#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪২]
নিস্তব্ধ রাত। শহরের মানুষজন তখন ঘুমে কাতর। খোলা আকাশের নিচে কুয়াশায় মোড়ানো রাস্তায় খানিক বাদে বাদে বাঁশি বাজিয়ে টহল দিচ্ছে পাহাড়াদারের দল। বড়ো বোনের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী খিলগাঁও এর একটি অপরিচিত দালানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে তৈমূর। ফোনকল পেয়ে তখনি সে বিছানা ছেড়ে উঠে কোনোমতে তৈরি হয়ে মোবাইল আর গাড়ির চাবি নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
বিশাল স্টিলের গেইটটিতে হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করল তৈমূর। তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে ভেসে এলো দারোয়ান ভদ্রলোকের কর্কশ স্বরের প্রশ্ন,“কে বাইরে? কাকে চাই?”
“এখানে শামীম সরকার থাকেন?”
গেইটের ছোটো দরজাটি খুলে দিলেন দারোয়ান। কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললেন,“আপনি উনার কে হন?”
“উনি আমার দুলাভাই।”
“উনি ঠিক কতজনের দুলাভাই লাগে বলুন তো? কিছুক্ষণ আগেও একজন এসে এই কথাটাই আমায় বললো।”
“কিছুক্ষণ আগে?”
“হ্যাঁ, ওই তো ভেতরে গাড়ি।”
ইশারায় দেখানো গাড়িটির দিকে তাকালো তৈমূর। চিনতে তেমন অসুবিধে হলো না তার। এটা তো তুরাগের গাড়ি! ভ্রু কুঁচকে বললো,“আমার বড়ো ভাইয়ের গাড়ি।”
“ওহ, আচ্ছা ভেতরে যান।”
“উনার ফ্ল্যাট নাম্বারটা যদি বলতেন?”
“শালা হন অথচ ফ্ল্যাট নাম্বার জানেন না?”
“না, কারণ এটা উনার দ্বিতীয় ফ্ল্যাট।”
দারোয়ান আর কথা বাড়ালেন না। ফ্ল্যাট নাম্বার বলে দিয়ে দেখিয়েও দিলেন। তৈমূর সর্বপ্রথম গিয়ে গাড়ি পার্কিং করল। তারপর চলে গেলো নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের সামনে।
ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। মধ্যরাতেই ভেতরে আলো জ্বলছে। চলছে তর্ক বিতর্ক। আশেপাশের লোকজন ঘুম বাদ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে সেসবই মনোযোগ সহকারে দেখছে। তৈমূর এসে সেখানে থামলো। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মাথায় অজস্র প্রশ্ন নিয়েই উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,“এটাই কী শামীম সরকারের ফ্ল্যাট?”
ব্যস্ত কণ্ঠে উত্তর এলো,“হ্যাঁ, হ্যাঁ এটাই।”
“ভেতরে কারো কিছু হয়েছে? সবাই এভাবে ভিড় জমিয়েছে কেনো?”
মাঝখান থেকে এক টাগড়া যুবক উৎসুক কণ্ঠে বলে উঠলো,“দুই বউ নিয়ে শালা কট খেয়েছে। ওদিকে প্রথম বউ রেখে এখানে এসে গোপনে আরেকটা সংসার পেতেছিল। কিন্তু আজ কোত্থেকে যেনো প্রথম বউ চলে এসে হাতে নাতে ধরে ফেলেছে।”
তার কথা শেষ হতেই মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক ভীষণ আফসোস করে বললেন,“শামীম ভাইয়ের সাথে আমার অনেক বছরের পরিচয়। উনাকে অতিশয় ভদ্রলোক, ব্যবসায়ী গোছের মানুষ বলেই জানতাম। কিন্তু উনি যে শেষমেশ এমন একটা ঘটনা ঘটাবেন! ভাবতেও অবাক লাগছে।”
সব গুলিয়ে গেলো তৈমূরের। এসব কী বলছে এরা? মনের প্রশ্ন মনে নিয়েই ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে তিথিয়া। পরনের ওড়না মুখে গুঁজে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। তার পাশেই তুরাগ দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে। সুযোগ পেলেই যেনো ঝাঁপিয়ে পড়বে হাতের আঁজলে মুখ ঢেকে অদূরে বসে থাকা শামীমের উপর।
ড্রয়িং রুমের অপজিটে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন অর্ধ বয়স্ক ভদ্রমহিলা এবং উনার পাশেই অল্প বয়সী যুবতী এক মেয়ে। বাকি দুটো ঘরের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুজন ছেলে। যারা বয়সে অবশ্য তৈমূরের চেয়েও বেশ কয়েক বছরের ছোটো হবে হয়তো।
সবাইকে আগ্ৰহভরা দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবার বড়ো বোনের পানে তাকালো তৈমূর। অপ্রস্তুত স্বরে ডাকলো, “বুবু!”
তার ডাকে সকলের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো সদর দরজার দিকে। মুখশ্রীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল শামীমের। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো সে। ছোটো ভাইকে দেখতেই দৌড়ে এলো তিথিয়া। জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ক্রন্দনরত স্বরে বললো,“তুই এসেছিস তৈমূ? দেখ তোর দুলাভাই কী করেছে! আমাকে ঠকিয়ে অন্য কারো সাথে…..”
বাকি কথা আর বলতে পারলো না তিথিয়া। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেলো শব্দ। বোনকে পূর্বের স্থানে ধরে নিয়ে বসালো তৈমূর। এবার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চাইলো সে বড়ো ভাইয়ের পানে। তুরাগ চোয়াল শক্ত করে বললো,“এই হারামজাদা আমাদের বুবুকে ঠকিয়ে এখানে সংসার পেতেছে। ব্যবসায়ের নাম করে দ্বিতীয় বউয়ের সাথে এসে সময় কাটাতো। ওই দেখ, ওই চরিত্রহীন মহিলার সাথে এতদিন এসব অপকর্ম করে এই তিনটা জন্ম দিয়েছে। আবার মেয়েকে বিয়েও দিয়েছে। একে তো আমার নিজ হাতে এখানেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
সারা মুখশ্রী বিষ্ময়ে ছেয়ে গেলো তৈমূরের। তুরাগের কথা শেষ হতেই এক কিশোর রাগত স্বরে বলে উঠলো,“মুখ সামলে কথা বলুন। আমাদের বাসায় দাঁড়িয়ে আমাদের মায়ের চরিত্র নিয়ে নোংরা কথা!”
সারাজীবন বাবা-মা, বড়ো বোন আর দুলাভাইকে সম্মান করে আসা সেই ভদ্র স্বভাবের তুরাগ আজ আর শান্তটি নেই। রাগে তার শরীর কাঁপছে। মানুষ খুন করার মতো রাগ! মুখ দিয়ে বিশ্রী এক গালি বের করে বললো,“তোদের বাড়ি? ফকিন্নির বাচ্চা তোদের বাড়ি কীভাবে হলো এটা? তোর বাপের সম্পর্কে জানিস কিছু?”
কিশোর ছেলেটি তেড়ে আসা ধরলো। কিন্তু তাকে আটকে দিলো আরেকটি যুবক। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“ঝামেলা করিস না আরিফ। দাঁড়া এখানে।”
“কিন্তু ও যে আমাদের বাবা-মাকে নিয়ে নোংরা কথা বলেছে তা শোনোনি?”
তৈমূর বুঝলো এরা দুজন ভাই। ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো, রাগী ছেলেটার চেহারার সাথে শামীমের চেহারার বেশ মিল আছে। তবে তৈমূর রাগারাগী করল না। বড়ো বোনের পাশে বসলো। কোমল স্বরে বললো,“আমি কিছু বুঝতে পারছি না বুবু। কান্না থামাও। শুরু থেকে সবকিছু বলো আমায়।”
নাক টানলো তিথিয়া। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে শুরু থেকে বলা শুরু করল,“বিয়ের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্ধের মতো তোর দুলাভাইকে আমি বিশ্বাস করে এসেছি। অথচ ও আমার বিশ্বাসের এমন প্রতিদান দিলো? রেস্তোরাঁর ব্যবসা করেও দুদিন পরপর ব্যবসায়িক কাজের নাম করে শহরের বাইরে এসে থাকতো। তবুও তাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করিনি আমি। কখনো তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করিনি। অথচ সে আমায় ঠকালো? আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এখানে এসে সংসার পাতলো? ওই দেখ, ওই মহিলা নাকি ওর বউ। ওই যে ওরা হচ্ছে দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে-মেয়ে। বাড়ি ফিরে আমি আমার মেয়েদের এখন কী জবাব দিবো তৈমূ? বলবো ওদের বাবা ওদের মাকে ঠকিয়েছে? ওদের ভাগ এখানে এসে অন্য কাউকে দিয়েছে?”
থামলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,“কদিন আগে রাস্তায় মিলির বান্ধবীর মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি আমায় জানালেন, ওকে অন্য মহিলার সঙ্গে সোনারগাঁওয়ের এক হোটেলে নাকি উনার স্বামী দেখে এসেছে। কিন্তু সেকথা আমি বিশ্বাস করিনি। উল্টো ওর নামে ভালো ভালো কথা বলেছি। তারপর সেদিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে জানতে পারি, ব্যবসায়িক সব দিক নাকি ম্যানেজার দেখে। এমনকি ম্যানেজারই আমায় বললো, ভাবী! ভাই না আপনাকে নিয়ে কদিন আগে ভারত গেলো চিকিৎসা করাতে? কথাটা শুনে তো আমি রীতিমতো অবাক! তারপর শুনি প্রায়শই পরিবারের দোহাই দিয়ে সে চলে যায়। দুদিন আগে সন্দেহবশত ওর মোবাইল চেক করে এই বাড়ির কেয়ার টেকারের নাম্বারটা পেয়েছি। তখনি নাম্বারটা আমি আমার মোবাইলে সেভ করে রেখে দেই। আজ দুপুরে ফোন করে জানতে পারি তার এই সংসারের কথা। জানিস? আজ সকালেও ওরি ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা তুমি কোথায়? স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং ডেকেছে। তোমায় সেখানে থাকতে হবে। অথচ মেয়ের কাছেও ও মিথ্যে বললো!”
বলতে বলতে পুনরায় কেঁদে উঠলো তিথিয়া। সব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো তৈমূর। কিছুতেই যেনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না এ কথা। এতকাল ধরে এতোটা নিখুঁতভাবে অভিনয় করে গেলো এই ধুরন্ধর লোক? অথচ তারা কেউ বুঝতেই পারলো না কিছু! ছেলে- মেয়েগুলোও তো ওরি, মিলির চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। তাহলে কী? ঠান্ডা মাথায় বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো তৈমূর। এমন জটিল একটি বিষয় উত্তেজিত হয়ে রাগের মাথায় সমাধান করা যাবে না। এর সাথে তার দুই ভাগ্নির ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শীতল কণ্ঠে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“বুবু যা বলেছে সব সত্যি? উনি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী? আর এরা দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান?”
ছোটো শ্যালকের ঠান্ডা মেজাজে করা প্রশ্নে শরীর কেঁপে উঠলো শামীমের। এই ছেলেকে এখন আর সে বোকাসোকার কাতারে ধরে না। তার জানা এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তৈমূর ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়। এখনো নিশ্চয়ই এই আচরণের পেছনে ভয়ংকর কিছু লুকিয়ে আছে! তাই এবার আর চুপ থাকার মতো সাহস পেলো না শামীম। উপরনিচ মাথা নাড়ালো। উপস্থিত সকলে যেনো আরো এক দফা অবাক হলো। তুরাগ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তৈমূর বাঁধা দিলো,“উহুম, এই সময়ে কোনো ভুল কাজ করো না ভাইয়া। এহসানকে বরং খবরটা জানিয়ে রাখো। ও তো মিলিটারিতে আছে। কয়েকদিন আগে প্রমোশনও পেয়েছে। তাই উপর মহলে তার অনেক চেনা জানাও আছে। প্রয়োজন পড়লে ছোটো চাচাকেও জানাবো। শামীম সরকারকে তো জানাতে হবে যে তার প্রথম স্ত্রীর বাপ মরলেও ভাই আর চাচারা এখনো জীবিত। তাদের ক্ষমতাও তো দেখাতে হবে নাকি?”
শান্ত হলো তুরাগ। কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে গেলো ছোটো ভাইয়ের এতো স্বাভাবিক থাকার কারণ। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো সে। মোবাইল নিয়ে দূরে সরে গেলো। শামীমের কপালে ঘাম জমেছে। চোখ জোড়া কুটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আমতা আমতা করে বললো,“তৈমূর! এমনটা করো না শালা। আমার কথা শোনো।”
“আপনার কথা শোনার জন্যই তো এখানে বসে আছি। আমি কিন্তু আপনার বলা কোনো কথা ভুলিনি দুলাভাই। কম তো আর বউ নিয়ে জ্ঞান দিলেন না। অথচ শেষমেশ নিজেই কিনা এভাবে ঠকালেন স্ত্রী আর নিজের মেয়েদের? যেই পাতে খেলেন সেই পাতেই ফুটো করলেন?”
কপালের ঘাম মুছে নিলো শামীম। তিথিয়ার দিকে তাকিয়ে শেষ চেষ্টা করল,“তিথি, তোমায় আমি সব বলবো। এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
“বুবু আপনার সাথে আর কোনো কথা বলবে না শামীম সরকার। আর না আপনার কথা শুনবে। যা বলার আমরা বলবো। তা আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েরা কী জানতো আপনার এসব অপকর্মের বিষয়ে?”
আশেপাশে ঘাবড়ানো দৃষ্টিতে তাকালো শামীম। দ্বিতীয় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে ধমক দিয়ে বললো,“এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঘরে যাও।”
স্বামীর ধমকে কেঁপে উঠলেন ভদ্রমহিলা। চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। তৎক্ষণাৎ তৈমূর উনাকে থামিয়ে দিলো,“এভাবে তো আপনি এখান থেকে যেতে পারেন না। শামীম সরকারের সাথে সাথে আপনিও সমান অপরাধী। আমি জানি, আপনি সব জানতেন। জেনেই এই ভদ্রলোককে ফাঁসিয়েছেন।”
ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু এবারো সেই আরিফ নামের ছেলেটা তেতে উঠলো,“বলেছি না? আমার মায়ের সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারিত হবে না।”
ছেলেটির দিকে তাকালো তৈমূর। হাতের ইশারায় সামনের সোফা দেখিয়ে বললো,“এখানে এসে বসো।”
দ্বিধান্বিত মনে এসে বসলো আরিফ। অপরজনকেও একই ইশারা করল তৈমূর। তার ইশারায় প্রথম ছেলেটিও ছোটো ভাইয়ের পাশে এসে বসলো। তৈমূর জিজ্ঞেস করল,“নাম কী তোমার?”
“ইসহাক।”
“তুমি সবার বড়ো?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার পরে আরিফ?”
“না, আমার পরে নাজমা। আরিফ সবার ছোটো।”
“কীসে পড়ছো?”
“ইঞ্জিনিয়ারিং ফোর্থ সেমিস্টার। নাজমার মাস চারেক আগে বিয়ে হয়ে গেছে। আর আরিফ এবার টুয়েলভে।”
“তোমরা কী জানতে তোমাদের মা তোমাদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী?”
ইসহাক দুদিকে না বোধক মাথা নাড়ালো। তৈমূর বললো,“আমরাও তোমাদের কথা জানতাম না। শুধু আমরা নই, পুরো সোসাইটির কেউ তোমাদের কথা জানে না। সবাই শামীম সরকারের বউ হিসেবে শুধু তিথিয়া তৌহিকেই চিনে। সবাই জানে উনার দুজন সন্তান। ওরি আর মিলি। এখন তোমাদের এ বিষয়ে মতামত কী? ধরো আজ যদি আমার বোনের জায়গায় তোমাদের বোন থাকতো আর আমাদের দুই ভাইয়ের জায়গায় তোমরা দুই ভাই। কী করতে তখন?”
ছেলে দুটো একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। কিন্তু দেওয়ার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। শামীম ওদের উদ্দেশ্যে কড়া কণ্ঠে বললো,“বলেছি না তোদের ঘরে যেতে?”
দেখেই বুঝা যাচ্ছে, বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান তারা। কিন্তু আজ অবাধ্য হলো। নিশ্চুপ বসে রইলো। তৈমূর শামীমকে শাসিয়ে বললো,“অপরাধ করেও এতো বড়ো গলা মানায় না। আপনি দুই বিয়ে করেছেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আপনি গোপনে কেনো করেছেন? কেনো এতোগুলো মানুষকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঠকিয়েছেন? কেনো আমার বুবুর ভালোবাসা, বিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন? আমার সমস্যা ঠিক এখানে। চাষার ছেলে ছিলেন। অল্প টাকা মাইনের চাকরি করতেন। কোর্টে উকিলের পেছনে ঘুরে সামান্য টাকা রোজগার করতেন। আপনার আচরণে মুগ্ধ হয়ে আমার বাবা উনার একমাত্র মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দিলেন। অথচ চাইলে তিনি এরচেয়েও বড়ো কোনো ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু তা দেননি। ভেবেছেন, গরীব ঘরের ছেলে!নিশ্চয়ই উনার মেয়েকে মাথায় তুলে রাখবে? ওই গ্ৰামে বুবু থাকতে পারে না বলে শহরে প্লট কিনে ফ্ল্যাট গুছিয়ে দিয়েছিলেন বাবা, ব্যবসায়ের জন্য দিয়েছিলেন অর্থ। আজ এই সফলতা আমার বাবার দেওয়া। অথচ তার মেয়েকেই আপনি ঠকিয়ে দিলেন? এতকিছু তো মেয়ের ভালোর জন্যই তিনি করেছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন দিয়ে গিয়েছেন। উনি মারা যাবার পর আমরা দুই ভাই মিলে দিয়েছি। এই তার প্রতিদান? আমাদের অর্থ দিয়ে এতো বছর যাবত পরনারী নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করছিলেন? এই ফ্ল্যাট কার টাকায় কিনেছেন? নিজের বাবার? নিজের নাকি আমাদের বাবার গড়ে দিয়ে যাওয়া সম্পদ দিয়ে?”
মুখ দিয়ে রা বের হলো না শামীমের। দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। ছেলে দুটোর উদ্দেশ্যে বললো, “এতক্ষণ বাবা- মায়ের অপমানে খুব রাগ হচ্ছিল তাই না? এখন রাগ হচ্ছে না তোমাদের? সব জেনে, শুনেও বিবেক কী বলছে? যেসব দিয়ে বিলাসীতা করছো সেসব আদৌ তোমাদের? নিজের মাকে প্রশ্ন করো, কেনো অন্য নারীর ঘর ভাঙলো সে? বাবাকে জিজ্ঞেস করো, কেনো প্রথম স্ত্রীকে ঠকালো?”
আরিফ বললো,“আমাদের ফুফু, ছোটো চাচা তারা তো সব জানতো। কই কখনো তো কিছু বলেনি?”
তিথিয়া অবাক হয়। ভীষণ অবাক। এসবের সাথে তবে ননদ আর দেবরও জড়িত?
তুরাগ চলে এলো। বললো,“সব জানিয়েছি। ও তো এখনি চলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি নিষেধ করে দিয়েছি। এর নামে যত মামলা আছে সব দিবো। যৌতুক, দুই নাম্বারী, পরকীয়া, মানহানি, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া গোপনে দ্বিতীয় বিয়েসহ সব। এই জীবনে আর জেল থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার মুখ দেখতে পারবে না।”
আঁতকে উঠলো শামীম। মিনতি করে বললো,“তিথি! এমনটা করতে নিষেধ করো ওদের। আমি মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু কখনো কী তোমাদের কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছি বলো? কখনো তোমার সাথে উচ্চবাচ্য করেছি? তুমি যখন যা বলেছো তাই মেনে নিয়েছি। দয়া করো তিথি। আমি তোমায় ভালোবাসি বউ। তোমাকে আর আমাদের মেয়েদের ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”
আরো একদফা অবাক হলো সকলে। বিশেষ করে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী আর সন্তানেরা। তৈমূর মুচকি হেসে বললো,“দেখলে তোমাদের বাবার আসল রূপ?”
তিথিয়া প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এতোই যখন ভালোবাসো তাহলে এমন করলে কেনো? জানো, এই মুহূর্তে আমার ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে? তুমি একান্তই আমার নও ভাবতেই শরীর কেঁপে উঠছে। ঠকার আগে আমার মরণ হলো না কেনো? কেনো আমার সাথে এমনটা করলে? পারবে কী জবাব দিতে?”
শামীম কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,“সব দোষ শুধুই কী আমার? তোমার কোনো দোষ ছিলো না এর পেছনে? এতো বছরের সম্পর্কে কখনো কী বলতে পারবে তুমি কোনো কিছু করার আগে আমার অনুমতি নিয়েছো? কখনো আমার কাছে আবদার করেছো? সময় দিয়েছো আমায়? নাকি আমার পরিবারের সাথে কখনো হাসি মুখে ভালো দুটো কথা বলেছো? সংসার আমাদের হলেও তাতে নাক গলিয়েছে তোমার বাবা-মা। বছরের দশ মাসই পড়ে রয়েছো বাপের বাড়ি। কিছু বলতে পারিনি কখনো। একবার একটা ধমক দিয়েছিলাম বলে বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করলে। তোমার বাবা তোমায় না বুঝিয়ে উল্টো আমাকে ডেকে নিয়ে যা নয় তা বললো। আর আমি সব মুখ বুঁজে মেনে নিলাম। বিয়ের তিন বছর পর বাচ্চার মুখ দেখলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেটা আমার আর বাঁচলো না। বাবা বাবা ডাকা ছেলেটাকে নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়ে এলাম। অথচ তোমরা কেউ আমার কষ্টটা দেখলে না। তোমার বাবা-মা তোমায় নিয়ে গেলো। আমি তখন নিঃস হয়ে গেলাম। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাউকে খুব করে পাশে প্রয়োজন ছিলো। অথচ তুমি তখন ছিলে না, তোমার জন্য আমার বাবা-মায়ের সাথেও আমার দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখনি জীবনে এলো আবেদা। স্বামী মারা গিয়েছে মাস সাতেক আগে। দুধের শিশু নিয়ে সে দিগ্বিদিক ভুলে বসেছে।লেখাপড়া তেমন জানে না, বাপ মরা মেয়ে। মা অসুস্থ, ভাইরাও অভাবের সংসারে বোনকে রাখবে না। আমাদের পাশের গ্ৰামেই ও থাকতো। স্কুল জীবনে ওর সাথে প্রেম ছিলো আমার। কিন্তু একসময় তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্য কোথাও। ওর দুঃখের কথা শুনে আমার কষ্ট লাগলো। প্রায়ই যেতাম ওর আর ওর বাচ্চা ছেলেটার খবর নিতে। কদিনেই বাচ্চার প্রতি আমার মায়া জন্মে গেলো। একসময় আশেপাশের মানুষরা আমাদের নিয়ে কথা তুললো। সেসময় ইউসুফ আর আনোয়ারা আমায় অনেক বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করালো। এদের তুমি কখনোই সহ্য করতে পারোনি। বাড়িতে এলে ঠিকমতো রান্না করোনি। ভালোমন্দ কথা বলোনি। কেউ অসুস্থ হলে কখনো দেখতে যাওনি কিন্তু আবেদার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে কিন্তু ঠিকই সব মেইনটেইন করে চলেছে। তারপর আমাদের কোল আলো করে নাজমা এলো, আরিফ এলো। ইসহাকের স্কুলে পড়ার বয়স হলো। শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে ওদের এখানেই রাখলাম। ভেবেছিলাম তোমায় ছেড়ে দিবো, তোমার বাবার দেওয়া সমস্ত সম্পত্তি উনার হাতে তুলে দিয়ে আমি সংসারে মন দিবো। কিন্তু পারলাম না। তোমার পেটে ওরি এলো।এরপর আমি বুঝলাম আমি তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার এই জীবন চলতে পারে না। আবেদা তো ছিলো শুধুই আমার অসময়ে সঙ্গী মাত্র! কিন্তু ততদিনে আমি দুদিকে জড়িয়ে গেলাম। কাউকেই ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে এখানে না এলে আবেদা আমায় হুমকি দিতো, তোমাকে সব জানিয়ে দিবে। তখন তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। আমার কী দোষ এখানে? আমি বাবা ডাক শুনতে চেয়েছিলাম, নিজের মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম, সুন্দর সংসার চেয়েছিলাম। তুমি যদি ওই দুঃসময়ে আমার পাশে থাকতে তাহলে এতোকিছু হতো? তোমার বাবা-মা আমাদের সংসারে হস্তক্ষেপ না করলেও এসব কিচ্ছু হতো না। স্ত্রী যদি স্বামীর সংসার ফেলে, স্বামীর গুরুত্ব কমিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে য়ে পড়ে থাকে তাহলে সেটা কখনো সংসার থাকে না তিথি।”
ছেচল্লিশ বছর বয়সে এসে নিজের সব দোষ, ত্রুটির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো তিথিয়া। চোখের পানি তার থেমে গিয়েছে। অনেক কষ্টে ভাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো সে। কম্পিত কণ্ঠে বললো,“আমায় বাড়ি নিয়ে চল তোরা। মাথাটা খুব ব্যথা করছে। আজ কারো উপর আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। সবাই সুখে থাকুক।”
স্ত্রীর এমন আচরণে বুক কেঁপে উঠলো শামীমের। বাঁধা দিতে চেয়েও পারলো না। সে যে স্বল্প সময়ের আনন্দের জন্য ফেঁসে গিয়েছে সম্পর্কের মারপ্যাঁচে! বাড়িতে গন্ডগোল বাড়লো। ইসহাক তবে শামীমের ঔরসজাত সন্তান নয়? আবেদার আগের পক্ষের সন্তান? এতো বড়ো সত্য এতকাল ধরে সকলের আড়ালে ছিলো?
তৈমূর, তুরাগ বোনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। আর কিছু জানা, শোনার ইচ্ছে তাদের নেই।
চলবে __________
#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৪৩]
রাতের আঁধার কেটে ধরণীতে আলো ফুটেছে। মালতী ফুফুর সাহায্যে অযু করে বিছানায় বসেই ফজরের নামাজ আদায় করে কোরআন পাঠ করছেন শাহানা। উথমী নামাজ শেষে নিচে নেমে চা বানিয়ে এক কাপ চা মালতী ফুফুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাকি দুই কাপ চা আর একটি পিরিচে করে কয়েকটি বিস্কুট নিয়ে শাশুড়ির ঘরে হাজির হলো। তারপর বিছানার একপাশে সেসব রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে খুলে দিলো দ্বার।
শাহান পড়া শেষে কোরআন শরীফটি পুত্রবধূর হাতে তুলে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,“শুনলাম তৈমূ নাকি মাঝরাতে কোথাও বেরিয়েছে?”
শাশুড়ির হাত থেকে কোরআন শরীফটি নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে বিছানায় এসে বসলো উথমী। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”
শাহানাও একটি কাপ হাতে তুলে নিলেন। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় গেছে?”
যাওয়ার আগে স্ত্রীকে সঠিক কিছু বলে যায়নি তৈমূর। হঠাৎ করেই একটা ফোনকল আসায় হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে চোখে চশমা আর গায়ে শার্ট জড়িয়েই মানিব্যাগ, গাড়ির চাবি পকেটে ঢুকালো সে। উথমী জিজ্ঞেস করেছিল,“কোথায় যাচ্ছেন?”
“বুবু হঠাৎ করেই ফোন করে যেতে বললো। আমি বের হচ্ছি। আপনি ঘুমান। মালতী ফুফু না হয় দরজাটা লাগিয়ে দিবেন। আর হ্যাঁ আম্মাকে আপাতত এ বিষয়ে জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি এসে জানাবো।”–শুধু এতটুকু বলেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে চলে গেলো তৈমূর।
তাই সত্যটা আর শাশুড়িকে জানালো না উথমী। শুধু বললো,“বলেনি কিছু, হঠাৎ করেই একটা ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেলো। আর চিন্তা করতে নিষেধ করল।”
কথা শেষে চায়ের কাপে সে চুমুক বসালো। এ বিষয়ে আর তেমন কিছু বললেন না শাহানা। জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থির করে চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে কান পেতে শুনতে লাগলেন পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কিছু একটা ভেবে নিরবতা ভেঙে উদাস কণ্ঠে বললেন,“গর্ভাবস্থার চার পাঁচ মাসে পা দিলেই তো বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে মানুষ বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকে। তা তুমি কী ভাবলে? এখনি যেতে চাও নাকি একেবারে পাঁচ মাসে পড়লেই যাবে?”
প্রশ্নটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইলো উথমী। ব্যাপারটি তার মাথায় এখনো আসেনি। তাই ভাবার জন্য সময় নিলো। বললো,“শ্বশুরবাড়ি থাকতে বাপের বাড়ি যাবো কেনো? আমি চলে গেলে সংসারের কী হবে?”
সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহানা। কদিনের ব্যবধানে মেয়েটির প্রতি জন্মানো বিরূপ মনোভাব বদলে গিয়েছে উনার। পুত্রবধূকে যতটা খারাপ তিনি মনে করেছিলেন ততটা খারাপ সে নয়। নইলে বিয়ে করে বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে যে শাশুড়ি তার সাথে দুটো ভালো কথা তো কখনো বলেইনি বরং সুযোগ পেলেই দোষ ধরতে, অপমান করতে সদা ব্যস্ত থাকতো সেই শাশুড়ির এই অবস্থায় কিনা সে মন থেকে সেবা শুশ্রূষা করছে? শরীরের এমন অবস্থা নিয়েও নিয়ম করে সেই দুতলা থেকে নেমে এসে নিজ হাতে রান্না করে সকাল, রাতে খাবার খাওয়াচ্ছে? ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগে শাহানার। এমনকি কলেজে গিয়েও যে মালতী ফুফুকে ফোন করে শাশুড়ির খবর নিতে উথমী ভুলে না তাও তিনি ভালো করেই জানেন।
যেখানে নিজের আদরের কন্যা মায়ের এমন দুর্দিন দেখেও নিজের পিঠ বাঁচিয়ে বাহানা দিয়ে চলে গেলো সেখানে পরের ঘরের মেয়ের এতটুকু সেবা যত্নই তো অনেক! সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহানা বললেন, “তিথির সময় ও আবার আমার কাছেই ছিলো। ওর তিন তিনটা বাচ্চা তো এ বাড়িতেই হয়েছে। কত আদর, যত্নে যে রেখেছিলাম মেয়েকে! ওদের বাবাকে দিয়ে এ বাজার, ও বাজার ঘুরিয়ে খুঁজে খুঁজে কত রকমের ফল এনে আচার বানিয়ে খাইয়েছি। তার সাথে বাহারি পিঠার কথা তো বাদই দিলাম। বড়ো বউয়ের সময়ও আমি অনেক আচার বানিয়ে রেখেছিলাম। তবে ও সব আবদার করতো নিজের মায়ের কাছে। তাই ওর মাও মাঝেমধ্যে মেয়ের জন্য এটা ওটা নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন বাড়িতে। এমনকি জোহান ওর নানার বাড়িতেই হয়েছে। আমার অবশ্য শুরুতেই এতে অনেক আপত্তি ছিলো। ভেবেছিলাম বাড়ির প্রথম বাচ্চা এ বাড়িতেই হবে। কিন্তু না, সে তো তার বাপের বাড়িতে গিয়েই থাকবে। তোমার শ্বশুর আবার অশান্তির ভয়ে সায় দিয়েছিলেন এতে। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই। এখন আমি পঙ্গু হয়ে গেছি। চলাফেরাও তেমন করতে পারি না। সব তো তুমিই করো। তবে আর কদিন? পেট আরেকটু উঁচু হয়ে গেলেই হাঁটাচলা করতে অনেক সমস্যা হবে। এর থেকে বাপের বাড়িতে গেলেই ভালো হবে। ওখানে বাবা-মা, ভাই-ভাবী আছে। সবার সেবা যত্ন পাবে। এদিকটা না হয় মালতী সামলে নিবে।”
“আল্লাহর ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না আম্মা, বুঝেছেন? এসব নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। আপনি না পারেন, আপনার ছেলে তো আছে নাকি? আমি কষ্ট করবো আর সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফ্রিতে বাপ হবে? এ সম্ভব নয়। তাকে ডেকে শিখিয়ে দিবেন কীভাবে বউ সেবা করতে হয়। শ্বশুরের মতো ঢেঁড়স হলে আবার সমস্যা।”
মুহূর্তেই মুখভঙ্গি বদলে গেলো শাহানার। মেয়েটির কাট কাট কথায় ভড়কে গেলেন। এসব আবার কেমন দ্বারার কথা? অন্যসময় হলে হয়তো এতে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হতেন তবে এখন বেশ মজাই পেয়েছেন।
______
তিথিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে দুই ভাই। অন্দরমহলে তা নিয়েই বসেছে ছোটোখাটো বৈঠক। বাড়ির গুরুজন বলতে শুধু শাহানাই উপস্থিত আছেন সেখানে। চাচারা এ বিষয়ে এখনো অবগত নয়। বশির উদ্দিনও আজ তিনদিন ধরে বাড়িতে নেই। মঈনুদ্দিন জোরপূর্বক কিছুদিনের জন্য বড়ো ভাইকে নিয়ে গিয়েছেন নিজেদের বাড়ি।
জামাতার কাহিনী শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন শাহানা। আকস্মিক বর্ণনাকৃত ঘটনার কিছুই যেনো উনার বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো বছর ধরে তিনি শামীমকে চিনেন, জানেন। নিজ স্ত্রী, কন্যাদের যে চোখে হারায় সে-ই কিনা এতো বছর ধরে ধোঁকা দিয়ে গেলো সবাইকে? অসহায় কণ্ঠে বললেন,“জামাই এমন কেনো করল? কী অন্যায় ছিলো আমার মেয়ে, নাতনিদের? আমার তো কিছুতেই এসব বিশ্বাস হচ্ছে না। এই বয়সে এসে আর কী কী দেখতে হবে আমায়?”
তিথিয়ার চোখে পানি নেই। বিমূঢ় দৃষ্টিতে মেঝের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে সে। স্বামীর করা অভিযোগ এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে তার শ্রবণালী জুড়ে। তুরাগের রাগ কমেনি। দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের বিপরীতে বললো,“ওই হারামজাদাকে আমি কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিবো না আম্মা। ওকে এতো এতো যৌতুক দেওয়া হয়েছিল কী এই অপকর্ম করার জন্য? ওকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”
বড়ো ছেলের কথার বিপরীতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহানা। তাকে শান্ত করতে বললেন,“মাথা গরম করিস না। তাকে জেলে দিলে আমার নাতনিদের কী হবে? সমাজে তারা চলাফেরা করবে কীভাবে? বিয়ের বয়স হলেও তো ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া যাবে না। ওদের কথা ওদের বাপ তো ভাবলোই না কিন্তু তোরা অন্তত ভাব।”
“ভবিষ্যৎ চিন্তা করে হারামজাদাকে সুখ শান্তির মধ্যে ছেড়ে দিবো? আমি আজই বুবুকে সঙ্গে নিয়ে ওর নামে মামলা করবো। তারপর ভালো উকিল দেখে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। ওরি, মিলির চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। ওদের মামারা এখনো মরেনি। ওই রেস্তোরাঁ, ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সব সম্পত্তির উপর শুধু ওদেরই অধিকার রয়েছে।”
এবার যেনো বিপাকে পড়লেন শাহানা। এই মুহূর্তে মাথা উনার কাজ করছে না। এই বয়সে এসে একটার পর একটা ঝামেলা আর কত সইবেন? শেষে কিনা মেয়ের সংসার ভাঙাও স্বচোক্ষে দেখতে হচ্ছে? মেয়ের সুখের জন্য কতকিছু করেছিলেন স্বামী-স্ত্রী! অথচ সবকিছুই যে বিফলে গেলো? এখন মেয়ের কী হবে? নাতনিদেরই বা কী হবে? অসহায় দৃষ্টিতে এবার ছোটো পুত্রের পানে চাইলেন তিনি। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,“তুই কিছু বল তৈমূ। তোকে ছাড়া আমি আর কারো উপর ভরসা করতে পারিনা।তুই বল, এতদিনের সাজানো গোছানো সংসার কী এতো সহজে ফেলে দিয়ে চলে আসা যায়? ওদের তো দুটো মেয়ে আছে নাকি?”
তৈমূর নিশ্চুপ। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মুখে যতই বলুক না কেনো দায়িত্ব নিবো কিন্তু আদৌ কী পারবে সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে? নিজেদেরও তো একটা সংসার আছে নাকি? কদিন পর তার বাচ্চা হবে। এদিকে বড়ো বোন আবার ভাই বউদের একদম সহ্য করতে পারে না। বাড়িতে থাকলেই যত অশান্তি! আবার বাবার সম্পর্কে এতো বড়ো সত্যিটা ওরি, মিলি জানলেও তো সমস্যা! বিরূপ ধারণা পড়বে তাদের মস্তিষ্কে।
তাদের এই নিরবতায় সকলের মাঝখানেই হঠাৎ করে গম্ভীর কণ্ঠে জেবা বলে উঠলো,“আমি মনে করি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এতো বছর যেহেতু কোনো সমস্যা হয়নি তাহলে এখন কেনো হবে? এমন তো নয় যে দুলাভাই এক সংসারের জন্য আরেক সংসারের সব দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন। বরং সমানভাবেই তিনি দুদিক মেইনটেইন করে চলেছেন। তার উপর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানরা শুনেছি আপার সন্তানের চেয়েও বয়সে বড়ো। তাহলে?”
স্ত্রীর কথা শুনে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিলো তুরাগ। বাকি সবার দৃষ্টিও এখন জেবার উপরেই নিবদ্ধ। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে তুরাগ প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কী বলতে চাইছো তুমি? সবকিছু জানার পরেও বুবু ওই নেমকহারামের সঙ্গে সংসার করবে?”
“তো তুমি কী চাইছো? সংসার ভেঙে যাক?”
“সংসার কী আদৌ আছে? এর থেকে ডিভোর্স নেওয়াই উত্তম।”
কঠোর হলো জেবা।এই প্রথম শাশুড়ি, ননদকে পরোয়া না করেই কড়াভাবে বললো,“তোমাদের আশকারাতে আজ উনার এই অবস্থা হয়েছে। আপার সংসার ভাঙার জন্য তোমরাই দায়ী।”
ভীষণ আশ্চর্য হলো সকলে। শাহানা শুধালেন, “আমরা?”
“অপরাধ মাফ করবেন আম্মা কিন্তু কথাটা ভুল নয়। বিয়ের নয় বছর চলছে আমার। অথচ এই নয় বছরে আপনাদের মা-মেয়ের কম অত্যাচার আমি সহ্য করিনি। সব কাজকর্ম করার পরেও কত কথা হজম করেছি। বিয়ের পরেও নিজ সংসার ফেলে দিনের পর দিন আপা পড়ে রয়েছে বাপের বাড়ি। স্বামীর কথা না ভেবে ভাই বউদের নিয়ে আপনার কান ভাঙিয়েছে। দু দুটো মেয়েকে কাজের লোকের হাতে ফেলে রেখে এ বাড়িতে এসে আপনার ছেলের কাছে আমার নামে নিন্দে করেছে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে নতুন করে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দিয়েছে। এমনকি দুদিন আগে পর্যন্ত তৈমূরের সংসার ভাঙার কম প্রচেষ্টা তিনি করেননি। কিন্তু আপনি একবারও মেয়েকে বাঁধা দেননি আম্মা। বরং উনার সাথে তাল মিলিয়েছেন। আমি বছরে দুবার বাপের বাড়ি যেতে চাইলে বলতেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই মেয়েদের বাড়ি। দুদিন পরপর বাপের বাড়ি গেলে সংসার টিকে না। পুরুষ মানুষের মন বাইরে দিয়ে ঘুরঘুর করে। অথচ একবারও এ কথাটা আপনি আপাকে বলেননি বা বোঝাননি আম্মা। বরং মেয়ের মা হয়েও মেয়ের সংসারে নাক গলিয়েছেন। আপা কী বলতে পারবে শেষ কবে নিজ হাতে রান্না করে স্বামী, সন্তানকে বেড়ে খাইয়েছে? বলতে পারবে, কখন স্বামীর ভরসা হয়ে তাকে স্বস্তি দিতে পেরেছে? পারবে না। মাসের পর মাস বাপের বাড়িতে পড়ে থাকলে পারবে কী করে? এমনকি সম্পত্তির জন্য বাড়ি ভরতি মানুষের সামনে নিজের ছোটো ভাইদের অপমান করতেও তিনি ছাড়েননি। মূল কথা হচ্ছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না আম্মা। পুরুষ মানুষের স্বভাব, চরিত্র একটু নড়বড়ে। কারো ক্ষেত্রে একটু বেশিই ঢিলে। তাই স্বামী, সংসার, সন্তান রেখে বাইরে ঘুরঘুর করা নারী আর যাই করুক সংসার করতে পারে না। দুলাভাই যা করেছেন একদম ঠিক কাজ করেছেন। ঘরে স্ত্রী থাকতেও মানসিক শান্তি না পেলে তো বাইরে যাবেনই। তবে তিনি খারাপ কাজ না করে বিয়েই তো করেছেন? এখন আবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, ডিভোর্স দিয়ে দাও। ডিভোর্স কী ছেলেখেলা? আজ না হয় ডিভোর্স হয়ে গেলো কিন্তু কাল? কাল কী হবে? সমাজে টিকতে পারবে? না, পারবে না। আমাদের সমাজে এখনো ডিভোর্সের জন্য নারীকে দায়ী করা হয়। পুরুষের করা অন্যায়ের জন্য নারীকেই অপমান করা হয়। তার উপর উনার দুজন মেয়ে আছে। তারাও তো বড়ো হচ্ছে নাকি? আর আপা তো তেমন শিক্ষিতও না যে কিছু একটা করে চলবেন। বাবা আর স্বামী ব্যতীত কেউ কারো দায়িত্ব সারাজীবনের জন্য বহন করতে পারে না। তাই যেভাবে চলছে চলুক। এতদিন একসাথে থাকতে পারলে বাকি জীবনটাও থাকা যাবে। আপনারা তো আবার বেশি শিক্ষিত মেয়ে পছন্দ করেন না। অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উত্তম মনে করেন। এসএসসি শেষে ওরিকেও না হয় ভালো ছেলে খুঁজে ওর মামারা বিয়ে দিয়ে দিবে। ফ্ল্যাট তো আপার নামেই আছে। মিলির লেখাপড়া যেভাবে চলছে চলুক। দুলাভাইয়ের সাথে সবাই আলাদা বসুন। উনি এখন কী চান সেটা শুনুন। আর উনাকে বলে দিন, সম্পত্তির অর্ধেক যেনো আপার নামে লিখে দেয়। এই বয়সে এসে সংসার ভাঙা ভালো নয়। নিজের সাধনার ফল অন্যকে অনায়াসে ভোগ করতে দিয়ে দেওয়াও উচিত নয়। একটা ভালো পরামর্শ দেই আপা, অন্যের সংসার নিয়ে না ভেবে এবার নিজেরটা নিয়ে ভাবুন। অন্যের কথায় প্ররোচিত না হয়ে নিজে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। আর হ্যাঁ, এমন কিছু করবেন না যাতে আপনার মেয়েদেরকেও তার জন্য ভুগতে হয়। কিছু ভাঙার থেকে মেরামত করা অনেক ভালো।”
সবাই মনোযোগ দিয়ে জেবার কথা শুনলো। তিথিয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। তার মনে পড়ে, বিয়ের প্রথম দুই বছরেও যখন জেবার বাচ্চা হচ্ছিল না তখন নিজেদের বাসায় তুরাগকে ডেকে নিয়ে সে আর শামীম মিলে কতই না বুঝিয়েছে, এই মেয়ে দিয়ে সংসার হবে না। একে ছেড়ে দে। বয়স্ক মেয়েদের বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাচ্চা না হলে বংশ রক্ষা হবে কীভাবে? তোর জন্য তোর দুলাভাই অল্প বয়সী, ভালো মেয়ে খুঁজে এনে দিবে। তবে তুরাগ সেদিন তাদের কথায় কান না দিলেও জেবা আর তুরাগের মধ্যে মনমালিন্য অবশ্য খুব ভালো করেই সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি আলাদা হয়েছিল তাদের বিছানা। ভাগ্যিস তাদের বাবা তখন জীবিত ছিলেন! নইলে শেষমেশ হয়তো আর বাঁচানো যেতো না সেই সংসার। তুরাগ ভুললেও জেবা সেসব ভুলেনি। নারী মন তো! কে কখন কষ্ট দিয়েছে, আত্মসম্মানে আঘাত করেছে সব তারা মনে রাখে। সেই পাপের ফলই কী তবে পাচ্ছে তিথিয়া? অন্যের অনিষ্ট করতে গিয়ে শেষে কিনা নিজেরই অনিষ্ট হয়ে গেলো? এতকাল হীরে ভেবে কাঁচের ঘরে সংসার করছিল সে? এই কী তবে পাপের ফল?
শাহানা দৃঢ় কণ্ঠে পুত্রবধূর উদ্দেশ্যে বললেন,“তোমার সাথে আজ এমনটা হলে কী করতে তুমি?”
জেবার সহজ উত্তর,“এক সময় আমার সাথেও এমনটা হতে চলেছিল আম্মা। কিন্তু আমি তখন শক্ত হাতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সংসারের দায়িত্ব ফেলে বাপের বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকিনি। অথচ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। তারপরেও আপনার কথা মাফিক ধরে নিলাম, আমার সঙ্গে যদি এমনটা হতো তাহলে আমি মোটেও বাপের বাড়ি গিয়ে বসে বসে কাঁদতাম না। এতক্ষণে আপনার ছেলের এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ধর থেকে মুন্ডু আলাদা করে জেলে চলে যেতাম। কারণ ঠকবাজদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আর না নিজে সৎ থেকেও সারাজীবন কষ্টে তড়পাতে তড়পাতে ঠকবাজদের সুখে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে মহত্ত্ব আছে।”–আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ত্রস্ত হেঁটে প্রস্থান করল জেবা।
স্ত্রীর এমন রূপের সঙ্গে পরিচিত তুরাগ। প্রায়শই ঝগড়া লাগলে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয় তাকে। শুকনো ঢোক গিলে সেও পিছু নিলো স্ত্রীর।
পরিস্থিতি হয়ে গেলো একেবারে ঠান্ডা। যে যার মতো চলে গেলো ঘরে। শুধু নিচে রয়ে গেলো শাহানা, উথমী, আর তিথিয়া। উথমী এগিয়ে এসে হুইল চেয়ারে হাত রাখলো। মালতী ফুফুর উদ্দেশ্যে বললো, “ফুফু! আম্মা আর আপার খাবারটা আপনি আম্মার ঘরেই দিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আশফাক ভাই মিলিকে নিয়ে চলে আসবে। ওর জন্য গলদা চিংড়ি ভুনা করেছি। তা দিয়ে ভাত দিয়েন।”
“আইচ্ছা।”—বলেই রন্ধনশালার দিকে রওনা দিলেন মালতী ফুফু। তৈমূর ফেরার আগে তাকে ফোন করে বলেছিল,‘বুবুকে নিয়ে বাড়িতে আসছি। স্কুল শেষে ওরি, মিলিও চলে আসবে।’ সেই অনুযায়ী রান্নাবান্না সারতেই বাড়িতে আগমন ঘটেছিল জেবার।
দাদার বাড়ি এসেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে জোহান। জেবা বিছানায় এসে বসলো কেবল। তুরাগ দরজা পেরিয়ে ভেতরে এসে থামলো। রাগ দেখিয়ে বললো,“তুমি সবার সামনে কীসব বলে এলে হ্যাঁ? আমায় খুন করবে?”
“দুলাভাইয়ের মতো কাজ করলে করতাম। কিন্তু তুমি এখনি রেগে যাচ্ছো কেনো? সত্যি সত্যিই কিছু করেছো নাকি?”
“মুখ সামলে জবা ফুল! আমাদের বংশে এমন কাজ কেউ কখনো করেনি।”
“না করলেই ভালো। দোয়া করি, আল্লাহ সবসময় যেনো তোমার মাথা ভরতি এমন সুবুদ্ধি দিয়ে ভরিয়ে রাখেন।”
চুপসে গেলো তুরাগ।
তৈমূর গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়েই বিছানায় বসে আছে। শাশুড়িকে ঘরে নিয়ে ঠিকমতো বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলো উথমী। স্বামীকে এক নজর দেখে বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাথার ভেজা চুলগুলো মুছতে লাগলো। হঠাৎ এহেন কাজে মুখ উঁচিয়ে স্ত্রীকে দেখতে চাইলো তৈমূর কিন্তু তোয়ালের কারণে তা আর পারলো না। উথমী গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“মাথা ঠিকমতো মুছেননি কেনো? রোগ বাঁধাতে চাইছেন? এসব চিন্তা মাথায়ও আনবেন না বলে দিচ্ছি।”
“কেনো? সেবার জন্য তো বউ আছেই।”
“বউয়ের পেটে যে বাচ্চা দিয়ে রেখেছেন, সেকথা কী ভুলে বসেছেন? সেবা যত্ন করার দায়িত্ব আপনার।”
“আচ্ছা?”
“হুম।”—-থামলো উথমী। কণ্ঠস্বরের বদল ঘটিয়ে বললো,“আপনি আপাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন তাই না?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। প্রত্যুত্তর করল,“হ্যাঁ, কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এতগুলো বছর ধরে একজন মানুষ নিখুঁত অভিনয় কীভাবে করল? কেউ ধরতেই পারলো না? দুলাভাই যে এমন করবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি।”
“একটা প্রবাদ বাক্য আছে না? অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। এই ভদ্রলোক হচ্ছে সেই চোর। শুরু থেকেই একে আমার চরম অপছন্দ। সুযোগ পেলেই আমায় জড়িয়ে আপনাকে অপমান করতে ছাড়েনি। এমনকি বর্ষর সাথে জড়িয়ে কীসব নোংরা কথা বলে সম্পর্কে গিট্টু লাগাতে চেয়েছিল? খারাপ লোক একটা। দেখবেন কখনো এর ভালো হবে না। কাউকে ঠকিয়ে কেউ সুখে থাকতে পারে না। কিন্তু আপার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বেচারি যেমনি হোক, স্বামীকে সত্যিই ভালোবাসতো।”
এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না তৈমূর। নিচে ভাবী ভুল কিছু বলেনি। ডিভোর্স কোনো সমাধান নয়। যৌবনে এমন হলেও না হয় কিছু একটা করা যেতো। কিন্তু এই মুহূর্তে আলাদা হওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। গুরুজনদের নিয়ে পারিবারিকভাবে বৈঠকে বসে বোন, ভাগ্নিদের ভবিষ্যৎ আগে সুরক্ষিত করতে হবে। স্বামীর চুল মুছে দিয়ে পুনরায় তোয়ালে নিয়ে বাইরে মেলে দিয়ে এলো উথমী। জিজ্ঞেস করল,“নিচে গিয়ে খাবেন নাকি উপরে নিয়ে আসবো?”
“আপনি খেয়েছেন?”
“গোসলের আগে খেয়েছিলাম। আপাতত বিকেলের আগে আর খাচ্ছি না।”
“তাহলে দরজা আটকে দিয়ে কাছে আসুন।”
“কেনো?”
“খুব মাথা ব্যথা করছে। এই মুহূর্তে না ঘুমালে আর শান্তি নেই, আসুন।”
“আমার একদম ঘুম পাচ্ছে না। আপনি ঘুমান আমি মাথা টিপে দিচ্ছি।”
“লাগবে না। যেটা বলছি সেটা করুন। না ঘুমালে নেই কিন্তু শুয়ে থাকবেন।”
“এই অসময়ে দরজা আটকে শুয়ে থাকলে সবাই কী মনে করবে?”
“আমার থেকেও আপনার সবাইকে নিয়ে চিন্তা বেশি? কেউ কিছু মনে করবে না। সবাই জানে আপনি প্রেগন্যান্ট।”
আর দ্বিমত করল না উথমী। ধীর পায়ে গিয়ে ঘরের দরজা আটকে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে চলে এলো বিছানায়। বালিশে মাথা রাখতেই তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুঁজলো তৈমূর।
__________
দুপুরে তিথিয়া খেলো না। যেখানে অনুভূতিরাই কাজ করছে না সেখানে ক্ষুধা নিবারণ তো দূরের কথা! মেয়ের এমন অবস্থা দেখে শাহানাও ঠিকমতো খেতে পারলেন না। গলা দিয়ে নামলো না ভাতের দানা। শামীমের নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসড কল এসেছে। যা তিথিয়ার নজর এড়ায়নি। ওরি, মিলি স্কুল থেকে ফিরে খাবার খেয়েই জোহানকে বগল দাবা করে কোথায় যে খেলতে চলে গেলো? সে খেয়ালটাও তিথিয়ার নেই।
শাহানা হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ডাকলেন,“কাছে আয় দেখি আমার। এভাবে বসে থেকে লাভ কী? যা হয়েছে তা কী আর চাইলেই ঠিক করতে পারবি?”
অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকালো তিথিয়া। এগিয়ে এসে মাথা রাখলো মায়ের কোলে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, এই মুহূর্তে এটাই তার একমাত্র ভরসার স্থান। যেখানে মাথা রেখে সে তার দুঃখ বিসর্জন দিতে পারবে।
শাহানা পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। অভিজ্ঞ হাতে চুলের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে লাগলেন। এমন আদরমাখা স্পর্শে চোখে অশ্রু জমলো তিথিয়ার। দুই মেয়ের মা তিথিয়া ভুলে বসলো নিজের সত্তা। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের ছোঁয়ায় হয়ে উঠলো এক কিশোরী। কান্না আটকানোর প্রয়াস চালিয়ে ভারি কণ্ঠে অভিযোগের সুরে বললো,“আমায় কেনো এতো আদর যত্নে বড়ো করলেন আম্মা? কেনো আমায় সংসার শেখালেন না? কেনো আপনার মতো একজন আদর্শ স্ত্রী, পুত্রবধূ হওয়া শেখালেন না?যখন হাজারটা অভিযোগ নিয়ে বাড়িতে এসে নালিশ করতাম তখন কেনোই বা ধমক দিয়ে বলেননি, বিয়ের পর স্বামীই হচ্ছে মেয়েদের ভূষণ? আপনি যদি সঠিক সময়ে আমায় শাসন করতেন, আমার অন্যায় আবদার মেনে না নিতেন তাহলে কী আজ আমায় এই দিন দেখতে হতো?”
বলতে বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তিথিয়া। পুনরায় বলতে লাগলো,“আমি যেমনই হই না কেনো আম্মা, ওদের বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি। বিশ্বাস করুন আম্মা, শিহাব যেদিন মারা গেলো সেদিন ওরির দাদী, ফুফু আমায় কত কটু কথা শুনালো! এমনকি আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য আমাকেই দায়ী করল। আপনিই বলুন আম্মা, মা কখনো নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে? কিন্তু ওরা সেসব ভাবলো না। দিনে দিনে সন্তান হারানো এক মাকে ওরা মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে লাগলো। তখন আপনাদের জামাই একবারও আমার হয়ে একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না। আপনারা না থাকলে হয়তো সেদিন আমার ঠাঁই হতো কোনো এক পাগলা গারদে। অথচ ও সবার সামনে আমার দোষগুলো কত অবলীলায় তুলে ধরলো? নিজে তো ঠিকই নতুন করে সংসার পেতে বাচ্চার বাবা হয়ে গেলো। এক সন্তানের কষ্ট অন্য সন্তান দিয়ে ভুলে গেলো। কিন্তু আমি? আমি তো আম্মা ভুলতে পারিনি। শিহাব মারা যাবার ছয় বছর পর ওরি এলো আমার পেটে। কিন্তু এই ছয় বছর তো আমি ভালো ছিলাম না আম্মা? তবুও ওর প্রতি কোনো অভিযোগ করিনি। আমি মানছি আমারও ভুল ছিলো কিন্তু সে তখন কেনো তা শুধরে দিলো না? আমি তো ওর সব কথা শুনতাম। বিশ্বাস করুন আম্মা, আমি এখনো ওদের বাবাকে ছাড়তে চাই না কিন্তু যখন মনে পড়ে আমি ছাড়াও তার জীবনে অন্য কেউ আছে তখনি বুকে ব্যথা করে আম্মা। মনে হয় আমি আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না।”
কণ্ঠনালী দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হলো না তিথিয়ার। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে তার। শাহানার চোখেও আজ অশ্রু টলমল করছে। মেয়েকে তিনি কখনো কষ্ট পেতে দেননি। ভীষণ আদরের মেয়ে উনার। প্রথম সন্তান যে! সেই মেয়ে এভাবে কাঁদছে? নিজের অনেক খামতিও মস্তিষ্ক স্মরণ করাচ্ছে উনাকে। সত্যিই মেয়েকে যদি আরেকটু শক্ত হাতে সংসারি বানাতে পারতেন? সাথে মন থেকে চলে আসছে শামীমের জন্য বদদোয়া। এক মায়ের বদদোয়া!
চলবে __________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)