প্রিয় পৌষমাস পর্ব-৫+৬

0
3

#প্রিয়_পৌষমাস ৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ঘরের ভেতর হুলুস্থুল কান্ড। নাজমা সবাইকে ডেকে ডেকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। আজ তার বাবার বাড়িতে নেমন্তন্ন পড়েছে পুরো পরিবারের। তার বড় ভাইয়ের মেয়ের ঘরের নাতনী এসেছে। তার ভাতিজী প্রথমবার নানী হল। তার বড়ভাই হল বড় নানা। সেই খুশিতে বিশাল আয়োজন চলছে তার বাবার বাড়িতে। তাকে রাতের বেলায় মুঠোফোনে দাওয়াত দিয়েছে। এত আনন্দের মাঝেও তার বড্ড আফসোস হল। আক্ষেপের সুর তুলে নিজমনে আওড়ালো, তার ঘরেও তো নাতি-নাতনী আছে। কিন্তু সে কখন বড়দাদু হবে। সে গৌরবকে ডাকল।

‘দেখলি বাপ, আমার বড় ভাই বড় নানু হয়ে গেল। কিন্তু আমার কপাল দেখ। আমার এত নাতি-নাতনী কিন্তু আমি কখন বড় দাদু হবো।’

গৌরব মায়ের কথায় থ’ হয়ে গেল। তার মা কীসব আবোল তাবোল বকছে। বুড়ো বয়সে পাগল-টাগল হয়ে গেল না’কি? সে নিজমনে হায় হায় করল। মায়ের কথার জবাব দিল হাসতে হাসতে,

‘আম্মা কীসব বল এগুলো? তোমার নাতী এখনো প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, আর পৌষী এখনো পিচ্চি। এত তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ে হবে না মা। তার উপর তোমার নাতী এখনো বেকার। তোমার ছোট ছেলে বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দেবে না, বুচ্ছো।’

নাজমা তেতে উঠল, ‘কিসের বিয়ে দিবি আবার? ছোট বেলায় তো বিয়ে দিলি, এখন আবার বিয়ে-শাদি লাগবো না’কি? দু’জন একলগে থাকলে তো হয়।’

গৌরব জ্বিহ্বা কামড় দিল। মাথা দুলিয়ে জবাবে বলল,
‘কি যে বল না, ছোটবেলায় মজারচ্ছলে ওদের কালেমা পড়িয়েছি, ওটা কি আর বিয়ে হবে? দু’জনই বিয়ে সম্পর্কে অজ্ঞাত। ওরা তো জানতোই না বিয়ে কি তখন?’

‘বিয়ে যেমনে দিস, মজা করে কর আর সত্যি করে কর। ওটা বিয়েই ছিল। তখন দু’জনে তো হাসতে হাসতে কবুল বলেছিল।’

‘মা, তখন তো দু’জনে পিচ্চি। একজনের আটবছর, অন্যজনের পাঁচ বছর। বিয়ে কি সেটা কি আর বুঝত না’কি। তাই মজায় মজায় জবাব দিয়েছিল।’

‘কিন্তু, এখন কি তাদের বলা উচিৎ না।’

‘মা, এখনো সেই সময় আসেনি। আরও পাঁচ-ছয় বছর পর তাদেরকে বলব। এত জলদি বললে সমস্যা হবে।’

‘এতদিন আমি বাঁচব? তোর বাপটাও নরম হয়ে গেছে। কোনদিন মরেটরে যায়, ঠিক নাই। আমাদের বেঁচে থাকা অবস্থায় ওদের সংসার দেখাবি না, বাপ।’

গৌরবের চোখ ছলছল। মায়ের মুখে মরণের কথা শুনে তার বুকটা ধুকপুক করছে। কষ্ট হচ্ছে ভাবতে। কিন্তু সে নিরুপায়। পৌষীটা এখনো ছোট, আরাভটাও অপ্রাপ্তবয়স্ক। তার উপর দু’জন দু’জনকে মানবে কি’না তাও সন্দেহ। কেমনে কি হবে তার মাথায় আসছে না। তবুও মায়ের কথায় সান্ত্বনার বাণী ছুঁড়ল,

‘আচ্ছা দেখি মা, কি করা যায়? এখন জলদি তৈরি হয়ে নাও। আবার দেরি হয়ে যাবে।’

নাজমা কিঞ্চিৎ হাসলেন। তবে ছেলের কথায় সন্তুষ্ট নন। তাকে কিছু করতে হবে। সুযোগের অপেক্ষায় রইল সে।

বসার ঘরে তৈরি হয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আরিবা, পূর্ণী স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে। তারা নিচে নেমে পড়েছে আগে আগেই। কিন্তু পৌষী এখনো ফিরেনি। সৌরভ নিচে গাড়ি বের করছে। গৌরব মালপত্র নিয়ে নিচে গেছে একটু আগে। প্রিয়া এর মাঝে বলে উঠল,

‘পৌষী তো এখনো ফেরেনি? সে’তো বাসায় একা থাকবে। আমাদের জলদি ফিরতে হবে তাহলে।’

প্রিয়ার কথায় নাজমা তেতে উঠলেন। কঠিন গলায় জবাব দিল,
‘তোমাদের ফিরতে হবে কেন? আরাভ তো আছেই। সে পৌষীকে দেখবে। আরাভের কাছে পৌষীর জন্য খাবার পাঠিয়ে দেব।’

প্রিয়া তব্দা খেল। কিন্তু পৌষী আরাভ দু’জনেই এখনো ছোট। এত জলদি এদের কাছে রাখা ঠিক না। সে চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। নরম সুরে বলল,

‘কিন্তু আম্মা, ওরা তো এখনো ছোট।’

‘কিসের ছোট! সমস্যা নাই। একটু একটু করে কাছে আসতে দাও। দু’জনের মাঝে দূরত্ব কমাও।’

নাজমার কথাগুলো প্রিয়ার পছন্দ হল না। ওদের সম্পর্ক ঠিক করার মত বয়স তাদের এখনো হয়নি, যথেষ্ট কম। এত জলদি কাছে আসা মানে, নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনা। সে ফের কিছু বলতে চাইল। আলিশবা ইশারায় তাকে চুপ হতে বলল। প্রিয়া বুঝতে পারল কি বলতে চায়। তার শাশুড়ী যত সহজ ভাবছে তত সহজ নয় এসব কিছু। এর ভুক্তভোগী সে নিজেই। মন খারাপ নিয়ে সে গাড়িতে বসল। কিন্তু মন পড়ে আছে তার মেয়েটার কাছে, কখন বাসায় ফিরবে সে চিন্তায়।
__

দুপুরের তেজ কিছুটা কমতেই পৌষী বাসায় ফিরে এল। আজকের আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই কোথাও। তাই তো নির্বিঘ্নে বাসায় ফিরে এসেছে। কিন্তু বাসায় এসে প্রথমে এক ঝটকা খেল। দরজার মাঝে বেশ বড়সড় তালা ঝুলছে। কালরাতে বলতে শুনেছে সবাই তার দাদুর বাবার বাড়ি যাবে। কিন্তু তার মা তাকে নিয়ে যায়নি। স্কুল মিস দিয়ে কোথাও নিয়ে যায় না। তার মন খারাপ হল। মন খারাপ হলে সে সোজা ছাদে উঠে যায়। আজও তাই করল।

ছাদের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে আছে। ফুল আর প্রজাপতির সাথে গল্প করছে পৌষী। দুষ্ট প্রজাপতি তার হাতে ধরাই দিচ্ছে না। সে নিজমনে কঠিন প্রতিজ্ঞা করল। আজ প্রজাপতি ধরেই ছাড়বে, যেভাবেই হোক। প্রজাপতি ধরতে এত মনোযোগী হল, বাসায় যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে বসল সে। কত সময় পেরিয়েছে তাও জানা নেই। সহসাই আরাভ বিদ্যুৎ গতিতে এসে পৌষীকে দাঁড় করিয়ে কষে এক চড় মারল।

আচমকাই পৌষী চড় খেয়ে হতভম্ব। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। ছলছল চোখে তাকাল আরাভের দিকে। আরাভ ভাই তার গায়ে হাত তুলেছে। তার তো এমনিতেই মন খারাপ, তার উপর আরাভও তাকে চড় বসালো। সে মুখে কিছু না বলে ছুটে চলল বাসার দিকে। তার পিছু পিছু নেমে পড়ল আরাভও। কিন্তু পৌষী তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দ্রুতই ছুটে এল আরাভও। তার আগেই শব্দ করে পৌষী নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। আরাভ বার কয়েক দরজায় করাঘাত করেই গেল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পৌষী দরজা খুলল না।

আরাভ ভয় পেল ভীষণ। দুপুর থেকেই পৌষী অভুক্ত, এখনো পেটে দানাপানিও পড়েনি। ঘড়ির কাটায় চার’টা বাজতে চলল। পেটে খিদে নিয়ে এভাবে কখন থেকে বসে আছে মেয়েটা। সে দরজায় দাঁড়িয়ে নরম সুরে ডাকল,

‘পৌষী আমার কথাটা শোন, দেখ আমি ইচ্ছে করে মারিনি। মাথা গরম হয়ে গেছিল তখন। তুই জানিস, তোকে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা ধরে খুঁজতে খুঁজতে আমি অস্থির হয়ে গেছি। সেই দুপুরে দরজায় এসে দেখি তুই এখনো ফিরিস নি, তাই স্কুলে ছুটে গেলাম তোকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি স্কুল পুরো খালি। সবার ছুটি হয়ে গেছে। তুই নেই। তাই তোর বান্ধুবীদের বাসায়ও গিয়েছি তোকে খুঁজতে। পথে-ঘাটে সব জায়গায় খুঁজেছি। তারপর বাড়ির দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, তুই ফিরেছিস আরও দেড় ঘন্টা আগে। আমার মাথা তখন এত গরম হল। কিন্ত বাসায় এসে দেখি দরজার সামনে তুই নেই। সব ভাড়াটিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। শেষে একজন বলল, তোকে ছাদে উঠতে দেখেছে। তুই ভাব একবার, তোকে পাগলের মত কতবার খুঁজেছি আমি। প্লিজ মাফ করে দে না এবার। আমার ভুল হয়ে গেছে।’

পৌষীর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আরাভ ফের বলে উঠল,
‘আচ্ছা আমি তোকে থাপ্পড় মেরেছি তো, যা তুইও আমাকে একটা মেরে শোধবোধ করে নেয়। তাও বেরিয়ে আয়। জলদি খেয়ে নেয়। আমি তোর জন্য খাবার গরম করে আনছি।’

পৌষী নাক টেনেই যাচ্ছে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আরাভ তাকে কেন মারল? সে’কি জানত না’কি তার আরাভ ভাই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে তো তালা বন্ধ দেখে ছাদে গিয়েছে। নয়ত কখনো এই সময় ছাদে যেত না। দুপুরে সেই কখন তার খিদে পেয়েছিল। এখনো তো পেট ছোঁ ছোঁ করছে খিদেয়। বাইরে থেকে ফের একবার আরাভের বলা বাক্য ভেসে এল।

‘দেখ পৌষমাস, আমি কান ধরেছি। তাও বের হ।’

আরাভ দু’কানে দু’হাত দিয়ে সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। পৌষী নিজের মুটোফোনের ক্যামেরা অন করল। চটজলদি দরজা খুলে কয়েক খানা ছবি তুলে নিল আরাভের। পৌষীর এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে আরাভ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। কিন্তু মুখ খুলে দ্বিতীয় কোন বাক্যে বিনিময় করল না। আবার যদি এই মেয়ে রেগে যায় তার আর রক্ষে নেই। পৌষী নিশব্দে হেঁটে খাবার টেবিলে বসল। আরাভ শুধু হা’ হয়ে পৌষীর কাজ দেখছে। খাওয়া শেষে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল মাত্রই।

আরাভ তার সামনে পথ আটকে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলে উঠল, ‘তুমি এখনো আমার উপর রেগে আছো?’

পৌষী কিঞ্চিৎ অবাক হল। আরাভ সবার সামনে তুমি বললেও সবার পেছনে কিন্তু তুই ডাকে। তাহলে এখন তুমি ডাকছে কেন? সে অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল আরাভের দিকে। আরাভের চাউনি কেমন যেনো অদ্ভুত ঠেকল। তার ছোট্ট মাথায় বুঝতে পারল না এই চাউনিতে কি ছিল? সে পায়ের কদম বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। পেছন থেকে আরাভ আবারও বলে উঠল,

‘সর‍্যিই পৌষমাস, আর কখনো এমন হবে না।’

পৌষী নিজের মাথা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে জবাবে বলল, ‘হুমম।’

আরাভ হাসল নিভৃতে। পৌষী না দাঁড়িয়ে নিজের গন্তব্য ছুটে গেল। রুমে আসতে দেখল তার মুঠোফোন কম্পিত হচ্ছে। স্ক্রিনে অপরিচিত এক নাম্বার ভেসে আছে। কিছুটা অবাক হল। রিসিভ করতেই তব্দা খেয়ে গেল সে।

চলবে,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৬.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

পৌষীর মুখে হাসি ফুটল। এত সময় তো চুপসে যাওয়া আঙ্গুরের মত মুখ করে রেখেছিল। তার আরাভ ভাইকে আজ বেশ জব্দ করেছে সে। কিন্তু ফোনের ওপাশে তিতলির কথা শুনে মুখ টিপে হাসল। তিতলি তাকে নিচে যেতে বলল। নিচে যাওয়ার বায়না আসতেই সে উল্টো আবদার করে বসল। তার বাসা খালি আছে, চাইলে সে উপরে আসতে পারে। তিতলি খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল। এত মেঘ না চাইতে জল। সে তো অবশ্যই আসবে। তিন মিনিট বাদে বাসার কলিংবেল বাজল। আরাভ উঠার আগে পৌষী গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। বসার ঘর থেকেই আরাভ সজাগ দৃষ্টি ফেলল। বুঝার চেষ্টা করল দরজার সামনে পৌষী কার সাথে হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে কথা বলছে।

পৌষী তিতলিকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল। সোফায় বসা আরাভের হেলদোল নেই। তার পূর্ণ মনোযোগ তখন টিভির স্ক্রিনে। সে ফুটবল খেলা দেখছে। ব্রাজিল – আর্জেন্টিনার বাঁচা-মরার লড়াই চলছে পুরোদমে। তিতলি এসেই আশাহত হল। তাকে একটুও তাকিয়ে দেখল না। সে কি সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে। গায়ে কালো জামা পরেছে। সে পৌষীর কাছে শুনেছে আরাভের প্রিয় রং কালো। সেই থেকে তার নিজেরও প্রিয় রঙ কালো। সবকিছু সে কালো রঙের কিনে রাখে। জামা থেকে শুরু করে তার বিছানাও সে কালো রঙের রেখেছে। কিন্তু আশাহত হলেও সে হাল ছাড়ল না। আরাভের এটেনশন তার চাই চাই। আরাভের পাশের সোফায় গিয়ে বসল। খেলার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা চলছে বুঝি। আচ্ছা আপনি কোন দল করেন আরাভ ভাই।’

আরাভ জবাব দিল না তার, না ফিরে তাকাল। গম্ভীরমুখে টিভির দিকে নিজর দিয়ে আছে। তিতলি ফের কিছু বলতে চাইল, তার আগে পৌষী স্বজোরে আওয়াজ দিল ড্রাইনিং রুম থেকে,

‘আর্জেন্টিনা।’

তিতলির মুখের কোণে তখন খুশি উপচে পড়ছে। হুট করে বলে উঠল, ‘জানেন, আমিও আর্জেন্টিনা।’

আরাভের মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল মুহুর্তে। টিভি বন্ধ করে সোফা ছেড়ে উঠল সে। দ্রুতই প্রস্থান করল সেই জায়গাও। তিতলি হতভম্ব পুরো। সে কি কোনো অন্যায় করল না’কি? ভালো কথায় তো বলেছিল। আরাভের চলে যাওয়ায় দিকে তাকাল হতাশ মুখে।

পৌষী এক বাটি পপকন নিয়ে এল। দু’জন মিলে খাবে আর গল্প করবে। সাথে দু’জনে অ্যানিমেশন মুভিও দেখবে। পুনরায় টিভি অন করল। পাশে রাখা পপকন বাটি, মুঠো ভরে দুজনে নিল মাত্রই। আচমকাই পাশের সোফায় দপ করে শব্দ হল। হুট করে এসে আরাভ পৌষীর পাশে বসেছে। পপকনের বাটি নিজের দিকে টেনে মুঠোভর্তি পুরে নিয়েছে সে। পৌষী মুখ কুঁচকে তাকাল। চোখে তার অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে যেন। কত কষ্ট করে এক ঘন্টা সময় নিয়ে পপকন ভেজে এনেছে সে। আরাভকে বলেছিল পপকন ভেজে দিতে। অথচ সে সরাসরি বলেছে, পারবে না। এখন তার পপকন খেয়ে নিচ্ছে। পৌষী রাগের ছোটে বলে উঠল,

‘আমার পপকন খাচ্ছো কোন সাহসে?’

আরাভ দায়সারা জবাব দিল, ‘তোর পপকন? নাম লিখা আছে। দেখা তো?’

‘আরাভ ভাই।’
কোপিত গলায় বলে উঠল পৌষী।

আরাভের হেলদোল নেই। সে শব্দ করে চিবিয়ে চিবিয়ে পপকন খেয়ে যাচ্ছে। কথায় না পেরে আরাভের হাত চেপে ধরল পৌষী। তার হাতের পপকনগুলো নেওয়ার জন্য নিজের হাত দিয়ে বলপ্রয়োগ করল। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হল সে। তখনি আরাভ এক ভ্রু উঁচিয়ে ধরল পৌষীর দিকে। চুকচুক শব্দ তুলে ইশারার বলে উঠল,

‘আহারে! বেচারী।’

পৌষী তেতে উঠল ফের। নিজের মুখ দিয়ে লালা বের করে আরাভের হাতের উপর মুখ বসালো। কিন্তু আরাভ ভ্রুক্ষেপহীন। সে পৌষীর ওড়না টেনে নিজের হাতের থুথু মুছে বাকি পপকন মুখে পুরে দিল। পৌষী অবাক হল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

‘ইয়াক! কি খবিশ তুমি। থুথু মেশানো পপকন খেয়ে নিলে।’

জবাব না দিয়ে বিনিময়ে আরাভ মুখ টিপে হাসল শুধু। পৌষী ভেঙচি কাটল রাগে। পাশে বসা তিতলি হা হয়ে আছে এদের ঝগড়া দেখে। তবে মনে মনে বেশ রাগ হল পৌষীর উপর। সে কেন আরাভের এত কাছে বসেছে? আরেকটু দূরে বসত। আরাভের হাতে কেন সে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বিষয়টা তাকে বেশ ভাবালো। শেষে নিজের বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে বলে উঠল,

‘পৌষী তুই আরাভ ভাইয়ের হাতে থু থু ছিটালি কেন?’

পৌষী চকিতে ঘাড় ঘুরাল। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকিয়ে বিদ্রুপের সুর তুলল মুখে,
‘তোর আরাভ ভাই! সেটা আবার কখন হল?’

আকস্মিক আসা এমন প্রশ্নে তিতলি থতমত খেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘তোর ভাই, আমারও ভাই।’

পাশে থাকা আরাভ যেনো মোক্ষম সুযোগ পেল কথা বলার। হুট করে উত্তর দিল তিতলির,
‘আমি অন্য কারো ভাই নয়, শুধু আরিবার ভাই। আমার একটাই বোন শুধু। আর পৌষীকে বোন বলে তো মানিই না। তাই সে আমার বোন, একদমই নয়।’

‘মানবে কেন? তুমি হিংসুটে একটা। অথচ আমার বানানো পপকন খাও।’
পৌষীও তেতে জবাব দিল।

‘তা তো খাবোই, তোর সবকিছুতে সবার আগে আমার অধিকার।’
চটজলদি আরাভও জবাব দিল পৌষীর।

তিতলি ফের অবাক হল। এরা ঝগড়াই করছে শুধু। তার মত জলজ্যান্ত একজন মানুষ পাশে বসে আছে অথচ তাদের হুঁসই নেই। সে গলা খাঁকারি দিয়ে মনোযোগের চেষ্টা করল। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হল সে। পৌষী আরাভের ঝগড়া চলমান তখনো। নিজমনে আক্ষেপের সুর তুলল। সে কেন পৌষী হল না? দুজনের এমন খুনশুটি তার বুকে কাঁটার মত বিঁধল। সে পৌষীকে ডাকল।

‘আমি চলে যাব পৌষী।’

তড়াক করে জবাব এল পৌষীর, ‘একদমই না।’

পৌষী আরাভের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। পপকনের বাটি নিজের হাতে রেখে তিতলিকে বলল,
‘রুমে চল, এখানে আর বসব না। এখানে একটা পেটুক বসে আছে। তার সাথে বসলে সব ওর পেটে চলে যাবে।’

‘মনে হয় তোর রুম আমি চিনি না, না তোর রুমে যেতে পারব না।’ তড়িৎ জবাব দিল আরাভ।

পৌষী ভাবতে পারে না মানুষ এত ছ্যাচড়া কেমনে হয়। এজন্যই সে আরাভকে দেখতে পারে না। তার সবকিছুতে ভাগ বসাবে। নির্লজ্জ একটা। নিজমনে কিছু গালিও ছুঁড়ল। অথচ আরাভ নির্লিপ্ত, মুখ টিপে হাসছে তখনও। রাগে গজগজ করে পৌষী নিজের রুমে ঢুকল। আরাভ টিভি বন্ধ করে সে নিজেও প্রস্থান করল। তিতলি আফসোসে পুড়ল আরও একবার।
__

রাত বাড়ল। তিতলি বাড়ি চলে গেছে। পুরো বাসায় আরাভ পৌষী ছাড়া আর কেউ নেই। সুনসান নীরবতায় আচ্ছন্ন বিরাজমান বাড়ি জুড়ে। রাত আটটার দিকে ফোনকল এল গৌরবের। তার বড় মামা হাসপাতালে। হঠাৎই স্টোক করায় তারা বাড়ি আসতে দেরি হতে পারে। তবে বাড়ি ফিরবে, চিন্তা করতে নিষেধ করল দু’জনকে। আরাভকে আরও বলল, পৌষীর খেয়াল রাখতে ভালোভাবে। আরাভও সান্ত্বনা দিল চিন্তা না করতে। সে পৌষীকে দেখবে।

আরাভ বসার রুমে বসে আছে। পৌষী ভয়ে নিজের রুমের দরজা লাগায়নি পর্যন্ত। সে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। শূন্য বাসা তাদের, কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। তার ভূতভীতিও আছে ভীষণ। আগে নিজরুমে একা থাকলেও বাসায় তাদের মানুষে গিজগিজ করত। মাঝে মাঝে তার সাথে আরিবা কিংবা পূর্ণী থাকত। কিন্তু আজ এত বড় বাড়িতে সে একা কিভাবে থাকবে? রাত দশটার ঘরে। অথচ কারও আসার নাম নেই। পৌষীর খিদে পেল। আরাভ এসে ডাকল তাকে,
‘চল খেয়ে নিই আমরা, পাপা’রা আসতে দেরি হবে।’

পৌষীর মন খারাপ হল। এরপর একা রাতে কিভাবে থাকবে? আরাভ তার দুঃচিন্তা দূর করতে ফের বলে উঠল,
‘ভয় পেও না, পাপা’রা না আসা পর্যন্ত আমি বসার ঘরেই থাকব।’

পৌষী রাগে তাকালো না। আরাভের উপর তার মনে সুপ্ত রাগ এখনো আছে। অথচ আরাভের তীর্যক দৃষ্টি তার উপর। এত পাশে তার মত এত বড় পাহারাদার বসে আছে। তাও এই মেয়ে ভয়ে কুঁচকে আছে। মাথামোটা একটা। পৌষীর নিশ্চুপতা তাকে পোড়ালো। সে উঠে কিচেনে চলে গেল। তরকারী গরম করছে। ভাত রান্না করা আছে। চুলায় আগুন জ্বালালো মাত্রই। হঠাৎই পৌষীর চিৎকার এল তার রুম থেকে। আরাভ দ্রুত ছুটে এল। কিন্তু যা দেখল, তাতেই চক্ষু চড়কগাছ।

চলবে,,,