প্রিয় পৌষমাস পর্ব-৭+৮

0
3

#প্রিয়_পৌষমাস ৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ওয়াশরুমের দরজা খোলা।
মেঝেতে বসে কোমরের পেছনে হাত রেখে এক পায়ের হাঁটু তুলে রেখেছে পৌষী, অন্য পা মেঝেতে মেলে রাখা। মুখে কিঞ্চিৎ গোঙানির মত শব্দ হচ্ছে। কিন্তু হঠাতই আরাভকে দেখে লজ্জায় গুটিয়ে গেল। গায়ে ওড়না নেই। দ্রুত নিজের চুল ছেড়ে দিল। আরাভের সাথে চোখ মেলাতে পারল না, তড়িঘড়ি চোখ নামিয়ে রাখল।
ছিঃ! কি লজ্জার বিষয়। ওয়াশরুমে এসে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে সে। কোমর আর পা দু’টোই গেছে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অনবরত। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হল সে।

আরাভ মুখে কিছুই বলল না। কাছে এসে চটজলদি কোলে তুলে নিল তাকে। পৌষীর চোখ কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘আ,,আমা,কে নামিয়ে দাও, আমি হাঁটতে পারব তো।’

আরাভ টুঁশব্দও করল না। সে নিজের কাজেই ব্যস্ত। না পৌষীর কথা শুনল, না জবাব দিল কিছু। চুপচাপ বিছানায় বসাল তাকে। পৌষীর লজ্জায় মরমর অবস্থা। ইচ্ছে করছে রুমের মেঝে দুভাগ করে ভেতরে ঢুকে যাক। তাকে আজই ওয়াশরুমে কোমর ভেঙে পড়তে হল। দুচোখ নামিয়ে হাসফাস করছে। এবার থেকে নিশ্চয় আরাভ ভাইও তাকে নিয়ে মজা উড়াবে। মাথার মধ্যে কত শত দুশ্চিন্তা ভর করল তার। অথচ আরাভ তাকে সেই কখন থেকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে,

‘কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?’

সে কানেই শুনল না। আরাভ তুড়ি বাজাল। কিঞ্চিৎ শব্দ করে বলে উঠল, ‘পৌষমাস।’
পৌষীর ধ্যান ভাঙল। আমতা আমতা করে বলে উঠল, ‘কি,,কি?’
আরাভ ফের বলে উঠল,
‘কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?’
পৌষী পায়ের কথা বললেও কোমর আর তার আশেপাশের কথা চেপে গেল। অথচ কোমরে সবচেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছে সে। বলে উঠল,

‘পায়ে পেয়েছি?’
‘আর কোথাও পাসনি।’

পৌষী মাথা নাড়িয়ে জবাবে বলল, না।
আরাভ ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
সে চলে গেল কিচেনে। পৌষী ব্যথায় ককিয়ে উঠল আবার। আরাভের সামনে নিজের কোমরে হাতও দেয়নি লজ্জায়। কিন্তু সারারাত কিভাবে থাকবে এত ব্যথা নিয়ে। বসতেও কষ্ট হচ্ছে।

কিছুসময় বাদে আরাভ পেইন কিলার নিয়ে এল। পৌষীর হাতে দিয়ে বলল,
‘নে এটা লাগিয়ে নেয়। আমি তরকারী গরম করেছি। ভাত নিয়ে আসছি তোর জন্য।’

আরাভ যেতেই পৌষী পেইন কিলার লাগিয়ে নিল কোমরের মাঝে। হাত দিয়ে হালকা করে মালিশ করল। কিন্তু অতটা ভালো করে মালিশ করতে পারল না। আরাভ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবই দেখল। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। এখন বললে মেয়েটা আরও বেশি লজ্জা পাবে। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছু সময়। এরপর ভাত নিয়ে এল পৌষীর জন্য। পৌষী বলে উঠল,

‘আমার খিদে নেই, খাব না।’

‘অল্প করে হলেও খেয়ে নেয়। তোর ওষুধ খেতে হবে। যদি ব্যথা না কমে কাল সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।’ জবাবে বলে উঠল আরাভ।

পৌষী দ্বিরুক্তি করল না। তবে হাত দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না তার। তাই বলে উঠল,
‘আমাকে খাইয়ে দাও।’
আরাভ নিজমনে হাসল। সে নিজহাতে খাইয়ে দেয়ার জন্যই এসেছে। এর মাঝে পৌষী নিজেই বলছে। সে ভাত মাখিয়ে পৌষীর মুখে ধরল। পৌষীও গপাগপ খেয়ে নিচ্ছে। পুরো প্লেট খালি হতেই আরাভ টিপ্পনী মারল,

‘তুই বললি ভাত খাবি না, এখন যে পুরো প্লেট খালি করে ফেললি।’

পৌষী লজ্জা পেল ভীষণ। ফের একবার লজ্জায় মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করল। চোখদুটো পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকাল। তার দমবন্ধকর অবস্থা তখন, নিঃশ্বাস আটকে আছে যেন। আরাভ বুঝতে পেরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল। পৌষী আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল পরে। আরাভ আবারও ওষুধ নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। পানি ওষুধ দুটোই পৌষীর দিকে এগিয়ে দিল। সেও হাতে নিয়ে খেয়ে নিল দ্রুতই। ঘুমানোর জন্য বলে আরাভ বেরিয়ে গেল। পৌষীর ভয় জেঁকে উঠল এবার। পেছন থেকে ডেকে উঠল,

‘আরাভ ভাই, তুমি,,

‘ভয় পাস না, আমি বসার ঘরেই আছি।’ পৌষী বলার আগেই আরাভই বলে উঠল।
পৌষী খুশি হলেও ভয় কমল না তার। তবু চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে। ঘড়ির কাটায় রাত এগারোর ঘরে তখন। পাশে থাকা মোবাইল ফোন কম্পিত হল তার। পৌষী রিসিভ করতেই প্রিয়ার আতঙ্কিত গলার স্বর ভেসে এল ওপাশ থেকে,

‘কি করছিলি পৌষী?’
‘মাত্র ভাত খেয়ে উঠলাম।’ পৌষীও জবাব দিল দ্রুতই।

প্রিয়া ফের বলে উঠল,
‘রাতে তো ফিরতে পারব না আম্মু’রা। তোর দাদা ভাই মারা গেছে পৌষী। হাসপাতালে নিয়ে এসেও লাভ হয়নি।’
পৌষী ইন্না-লিল্লাহ পড়ল আতঙ্কিত হয়ে। বলে উঠল, ‘আম্মু, দাদাভাইর হঠাৎ করে কি হয়েছিল?’
‘তোর দাদাভাই আগেও অসুস্থ ছিল। তার হায়াত হয়ত এখানেই শেষ। তুই আরাভের সাথে সকালে আসিস তোর দাদা ভাইকে দেখতে।’

তার দাদা ভাই মারা গেছে শুনে পৌষী নিজের ওয়াশরুমে পড়ে যাওয়ার ঘটনা বেমালুম ভুলে গেছে। মায়ের কল কাটতেই তীব্র মন খারাপ হানা দিল। নিজমনে আক্ষেপ করল ভীষণ, তার দাদাভাই তাকে বেশ আদর করত। তাকে বন্ধুভাই বলে ডাকত। যতবার দেখা হত ততবারই বলত, আমার বন্ধুভাই কেমন আছ? আজ বড্ড খারাপ লাগছে তার জন্য। মধ্যরাতে বড্ড আফসোস নিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুম নেই চোখে, আপনাআপনি নোনাপানি গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ থেকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শেষে।

আরাভ শুনে দৌঁড়ে এল। দেখল বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বাচ্চাদের মত শব্দ করে কাঁদছে সে। আরাভ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সান্ত্বনার বাণী হিসেবে বলল,

‘কাঁদিস না পৌষী, দাদাভাইয়ের জন্য দোয়া কর। তিনি যেন জান্নাতবাসী হন।’

পৌষীর কান্নার বেগ কমল না বরং বাড়ল। আরাভ তখনো পাশে বসা। মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। পৌষীর এখন নিজের দাদার কথা মনে পড়ল। আচ্ছা, তার দাদাও কি এভাবে ছেড়ে চলে যাবে। একদিন সবাইকে তো এভাবে চলে যেতে হবে। খুব কষ্ট লাগল তার। চোখের পানি বাঁধা মানছে না। আরাভ পাশে বসে সান্ত্বনার বাণী আওড়ালেও তা যেন পৌষীর কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাল না। আরাভ ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়ল না। শেষে বলে উঠল,

‘পৌষী বারান্দায় যাবি।’

পৌষী মুখে জবাব দিল না। আরাভ পৌষীর এক হাত চেপে তাকে শোয়া থেকে উঠালো। শক্ত হাতের বাঁধনে রেখে বারান্দার মেঝেতে বসল দুজন। আরাভ একহাত চেপে ধরে রেখেছে। আরেক হাত মাথায় রেখে বলে উঠল,

‘পোষী, তোকে কাঁদলে কেমন লাগে জানিস?’

পোষী মুখে জবাব না দিলেও নিজের দু’কান খাঁড়া রাখল শোনার জন্য। আরাভ বলে উঠল,

‘মাঝে মাঝে আমি ভাবি, তুই এমন করেও কাঁদতে পারিস।’

পৌষী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কার মত?’
আরাভ এবার ভাব নিল। বলল,
‘বলে কি লাভ, সেই তো আবার তার মতই কাঁদবি, নাক ফুলাবি, গাল ফুলাবি।’

পৌষী ভ্রু কুঁচকালো, ‘মানে কি যা-তা বলছো?’

আরাভ গলা খাঁকারি দিল, ‘থাক আজকে না, আরেক দিন বলব।’
‘আরেক দিন বলবে মা-নে, এক্ষুনি বলবে আমাকে।’

আরাভ ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল, ‘তুই এত হাইপার হচ্ছিস কেন?’
‘তো, হাইপার হব না? কার মত লাগে বলো জলদি।’

‘কার মত লাগে সেটাও বলতে হবে এখন।’

পৌষীর রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। এত ডং তার সহ্য হয় না। সে তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
‘তুমি কি বলবে?
আরাভ পড়ল মহা ফ্যাসাদে। কান্না বন্ধ করতে এই ট্রিকস অবলম্বন করেছিল। এখন কি সত্যি সত্যিই বলতে হবে কার মত লাগে। কি মুশকিল রে বাবা! ফের কথা ঘুরালো,

‘যদি না বলি কি করবি?’

পৌষী আরাভের মাথার চুল টেনে ধরে বলল, ‘না বললে চুল ছিড়ে ফেলব কিন্তু।
আরাভ ককিয়ে উঠল। পৌষীকে থামিয়ে বলল, ‘বলছি বলছি, তুই চুল ছাড়।’

আরাভ দ্রুতই উঠে দাঁড়াল। পেছনে না তাকিয়ে বলল, ‘তোকে কাঁদলে একদম তোর মতই লাগে।’

পৌষী ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সে ভেবেছিল আরাভ অন্যকিছু বলবে তাকে। সে বোকার মত আরাভের দিকে তাকাল। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কান্নাও থেমে গেছে বহু আগে। আরাভ তার রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে বলল,

‘তুই ঘুমা, আমিও গেলাম।’

পৌষী তখন বলল, ‘না, একদম তুমি রুমে যাবে না। আমার ভয় করছে।’

আরাভ বিড়বিড় করল, ভীতুর ডিম একটা। কিন্তু পৌষীকে বলল,
‘আমি বসার ঘরে ঘুমাচ্ছি। তুই শুয়ে পড়। বাতি জ্বালিয়ে রেখেছি কিন্তু, ভয় পাস না আবার।’

পৌষী শুয়ে পড়ল। রাত কাটল নির্ভয়ে তার। কিন্তু আরাভের দু’চোখে ঘুম নেই। তৃষ্ণার্ত দু’চোখ এক রমণীকে দেখতে ব্যস্ত। সারারাত কাটাল তার শিয়রে। ভোররাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। পৌষীর আবছায়া এখনো মনে পড়ে সেই রাতের কথা। কত নিকটে ছিল আরাভ তার কাছে। তবুও সেই দূরত্ব কমেনি কিঞ্চিৎ।

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ক্লাসের এককোণে মনমরা হয়ে বসে আছে পৌষী। আজকাল সবকিছুতে কেমন উদাসীন লাগে তার। কিছু একটা যেন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তার দাদা ভাইয়ের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়েছি। তবু যেন তাকেই মিস করছে। তার এমন উদাসীনতা সাফা, তিতলিকে ব্যথিত করল। তাকে টেনেটুনে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছে দুজনে। এখানে গরম গরম সিঙ্গারা পাওয়া যায়। তিতলি দু’জনকে সিঙ্গারা খাওয়ালো। কিন্তু তাতেও পৌষীর মন খারাপ কমেনি। এজন্য ক্লাস শেষ হতে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলো দুজন।

রাজাঝির দিঘির পাশে গিয়ে বসল তিনজন। পাশে চটপটির দোকান। সাফা জিজ্ঞেস করল, চটপটি খাবি?
তিতলি কিছু না বললেও পৌষী বলে উঠল সে খাবে। শেষে তিতলিও সায় জানালো। এদের আড্ডার মাঝে পার্থ আর সারিফ এসে যোগ দিল। তারাও চটপটি অর্ডার করল নিজেদের জন্য। পাঁচজনে মিলে আড্ডা দিচ্ছে নিজেদের মত।

আচমকাই কিছু ছেলেপুলে মিলে চটপটির দোকানীর সাথে তর্কে জড়ালো। সবাই চুপচাপ দেখলেও পৌষী তেতে উঠল। সে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
‘আপনাদের সমস্যা কি? এখানে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন কেন?’
ছেলেগুলো দোকানীকে রেখে তার দিকে তাকাল। বলে উঠল,
‘এই শালীর ঘরে শালী, তোর কি সমস্যা? চুলকানী উঠছে?

পৌষীর চোয়াল শক্ত হল মুহুর্তে। জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই কেউ একজন সেই ছেলের মুখ বরাবর ঘুষি মারল। আচমকাই এমন হওয়ায় সবাই আৎকে উঠল। তখন সেই ছেলেটার মুখ অস্পষ্ট ছিল তার কাছে। শেষে যাকে দেখল পুরো দস্তর অবাক হল। এই ছেলেটাকে সে চেনে, তার আরাভ ভাইয়ের বন্ধু। ঘুষি খেয়ে তর্কবাজ ছেলেটা নিচে পড়ল। নিচে পড়া ছেলেটা মুখ তুলতেই সাফওয়ানকে দেখে ঘাবড়ে গেল। ভয়ে দু’হাত জোড় করে মাফ চাইল তার কাছে। বলে উঠল,

‘সর‍্যিই বড় ভাই। আর এমন হবে না কোনদিন। এবারের মত মাফ করে দেন।

সাফওয়ান কলার ধরে টেনে তুলল আবার। বাকি ছেলেগুলো তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাফওয়ান প্রথমেই ক্ষমা চাইতে বলল দোকানীর কাছে। ক্ষানিক বাদে পৌষীর কাছেও নিয়ে এল। তার সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘ওর কাছেও ক্ষমা চা।’

ক্ষমা চাওয়া শেষে সাফওয়ান কড়া করে হুঁশিয়ারী দিল ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় বার যেনো এমন অন্যায় না হয়।
ছেলেগুলো তার কাছেও ক্ষমা চেয়ে দ্রুত জায়গা প্রস্থান করল। সাফওয়ান পৌষীর দিকে চেয়ে বলল,
‘পৌষী কেমন আছো?’

পৌষী সাফওয়ানের ব্যবহারে খুশি হল। জবাব দিল, ‘জ্বী ভালোই।’
সাফওয়ান মৃদু হাসল। বলল,
‘ছেলেটা তোমাকে বাজে কথা বলেছে, তার জন্য দুঃখিত। আর কখনও সাহস হবে না এরকম কিছু বলার।’
পৌষী মাথা নাড়ালো। বলল, ‘সমস্যা নেই।’

‘তবে যদি কোন বড় সমস্যা হয় আমাকে দ্রুতই জানাবে। আমি কিন্তু পাশেই থাকি।’
পাশের সাদা বিল্ডিং এর দিকে সাফওয়ান নিজের এক আঙ্গুল তাক করে বলল,
‘ঐ যে দেখছো সাদা বিল্ডিং, ঐখানেই থাকি। তাই আর কখনও কোনো ঝামেলায় পড়লে আমাকে দ্রুত জানাবে। চাইলে নাম্বার রাখতে পার আমার।
পৌষী মাথা নাড়ালো। ফের বলে উঠল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

সাফওয়ান নিজের একটা কার্ড এগিয়ে দিল পৌষীর দিকে। পৌষী না চাইতেও কার্ডটা হাতে নিল। সাফওয়ান যাওয়ার আগে বলল,
‘তোমার খাওয়ার বিলটা দিয়ে দিয়েছি। তোমাকে দিতে হবে না আর।’
পৌষী নিষেধ করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই সাফওয়ান নিজের মোটরবাইকে চেপে বসল গন্তব্যর উদ্দেশ্য। নিরুপায় হয়ে সাফওয়ানের কথা মানতে বাধ্য হল সে।

বাড়ি ফেরার পথে তিতলি কিছু একটা পৌষীর ব্যাগে রাখল অতি সন্তপর্ণে। পৌষীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সেই কথা। কিন্তু সেই বিষয় নিয়ে সে এত পাত্তা দেয়নি। বাসায় ফিরেও বেমালুম ভুলে বসল সেই কথা। বিকেলে সৌরভ তাকে ডেকে বলল,
‘আরাভ বিকেলে তোকে পড়াবে। আমি সময় করে সকালে তোর পড়া দেখব। কিন্তু আরাভ এখন থেকে তোর ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত সব পড়া সে দেখবে।’

পৌষী বুঝল না সে খুশি হবে না-কি অখুশি? তবে আরাভ ভাই তাকে পড়ালে মারদোর আর বকাঝকা যদি বেশি করে। তখন তো সে প্রতিবাদও করতে পারবে না। না কোনো দুষ্টুমি করতে পারবে। নানা চিন্তা নিয়ে বসে অপেক্ষা করল আরাভের জন্য। কিছু সময় বাদেই আরাভ এল তার ঘরে। পড়ার টেবিলে বসতেই আরাভ ধমক দিল।

‘সালাম দেয়া শিখিস নি। আমি তোর টিচার হিসেবে এসেছি এখানে, কাজিন হিসেবে নই।’

এসেই ধমক দেয়া শুরু। এই লোক তাকে এবার প্রতি পদে পদে অপদস্ত করবে। কিন্তু সে’কি দমার পাত্র না-কি? পৌষীও ঝাঁঝালো গলায় বলল,

‘তাহলে ঘরের বাইরে যাও। রুমে প্রবেশ করার আগে নক করে তবেই আমার ঘরে আসবে। আমার অনুমতি ছাড়া ভেতরে আসবে না কিন্তু।’

আরাভ অবাক হয়নি। সে জানত, এটাই বলবে সে। সে সত্যিই বাইরে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমি কি আসব মিস পৌষী?’
পৌষী অনুমতি দিল না। চুপচাপ আরাভকে দেখতে লাগল। নিজমনে ফন্দি আঁটল। কীভাবে জব্দ করবে আরাভকে। এবার থেকে রোজ তার বকাঝকাই খেতে হবে তাকে। মন খারাপ হল ভীষণ। আরাভ কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে বলে উঠল,

‘আমি কি ছোট পাপাকে ডাকব পৌষমাস?’
পৌষী দ্বিরুক্তি না করে দ্রুত অনুমতি দিল, ‘জ্বী স্যার আসুন।’
আরাভ চোয়াল শক্ত করে ঘরে এল। অনুমতি ছাড়াই এবার চেয়ারে বসল। পৌষী তখন দাঁড়িয়ে আছে। আরাভ বলে উঠল,

‘বসবি, না-কি কষে একটা ছাটা খাবি আমার।’

পৌষী ভেংচি কেটে পাশের চেয়ার টেনে বসল। নিজের বাবার উপর রাগ হল ভীষণ। আরাভকে দিয়ে পড়ানো মানে তার জন্য শাস্তি স্বরূপ এটা। আর কোন টিচার পেল না। আরাভ ম্যাথের বই খুলে তার সামনে রাখল। মাত্র দু’ মাস আছে তার নবম শ্রেণীর ফাইনাল এক্সামের। তাই বইয়ের যেকোন অধ্যায় থেকে এলোমেলো ভাবে অংক করতে দিল। প্রথম তিনটা পারলেও পরেরটাতে গিয়ে পৌষী ভুল করল। আরাভ রেগে বলে উঠল,

‘তোর মন কই থাকে পৌষমাস? এখনও তুই অংকগুলো পারিস না। পরীক্ষার নাই দু’মাস।’

পৌষী ফন্দি আঁটল মনে। আরাভকে চুপ করাতে ভিন্ন উপায় ভাবল। বলল,
‘আরাভ ভাই দেখ, তোমার ঘাড়ে কি সুন্দর তিল।’

আরাভ ভ্রু কুঁচকে তাকাল পৌষীর দিকে। ইশারায় তার দিকে মাথা এগুতে বলল। পৌষী সরল মনে তার দিকে মাথা এগিয়ে দিল। আরাভ কপালে কলম দিয়ে এক গাট্টা মেরে বলল,
‘পড়াশোনায় মন নেই তোর, শুধু আছে ফাইজলামির দিকে।’
পৌষী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আমি কখন ফাইজলামি করলাম। সত্যিই তো বলেছি।

‘তোর গলার নিচে ডানদিকে ইয়া বড় একটা তিল আছে। আমি কখনো বলেছি তোকে।’

পৌষী ভ্যাবাচ্যাকা খেল। দ্রুত নিজের জামা ঠিক করল। তার তিলটা আরাভ ভাই কীভাবে দেখল? সেটা তো ঢাকাই থাকে সবসময়। লজ্জায় তখন তার মরমর অবস্থা। আরাভ নিজমনে বিড়বিড় করল, মাথামোটা একটা। কোথায় কি বলতে হয় তাও জানে না।

পড়ানোর বাকি সময়টা পৌষী মাথা নিচু করে রাখল। লজ্জায় আর আরাভের সাথে চোখ মেলাতে পারিনি সে। আরাভও তাকে আর কিছু বলে ক্ষেপায়নি। পড়ানো শেষে আরাভ পৌষীর ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ পেল। কৌতুহল বশত সে খুলে দেখল সেই কাগজ। কিন্তু যা দেখল তাতে চক্ষু চড়কগাছ। দ্রুত নিজের তা বুকপকেটে রেখে দিল।
__

সৌরভ রাতে বসে ক্লাস টেস্টের কাগজ দেখছিল। প্রিয়া নিশব্দে পাশে এসে বসল তখন। সৌরব বউয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে বলে উঠল,
‘প্রিয়ারানী তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। সময় হবে শোনার।’

প্রিয়া অবাক হল। তার জামাই অনুমতি চাইছে তার কাছে। ভ্রুকুঞ্চন করে জবাব দিল,
‘তুমি অনুমতি চাইছো আমার কাছে।’

সৌরভ হাসল। প্রিয়ার একটা হাত টেনে বলল,
‘একটা মাত্র বউ আমার, অনুমতি চাইব না।’

প্রিয়া জবাব দিল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। সৌরভ ফের বলে উঠল,

‘আম্মা আর ভাই চাচ্ছে আরাভ-পৌষীকে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানাতে। তুমি কি বল?’

প্রিয়ার চোয়াল শক্ত হল মুহুর্তে। গর্জে বলল, ‘মাথা গেছে তোমার? ওরা যদি জানে এই বিষয়টা, কি হবে তখন? বুঝতে পারছো না?’

‘কি হবে আর? তাই বলে সত্যি’টা জানানো উচিৎ না তাদের?’
‘একবার ভাবো তো, ওরা এখন সাধারণ ভাবে মিশছে একে অপরের সাথে। কিন্তু আরাভ যদি স্বামীর অধিকার চাই? তখন কি হবে? দু’জনেই কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক।’

সৌরভ প্রিয়ার কথায় সায় জানালেও বলে উঠল, ‘কিন্তু একে অপরকে পছন্দ করে কি’না তাও তো ভাবতে হবে। পরবর্তীতে তারা যদি ভিন্ন কাউকে পছন্দ করে। এই বিয়ে না মানে। তখন?

প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলে উঠল, ‘যাই হয়ে যাক, এখনি বলার দরকার নেই।’

‘দেখ প্রিয়ারানী, দু’জনকে একসাথে থাকতে কে দিচ্ছে। শুধু জানানো হবে যাতে দু’জনে বিয়ের মত পবিত্র একটা সম্পর্ক নিয়ে অজ্ঞাত না থাকে। দু’জনেরই আবেগের বয়স। কখন আবার কি করে বসে? তাই বলছিলাম আর কি?’

প্রিয়া চুপ করে ভাবনায় পড়ল। সৌরভের কাছ থেকে উঠে দাঁড়াল সে। রুম থেকে বেরুতে বেরুতে তার জবাব এল,
‘দেখি কি করা যায়। তবে সাবধান, আমাকে না বলে কিচ্ছু করবে না।’
__

আরাভ বিছানায় শুয়ে আছে। দু’চোখে ঘুম নেই। মনটা বড্ড ছটফট করছে কিছু একটা জানার জন্য। টেবিল ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় ভাঁজ করা চিঠিটা খুলল। কাঁপা কাঁপা হাতের এলোমেলো লিখাগুলো। বুঝল, লজ্জা আর ভয় মিশানো এই চিঠির প্রতি বাক্যে।

’প্রিয় আরাভ ভাই,
আমি জানি না, তুমি আমাকে নিয়ে কি ভাবো? কিন্তু কি করব বল? সামনে চাইলেও তো তোমাকে বলতে পারি না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রথমবার যখন তোমার প্রেমে পড়ি, সেদিন তোমার গায়ে কালো শার্ট ছিল। বিশ্বাস কর, আমি একবারের জন্যও চোখ ফিরাতে পারেনি। আচ্ছা, আমার কথা শুনে কি হাসছো? জানো, তোমার গায়ের পারফিউমে মন মাতানো একটা সুগন্ধ লুকিয়ে থাকে। তুমি কাছে আসলে তো আমি দেওয়ানা হয়ে যাই তখন। তোমার কাছে কি জাদু আছে?
আজকাল রাতেও ঘুম হয় না। জানো, অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে তোমাকেও দেখি। আমার পাশে ঘুমাচ্ছো কি সুন্দর করে। কিন্তু চোখ খুললে আর তোমাকে খুঁজে পায় না। তখন ভীষণ মন খারাপ হয়। তুমি এভাবে পালিয়ে যাও কেন?
আচ্ছা, আমার কথা শুনে কি আমাকে পাগল ভাবছো। তাহলে ভেবে রাখও। আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি তোমার প্রেমে। কিসব লিখছি জানি না। আমাকে আবার এসব বলে লজ্জা দিও না সামনে। মনে থাকবে তো।
ইতি
তোমার একান্তই প্রিয়জন।’

আরাভ হাসল। আনমনে বিড়বিড় করল, মাথামোটা’টা আজকাল প্রেমেও পড়ে। কিন্তু বলতে আবার লজ্জাও পায়।
চোখমুখ উচ্ছ্বসিত। অদ্ভুত ভালো লাগায় চেয়ে গেল তার মন। তড়িঘড়ি ছুটে এল বারান্দায়, উঁকি দিল কয়েক গজ দূরত্বের অপর বারান্দার দরজায়। কিন্তু যাকে খুঁজল তাকে আর পাওয়া গেল না। সে ঘুমের অতলে পাড়ি জমিয়েছে নিশ্চয়ই। রাত তো কম হয়নি আর। মন খারাপ হল কিঞ্চিৎ। ইচ্ছে করছে তাকে একপলক দেখার।

হতাশ হয়ে বারান্দা ছেড়ে পড়ার টেবিলে গা এলিয়ে বসল। অজান্তে বুনলো নিজের অপ্রকাশিত কিছু অনুভূতি। মোবাইল ফোনের যুগে হোক না কিছু কথা কলমের কালিতে। মন্দ কি তাতে?

চলবে,,