প্রিয় পৌষমাস পর্ব-০২

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

শান্ত ও স্থবির হয়ে সৌরব খাটে হেলান দিয়ে বসেছে। মুখে গম্ভীরতার ছাপ স্পষ্ট। প্রিয়া স্বামীর গম্ভীরমুখ দেখে অবাক হল। কিছুসময় পূর্বেও বেশ শান্ত দেখাচ্ছিল। আচমকাই এত গম্ভীর হওয়ার কারণটা কি তার? স্বামীর পাশে গা ঘেঁষে বসল সে। হাতে হাত রেখে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার? এত কি ভাবছেন?’

সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শান্ত গলায় ফুটে উঠল তার আক্ষেপের সুর।
‘প্রিয়ারানী, আরাভ সরাসরি নাকোচ করে দিয়েছে। সে পৌষীকে বিয়ে করবে না। ভাই শেষ একবার জিজ্ঞেস করেছিল তাকে।’

প্রিয়া পুরো কথা শুনল শান্তভাবে। কিছুসময় বাদে সেও জবাব দিল তার।
‘এজন্যই আপনি এত হতাশ হয়ে আছেন। দেখুন, ওরা বড় হয়েছে। দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। এখন ওদের নিজস্ব একটা রুচিবোধ আছে। আমি আরাভের রুচিবোধকে সম্মান করি। আপনারও তার রুচিবোধকে সম্মান করা উচিৎ।’

‘প্রিয়ারানী, ব্যাপারটা তা নয়। আমার মেয়েটা কেমন শান্ত-গম্ভীর হয়ে গেছে দেখেছো। সেই চঞ্চলতা তার মাঝে একদমই নেই। আগের মত আমার মেয়ে সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে বেড়ায় না। মাত্র বিশ বছর বয়সেই একদম বুঝদার হয়ে গেছে। তাকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে বেশি। ও মানতে পারবে তো!’

‘সময় মানুষকে ঠিক করে দেয়। কিছুদিন সময় তো লাগবেই। তবে পৌষীর জীবনেও এমন কেউ আসুক তাকে হাসিখুশিতে রাখার জন্য, সেই দোয়া তো করতে পারি। আপনি একটা কাজ করুন, পৌষীর জন্য এখন থেকে ভালো পাত্রের সন্ধান করুন। দেখবেন তার জীবনে সত্যিকার কেউ একজন মানুষ আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সৌরভ নিরুত্তোর। সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে যাবে। তার মেয়ে আগের মতই হয়ে যাবে? বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। মাথায় ঘুরপাক করা ভাবনাগুলোকে আপাতত ছুটি দিল সে। ঘুমাতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য।
__

মধ্যরাত। ঘুমের অতলে যান্ত্রিক নগরের বাসিন্দারা। অথচ পৌষীর চোখে ঘুম নেই। বারান্দার দরজা হাট করে খোলা। তার দৃষ্টি আকাশ সীমা ভেদ করে জ্বলজ্বল করা এক ক্ষুদ্র তারার উপর। যে একাকী আকাশের বুকে নীরবে আলো ছড়াচ্ছে। অজান্তেই সে তারাকে নিজের মনোভাব প্রকাশ করল,

‘তুমিও কি একা, তোমার উপরও কারো অভিমান জমে আছে? সেও কি আর তোমাকে চায় না। প্রচন্ড ঘৃণা করে? জানো, আমাকেও কেউ একজন প্রচন্ড ঘৃণা করে। সে যাওয়ার আগে শেষবার বলে গিয়েছে,
পৌষমাস আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তোকে ঘৃণা করে যাব। তুই আমার আপন কেউ না। তোকে আমি ঘৃণা করি।’

দু’চোখ ছলছল তার। এটাই তো চেয়েছিল সে কোন একদিন। তাহলে আজ কেন এত কষ্ট পাচ্ছে? বুকেও প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে? তবে কি সে আজও তার আরাভ ভাইকে খুঁজে বেড়ায়? কিন্তু তাতে কি লাভ? তার আরাভ ভাই নতুন অধ্যায় খুঁজতে ব্যস্ত। সে যে তার আরাভ ভাইকে কঠিন কষ্ট দিয়েছে। বারান্দা ছেড়ে টেবিলে গা এলিয়ে বসেছে সে। সহসাই চোখ পড়ল নীল ডায়েরির মাঝে। দু’পাতা উল্টাতে মনে পড়ল তার রঙিন সেসব দিনের কথা। চোখ বুঝল সেই অতীতের মাঝে।

অতীত,,,

শুক্রবার ছুটির দিন। তবে মাসে একবার করে এদিনে বাড়িতে ভোজনের বিশাল আয়োজন হয়। বড় পাপা, ফুপ্পি, খালামনি, মামা, তার পাপার বন্ধুরা সবাই আসে তাদের বাসায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। ছাদের এককোণে বসানো হয়েছে প্যান্ডেল। অন্যপাশে তার পাপার শখের বাগান। অবশ্যই এ বাগানের দায়িত্ব এখন তার আর আরাভের উপর। কিন্তু তার পাপা মাঝেমধ্যে দেখভাল করে, এই যা।

ঘরভর্তি অতিথিতে পূর্ণ। পৌষীর থেকে মাত্র তিন মাসের ছোট প্রীতির মেয়ে সাফা। সে এসে পৌষীকে খুঁজল সবার আগে। সে আর পৌষী একই ক্লাসে। তার সাথে আছে পরশের ছেলে পার্থ। তিনজনই স্কুলে খুব ভালো বন্ধু। একদম জানে জীগার। সাফা ঘরে এসে দেখল, পোষী তার ঘরে নেই। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হল। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে গেল সে। ছাদে গিয়েই তার চক্ষুচড়ক। পৌষী তার বড় পাপার সাথে কাজ করছে। একদম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। হা হয়ে দেখছে সব।

গৌরব নিজেও মাঝেমধ্যে বুঝতে পারে না। পৌষী তার মেয়ে না। মেয়েটা সারাক্ষণ তার আশেপাশে থাকে। একদম পায়ে পায়ে কদম মিলিয়ে চলে, তা অবশ্যই বিপদে পড়লে। আজ আরাভ তাকে একা পেলে শাস্তি দিবে। সে ভয়ে তার বড় পাপার আশ্রয়ে বসে আছে।
গৌরব মিটমিট করে হাসছে দু’জনকে দেখে। এখন সবজি কাটছে তার সাথে।
পাশে আরাভও নিজ কাজে মগ্ন। তবে আরাভ পোষী দু’জন দুজনকে আড়চোখে দেখছে। আরাভ সুযোগ বুঝে তবেই পৌষীর মজা নেবে। এই মেয়ে এত বড় হয়েছে তাও বাচ্চাদের মত দুষ্টুমি করে। মাঝে মাঝে পৌষীর দিকে তাকিয়ে সে কুটিল হাসে। পৌষী বুঝতে পারে না, এই সংকর জাতী তাকে দেখে এমন করে হাসছে কেন? কোন খিচুড়ি পাকাচ্ছে কে জানে? তার বড় পাপার পাশে বসে থাকলেও ভয়ে গুটিয়ে আছে সে।

দুপুর হওয়ার আগে সকল রান্নার কাজ শেষ। জুম’আর নামাজের সময় হতেই পুরুষ’রা মসজিদে চলে গেল। পৌষী সমবয়সী ও বাচ্চাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। শোভার মেয়ে কিনান, আরিবা, সাফা আরও অনেকেই আছে তার সাথে। ভোজনের আয়োজন শুরু হওয়ার আগে মেয়েরা নিজেরা তৈরি হতে ব্যস্ত। এদিকে পৌষীর তাতে হুঁশ নেই। সে আছে তার আড্ডা নিয়ে। প্রিয়া এসে যখন রামধমক দিল, তখন দু’ঠোঁট উল্টো করে নিজের রুমে ছুটল। কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে টপস আর প্লাজু পরে আবার ফিরে এল। মাথার কাঁধ বরাবর চুলগুলো ভেজা, চুলের পানি পড়ে পিঠের অংশ ভিজে যাচ্ছে তার। গায়ের ওড়না টেনেটুনে গায়ে আছে কোনোভাবে।

জুম’আর নামাজ শেষে পুরুষগণ ফিরে এসেছে। পার্থ এসে পৌষীদের সাথে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে। কথার মাঝে সাফা, পৌষী খিলখিল করে হাসছে। আরাভ দরজার চৌকাঠে পা রেখেছে সবেমাত্র। পৌষীর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে দাঁতে দাত পিষল সে। সবার সামনে এসে আরাভ গলা খাঁকারি দিল। বিদ্রুপের সুরে বলল,

‘বুঝলাম না তোদের মতিগতি? তোরা খেতে এসেছিস না’কি ভিক্ষে করতে? আমাদের পৌষমাসকে দেখ, মনে হয় কোনো এক বস্তি থেকে উঠে আসা রাস্তার পাগলী। এজন্য গায়ে ভেজা পুরনো জামা, জুতা জোড়াও মনে হয় কারো কাছ থেকে ধার করা। হ্যাঁ,রে পৌষমাস তোর কাছে জামা-কাপড়ের বড্ড অভাব দেখছি। তা আমাদের পার্থকে বললেও তোকে একজোড়া জামা কিনে দিত।’

পার্থর দিকে চোখে চোখ রেখে জবাব দিল আরাভ।

পৌষীর চোয়াল শক্ত হল মুহুর্তে। এসব কিছুই তাকে অপমান করার জন্যই বলেছে সংকর জাতী। সে পুরনো ভেজা জামা পরলে তার কি সমস্যা! দাঁত কটমট করল কিছুসময়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয়ার আগমন হল। পৌষীর এমন বেশভূষা দেখে সে আরেকবার চেঁচালো। পৌষী বিড়ালের মত চুপচাপ নিজের রুমে ফিরে গেল। তার রণচণ্ডী মা সারাক্ষণ তাকে বকে। অর্ধেক তার ঐ সংকর জাতীর জন্য। মনের দুঃখ মনে চেপে নিজের পোশাক বদলালো।

সন্ধ্যা নামার আগেই সব অতিথি বাসায় ফিরে গেছে। তবে সাফা রয়ে গেছে। কাল স্কুল শেষে সে বাসায় ফিরে যাবে। দুজনেই একসাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। তাদের সাথে আরিবাও আছে। মোবাইলে লুডু খেলছে তিনজনে মিলে। হঠাৎই বসার ঘর থেকে সৌরভের ডাক শোনা গেল। পৌষী হকচকিয়ে খেল। এ অসময়ে তাকে ডাকছে কেন? খেলায় টান টান উত্তেজনা চলছে। এখন কিভাবে উঠবে সে। তাই অপেক্ষা করল আরও কিছু সময় পর যাবে তার বাবার কাছে। কিন্তু তখন পূর্ণী এসে বলল,

‘আপু তোমাকে ডাকছে আব্বু। জলদি যেতে বলেছে।’

পৌষী বিরক্ত হল। জবাব দিল তিরিক্ষি স্বরে,
‘যা তো এখন। পাপাকে বল একটু পর আসছি।’

পৌষীর খামখেয়ালিপনা দেখে পূর্ণী হতাশ হয়ে ফিরে গেল। এর মাঝে সৌরভ আরেকবার ডাকল। এবার বেশ কড়াভাবেই ডাক পড়ল তার। পৌষী না পেরে নিজের খেলা ছেড়ে বসার ঘরে ছুটে এল। কিন্তু এসেই দেখল তার পাপা রক্তচক্ষু নিয়ে বসে আছে। পৌষী ভয় পেল। তার পাপা এমন করে বসে আছে কেন? কিন্তু হাতের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠল? এটা কি? তার প্রফেসর বাপ কি আজ তাকে বকবে না’কি মেরে দিবেই। কি হবে আজ তার!

আচমকাই চোখ পড়ল আরাভের রুমের দিকে। আরাভ দরজার সামনে দাঁড়ানো সটান হয়ে। মুখে কুঠিল হাসি ঝুলছে। পৌষীর মনে খটকা লাগল। এই সংকর জাতী কিছু করেছে। নয়ত তার প্রফেসর বাপ এত রাগবে কেন?

চলবে,,