে টানে আবার কী? প্রাক্তন মানে প্রাক্তন। এক্স ওয়াই জেড।”

প্রত্যুত্তর করতে পারলো না উথমী। মুখশ্রী মলিন হয়ে গেলো তার। শান্ত দৃষ্টি মুহূর্তেই হয়ে গিয়েছে অশান্ত। নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তৈমূর সেসব দেখে ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটিকে আরেকটু ঘাবড়ে দিতে পুনরায় বললো,“ডন্ট বি সিরিয়াস। কথাটা আমি মজা করে বলেছি। কিন্তু সত্যিই কী আপনার কোনো প্রাক্তন নেই? স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি বিনা প্রেমে পার করে এসেছেন?”

শুকনো ঢোক গিলে চোয়াল শক্ত করে নিলো উথমী। দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিবাদী কণ্ঠে বললো,“এসব প্রশ্ন বিয়ের আগেই আপনার করা উচিত ছিলো। বিয়ের পর এসব প্রশ্নের মানে কী? যদি শুনেন কেউ ছিলো না তাহলে কী করবেন? আর থাকলেই বা কী করবেন? ছেড়ে দিবেন?”

“বিয়ে করেছি কী ছেড়ে দেওয়ার জন্য? আমি তো শুধু মজা করে জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু আপনি তো দেখছি পুরো সিরিয়াস হয়ে গিয়েছেন!”

“মজা না ছাই। আমার সামনে একদম হাসবেন না। নিষেধ করেছি না?”

“কেনো? আমার হাসি কী একটু বেশিই সুন্দর?”

“একদম কুৎসিত। হাসলে আপনাকে হাদারাম লাগে।”

রাগত স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে চলে গেলো উথমী। লাইট নিভিয়ে একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার পেছন পেছন তৈমূরও এলো ভেতরে। বারান্দার দরজা আটকে বিছানায় তার জন্য রাখা অবশিষ্ট জায়গাটিতে বসলো। ভাবুক হয়ে বললো,“যাবেন না যেহেতু তাহলে আর কী করার? তবে আপনাকে বিয়ে করে কিন্তু আমি একদম ভুল করিনি। আমার হানিমুনের টাকাটা তো অন্তত বেঁচে গেলো। যাক আলহামদুলিল্লাহ। এমন বউ ঘরে ঘরে হোক।”

কথাটা বলে শব্দ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল তৈমূর। ললাটে ভাঁজ পড়ল উথমীর। পাশ ফিরে অন্ধকারের মধ্যেই তাকালো স্বামীর পানে। রূষ্ট কণ্ঠে বললো,“একটা মানুষ এতোটা হার কিপটে হয় কীভাবে? লজ্জা করে না বউয়ের সাথে কিপটামি করতে?”

“কিপটামি? আমি? কখন করলাম? আপনিই তো বললেন, যাবেন না।”

“তাই বলে টাকা বেঁচে যাওয়ার খুশিতে আনন্দ উল্লাস করবেন?”

“অপচয়ের হাত থেকে বাঁচলাম তো আনন্দ করবো না?”

“হানিমুন আপনার কাছে অপচয়?”

“তাছাড়া আর কী? বেডরুম থাকতে মানুষ টাকা খরচা করে বউয়ের সাথে রোমান্স করতে দূরদূরান্তে চলে যায়। এটা অপচয় আর বোকামি ছাড়া আবার কী?”

হতাশ হলো উথমী। চরম হতাশ! পূর্বের ন্যায় ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শুয়ে চোখ বুজে মনে মনে বললো,“আস্ত একটা আনরোমান্টিক পুরুষ মানুষ।”
___________

গ্ৰীষ্ম থেকে শুরু করে হেমন্ত ঋতু পর্যন্ত সময়গুলোতে ভোর আসে এক অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে। ভোর আসতে দেরি কিন্তু সূর্যের আলো ধরণীকে গ্ৰাস করতে হয় না কোনো দেরি। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই বাড়ির মেয়ে বউদের কাজের হিরিক পড়েছে রন্ধনশালায়। কেউ কুটনো কুটছে, কেউ রুটি বেলছে আবার কেউ বা রুটি ছ্যাঁকতে আর তরকারি রাঁধতে ব্যস্ত। তিনতলার বিশাল বাড়িটির এই একটিই রন্ধনশালা হওয়ায় চুলার সংখ্যা চারটি।

ফজরের নামাজ আদায় করে কোরআন পাঠ করে তারপর রন্ধনশালায় এসেছেন শাহানা। সকাল সকাল নিজের এবং ছেলের জন্য চা বানানো হচ্ছে উনার রোজকার রুটিন। যদিও গতকাল রুটিনটির ব্যতীক্রম ঘটেছিল তবে আজ তেমনটি হয়নি। চায়ের ট্রে হাতে অন্দরমহলে এসে টি টেবিলে ট্রে টা রাখলেন তিনি। তুরাগ আর তৈমূর দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে সোফায়। চলছে কোনো এক বিষয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে গুরুতর আলোচনা।

মায়ের উপস্থিতি টের পেতেই মৃদু হেসে সালাম দিলো তৈমূর। ট্রে থেকে তুলে নিলো একটি কাপ। সালামের জবাব নিয়ে শাহানা বড়ো পুত্রের পানে তাকান। কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই জিজ্ঞেস করেন,“মায়ের হাতের চা কী চলবে? নাকি এতক্ষণে বউয়ের বানানো চা খাওয়া হয়ে গেছে?”

অপ্রস্তুত হলো তুরাগ। মায়ের এমন খোঁচা মারা কথায় প্রায়সই মাকে দেখলে আতঙ্কে থাকে সে। আজও তাই। জোরপূর্বক হেসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে জবাবে বললো,“কী যে বলেন না আম্মা। বাড়ি আসলে আপনার চা দিয়েই তো সকালটা শুরু হয়।”

মুখ ঘুরিয়ে নিলেন শাহানা। বাড়ি ছাড়ার পর থেকেই বড়ো পুত্রের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ নারাজ। যা তুরাগ খুব ভালো করেই জানে। তবে মায়ের এই রাগ, ক্ষোভ মেটানোর কোনো প্রয়াসই যেনো ছেলেটার মধ্যে আর নেই।

চায়ের কাপ খালি করে সোজা হয়ে বসলো তৈমূর। গলা পরিষ্কার করে নম্র স্বরে বললো,“বিয়ের পর নাকি মেয়েদের বাপের বাড়িতে ফিরানি যেতে হয়? সেই হিসেবে উথমীরও তো গতকালই যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু যাওয়া তো আর হলো না। বাড়ি ভর্তি মেহমান রেখে বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে কেমন দেখায় বলুন তো আম্মা?”

“তা কী ভাবলি?”

“উৎস ভাই আর শ্বশুর মশাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। ভেবেছি আজ বিকেলেই উথমীকে নিয়ে রওনা দিবো। এখন আপনি যদি অনুমতি দেন আম্মা?”

“যা সিদ্ধান্ত নেবার তা তো নিয়েই নিয়েছিস। আমার অনুমতি নেওয়ার আবার কী আছে? বিয়েটাও তো আমার অনুমতি ছাড়াই করেছিস।”

চুপসে গেলো তৈমূর। ঠোঁটের কার্নিশে বর্ধিত হাসিটি বিলীন হলো চট করে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শাহানা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“তা কোথায় তোর বউ? সকাল থেকে একবারও তো তাকে এমুখো দেখলাম না। কোথায় উনি? নাকি এখনো মহারানীর ঘুম ভাঙেনি?”

“আসলে উনি…”—-বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে পারলো না তৈমূর।

সিঁড়ি বেয়ে দুতলা থেকে নিচে নেমে এলো উথমী। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। আড়চোখে স্বামীর পানে একপলক চেয়ে তারপর সে দৃষ্টি রাখলো শাশুড়ির মুখশ্রীতে। মৃদু আওয়াজে সালাম দিলো। তৎক্ষণাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালেন শাহানা। রুক্ষ কণ্ঠে সালামের জবাব নিয়ে বললেন,“কোনো ভদ্র ঘরের বউরা এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। এসব ছোটো খাটো শিক্ষা মানুষ তার বাপের বাড়ি থেকেই পেয়ে আসে। তোমার মা কী সেসব শেখায়নি তোমায়?”

শাশুড়ির এমন আচরণে অবাক হলো উথমী। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলো তাকে! মায়ের এমন আচরণে ভেতরে ভেতরে স্ত্রীর নিকট কিছুটা লজ্জিত হলো তৈমূর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বোঝানোর ভঙিতে বললো,“এভাবে বলছেন কেন আম্মা? উনি ফজরের আগেই ঘুম থেকে উঠেছিলেন। তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাজ আদায় করার পর আমিই বলেছিলাম আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে। অতো সকাল সকাল নিচে নেমেই বা কী করবে বলুন তো? নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতেও তো একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। সবাই তো আর সবকিছু আগে থেকেই শিখে আসে না, তাই না আম্মা?”

বিয়ে করতে না করতেই এভাবে বউয়ের পক্ষ নেওয়ায় ছেলের উপর চরম ক্ষীপ্ত হলেন শাহানা। পুত্রবধূর সম্মুখে অপমানবোধ করলেন। রাগত স্বরে পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,“বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের পক্ষে কথা বলা শুরু হয়ে গেছে? কই আমাদের সময় তো এসব ছিলো না। বরং বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পরেরদিনই হেঁশেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। অথচ তোর বউয়ের এ বাড়িতে আজ তিনদিন চলছে। জিজ্ঞেস করলে তো রান্নাঘর কোথায় সেটাও বলতে পারবে না।”

“আপনাদের সময় আর এখনকার সময় কী আর এক হলো আম্মা? যুগ বদলেছে তাছাড়া দাদীর কথাই বা আর কী বলবো? তিনি ছিলেন পুরোনো ধ্যান ধারণার, কঠোর মনের শাশুড়ি। আপনি তো আর দাদীর মতো নন, তাই না?”

পুত্রের এহেন কথায় চুপসে গেলেন শাহানা। কথাটির বিপরীতে বলার মতো খুঁজে পেলেন না কোনো বাক্য। উথমী নিজ স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নিরবে শুনছে মা- ছেলের কথপোকথন। মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্ত্রীর পানে তাকায় তৈমূর। শীতল কণ্ঠে আদেশের সুরে বলে,“হাতের বামে গিয়ে সোজা হাঁটলেই ডান দিকে রান্নাঘর পেয়ে যাবেন। ভাবী ওখানেই আছে। যান গিয়ে নাস্তা করে নিন।”

বাধ্য মেয়ের মতো উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে উথমী। তৈমূরও বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাকে বিদায় জানিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। পুত্রের
যাওয়ার পানে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন শাহানা। বিয়ে করে বাড়িতে বউ আনতে না আনতেই ছেলের এতোটা অধঃপতন? তাহলে বাকি দিনগুলো কী হবে?
__________

ছোটো জা কে রান্নাঘরে দেখে মুচকি হাসলো জেবা। খুন্তি নাড়ানো চলমান রেখেই শুধালো,“ঘুম ভেঙেছে?”

উথমীও বিপরীতে মৃদু হাসলো। উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে উত্তরে ছোট্ট করে বললো,“হ্যাঁ।”

“বেলা তো কম হলো না। খিদে পায়নি? যাও গিয়ে টেবিলে বসো। আমি খাবার দিচ্ছি।”

খিদে যে পায়নি এমন নয়। বাড়িতে থাকতে সাড়ে সাতটা অথবা আটটা নাগাদই সকালের নাস্তা করা শেষ হয়ে যেতো উথমীর। তবে বিয়ের পর থেকে এই তিনদিন তার খাবার দাবারে বড়োই অনিয়ম হচ্ছে। তাই আর বিলম্ব না করে গিয়ে বসলো সে খাবার টেবিলে।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিগোচর হলো টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে স্বামী সন্তান নিয়ে নাস্তা করতে থাকা ননদ তিথিয়াকে। তাদের পাশে বসা অর্ধ বয়স্ক লোকটিকে অবশ্য আগে কখনো দেখেনি উথমী তবে মেয়ে দুটোর সাথে খোশ মেজাজে গল্প করতে দেখেই খুব সহজে বুঝে গিয়েছে এটাই যে তাদের পিতা। ছোটো মেয়ে মিলি তাকে দেখতেই আনন্দিত হয়ে বলে উঠলো,“বাবা দেখো দেখো, ওই যে নতুন মামী।”

মেয়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই চোখ পাকিয়ে তার পানে তাকায় তিথিয়া। মায়ের চাহনিতে সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে যায় মিলি। যত যাই হোক না কেনো মাকে বরাবরই প্রচন্ড ভয় পায় মেয়ে দুজন। শুধু মেয়েরা নয় মেয়েদের বাবাও কম যায় না। ভদ্রলোক স্ত্রীর থেকে বয়সে দ্বিগুণ হলেও উঠবস অবশ্য স্ত্রীর কথাতেই করেন। না করেই বা কী আর উপায় আছে? স্ত্রী যে উনার বরাবরই রাগী প্রকৃতির খিটখিটে মেজাজের মেয়ে মানুষ। অল্পতেই রেগে যাওয়া, অন্যের সাথে মেজাজ দেখানো তিথিয়ার স্বভাব। আর এই স্বভাবটা সে বংশ পরম্পরায় পেয়েছে তার দাদীর থেকে।

তিথিয়া মুখ ফিরিয়ে পুনরায় খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। জেবাও এসে উপস্থিত হলো উথমীর খাবার নিয়ে। তাকে দেখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন,“কী গো বড়ো বউ! নতুন বউ তো দেখছি আমাকে চেনেই না। নাহলে সামনে নন্দাই বসে আছে আর সে সালাম দিলো না? এটা তো মোটেও ভালো দেখালো না। দ্রুত পরিচয় করিয়ে দাও দেখি। লোকে জানলে কী ভাববে?”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকালো জেবা। কৃত্রিম হেসে প্রত্যুত্তরে বললো,“সে কী দুলাভাই! আপা আপনার সাথে তৈমূরের বউয়ের পরিচয় করিয়ে দেয়নি? সে না দিক কিন্তু আপনি তো আমাদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। তাই নিজ দায়িত্বে পরিচয় করে নেওয়াটা কী আপনার উচিত ছিলো না? বিয়ের দু’দিন পেরিয়ে তিনদিনের দিন আপনি শ্যালক বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন?”

ভদ্রলোক জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আর রইলেন না। বাকরুদ্ধের মতো চুপ হয়ে গেলেন। সাথে উনার চোখেমুখে নেমে এসেছে আঁধার। তিথিয়ার খাওয়া শেষ। এঁটো প্লেটটা নিয়ে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভাইয়ের বউয়ের পানে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,“খেতে বসে বেশি কথা বলার স্বভাবটা তোমার আর গেলো না ওরির বাবা? আমার খাওয়া শেষ। আমি ঘরে গেলাম। তোমার হলে মেয়েদের নিয়ে চলে এসো।”

বউয়ের কড়া বাক্যে যেনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলেন শামীম ভদ্রলোক। এঁটো হাতটা ধুয়ে মেয়েদের নিয়ে স্ত্রীর পিছুপিছু তিনিও স্থান ত্যাগ করলেন। এমন একটি দৃশ্যে ভেতরে ভেতরে ভীষণ মজা পেলো জেবা। তবে বাহিরে তা কিছুতেই প্রকাশ করল না। বরং তারা চলে যেতেই একটি চেয়ার টেনে বিপ্রতীপ হয়ে ছোটো জায়ের সম্মুখে বসলো। আশপাশ সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“ইনিই হচ্ছেন তিথিয়া আপার স্বামী। বয়সে আপার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়ো হলেও বউকে ভীষণ ভয় পান। বউ উঠতে বললে উঠবেন আবার বসতে বললে বসবেন।”

রুটি চিবোতে চিবোতে মনোযোগ দিয়ে তার কথাটি শুনলো উথমী। বিপরীতে প্রশ্ন করল,“তাহলে উনাকে যে দেখলাম না এতোদিন? বিয়ে থেকে শুরু করে বৌ ভাত কোথাও তো দেখলাম না।”

“আসেননি উনি। আপার নিষেধ ছিলো মনে হয়। দেখলে না গতকাল মেয়ে দুটো এসেছিল দেখে কেমন করলেন? আর দুলাভাই এসেছেন গতকাল রাতে। আপাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আম্মা বলে দিয়েছেন, জামাই আদর না নিয়ে এখান থেকে উনাকে একদম যেতে দেওয়া হবে না।”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাবী?”

“হুম করো।”

“উনারা আমায় মেনে নিতে পারেননি তাই না? কিন্তু কেনো এই মেনে না নেওয়া? কেনো এতো অপছন্দ? আমি তো উনাদের ভালো করে চিনিই না। তবে? এতো এতো অপছন্দের ভেতরে নিজেকে আমার বড্ড বেমানান লাগছে।”

“ছাড়ো তো এদের কথা। বিয়ের এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলো অথচ আমাকেই মেনে নিতে পারেনি আর তুমি তো কোন ছাড়।”

কথাটায় ভীষণ আশ্চর্য হলো উথমী। কৌতূহল নিয়ে শুধালো,“আপনাকেও মেনে নেয়নি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেবা। উত্তরে বলে,“নারীদের কাছে তাদের স্বামীই সব। স্বামী ভালো থাকলে সম্পর্কের বাঁধন থাকে শক্ত। আর স্বামী খারাপ হলে সামান্য দমকা হাওয়াতেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ভেঙে যায় সম্পর্ক। তা সেই শ্বশুরবাড়ির লোক যতই ভালো থাকুক না কেনো। এরা হচ্ছে শাশুড়ি আর ননদের জাত। এদের কলিজা কেটে রান্না করে খাওয়ালেও তোমার দোষ ধরতে ভুলবে না। এদের মন পাওয়া কঠিন। বিয়ের প্রথম দুই বছর কম চেষ্টা তো আর করিনি কিন্তু কোনোভাবেই এদের মন পাইনি, উল্টো পেয়েছি অভিশাপ। আর ওই যে এক ননদ! সারাক্ষণ মায়ের কানের কাছে কানপড়া দিতেই থাকে। আসলে ননদগুলো এমনই। নিজের জামাইকে আঙুলে নাচাবে তাতে কোনো দোষ নেই। যত দোষ সব ভাইয়ের বউয়ের।”

ভদ্রমহিলার জন্য সহানুভূতি হলো উথমীর। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে জেবা পুনরায় বললো,“ভেবো না আমি তোমার কাছে নিন্দে করছি। আমরা হচ্ছি একই পথের পথিক। বাড়ির বউ আমরা। কখনো সখনো কটু কথা মুখ বুজে সহ্য করতে হবে কখনো বা না পেরে প্রতিবাদ করতে হবে কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। স্বামীর মন জয় করা মানেই দুনিয়া জয় করা। তুমি আমার ছোটো বোনের মতো। তোমাকে প্রথম দেখাতেই আমার মনে ধরেছিল। আম্মা আর আপার পছন্দের সদ্য এসএসসি পাস করা মেয়ের থেকে তোমাকেই তৈমূরের জন্য সঠিক মনে হয়েছিল। তাই এতোকিছুর পরেও দেবরের বউ করে তোমায় নিয়ে এসেছি। মন দিয়ে সংসার করবে। কীভাবে স্বামীর মন রক্ষা করে চলা যায় সেটাই ভাববে। এর বেশি ভাবার প্রয়োজন নেই। বেশি ভাবলে কষ্ট পেতে হয়। বুঝেছো?”

“হুম।”

“এবার খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আজ বিকেলে তো বাপের বাড়ি যাচ্ছো। ব্যাগপত্র গোছগাছ হয়েছে?”

চমকে গেলো উথমী। জিজ্ঞেস করল,“আজ বাড়ি যাচ্ছি আমি?”

“শুধু তুমি নও, তৈমূরও যাচ্ছে। আর কথা নয় এখন খাও।”

চলবে _______

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৫]

বিছানায় আধশোয়া তৈমূর। নাকের ডগায় ঝুলছে তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা। কোলে রাখা বালিশের উপর ল্যাপটপ রেখে মনোযোগী দৃষ্টিতে দ্রুত হাতে কিছু একটা টাইপিং করতে ব্যস্ত সে। তখনি ঘরে এসে প্রবেশ করল উথমী। ঘরে থাকা মানুষটিকে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে শব্দ করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে। আয়নার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট দেখা যায় বিছানা। সেদিক পানেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি। লোকটির কোনো নড়চড় নেই। সে নিজের কাজেই পূর্বের ন্যায় ব্যস্ত। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রশ্ন করল উথমী,“আমরা কী সত্যি সত্যি আজ ও বাড়িতে যাচ্ছি?”

প্রশ্নটি শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই স্ত্রীর পানে তাকায় তৈমূর। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে চশমা ঠিক করে উত্তর দেয়,“হ্যাঁ, বিকেল হলেই রওনা দিবো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিন।”

“কই আমায় তো একবারও জানালেন না?”

“সকালে উৎস ভাই ফোন করে আজকেই যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে জোরাজুরি করলেন। তখনি আরকি সিদ্ধান্তটা নেওয়া। এরপর তো আর ঘরে আসা হয়নি তাই আপনাকেও বলা হয়নি। তবে ভাবীকে তো জানিয়ে দিয়েছিলাম। কেনো? বলেনি?”

“হ্যাঁ বলেছে।”

“তাহলে আর কী? যান গিয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিন। পরে কিন্তু আর সময় পাবেন না।”

মাথা নাড়ায় উথমী। ধীর পায়ে হেঁটে এগোয় গোছগাছ করতে।

নিজ কক্ষের মেঝেতে বসে কাঁসার পান ছেচুনিতে পান ছেঁচছেন শাহানা। সেই বিদঘুটে শব্দটা তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলে চলেছে পুরো কক্ষ জুড়ে। মাড়ির দাঁতগুলো পোকায় খেয়েছে বলে তা ফেলে দিতে হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। অবশিষ্ট দাঁতগুলোর মধ্যেও কিছু কিছু এখন বয়সের ভারে নড়ছে। এতকিছুর পরেও পান খাওয়াটা যেনো কিছুতেই ছাড়তে পারলেন না তিনি! আর পারবেনই বা কী করে? পুরোনো অভ্যাস কী আর এতো সহজে ছাড়া যায়?

চোখেমুখে একঝাঁক বিরক্তি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল তিথিয়া। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেই মায়ের উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো,“আপনার এই রোজ রোজ পান ছেঁচার শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি আম্মা। বয়স তো আর কম হলো না এবার অন্তত এই পান খাওয়াটা ছাড়ুন। আপনিও ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং আমাদের কানকেও একটু ভালো থাকতে দিন।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই মেয়ের পানে চোখ পাকিয়ে তাকালেন শাহানা। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“আমার পান নিয়ে একদম কথা বলবি না। বেশি অসুবিধে হলে কানে তুলো গুঁজে দে।”

“সেই তো। আপনার তো আর ভালো কথা ভালো লাগে না। তা শুনলাম তৈমূ নাকি বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে? আর আপনিও কিনা যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন?”

“যাচ্ছে যাক। বিয়েটাই তো করে নিয়েছে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। সেখানে এই সামান্য বিষয়ে অনুমতি দিলেই কী আর না দিলেই কী?”

মায়ের এমন খামখেয়ালি কথায় কপালে সরু কয়েকটা ভাঁজ পড়ে তিথিয়ার। দরজার দিকে একপলক সজাগ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বলে,“আহা! আপনি বুঝতে পারছেন না আম্মা। বিয়ের পরপরই শ্বশুরবাড়ি যেতে দেওয়া উচিত নয়। তুরাগের অবস্থা দেখেননি? সেও তো গিয়েছিল। তারপর কী হলো? শ্বশুর-শাশুড়ির কান ভাঙানিতে বউয়ের জন্য কিনা আপনাকেই ছেড়ে চলে গেলো?”

হাত থেমে গেলো শাহানার। শঙ্কিত হলো মন। শুকনো ঢোক গিলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে মেয়ের বিপরীতে বললেন,“তৈমূ এমনটা করবে না তা আমি জানি। ও তুরাগের মতো নয়। নিজের আম্মাকে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না।”

“যেই ছেলে ভাই ভাবীর কানপড়ায় এভাবে বিয়ে করে নিতে পারে সে যে বউ আর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কথায় আলাদা হবে না তার কী গ্যারান্টি?”

এবার বড়োই চিন্তিত হলেন শাহানা। মেয়ের কথাটা একদম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সত্যিই যদি তৈমূরও তুরাগের পথেই হাঁটে? তখন কী হবে?
_________

মিরপুরের একটি আলিশান ভবনের সপ্তম ফ্লোরের মস্ত বড়ো একটি অ্যাপার্টমেন্টে চলছে দুই গৃহিণীর চরম ব্যস্ততা। বিয়ের পর এই প্রথম বাড়িতে মেয়ে আর মেয়ে জামাই আসবে বলে কেয়া বেগমের ঘাম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী থেকে কী রাঁধবেন? কীভাবে পরিবেশন করবেন? সেই ভাবনাতেই ছোটো মেয়েটিকে ঘণ্টা দেড়েক ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন রান্নাঘরে পুত্রবধূর হাতে হাতে সাহায্য করাতে।

ড্রয়িং রুমে বসে গতকালের ফুটবল ম্যাচটা মনোযোগ সহকারে দেখছে বাপ-ছেলে। প্রিয় দল গোল দিতে না দিতেই চেঁচিয়ে উঠছে একেকজন। তাদের এই কান্ডে বিরক্ত কেয়া বেগম। ভেতর থেকেই চিৎকার করে বলছেন,“তোমরা থামবে?আমার কিন্তু এই চেঁচামেচির শব্দ একদম ভালো লাগছে না।”

স্ত্রীর চিৎকারে সাথে সাথেই থেমে যান রায়হান কবীর। সাথে ইশারায় ছেলেকেও চুপ থাকার নির্দেশ দেন। পিতার ইশারায় থেমে যায় উৎস। আজ আর সে অফিসে যায়নি। দুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। সকাল থেকেই বাবা আর ড্রাইভারকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাজার করে বেড়িয়েছে। যতই হোক বোন আর বোন জামাই আসছে বলে কথা! আপ্যায়নে ত্রুটি রাখলে হবে?

বাড়ির কাজকর্ম করতে ঊষার মোটেও ভালো লাগে না। এমনকি এখনো লাগছে না। আগুনের তাপে ফর্সা চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে বেচারির। গত মাসেই রান্নাঘরের এসিটা খারাপ হয়ে গিয়েছে যার দরুন আজকে তাদের এই দুর্দশা। রিনিতা অবশ্য বেশ কয়েকবার স্বামীকে এ বিষয়ে বলেছে কিন্তু উৎস’র যেনো সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সময়ের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। তার উপর ছেলেটা স্বভাবের দিক দিয়ে কিছুটা অলস। অফিস করে বাড়িতে ফিরে আর কোনোদিকে খেয়াল করার মতো সময়ই পায় না।

ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দুঃখী দুঃখী মুখ করে মায়ের পানে তাকায় ঊষা। অসহায় কণ্ঠে বলে ওঠে,“আমার কাজ তো শেষ মা। এখন আমি ঘরে যাই?”

কেয়া বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন না। মাংসে গরম মশলা দিতে দিতে ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“উথমীর ঘরটা গুছিয়েছিস? যা গুছিয়ে আয়। আমার আলমারিতে গিয়ে দেখ নতুন একটা বিছানার চাদর রাখা। পুরোনোটা সরিয়ে নতুনটা বিছিয়ে দিস।”

“কিন্তু ওই ঘরে তো আমার শিফট করার কথা ছিলো মা। তোমায় বললাম না?”

হাত থেমে গেলো কেয়া বেগমের। চোখেমুখে জমা হলো ক্ষোভ। ছোটো কন্যার চোখে চোখ রেখে ধমক দিয়ে বললেন,“সবকিছুই শুধু তোর চাই আর চাই? কোনো শিফট করা হচ্ছে না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে যে তার ঘর দখল নিবি সেসব চলবে না। যা বলছি তাই গিয়ে কর।”

মায়ের কথায় মন খারাপ হলো ঊষার। যেতে যেতে বললো,“আপুর বিয়ে হতে না হতেই তুমি বদলে যাচ্ছো মা। কই আগে তো কখনো আমায় বকোনি।”

“বকিনি বলেই আজ এই অবস্থা।”—-বিড়বিড় করে কথাটা বলে পুনরায় রান্নায় মনোযোগ দিলেন তিনি

পৃথিবীর সবচেয়ে বিদঘুটে এক শব্দ হচ্ছে অপেক্ষা। এই অপেক্ষা করতে করতেই মানুষের জীবন ফুরায়, সময় ফুরায়, ফুরায় ধৈর্য। উথমীরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। রোজকার থেকে আজকের দিনটি তার কাছে মনে হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো একটি দিন। নইলে সকাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে বসে থাকার পরেও কিনা বিকেল হওয়ার খবর নেই? অন্যসব দিন তো ঠিকই চোখের পলকে দিন চলে যায় তাহলে আজ কেনো এতো অনিয়ম? শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকে তার মন আর টিকছে না। নিজেকে জেলখানায় বন্দী এক কয়েদি বলে মনে হচ্ছে। মনে পড়ছে অতীতের দিনগুলো।

এভাবেই দিনটি পার হলো। কথামতো বিকেলের দিকেই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে করে শ্বশুরবাড়ির পথে রওনা হলো তৈমূর। পথে গাড়ি থেকে নেমে কিনে নিলো মিষ্টান্ন, ফলমূল থেকে শুরু করে আরও কত কি! খয়েরি রঙের প্রাইভেট কারটি নির্দিষ্ট দালানটির সামনে থামতেই ভেতরের হাঁসফাঁস থেমে গেলো উথমীর। গাড়ি থেকে নেমে বড়ো করে শ্বাস টেনে নিলো ভেতরে। তাকে দেখতেই অর্ধ বয়স্ক দারোয়ান লোকটি এগিয়ে এলেন। অকৃত্রিম হেসে বললেন,“আসসালামু আলাইকুম আম্মা। ভালা আছেন?”

উথমীও বিপরীতে হাসে। উত্তর দেয়,“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ চাচা। আপনি ভালো আছেন?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তা আইজ আইলেন যে? আফনেগো না কাইল আওয়ার কথা আছিল?”

“ছিলো তবে কিছু সমস্যা থাকার কারণে আসা হয়নি।”

মাথা নাড়লেন জামিল। এই বাড়িটিতে উনার চাকরির বয়স এক যুগ পেরিয়েছে সেই কবেই। তাই বিস্তর বড়ো দালানটিতে থাকা প্রত্যেক ফ্ল্যাটের মানুষগুলোকেই লোকটির খুব ভালো করে চেনা। রায়হান কবীর খুবই মিশুক প্রকৃতির লোক। মানুষের পেশার থেকে আচার- ব্যবহার, চালচলনটাই উনার কাছে বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে গুরুত্ব সহকারে। তাই দারোয়ান থেকে শুরু করে আশেপাশের সব মানুষদের সাথেই উনার সম্পর্কটা চমৎকার। তৈমূর গাড়ি থেকে নামতেই তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলেন জামিল। তারপর সঙ্গে আনা ব্যাগগুলো জোরপূর্বকই নিজ হাতে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলেন ভেতরের দিকে। বললেন,“এইগুলা আমি দিয়া আইতাছি। আপনেরা ধীরে সুস্থে উপরে আইয়েন।”

উনাকে আর বাঁধা দিতে পারলো না কেউ। ততক্ষণে বড়ো বড়ো কদম ফেলে লোকটি পরিত্যাগ করেছেন স্থান। ড্রাইভারকে গাড়ি পার্কিং করতে বলে তৈমূরও এগোলো উথমীর পিছুপিছু। নতুন জামাইয়ের আগমনে বাড়ির পরিবেশটা মুহূর্তেই বদলে গেলো। সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হলেন কেয়া বেগম। তৈমূরকে তোষামোদ করে বসালেন সোফায়।

সবটাই নিরব চিত্তে দেখে গেলো উথমী। নির্বিকার ভঙিতে বাবা, ভাই, ভাবীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করে চলে এলো নিজের সেই প্রাণপ্রিয় শান্তি বিজড়িত কক্ষে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ছুঁয়ে দিতে লাগলো একে একে সব জিনিসপত্র। যেভাবে যা রেখে গিয়েছিল সব ঠিক তেমনি রয়েছে নিজ নিজ স্থানে। একমাত্র বিছানার চাদর ব্যতীত নড়চড় হয়নি আর কিছুই। বিলম্ব না করে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।

কেয়া বেগম জামাতার হাতে শরবতের গ্লাসটি ধরিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন রান্নাঘরে। শরবতটুকু পান করে সোজা হয়ে বসলো তৈমূর। তার সামনেই বসা রায়হান কবীর আর উৎস। তাকে পেয়েই দুজন মিলে শুরু করে দিয়েছে বিভিন্ন কথাবার্তা। তৈমূর সেসব নিরবে শুনছে আর খানিক পরপর মাথা নাড়াচ্ছে। কেয়া বেগম আবারো এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। রূষ্ট কণ্ঠে স্বামী আর পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,“এতোদূর থেকে এসেছে ওরা! তোমাদের যত গল্পটল্প আছে সব পরে করবে।” তারপর তৈমূরের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক বদলে নাও বাবা। এতোটা পথ এসেছো নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো? যাও একটু বিশ্রাম করো গিয়ে।”

স্ত্রীর কথায় নড়েচড়ে উঠলেন রায়হান কবীর। সায় জানিয়ে বললেন,“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। উথমী মা মনে হয় ঘরে গিয়েছে। যা উৎস তৈমূর বাবাকে ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে আয়।”

পিতার কথায় উঠে দাঁড়ালো উৎস। তৈমূরও তাদের থেকে বিদায় নিয়ে তার পিছুপিছু গেলো। বোনের কক্ষের সামনে এসেই থেমে দাঁড়ালো উৎস। বোন জামাইয়ের কাঁধে চাপড় মেরে মৃদু হেসে বললো, “এটাই উথমীর ঘর। যাও ভেতরে যাও। পরে কথা হচ্ছে তবে।”—বলেই বড়ো বড়ো কদম ফেলে প্রস্থান করল সে।

হাতমুখ ধুতে গিয়ে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো উথমী। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সামনে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো তৈমূরকে। পকেটে হাত গুঁজে ঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখছে সে। তোয়ালেটা হাতের ভাঁজে নিয়ে গলা ঝাড়লো উথমী। জানান দিলো নিজের উপস্থিতি। তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তৈমূর। বললো, “আপনি তো দেখছি ভারি অগোছালো মানুষ! কিন্তু দেখে তো তেমন মনে হয় না।”

“আমি অগোছালো?”

“হুম, তাই তো মনে হচ্ছে।”

“হঠাৎ এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“ড্রেসিং টেবিল আর পড়ার টেবিলের অবস্থা দেখেই মনে হলো।”

লোকটির কথাটি শ্রবণাতীত হতেই দ্রুত সেদিক পানে তাকায় উথমী। দৃশ্যটি দেখতেই ভেতরে ভেতরে চরম লজ্জিত হয়। ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা চিরুনির মধ্যে এখনো লেগে আছে বেশ কয়েকটা লম্বা কালো চুল। সেফটিপিনের কৌটা খোলা। দুটো লিপস্টিকের অবস্থাও যাচ্ছে তাই। ঘরের এক কোণে রাখা পড়ার টেবিলের উপরে এলোমেলো হয়ে আছে বইপত্র। অলস স্বভাবের মেয়ে হওয়ার দরুন সময়ের কাজ সময়ে করা কখনোই হয়ে ওঠেনা তার। তাই বলে বাড়িতে এতোগুলো মানুষ থাকতেও কিনা কেউ একবার এসে এগুলো গোছানোর প্রয়োজনবোধ করল না? ভেতরে ভেতরে চরম ক্ষুব্ধ হলো উথমী। নিজের ক্ষোভটা চেপে রেখে কথা ঘোরানোর উদ্দেশ্যে বললো, “ফ্রেশ হবেন না আপনি? নাকি একেবারে শাওয়ার নিবেন? ব্যাগ থেকে পোশাক বের করবো?”

“হুম বের করুন। শাওয়ার নিবো।”

বিলম্ব না করে দ্রুত গিয়ে লাগেজ থেকে তৈমূরের জন্য নিয়ে আসা পোশাকের থেকে ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে দিয়ে বললো,“নিন।”

বিপরীতে কিছু বললো না তৈমূর। পোশাক নিয়ে নিরবে প্রবেশ করল বাথরুমে। উথমী তোয়ালে মেলে দিয়ে বারান্দার গ্ৰিল ধরে দাঁড়ালো। অন্ধকারে চারিদিকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু দালানগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বন্ধ করে নিলো আঁখি যুগল। মুখশ্রীতে তার ফোটে উঠেছে প্রশান্তি। এভাবেই কিছুক্ষণ পার হলো। কারো উপস্থিতি টের পেতেই বন্ধ আঁখি খুলে অপ্রস্তুত হলো সে। শুধালো,“এতো তাড়াতাড়ি গোসল শেষ?”

“হ্যাঁ, শেষ।”

“ওহ।”

উল্টো ঘুরে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো উথমী। তৎক্ষণাৎ দু হাত দুদিকে মেলে গ্ৰিল ধরে তাকে আটকে দিলো তৈমূর। গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো তার নতুন স্ত্রীর পানে। এহেন কান্ডে ঘাবড়ে গেলো উথমী। অশান্ত হলো চোখের মণি। ধীরে ধীরে লোকটির মুখটা তার দিকে এগোতেই মনের গহীনে উঁকি দিতে লাগলো নিষিদ্ধ সকল চিন্তা। শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে এলোমেলো বাক্যে বলে উঠলো,“কী করছেন? দরজা খোলা। ভাবী মনে হয় ডাকছে। আমি যাবো।”

আরো কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে তার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো তৈমূর। ছাড়া পেতেই সন্তর্পণে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো উথমী। ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে বড়ো বড়ো কদম ফেলে বারান্দা থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে এগোতে লাগলো। তখনি পেছন থেকে নির্বিকার ভঙিতে তৈমূর বলে উঠলো,“বউয়ের দিকে নির্জনে একাগ্ৰ চিত্তে তাকিয়ে থাকলে নাকি হার্ট সুস্থ থাকে?”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ায় উথমী। শুধায়,“কে বলেছে।”

“কেউ না কেউ তো বলেছেই তবে আপনি এরকম ঘাবড়ালেন কেন? অন্যকিছু ভেবেছিলেন?”

“কী ভাববো?”

“তা তো আপনিই জানেন। আবার চুমু টুমুর কথাও ভাবতে পারেন।”

চরম আশ্চর্য হলো উথমী। লজ্জায় কান গরম হওয়ার উপক্রম হলো। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে তৈমূর পুনরায় বললো,“বাসর রাত পেরিয়ে এসেছি। চুমু যদি দিয়েও ফেলি কিই বা হবে?”

“তো? কিছু তো আর হয়নি। আর পাঁচটা রাতের মতোই তো ঘুমালাম।”

“সেটা তো আপনি আর আমি জানি। বাকিরা তো আর জানে না।”

হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো উথমীর। লোকটিকে সে যতটা হাবাগোবা মনে করেছিল ততোটা ইনি নন। বরং চরম রকমের ঠোঁটকাটা স্বভাবের লোক একটা। তখনি বাহির থেকে ডাক এলো কেয়া বেগমের। এমন একটা পরিস্থিতি থেকে যেনো মুক্তি মিললো লাজে রাঙা মেয়েটির। কক্ষ ত্যাগ করতে করতে বলে গেলো,“মা ডাকছে। আমি গেলাম। আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে মন পরিষ্কার করুন।”

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)