জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-১৬+১৭

0
200

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৬]

ঝর্ণা থেকে বর্ষনকৃত পানির ঝনঝন শব্দের সাথে বাথরুম থেকে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠস্বরের গুনগুন গান। বাহির থেকে সেই গানের শব্দমালা ঠাহর করা যেনো বড়োই দুষ্কর। টানা আধ ঘণ্টা সময় নিয়ে গোসল সেরে দরজা খুলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো উথমী। মাথায় তার তোয়ালে প্যাঁচানো।আর হাতে ধৌত কাপড়ে বোঝাই নীল রঙের বালতি।পরনের ওড়না ঠিক করে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। ঠিক তখনি দরজার পর্দা সরাতে গিয়ে আচমকা শক্তপোক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো উথমী। ব্যথাতুর স্থানে আঙুল ঘষে ব্যথিত সুরে চাপা আর্তনাদ করে বলে উঠলো,“আহ! চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি?”

তখনি ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। স্ত্রীর আর্তনাদে উদ্বিগ্ন হলো তার মন। এগিয়ে এসে শুধালো,“ব্যথা পেয়েছেন খুব?”

“তো কী এমনি এমনি নাক ধরে দাঁড়িয়ে আছি? এটা আপনার মানব দেহ নাকি শক্ত কোনো লোহা?”

“আমি সত্যিই দেখিনি। হুট করে কোত্থেকে যে চলে এলেন! খুব ব্যথা করছে? দেখি বসুন, মলম লাগিয়ে দেই।”

“তার প্রয়োজন নেই, সরুন।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“ছাদে, কাপড় মেলতে।”

“ছাদে? তা হঠাৎ করে সকাল সকাল গোসল করছেন যে?”

“গতকাল আপনার মায়ের কথায় করেছিলাম, ফরজ গোসল। তবে আজ করেছি কলেজ যাবো তাই। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে পারে। সারাদিন গোসল ছাড়া থাকবো কীভাবে?”

“কলেজ? আজ আপনি কলেজ যাবেন?”

“হ্যাঁ, ছুটি তো শেষ হয়ে গিয়েছে সেই বৃহস্পতিবারে আর কাল ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সেই অনুযায়ী আজ থেকেই পুনরায় জয়েন করার কথা।”

“কই বলেননি তো।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে উথমীর। সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়, “কিহ! বলিনি?”

“উহুম, বললে কী আর জিজ্ঞেস করতাম?”

“তা বললে তো হয় না, আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম। হয়তো আপনিই ভুলে গিয়েছেন।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তৈমূরের। মনে করার চেষ্টা করে, কবে এ কথা তাকে বলেছিল উথমী? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সে মনে করতে পারে না। তাই নিজের ভুলটাই স্বীকার করে নেয়,“হবে হয়তো, আমারই মনে ছিলো না। তো কখন বেরোবেন?”

“ছাদ থেকে এসে তৈরি হয়ে তারপর বের হবো।”

“আচ্ছা যান তবে।”

স্বামীর অনুমতি পেয়ে উথমী আর দাঁড়ালো না। চলে গেলো নিজের কাজে। আর তৈমূর গেলো গোসল সারতে।

টেবিলের উপর খাবারগুলো পরিবেশন করে ঢেকে রাখা। একে একে ঢাকনা সরিয়ে সবগুলো খাবারই দেখে নিলো তিথিয়া। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে ডাকলো,“মালতী ফুফু! ও মালতী ফুফু!”

ডাক শুনে ছুটে আসে মালতী ফুফু। সাড়া দিয়ে বলে, “কও।”

“তুমি তো সময়মতো রান্না সেরে টেবিলে এভাবে খাবার সাজিয়ে রাখার মতো মানুষ নও। সবসময় রান্নায় দেরি করো। তাহলে আজ এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হলো কী করে?”

“এসবের কিছুই আমি করি নাই। তুরাগ বাবারা যাওয়ার পর থাইক্কা তৈমূ বাবার বউই তিনবেলার রান্না করে। আইজকাও হেয়ই করছে। সেই ভোরবেলা উইঠা সব গোছগাছ কইরা তারপর ঘরে গেছে।”

কথাটা বিশ্বাস হয় না তিথিয়ার। চেয়ার টেনে বসে দৃঢ় গলায় আবার ডাকে,“ওরি, মলি! নানুকে নিয়ে খেতে আয় তোরা।”

তারপর একে একে নির্দিষ্ট প্লেটগুলোয় খাবার বেড়ে রাখে জায়গামতো। গতকাল জুম্মার নামাজ আদায় করে শ্বশুরবাড়ি আসার কথা থাকলেও আর আসেনি শামীম। বিকেলের দিকে ফোনকলে জানিয়েছে, তার খালাতো বোন নাকি ভীষণ অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। তাই আর স্বামীকে আসার জন্য জোরাজুরি করতে পারেনি তিথিয়া। তবে অসুস্থ ভদ্রমহিলাকে সে চিনে।ক্যান্সারের রোগী তিনি। এর আগেও বেশ কয়েকবার আত্মীয়তা রক্ষার্থে উনাকে দেখতে গিয়েছিল তিথিয়া ।তবে শ্বশুরবাড়ি পক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের মোটেও পছন্দ নয় তার। কেমন যেনো গায়ে পড়া স্বভাবের লোক এরা। আর এই গায়ে পড়া স্বভাবের অত্যধিক ভালো মানুষ তিথিয়ার একদম ভালো লাগে না। বরং এরা যেনো তার দুই চোখের বিষ।

একেবারে শাহানাকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নামলো ওরি আর মিলি। চেয়ার টেনে উনাকে বসিয়ে নিজেরাও বসে পড়ল উনার দু’পাশে। চেয়ারে বসেই সর্বপ্রথম মালতী ফুফুকে ডাকলেন শাহানা। বললেন,“তুমি গিয়ে তৈমূকে ডেকে আনো তো। নাস্তা সেরে তারপর না হয় তৈরি হবে।”

সঙ্গে সঙ্গেই মালতী ফুফুর নিকট থেকে উত্তর এলো,“ডাকছিলাম, কইছে একেবারে রেডি হইয়া তারপর খাইবো।”

তিথিয়া সেসব কথা শুনে বিরক্ত হলো। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,“আপনি খান তো আম্মা। এখন কী আর ছেলেদের খাবার দাবার নিয়ে চিন্তা করার সময় কিংবা বয়স আছে আপনার? তাদের নিয়ে ভাবার জন্য এখন তাদের বউ আছে।”

মেয়ের কথায় বিতৃষ্ণা ধরে গেলো শাহানার মনে। বিরস মুখে নিরব হয়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

গোসল সেরে তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে তৈমূর। ছাদ থেকে নেমে সোজা ঘর প্রবেশ করে উথমী। স্বামীর বেশভূষা দেখে ভীষণ অবাক হয় সে। হাতের বালতিটা জায়গামতো রেখে এসে জিজ্ঞেস করে,“আজ এতো তাড়াতাড়ি তৈরি হলেন যে? আপনার অফিসের তো এখনো অনেক দেরি।”

“হ্যাঁ, তবে আপনাকে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমার অফিস যেতে যেতে ঠিক সময় হয়ে যাবে।”

“আমাকে পৌঁছে দিতে?”—-কিছুটা অবাক হয়ে শুধায় উথমী।

বিপরীতে তৈমূরের সহজ জবাব,“হ্যাঁ, বউকে তো আর একা একা বাইরে ছেড়ে দিতে পারি না।”

“তার কিন্তু কোনো প্রয়োজন ছিলো না তৈমূর সাহেব। আপনার অফিস থেকে আমার কলেজ সম্পূর্ণ উল্টো পথে। দুদিকে যেতেই তো বেশ সময় লাগে। তার উপর ওই উল্টো পথে আমায় পৌঁছে দিয়ে আবার আপনি নিজে অফিস যাবেন? অনেকটা সময়ের অপচয় এবং কষ্টও হয়ে যায়।”

“কষ্ট হলে হোক কী আর করার আছে? বউকে চোখে চোখে রাখার জন্য এইটুকু কষ্ট করতে তৈমূর রাজি।”

এহেন কথায় ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকায় উথমী। কৌতূহলী হয়ে শুধায়,“ব্যাপার কী? বিয়ে করতে না করতেই বউ হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছেন মনে হচ্ছে?”

“তা অবশ্য পাচ্ছি। এমনিতেই আমি যা কালো মানুষ তার উপর না চাইতেই পেয়ে গিয়েছি এতো সুন্দর একটা বউ। ও হ্যাঁ, বউ আবার সরকারি চাকরিও করে! যদি কেউ নিয়ে চলে যায়? তখন কী হবে আমার?”

কথাটায় ভীষণ মজা পায় উথমী। ফিক করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে একসময় তার চোখে অশ্রু জমে। লাজুক স্বরে বলে,“আপনি না যা তা। কেউ নিতে এলেই কী আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো?”

“যাবেন না বলছেন?”

“একদম না। এমন ভালো স্বামী ফেলে চলে যাওয়ার মতো বোকা মেয়ে আমি না।”

“তাহলে ভালো বলছেন?”

“আপাতত বলছি, এমন ভালো মানুষি অব্যাহত রাখলে ভবিষ্যতেও বলবো।”

মুচকি হাসে তৈমূর। অফিস ব্যাগ হাতে নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,“নাস্তা করেছেন?”

“হ্যাঁ করেছি।”

“তাহলে আপনি তৈরি হয়ে নিচে আসুন। আমি বরং এই ফাঁকে গিয়ে নাস্তা সেরে নেই।”

“আচ্ছা।”—বলে তৈরি হতে গেলো উথমী।

ওরি আর মিলি খাবার খেয়ে ঘরে চলে গিয়েছে। তিথিয়ার খাওয়া সম্পূর্ণ হলেও শাহানার এখনো শেষ হয়নি। তিনি খাচ্ছেন। তৈমূর এসে চেয়ার টেনে বসলো। মা-বোন দুজনকেই একসঙ্গে দেখে মৃদু হাসলো। তিথিয়া দ্রুত হাতে খাবার বেড়ে দিলো ছোটো ভাইয়ের প্লেটে। শুধালো,“খেয়েই বেরোবি?”

“হ্যাঁ, ওরি আর মিলি কোথায়? খেয়েছে ওরা?”

“হ্যাঁ খেয়েছে, মাত্রই উপরে গেলো।”

“তা দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? কাল তো আর এলেন না তিনি।”

“হ্যাঁ হয়েছে, বলেছিলাম আজ আসতে কিন্তু আসবে না বললো। এতো কাজের চাপ বেড়েছে না ওর! দিনদিন রেস্তোরাঁ বড়ো হচ্ছে আর চাপ বাড়ছে।”

“তা থাকবে তো কয়েকদিন? ওরি মিলির স্কুল তো মনে হয় খোলা, তাই না?”

“হ্যাঁ রে, ইদের আগে আর তেমন একটা বন্ধ নেই। আজ বিকেলেই চলে যাবো।”

“দুলাভাই নিতে আসবে?”

“বললাম না সে ব্যস্ত? তার এতো সময় কোথায়?”

“তাহলে না হয় রাতে যেও। আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

“তার প্রয়োজন নেই, আমরা মা-মেয়েরা মিলে যেভাবে এসেছি সেভাবেই চলে যেতে পারবো। তোর চিন্তা করতে হবে না। তা তুই আজ তাড়াতাড়ি বের হবি যে?তোর বউ কোথায়? তাকে তো সকাল থেকে দেখছি না। শুনলাম রান্নাবান্না করেই নাকি ঘরে চলে গিয়েছে।”

“হুম উনি ঘরেই, রেডি হচ্ছে।”

“রেডি হচ্ছে? কেনো? কোথায় যাবে?”

“কোথায় আবার? কলেজে। ছুটি শেষ হয়েছে না।”

উপস্থিত দুজন মানুষই কথাটায় যেনো ভীষণ অবাক হলো। মুহূর্তেই ফুঁসে উঠলেন শাহানা। পুত্রের উদ্দেশ্যে ক্ষীপ্রতার সহিত বললেন,“কলেজে যাবে মানে? চাকরি করতে? আমি তো সেদিনই সবার সামনে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, এসব চলবে না এ বাড়িতে।”

তিথিয়াও মায়ের সঙ্গে তাল মেলালো,“ঠিকই তো। বিয়ের আগে যা করার করেছে, বিয়ের পর আবার কীসের চাকরি? এসব চলবে না। তোর বউকে ভালো করে গিয়ে বলে দে, এ বাড়িতে কোনো ধরণের নষ্টামি আমরা সহ্য করবো না।”

মুখের খাবার শেষ করে পানি পান করল তৈমূর। খাবার অর্ধ সমাপ্ত রেখে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বড়ো বোনের পানে তাকালো সে। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “ভাষা সংযত করো বুবু। তোমারও বিয়ে হয়েছে, নিজের স্বামী- সন্তানসহ আলাদা সংসার আছে তাই ভাইয়ের সংসারে অযথা কথা বলো না।”

হতভম্ব হয়ে গেলো মা-মেয়ে। সাথে ভাইয়ের কথায় অপমানিত বোধ করল তিথিয়া। মায়ের পানে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,“দেখলেন আম্মা, দেখলেন? কী ধরণের আচরণ করছে আমার সঙ্গে?”

মেয়ের কথায় রাগের পারদ বৃদ্ধি পেলো শাহানার। ধমকের সুরে বললেন,“এ কী ধরণের অসভ্যতা তৈমূ? এভাবে কেউ বড়ো বোনের সঙ্গে কথা বলে? শুনে রাখ, আমার কথাই হচ্ছে শেষ কথা। তোর বউ যেনো বাড়ি থেকে বের না হয়, চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দিতে বল।”

মায়ের কথায় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না তৈমূর। তার মুখশ্রীতে পূর্বের ন্যায় এঁটে আছে গাম্ভীর্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“দুঃখিত আম্মা, বেয়াদবি মাফ করবেন। আমার স্ত্রী পেশায় একজন শিক্ষক।যা অত্যন্ত সম্মানিত একটি পেশা। তাই উনার উপর কোনো প্রকার চাপ আমি প্রয়োগ করতে পারি না। এ বিষয়ে দয়া করে আপনারা আর কোনোরূপ কথা বলবেন না। আমার উপর আপনার অধিকার এবং হক থাকলেও আমার স্ত্রীর উপর কিন্তু তা নেই। তার একমাত্র অভিভাবক আমি। আর হ্যাঁ, উনি যদি ভুল করে তাহলে তা আমায় জানাবেন কিন্তু তার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করবেন না আম্মা। এটা আমার অনুরোধ।”

ছেলের কথাগুলো কিছুতেই নিতে পারলেন না শাহানা। রাগে উনার শরীর কাঁপছে। চিৎকার করে বলে উঠলেন,“তৈমূ! বউ পেয়ে কিনা এখন মায়ের মুখের উপর বড়ো বড়ো কথা বলছিস তুই? শেষমেশ তুইও তুরাগের পথে হাঁটছিস?”

“আপনি আমার জন্মদাত্রী মা আম্মা। বয়স, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানে আমার থেকে আপনি অনেক এগিয়ে। তাই এটাও নিশ্চয়ই জানেন? প্রত্যেকটি সম্পর্কের সমীকরণ আলাদা। মা মায়ের স্থানে সম্মানিত, গুরুত্বপূর্ণ এবং স্ত্রী হচ্ছে স্ত্রীর স্থানে। আর এই দুটো সম্পর্ক একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলাটা নিকৃষ্ট মস্তিষ্কের পরিচয় বহন করে আম্মা। ভাইয়ার কথা বারবার যে কেনো আপনি টেনে আনেন তা আমি বুঝি না। ভাবী কিন্তু মোটেও খারাপ নন বরং তিনি সবসময় আপনার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে এসেছেন। কিন্তু আপনিই তাকে সহ্য করতে পারেননি, বরাবর হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আজ একটা কঠিন কথা বলছি আম্মা, পরের বাড়ির মেয়ের কোনো ঠ্যাকা পড়েনি যে কারো কটু কথা শুনেও তার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিবে। একজন নারী হিসেবে অপর নারীকে বুঝা এবং সম্মান করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি তা না করে পুত্রবধূর উপর মানসিক অত্যাচার চালিয়েছেন আম্মা। তাই ভাইয়া যা করেছে একদম সঠিক করেছে। আপনার ব্যবহার সন্তানদের সঙ্গে যেমন তার এক অংশও যদি পুত্রবধূদের সাথে হতো তাহলে আজ হয়তো এমন দিন আপনাকে দেখতে হতো না। অন্ধের দৃষ্টি দিয়ে না দেখে সব বিবেক দিয়ে দেখুন আম্মা। যাই হোক, আমি কখনোই আপনার মুখে মুখে তর্ক করতে চাই না। আজও করতাম না যদি আপনারা বাধ্য না করতেন। তাই দয়া করে আর পরিস্থিতি জটিল করবেন না আম্মা।”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো তৈমূর। খাবার ঘর থেকে অন্দরমহলে আসতেই দেখা মিললো স্ত্রীর। উথমী সবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছে। স্বামীকে দেখতেই শুধালো,“কিছু হয়েছে বাড়িতে? চেঁচামেচির শব্দ শুনলাম।”

“তেমন কিছু না, চলুন।”

বলে দরজার দিকে এগোয় তৈমূর। উথমীও আর কথা বাড়ায় না, পিছুপিছু ছোটে তার।
___________

আকাশটা পরিষ্কার। সূর্যের কিরণে খোলা আকাশের নিচে টিকে থাকা দায়। বিল্ডিংয়ের সম্মুখে বিশাল মাঠটিতে গার্ল গাইড মেয়েগুলো খেলছে। চলছে তাদের মধ্যে হৈ হুল্লোড়।

উথমী বসে আছে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত টেবিলে। এই রুমটিতে ও সহ ডিপার্টমেন্টের তিনজন ম্যাম বসে। তাদের মধ্যে একজন এসে পৌঁছায়নি। আরেকজন আছে ছুটিতে। বেশ কয়েকদিন ক্লাস না নেওয়ায় বসে বসে কিছু ফাইল চেক করছে সে।

“আরে মিসেস উথমী যে! কেমন আছেন?”

কথাটি শ্রবণাতীত হতেই মাথা তুলে সম্মুখে তাকায় উথমী। দেখতে পায় কেমিস্ট্রির শিক্ষিকা ডালিয়াকে। টেবিলের উপর ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে নিজ আসনে বসেন ডালিয়া। হাস্যোজ্জ্বল মুখে পুনরায় শুধান, “এতো দ্রুত যে জয়েন করবেন ভাবতেই পারিনি। হানিমুন শেষ?”

স্লান হাসে উথমী। বুড়ো আর তর্জনী আঙুলের সাহায্যে কলম নাচাতে নাচাতে পুরোনো প্রশ্ন সহকারে উত্তর দেয়,“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ছুটি নিয়েছিলাম প্রায় পঁচিশ দিনের মতো কিন্তু হানিমুনে আর যাওয়া হয়নি। তা আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। সে কী, হানিমুনে জাননি? এটা আবার কেমন কথা? এমন সুযোগ মিস করে কেউ?”

হাসিটা চওড়া হয় উথমীর। প্রশ্নটি এড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গ বদলে শুধায়,“শুনলাম জারিন ম্যাম ছুটিতে? অসুস্থ নাকি?”

“হ্যাঁ, সাত মাসে পড়ে গিয়েছে না? তাই ছুটিতে চলে গিয়েছেন। একেবারে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে তারপর ফিরবেন।”

ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে কাজে মনোযোগ দেয় উথমী। তার মনোযোগ নষ্ট করে পুনরায় ডালিয়া বলে ওঠেন,
“এরপর কিন্তু সিরিয়ালে আপনি আপা।”

“আমি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, নতুন বিয়ে হয়েছে বলে কথা। বাচ্চাকাচ্চা কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে নিবেন।”

কথাটায় যেনো বেশ লজ্জা পেলো উথমী। দৃষ্টি পটে ভেসে উঠলো স্বামীর মুখশ্রী।

বিছানায় বসে আম আর চালতার আচার খেতে খেতে গল্প করছে মা-মেয়ে। অন্যপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে লেজ দুলাচ্ছে আইসক্রিম। তর্জনী আঙুল দিয়ে একবার নিজের মুখে তো আরেকবার বিড়ালের মুখের কাছে নিয়ে আচার ধরে তনি। কিন্তু আইসক্রিম তা খায় না। প্রথমবারের টক সহ্য করতে না পেরে সেই যে মুখ বন্ধ করে শুয়েছে আর ওঠেনি। এদিকে মেয়েকে সাবধান করে রিনিতা বলছে,“ওকে দিও না, এসব ওর খাবার নয়।”

অবাধ্য তনি বিপরীতে প্রশ্ন ছুঁড়ে,“ক্যানো? আমি খেলে ও খাবে না ক্যানো?”

“ও ছোটো তাই।”

“আমিও তো ছুতো।”

“তুমিও খেও না, নিষেধ করছি না?”

“তাওলে তুমি খাও ক্যানো?”

“আমি বড়ো তাই।”

“তাওলে আমিও বড়ু।”

মেয়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় রিনিতা।কিন্তু মায়ের এই কড়া দৃষ্টিতে ভয় পায় না তনি। রিনিঝিনি শব্দে হেসে ওঠে। তার এই মিষ্টি হাসির ঝংকারে আর রাগ দেখাতে পারে না রিনিতা। সেও পাল্লা দিয়ে হেসে ফেলে। মেয়েটা যে কোত্থেকে এমন চঞ্চল আর দুষ্টু হলো তা সে জানে না। তবে সৌন্দর্য্য আর মুখশ্রীর অঢেল মায়া যে ঠিক বংশানুক্রমে দাদী, ফুপুদের নিকট থেকেই পেয়েছে তা অবশ্য বোঝে।

বউ বাচ্চার হাসির শব্দে ঘরে আসে উৎস। আজও সে অফিস যায়নি। ছুটি নিয়েছে অসুস্থতার বাহানায়। সুযোগ পেলেই এমনটা করতে পিছপা হয় না উৎস। অফিস করতে যেনো তার মোটেও ভালো লাগে না। প্রশ্ন করে,“ব্যাপার কী? মা-মেয়ের এতো হাসির ফোয়ারা বইছে কেনো?”

রিনিতা হাসি থামিয়ে উত্তর দেয়,“তোমার মেয়ের পাকা কথায় না হেসে কী আর পারা যায়?”

উৎস এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। মেয়েকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে শুধায়,“আমার মামনি কী পাকামো করেছে শুনি?”

তনি বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়,“তনি কিছু করেনি। নাও আচার খাও পাপা।”

“এসব বরং তোমার আম্মু খাক। তুমি আমার সাথে চলো, তোমাকে আমি খাবার আইসক্রিম খাওয়াবো।”

আইসক্রিমের কথা শুনতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো তনি। জড়িয়ে ধরলো বাবার গলা।
_________

কলেজ ছুটি হতে হতে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেলো উথমীর। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেইটের বাইরে বেরোলো সে। খোঁজ করতে লাগলো রিক্সার। এখান থেকে ডানে গেলে তার বাপের বাড়ির দূরত্ব মোটে আধ ঘণ্টা। একটা রিক্সা নিলেই একেবারে বাড়ির সামনে পৌঁছে যাওয়া যায় অথচ এখন তার পথ এবং গন্তব্যটা বদলেছে। ডান বদলে হয়ে গিয়েছে তা বাম। এখন রিক্সায় করে সোজা বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে ভেবেই ক্লান্তি ভাবটা জেঁকে ধরলো তাকে।

“ম্যাডাম! এই যে ম্যাডাম!”

একনাগাড়ে ডাকগুলো শুনে কৌতূহলী দৃষ্টিতে পেছন ফিরে রাস্তার ওপারে তাকায় উথমী। ড্রাইভিং পোশাকে আশফাককে দেখে চমকায় সে। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেটির সঙ্গে আজ সকালেই পরিচয় হয়েছে উথমীর। ছেলেটি তৈমূরের ড্রাইভার। সে এখানে কেনো? প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে সাবধানে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো উথমী। আশফাক বলে উঠলো,“অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম ম্যাডাম। গাড়িটা ওপারেই দাঁড় করাতাম কিন্তু নিয়ম নেই বলে‌‌ এপারে দাঁড় করিয়েছি।”

“আচ্ছা, কিন্তু আপনি এখানে কেনো? জানলেন কীভাবে এসময় যে আমি বের হবো?”

“স্যার জানিয়েছেন। আর বলেছেন, আপনাকে যেনো নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেই। নিন উঠুন ম্যাডাম।”

বলেই গাড়ির দ্বার খুলে দিলো আশফাক। কথা না বাড়িয়ে ভেতরে উঠে বসলো উথমী। মনে করার চেষ্টা করল, দুপুরে তবে এই জন্যই ফোন করে কখন বের হবে তা জিজ্ঞেস করেছিল তৈমূর?

চলবে ________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৭]

অন্দরমহলের সোফায় বসে কোনো এক বিষয় নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি চলছে শাহানা এবং তিথিয়ার মধ্যে। উথমীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখতে পেয়েই নড়েচড়ে উঠলো তিথিয়া। সজাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইশারা করল মাকে। মেয়ের ইশারায় নিরব হয়ে গেলেন শাহানা। থেমে গেলো দুজনার হাসাহাসি। উথমী তা ঠিকই লক্ষ্য করল। কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করে নিরবে উপরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সিঁড়িতে। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন শাহানা,“তেলের পিঠা বানাতে পারো?”

শাশুড়ির কণ্ঠস্বর থেকে নিঃসৃত হওয়া প্রশ্ন বাণে পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ায় উথমী। পিছু ফিরে তাকায়। উত্তর দেওয়ার আগেই পুনরায় শাহানা বলে উঠেন, “মিলির খুব খেতে ইচ্ছে করছে। পিঠা আবার মেয়েটার খুব পছন্দের তাই দুপুর থেকে পিঠা খাবে বলে কি যে বায়না ধরেছে! আমিই বানাতাম কিন্তু সকাল থেকে কোমর ব্যথাটা খুব বেড়েছে। এই ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তো আর সম্ভব নয়।”

কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ নিরব থাকে উথমী। শুধু তেলের পিঠা কেনো? কোনো ধরণের পিঠা তৈরি করতেই সে জানে না। ছোটো থেকে পিঠার প্রতি তীব্র অনিহা থাকায় কখনো শেখার চেষ্টা পর্যন্তও করেনি। রান্নাটাই যা ভালো পারে। তবে এই মুহূর্তে নিজের এই অজ্ঞতা স্বীকার করতে পারলো না উথমী। আবার মুখের উপর না বলতেও পারলো না। নিষ্পৃহ স্বরে সম্মতি জানিয়ে ছোট্ট করে বললো,“আচ্ছা।”

“তাহলে আর দেরি করো না, বাইরের কাপড় বদলে এসে পিঠাগুলো বানিয়ে ফেলো।”

“এখন? সবে এক জায়গা থেকে ফিরলাম। এখন সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় বরং বানিয়ে দেই।”

উত্তরটি মোটেও পছন্দ হলো না শাহানার। অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,”মাগরিবের আজানের পরপর ওরা চলে যাবে। তখন পিঠা দিয়ে কী করবে?”

তিথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখ ভার করার ভং ধরে মায়ের উদ্দেশ্যে অভিযোগের সুরে বলে,“থাক বাদ দেন আম্মা। বাড়িতে চাকরি করা বউ এনেছে আপনার ছেলে। তার কী দায় পড়েছে আমার মেয়ের বায়না মেটানোর? বেশি কিছু বলতে গেলে দেখবেন তৈমূর কাছে গিয়ে নালিশ করবে, থাক বাদ দিন।”

বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই এদের এমন রং ঢংয়ে চরম বিরক্ত হলো উথমী। রাগকে দমন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে বললো,“সামান্য পিঠার জন্য এতো হায় হুতাশ করার প্রয়োজন নেই, বানিয়ে দিচ্ছি।”–কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে উপরে চলে গেলো সে।

তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রাগে গজগজ করে উঠলো তিথিয়া। ক্রোধ নিয়ে বললো,“শুনেছেন আম্মা, কী বলে গেলো ও? আপনার ছেলের বউ আমায় অপমান করে গেছে আর আপনি কিছু বলবেন না?”

“বাদ দে, সব কথা ধরতে নেই। জব্দ করতে পেরেছি এটাই অনেক।”

মায়ের কথায় কিছুটা হলেও শান্ত হলো তিথিয়ার মন কিন্তু ঘটনাটা কিছুতেই ভুললো না সে।

ঘরে এসে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসলো উথমী। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল লাগালো ভাবী নামে সেভ করা নাম্বারে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কলটা রিসিভ হলো। সালাম দিলো উথমী,“আসসালাম আলাইকুম ভাবী, কেমন আছো?”

অপরপাশ থেকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে রিনিতা উত্তর দিলো,“ওয়া আলাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। শরীর ভালো? তনির কী খবর?”

“হ্যাঁ শরীর ভালো। তনির অবস্থাও ভালো, আগের মতোই পাকামো আর দুষ্টুমি নিয়মমাফিক চলছে। তা তুমি বলো, সংসার কেমন চলছে?”

“ভালোই।”

“আর তৈমূর? কেমন ও?”

“সেও ভালো।”

“সন্তুষ্ট স্বামীর প্রতি?”

উত্তর দিলো না উথমী। প্রসঙ্গ বদলে বললো,“সেসব ছাড়ো, তুমি তো তেলের পিঠা খুব ভালো বানাতে পারো। এবার চটজলদি আমায় রেসিপিটা বলে ফেলো দেখি।”

“কখনো তো বকাঝকা করেও কেউ তোমায় পিঠা খাওয়াতে পারেনি, তাহলে আজ হঠাৎ রেসিপি চাইছো যে?”

“কী আর করার? ননাসের মেয়ের আবদার। এখন যদি পারি না বলে দেই তাহলে কেমন দেখায় না? নিজের কাছেই তো লজ্জাজনক।”

“তাও ঠিক, একটু অপেক্ষা করো। রেসিপি বরং আমি তোমার হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠাচ্ছি।”

“ধন্যবাদ ভাবী।”

“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই, মন দিয়ে সংসার করো।”

“আচ্ছা রাখছি তবে।”

“আচ্ছা।”

কল কেটে দিয়ে চুপচুপ বসে রইলো উথমী। তার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই রিনিতার অ্যাকাউন্ট থেকে চলে এলো তেলের পিঠার রেসিপি। মনোযোগ সহকারে সেটা দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো সে।

রন্ধনশালা আজ ফাঁকা। এসময় রোজ মালতী ফুফু চা বানালেও আজ উনাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তবে সেদিকে ধ্যান দিলো না উথমী। ভাবীর দেওয়া রেসিপি মোতাবেক সব খুঁজে খুঁজে জোগাড় করতে লাগলো সে। একসময় কিছু একটা হাতের নাগালে না পেয়ে উচ্চস্বরে ডাকলো,“মালতী ফুফু!”

এরও কিছুক্ষণ পর হেলেদুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন মালতী ফুফু। চোখেমুখে উনার বিষাদের ছাপ। সেদিকে শুরুতে খেয়াল করল না উথমী। ব্যস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,“চালের গুঁড়া কোথায় রেখেছেন ফুফু?”

প্রশ্নের বিপরীতে কোনোরূপ জবাব না দিয়ে স্টিলের আলমারি থেকে তিনি বের করে দিলেন মাঝারি সাইজের একটি কন্টেইনার। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে অনুযোগের সুরে বললেন,“আগামী একমাসের বাজার বাড়িতে করাই আছে। কাঁচা সদাই যা আছে তা দিয়া তিন-চাইরদিন চইল্লা যাইবো, শেষ হইয়া গেলে বড়ো ভাইজান নইলে ফজলুলরে কইয়ো। ফজলুল বাড়ির দারোয়ান। হেয়ই মাঝেমধ্যে আনাসপাতি আইন্না দেয়।”

কড়াইতে তেল গরম করতে করতে বাঁকা দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকায় উথমী। শুধায়,“কেনো? আপনি আবার কোথায় যাবেন? বেড়াতে?”

“না, তিথি মায় আমারে তার লগে হেগো বাড়িত লইয়া যাইবো। আইজকার পর থাইক্কা নাকি তাগো বাড়িতই আমার থাকতে হইবো আর কাম করতে হইবো।”

কথাটায় ভীষণ অবাক হয় উথমী। মালতী ফুফু পুনরায় বলেন,“এই বাড়িত কাম করি দুই যুগ পার হইতে চললো। তমালের বাপ মরনের পর মেজো ভাইজানই গেরাম থাইকা আমারে আইনা এনে আশ্রয় দিছিলো। আশা করছিলাম শেষ দিন পর্যন্ত গায়ে গতরে এই বাড়িতেই খাটমু কিন্তু তা আর হইলো না। ভালা থাইক্কো তুমরা, আল্লাহর কাছে তুমগো লাইগা দোয়া করি।”

“তমাল কে? আপনার ছেলে?”

“হ।”

“সে কোথায়?”

“কই আর থাকবো? বিয়ার পর বউ লইয়া আলাদা থাকে। নিজের পেডের পোলায়ই আমারে ভাত দেয় না।”

“তা হঠাৎ এতোদিন পর আপনাকে আপার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাওয়ার কারণ?”

“জানি না, তয় দুপুরে হঠাৎ কইরাই কইলো ব্যাগ গুছাইতাম। আমি কইলাম, আমি গেলে এতো বড়ো বাড়ির দেখভাল করবো কেডায়? কাম করবো কেডায়?”

“কী বললো?”

“কইলো, বাড়িতে মাইনষের অভাব আছে? তৈমূর আর হের বউ বুইঝা লইবো।”

এই সামান্য কথাতেই যা বোঝার বুঝে গেলো উথমী। বুঝে গেলো শাশুড়ি আর ননদের সাংসারিক রাজনীতির চাল। তাই আর কথা বাড়ালো না সে। চুপচাপ পিঠা ভাজায় মন দিলো। মালতী ফুফুও আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন ভেতরে।

গরমে ঘেমে নেয়ে পরনের জামা ভিজে গিয়েছে উথমীর। আগুনের তাপে এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মুখশ্রী জ্বলে যাচ্ছে। পিঠা ভেজে এক বাটি ভর্তি করতে না করতেই ওরি দৌড়ে এসে তা নিয়ে যাচ্ছে অন্দরমহলে। আবার কিছুক্ষণ পর খালি বাটি ফেরত দিয়ে পূর্বের মতোই নিয়ে যাচ্ছে আরেকটি পিঠা ভর্তি বাটি। এভাবেই চললো পরপর তিনবার। তাতে বেজায় বিরক্ত হলো উথমী। রাগে ক্ষোভে মস্তিষ্ক তার দাউদাউ করে জ্বলছে। আবারো নতুন করে পিঠার গোলা বানাতে বানাতে বিড়বিড় করল, “রাক্ষসের দল। মনে হচ্ছে জীবনেও যেনো খায়নি।”
__________

অফিসের কাজ শেষ করে আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো তৈমূর। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। গাড়ি থেকে নেমে আশফাককে আজকের জন্য ছুটি দিয়ে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। কলিং বেল চেপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু রোজকার মতো আজ আর ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না, এমনকি দরজাও খুললো না কেউ। পরপর বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরেও একই অবস্থা দেখে ললাটে ভাঁজ পড়ে তৈমূরের। মনে মনে আওড়ায়,“বাড়ির সবাই কী ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি? আর মালতী ফুফু? আমি না ফেরা পর্যন্ত তো উনি কখনো ঘুমান না। তাহলে?”

কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে একসময় বাধ্য হয়ে উথমীর নাম্বারে কল দিলো সে। কিন্তু সাথে সাথে আর রিসিভ হয় না তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈমূর। হার না মেনে বারবার একই নাম্বারে কল দিতে থাকে।যেনো আজ কল রিসিভ না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই সে হার মানবে না।

বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে উথমী। বাড়ি ফিরে কোনো ধরণের বিশ্রাম ছাড়াই রন্ধনশালায় গিয়ে প্রবেশ করে সেখান থেকে বেরোতে বেরোতে বেজে গিয়েছিল সন্ধ্যা সাতটা। তারপর ক্লান্ত দেহখানা বিছানায় এনে ফেলতেই কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে খেয়াল নেই তার। অনেকক্ষণ ধরে অনবরত মোবাইল বাজার শব্দে ঘুমটা হালকা হয়ে যায় উথমীর। আবছা দৃষ্টিতে মোবাইলটি হাতে নিয়ে রিসিভ করে কল। ঘুমঘুম কণ্ঠে শুধায়,“হ্যালো, কে?”

“আমি তৈমূর, কোথায় আপনি? দরজাটা এসে খুলে দিন না। অনেকক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”

বাক্যগুলো শ্রবণালীতে পৌঁছা মাত্রই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠে উথমীর। অবশিষ্ট ঘুমটাও কেটে যায়। একলাফে শোয়া থেকে উঠে বসে। বাম হাতের অঙুলি দিয়ে চোখ দুটো ঘষে ভালো করে তাকায় মোবাইলের স্ক্রিনে। ‘তৈমূর সাহেব’ নামে জ্বলজ্বল করা নাম্বারটি দেখতেই আবারো তা কানে ধরে ব্যস্ত স্বরে বলে, “আপনি একটু দাঁড়ান আমি এখনি আসছি।”

কথাটা শেষ করেই কল কেটে মোবাইলটা বিছানায় ফেলে হন্তদন্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো উথমী। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে অন্দরমহল পেরিয়ে খুলে দিলো দরজা। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিগোচর হলো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত শ্রান্ত তৈমূরকে। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে তাকে ভেতরে প্রবেশের জায়গা দিলো উথমী। অপরাধী কণ্ঠে বললো,“কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। অনেকক্ষণ ধরে আপনি অপেক্ষা করছিলেন তাই না?”

স্ত্রীকে আপাদমস্তক পরখ করে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয় তৈমূর। শীতল কণ্ঠে বলে,“হুম, তা অবশ্য করতে হয়েছে কিন্তু আপনি কী তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে গায়ে ওড়না জড়াতেই ভুলে গিয়েছেন নাকি?”

হঠাৎ এমন একটি কথায় থতমত খেয়ে গেলো উথমী। নিজের দিকে তাকাতেই ভীষণ অবাক হলো সে। সাথে পেলো ভীষণ লজ্জা। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ওড়নাটা ভুলক্রমে ঘরে ফেলে রেখে এসেছে সে। আমতা আমতা করে,“আসছি” বলেই সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না উথমী।

তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে তৈমূর। পিছুপিছু নিজেও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

বিছানার একপাশে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে হলদে রঙের ওড়নাটা। কক্ষে প্রবেশ করে দ্রুত হাতে ওড়না তুলে গায়ে জড়ালো উথমী। পিছু ফিরেই ভেতরে আসতে দেখলো তৈমূরকে। শুধালো,“আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এলেন মনে হচ্ছে?”

তৈমূর আর ফিরে তাকালো না। ব্যাগটা রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলতে খুলতে উত্তর দিলো,“কাজ শেষ তাই চলে এসেছি। আম্মা রাতে খেয়েছেন?”

“বিকেলে তেলের পিঠে বানিয়েছিলাম, ওসব খেয়েই পেট ভরিয়ে আর ভাত খাননি।”

“এসব কেনো বানাতে গেলেন? এমনিতেই তো উনার শরীরে হাজারটা রোগ। ভাজা পোড়া খাওয়া নিষেধ।”

“আমি অযথা কেনো বানাতে যাবো? ফিরতে না ফিরতেই তো শুনি আপনার ভাগ্নিদের আবদার তেলের পিঠা খাবে। সেই আবদার না মেটালে কী আর আমার রক্ষে আছে? তাছাড়া আপনার মা আমার কথা শুনেন? তা তো শুনেন না এমনকি আপাও তো কোনো বাঁধা দিলেন না উনাকে।”

কথাটির কোনো প্রত্যুত্তর না করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে তৈমূর,“মালতী ফুফু কোথায়? উনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি?”

প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে গিয়েও দিলো না উথমী। কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা ভাবলো। তারপর সহাস্যে বলে দিলো এক মিথ্যে,“হবে হয়তো। সেই সন্ধ্যায় পিঠে বানানোর সময় দেখেছিলাম উনাকে, তারপর তো আমি ঘরে এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আপনার ফোন পেয়ে উঠলাম। তাই জানি না।”

“ওহ, খিদে পেয়েছে। খাবার বাড়ুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”—–কথাটা বলতে বলতে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে তৈমূর। উথমীও আর দাঁড়ায় না। বাধ্য স্ত্রীর মতো চলে যায় নিচে।
________

তিথিয়াদের বিশাল ফ্ল্যাটটিতে কক্ষ সংখ্যা তিনটি। সাথে এটাচ বাথরুম, ড্রয়িং রুম আর একটা রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরের সামনেই গতকাল রাতটা ঘুমিয়ে পার করেছেন মালতী ফুফু। সঙ্গে আনা পোঁটলা পুঁটলি সব পড়ে ছিলো ড্রয়িং রুমের সোফার পেছনে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেসব দৃষ্টিগোচর হতেই টনক নড়ে উঠলো তিথিয়ার। তখনি উনার জন্য অন্যত্র থাকার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলো সে।

স্বামী শামীম বাড়িতে নেই। গতকাল রাতেও ফিরেনি। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, কিছু মালপত্র আনার জন্য আজ সকালে চট্টগ্রাম গিয়েছে সে। ফিরতে ফিরতে দুদিন পেরোবে তার। তিথিয়া অবশ্য তেমন কিছু বলেনি। স্বামীর প্রতি বরাবরই তার অটুট বিশ্বাস। ভদ্রলোক শুরু থেকেই স্ত্রীর প্রতি ভীষণ দুর্বল। খুব ভালোবাসে তাকে। স্ত্রী যা বলবে তাই তার কাছে শেষ কথা।

মালতী ফুফুকে রান্নাঘরের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে মেয়েদের কক্ষে চলে এলো তিথিয়া।ওরি তৈরি হয়ে মিলির চুলে করে দিচ্ছে বেনুনী। তিথিয়া কিছুক্ষণ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখতে লাগলো তাদের কর্মকাণ্ড।একসময় নিরবতার অবসান ঘটিয়ে বড়ো মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,“মিলিকে কোচিং ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে তারপর তুই নিজের কোচিংয়ে যাবি। কোচিং শেষে ওকে নিয়ে একসঙ্গে স্কুলে ঢুকবি, ঠিক আছে?”

বোঝদারের মতো মাথা নাড়ায় ওরি। উত্তরে বলে, “রোজ রোজ ওর হাত ধরে নিয়ে যাই আর নিয়ে আসি কিন্তু ও প্রচুর দুষ্টুমি করে আম্মু। ওকে বলে দাও ও যেনো আর দুষ্টুমি না করে।”

বড়ো মেয়ের কথা শুনে কৃত্রিম রাগ দেখায় তিথিয়া। ছোটো মেয়েকে শাসন করার ভঙিতে বলে,“এসব কী শুনছি মিলি? রাস্তাঘাটে দুষ্টুমি করিস কেনো? এসব কিন্তু আর করবি না।আবার নালিশ পেলে আচ্ছামতো মাইর দিবো।”

মায়ের কথায় ভয় পেয়ে যায় মিলি। মাথা নাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,“আর করবো না আম্মু।”

মেয়ের ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে সন্তুষ্ট হয় তিথিয়া। আবারো ছুটে যায় রান্নাঘরের পথে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,“মালতী ফুফু! নাস্তা কত দূর? তাড়াতাড়ি দাও। ওদের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে তো।”

মালতী ফুফু ব্যস্ত স্বরে উত্তর দেন,“দিচ্ছি।”

রোজকার মতো সকালের নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে কলেজের জন্য গিয়ে তৈরি হয়ে নিলো উথমী। জয়নবের জন্য নাস্তা তৈরির দায়িত্বটাও এখন তার উপরেই পড়েছে। যদিও সরাসরি কেউ দায়িত্বটা দেয়নি তাকে বরং ধীরে ধীরে যেনো চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার উপর। তবে এতে কোনো সমস্যা নেই উথমীর। রান্না করতে তার কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু বাড়ির মানুষদের আচরণে। খারাপ আচরণ কখনোই নিতে পারে না সে। এতে প্রচন্ড রাগ হয় তার।

আজ নাস্তা সেরেই উপরে এসেছে তৈমূর। তারপর তৈরি হয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)