প্রিয় পৌষমাস পর্ব-১৩+১৪

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ১৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

হঠাৎই বলিষ্ঠ পুরুষালী এক চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে গেল পৌষী। প্রায় ঘন্টাখানেক সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে নিজের রুমে ফিরে এল পরনের কাপড় চেইঞ্জ করার জন্য। দীর্ঘসময় ধরে ভারী পোশাক পরে থাকতে বিরক্ত লাগছিল তার। বড় পাপাহ, বড় আম্মু, আরিবা ও আকসা আপুর সাথে এতক্ষন বসে বসে আলাপ জুড়ে ছিল সে। কিন্তু শত খুঁজেও কাঙ্ক্ষিত ঐ ব্যক্তিকে পায়নি। লজ্জায় জিজ্ঞেসও করেনি সে কোথায়? বড় পাপাহ শুধু একবার বলেছে, সে সবার আগে দেশে ফিরেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে কোথায় আছে জানা নেই তাদের। সেও আর দ্বিতীয়বার জানতে চায়নি তার আরাভ ভাই এখন কোথায়? কিন্তু মন তো বার বার জানতে উঁকি দিচ্ছে সেই লোকটা কি তবে এবারও বাড়ি ফিরবে না। কত শত দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের রুমে ফিরল। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি।

দরজা ঢেলে নিজের রুমে এসে দাঁড়ানো মাত্রই তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল এক মহা বদপুরুষ। উষ্কখুষ্ক চুল, গায়ে ঢিলেঢালা টিশার্ট আর পরনে লুঙ্গি। এমন অদ্ভুত পোশাক পরিহিত দেখে প্রথমে দ্বিগুণ অবাক হয়েছিল। এই লোককে কোনোদিন লুঙ্গি পরিহিত বোধহয় দেখা হয়নি তার। তাই আজ অদ্ভুতই লাগল। তবে তার গায়ের রঙ যেন আগের থেকে আরও দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়েছে। পুরো রুমে তার সেই উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে যেন। সে বেহায়ার মত তাকিয়ে আছে সেই পুরুষের দিকে। তার একান্তই প্রিয় পুরুষ, তার আরাভ ভাই। কিন্তু বুঝল না তার আরাভ ভাইয়ের এরকম চিৎকারের কোনো কারণ। এতক্ষন ধরে জমে থাকা কষ্টের পারদ যেন রূপ নিল হঠাৎ তীব্র অভিমানের মাঝে।

অপর পাশে দাঁড়ানো আরাভ পৌষীর দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। তার চিৎকারে ততক্ষণে ঘরের বাকি সদস্যরাও উপস্থিত। প্রিয়া জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে বাবাজী এমন করে চেঁচালে কেন?
আরাভ দু’চোখ পিটপিট করে বিস্ময় প্রকাশ করল। নিজের ঠোঁট বাঁকিয়ে প্রিয়ার জবাবে বলে উঠল,
‘এটা তোমার মেয়ে ছোট আম্মু?’
প্রিয়া জবাব দিল, ‘হুম। কেন, বিশ্বাস হয় না?’
‘তোমার মেয়ে এত ভূতের মত সাজলে তাকে আমি চিনব কি করে? আগে তো ছিল রাক্ষুসি রানী কটকটি আর এখন হয়েছে শেওড়া গাছের পেত্নী।’

পৌষী তেতে উঠল, ‘আমি রাক্ষুসি রানী হই বা পেত্নী হই, তাতে তোমার কি সমস্যা?’

‘আমি কখন বললাম আমার সমস্যা। সমস্যা তো অন্যদের হচ্ছে। তারা এরকম পেত্নীকে স্বশরীরে নিজেদের সামনে ঘুরতে দেখছে। বুড়ো-বাচ্চারা ভয় পাচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় বলতেও পাচ্ছে না। আজ তো যাও একটু রাক্ষুসি রানী লাগছে। কিন্তু গতকাল তো শাড়ি পড়ে শেওড়া গাছের তিনশ বছরের থুরথুরে বুড়ি লাগছিল। দেখার পর ভয়ে আমি রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।’

পৌষী যেন যারপরনাই অবাক। রাতে সে শাড়ি পরেছে এটা আরাভ কি করে জানে। কিন্তু মুখ ফুটে বলল অন্যকিছু,
‘তাহলে তো ভয় দেখানোর জন্য হলেও আমাকে বেশি করে সাজতে হবে।’

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে আছে। সৌরভ একপলক দেখে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল। আগে হলে খুশি হত হয়ত। ভাবতো এরা একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু এখন সে জানে, এসব শুধু ভ্রম। দুজনেই অপর প্রান্তের পথচারী। কেউ কারো নয়। আরিবা, পূর্ণী দু’জনেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ঝগড়া দেখছে। মিটমিট করে হাসছে আরিবা। অনেকদিন পর তার ভাইকে ঝগড়া করতে দেখেছে। আলিশবা বুঝে উঠতে পারছে না, ছেলেকে কি বলবে?এত ঝগড়া করার কারণ তার হজম হচ্ছে না। এভাবে কেউ কাউকে ক্ষেপায়?

কিন্তু সবার থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকসা। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার সাথে আরাভের কখনো ঝগড়া হয়নি। আরাভ অনেক ম্যাচিউর। তারা কত শত জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ করেছে। দু’জনেই সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে একসাথে ছিল। না রাগ, না ঝগড়া কোনো কিছুই ছিল না তাদের মাঝে। না প্রেমিক প্রেমিকার মত ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছে তারা। পড়াশোনা ব্যতীত অন্য বিষয় নিয়ে কথায় হত না। কি অদ্ভুত সম্পর্ক তাদের! সে আরাভকে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্যই পছন্দ করত। কিন্তু পৌষীর সাথে ঝগড়া দেখে তার কাছে অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে। আরাভের মাঝেও চঞ্চলতা আছে। কিন্তু সেটা সবার সাথে সে প্রকাশ করে না। তবে কি পৌষীই সে বিশেষ কেউ? তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আরাভ বলেনি কখনো তার বিশেষ মানুষটি কে? শুধু বলত তার জীবনে প্রিয় একজন মানুষ আছে, যাকে সে চাইলেও ভুলতে পারবে না। আকসা নিভৃতে দীর্ঘশ্বাস টানল। এমনটা যেন না হয়। দোয়া করছে আপনমনে।

প্রিয়া এতক্ষণ চুপচাপ দেখলেও এবার মেয়েকে ধমক দিয়ে উঠল। বলল,
‘পৌষী এসব কি হচ্ছে। চুপ করবি।
পৌষী মায়ের দিকে তাকাল। জবাবে বলল,
‘তোমার আদরের আরাভ বাবাজী আমার রুমে কি করছে বল তো।’
আরাভ তড়িৎ জবাব দিল, ‘এটা তোর রুম? কোথায় লিখা আছে বল তো?’
প্রিয়া পুনরায় বলল, ‘হয়ত কোনো দরকারে এসেছিল এই রুমে। তার জন্য এভাবে কথা বলছিস কেন ওকে?’

পৌষী যেন একটু নড়েচড়ে উঠল। এ ছেলেটার জন্য এতদিন সে চোখের জল ফেলেছিল। যে ছেলেটা তাকে পাত্তাই দেয়নি কখনো। উল্টো শুধু কথায় শুনিয়ে এসেছে। তার ভেতরের সত্ত্বা হাহাকার করে উঠল। রাগ অভিমান দুটোই তাকে পেয়ে বসেছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মুখে জবাব দেয়ার অবস্থায় সে আর নেই। চুপসে গেল মুহুর্তে।

গৌরব নিজের নীরবতা ভেঙে আরাভকে ধমক দিল,
‘মাত্র তো আসলি, এসেই শুরু করে দিলি।’
আরাভ নিজের বাবার দিকে তাকাল। কথার প্রেক্ষিতে বলল,
‘আমি মাত্রই আসেনি পাপাহ, ১৮ ঘন্টা হতে চলল। আমি যে এলাম, কেউ তো আর আমার খোঁজ করেনি।’

পৌষী আরও একবার চমকালো। ১৮ ঘন্টা হয়েছে, কিন্তু সে তো কিছুই জানেই না। ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি সে। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয়নি, শেষের কথা কাকে মীন করল সে? তাকে না তো? সে সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত তখন। তাহলে ছাদে দেখা সেই অবয়ব কি আরাভ ভাই ছিল? কিন্তু তখন তার সাথে কথা বলেনি কেন? কি এমন কারণ থাকতে পারে? এখনও কি তাকে ঘৃণা করে? না’কি অন্যকিছু? তার ভারাক্রান্ত মন তখনও কত শত ভাবনায় মশগুল। কিন্তু মুখ ফুটে রাগের সাথে অভিমানের বহিঃপ্রকাশ করতে চাইল। তার আগেই আরাভ বলে উঠল,

‘আমার রুমে ঘুমানো যাচ্ছিল না, রুম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কেমন বিদঘুটে গন্ধ লাগছিল। তাই এখানে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু কোথা থেকে এক পেত্নীর আগমনে আমার ঘুম গায়েব হয়ে গেল। তাই হম্বিতম্বি করে উঠে পড়লাম। কখন আবার আমার গায়ের উপর হামলা করে বসে।’

‘আমি তোমার গায়ে হামলা করে বসব মানে, আমাকে তোমার কি মনে হয় আরাভ ভাই?’

‘সেটাই তো বললাম একটু আগে। আবার নতুন করে তোকে আবার কি মনে হবে বল তো? পেত্নী একটা।’
আরাভ দায়সারা জবাব দিয়ে বেরিয়ে গেল দ্রুতই। আরাভের সাথে বাকিরাও বেরিয়ে এল তখন। নির্লিপ্ত পৌষী শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সবাইকে। সবাই যেতেই আরিবা এসে টিপ্পনী মারল,
‘পৌষী আপু, ভাইয়া এখনো তোমাকে ক্ষেপিয়ে মজা নেয়। বিশ্বাস কর, আমাকেও কখনো এত ক্ষেপায় না, যতটা তোমার সাথে করে।’
‘তা তো দেখতেই পারছি। তোর ভাইয়ের কোন জন্মের শত্রু আমি, বলতো?’

আরিবা কিঞ্চিৎ শব্দ করে হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘জানি না আপু।’
পৌষী রাগে গজগজ করছে। এতদিন পর বাড়ি ফিরে কোথায় ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করবে। এতদিন কেন যোগাযোগ করেনি তা বলবে। কিন্তু এসেই তাকে নিয়ে পড়েছে কেন? আশ্চর্য তো! রাগে তার মাথা টনটন করছে। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল সে। আরিবা চুপচাপ দেখছে আর হাসছে।
__

গোধূলির ঈষৎ আলো ধরণীতে পড়তেই বসার ঘরে উৎসবমুখর পরিবেশ তখন। কানাডা থেকে বয়ে আনা উপহার সামগ্রীর বড় ল্যাগেজ খোলা হচ্ছে। সবার মাঝে পৌষী অনুপস্থিত শুধু। গৌরব ঘাড় বাঁকিয়ে তাকে না দেখে আলিশবাকে বলল, যাও তো ওকে ডেকে নিয়ে আসো। আলিশবা যাওয়ার আগে পৌষী নিজেই উপস্থিত। গৌরব কাছে ডাকল, এদিকে আসো আম্মাজান। পৌষী চুপচাপ পাশে গিয়ে বসল। কিন্তু সে মাত্রই বসতেই দেখল তার পাশে আরাভ এসে দপ করে বসে পড়েছে। পৌষী অবাক হল ভীষণ। কেমন এক দমবন্ধকর পরিবেশ। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার। আরাভ ভাই তাকে কেন এত ঘৃণা করে? পাঁচটা বছর কেন যোগাযোগ করেনি। কিন্তু এই যে এখন তার এত চঞ্চলতা, যেন কিছুই হয়নি। অজস্র প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেলেও ঘরভর্তি মানুষের সামনে কিছুই বলা হল না তার। আরাভও চুপচাপ বসে শুধু দেখে যাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি, সব স্বাভাবিক।

গৌরব কিছু চকলেট, কসমেটিকস আর জুয়েলারি তুলে দিল পৌষীর হাতে। পৌষী না চাইতেও সেসব নিল। মুখের কোণে ঈষৎ হাসি। তার বড় পাপাহ কত ভালোবেসে দিয়েছে। যদি না বলে তবে ভীষণ কষ্ট পাবে। তাই তো মনের জোর না থাকলেও সবই নিজের হাতে নিয়ে আবদ্ধ করল। আঁড়চোখে একবার আরাভকে দেখল। সে তার দাদুর সাথে কথা বলায় মশগুল। তার সাথে আর কোনো বাক্য বিনিময় হল না। সেও যেচে পড়ে কিছু বলল না। কেন বলবে? একবার কি তাকে জিজ্ঞেস করেছে, সে কেমন আছে? গৌরভের দেয়া উপহার নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এল। বিছানায় রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সব। তার বড় পাপার পছন্দের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু তার এসবে মন ভরছে না একদমই। কোন এক শূন্যতায় পোড়াচ্ছে ভীষণ। আনমনে ভগ্নহৃদয়ের হিসাব কষছে সে। অতর্কিত কারো এক বিষফোঁড়ন বাক্যে ভেসে এল,

‘না সালাম, না দোয়া, না কোনো ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করলি? আমাকে কি তোর মানুষ মনে হয় না, পৌষমাস?’

নীরব রুমে এমন বাক্যে যেন ঝনঝন শব্দ তুলল। বিমর্ষ পৌষী যেন লাভার মত দপ দপ করে জ্বলে উঠল। অনেক সহ্য করেছে এই লোককে, আর নয়। তাই বলে উঠল,
‘কে আপনি? আপনাকে কেন সালাম দোয়া দিতে হবে? আমি তো আপনাকে চিনি না।’

আরাভ ভীষণ রকম অবাক হল। চোখমুখে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নামল যেন মুহুর্তে। স্তব্ধ হয়ে থাকল দীর্ঘসময়। জবাব এল না ভেতর থেকে। কন্ঠরোধ হয়ে আছে তার। বেশ খানেক বাদে মুখে জবাব না দিয়ে পৌষীর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটালো শুধু। যেভাবে এল ঠিক সেভাবেই বের হয়ে গেল পৌষীর রুম থেকে।
কিন্তু আপনমনে বিড়বিড় করল, সত্যিই তো! আমি কে তোর?

চলবে,,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ১৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সকালের মিঠেরোদে ঘুম ভাঙল পৌষীর। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই ঘরের ভেতর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসল তার কর্ণকুহরে। কতদিন পর তাদের ঘর পরিপূর্ণ ও জীবন্ত মনে হচ্ছে। তার বড় পাপাহ, বড় আম্মুর গলার স্বর আর আরিবার খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে একেবারে ফ্রেশ হয়েই বসার ঘরে গেল। গৌরব আর সৌরভ মিলে গল্প করছে তখন। তাকে দেখে গৌরব বলল,
‘শুভ সকাল আম্মাজান।’
বিনিময়ে মৃদু হেসে সেও বলল, ‘শুভ সকাল বড় পাপাহ।’

তখন প্রিয়ার রান্নাঘর থেকে চেঁচানোর শব্দ ভেসে এল, ‘পৌষী এদিকে আয় তো।’
সে আর কথা না বাড়িয়ে গৌরবকে বলল বড় পাপাহ আসছি। গৌরব আলতো করে হাসল। মনের ভেতর এক চাপা কষ্ট অনুভব করল। এই মিষ্টি মেয়েটাকে নিজের করে রাখতে না পারার জন্য।

প্রিয়া পৌষীকে সবজি কাটতে দিল। পাশাপাশি চা বানানোর দায়িত্বও পরলো তার। ঘন্টাখানেকের মাঝে পৌষী নিজের কাজ শেষ করে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। নিজের রুমে ফিরে একেবারে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এল। খাবার টেবিলে তখন সবাই উপস্থিত। সকালের নাস্তা মুখে তুলছে। আরাভ মাথা নিচু করে খাচ্ছিল। কিন্তু একপলক পৌষীকে দেখল। তবে তার কোনো ভাবাবেগ নেই এই মুহুর্তে। পৌষী একটা চেয়ার টেনে তার পাশে খেতে বসল। হুট করে আকসা জিজ্ঞেস করল,
‘কোথাও যাচ্ছো?
পৌষী জবাব দিল, ‘হুমম, ভার্সিটি যাবো।’

প্রিয়া মেয়ের ভার্সিটি যাওয়ার কথা শুনে কিছুটা অবাক হল। তার ফুফু-মামারা আসবে তাই যেতে নিষেধ করল। কিন্তু পৌষী বুঝল না তার ফুফু-মামার সাথে তার ভার্সিটির কি সম্পর্ক? মায়ের জবাবে বলল, এর আগেও দু’দিন যাইনি। আজ না গেলে কেমনে হবে। সৌরভ প্রিয়াকে থামাল। বলল, মেয়েটাকে যেতে দাও। প্রিয়ার এক বাক্যে, এত দূরের পথ, ঘন্টা দেড়েক লাগে যেতে। এভাবে মেয়েটা একা ভার্সিটি কিভাবে যাবে? আগে তারা পালাবদল করে দু’জনের একজন মেয়ের সাথে যেত। কিন্তু সৌরভ আজ ব্যস্ত থাকবে। তার যাওয়া সম্ভব না, প্রিয়া সেও ব্যস্ত আছে। তাদের দু’জনের কেউ যেতে পারবে না। তার এত দুশ্চিন্তার মাঝে আরাভ বলে উঠল,

‘ছোট আম্মু আমি যাই পৌষীর সাথে।’

আরাভের এমন আবদারে সৌরভ, গৌরব দু’জনই বিস্মিত। তারা দু’জনেই কিছুটা সন্দিহান। গতকাল থেকে আরাভের আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগছে তাদের কাছে। কিন্তু কেউ মুখ খুলে তার বহিঃপ্রকাশ করল না। সৌরভ নিষেধ করতে চাইল। শুধু শুধু মায়া বাড়ানোর কি দরকার এখন? কিন্তু গৌরব এ সুযোগ কাজে লাগাল। প্রিয়ার জবাবের অপেক্ষা না করে বলল,

‘আরাভ, তুমি যাও আমার আম্মাজানের সাথে। ওর খেয়াল রেখ, এটা তোমার উপর গুরুদায়িত্ব এখন।’

পৌষী অবাকের চরম শিখরে। কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
‘আমি কি বাচ্চা মেয়ে? ভার্সিটি যাবো নিজস্ব গাড়ি করে, কোনো বাসে নয়। তাও এত ভয় কিসের তোমাদের?’
আরাভ বিড়বিড় করল, ‘বাচ্চা কিসের, তিন বাচ্চার মা সে। কারো কর্ণকুহুরে না পৌঁছালেও পৌষীর কানে ঠিকই পৌঁছে গেল আরাভের টিপ্পনী মারা তীর্যক বাক্য। কিন্তু জবাব দেয়ার এখনই সময় নয়, তাই চুপই থাকল। খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তৎক্ষনাৎ আকসা বলে উঠল,
‘কখন ফিরবে?’
‘দুপুর দু’টো বা আড়াইটা লাগতে পারে।’
‘জলদি ফিরে এসো, সারপ্রাইজ আছে কিন্তু।’

পৌষী আকসাকে যেচে গিয়ে আর জিজ্ঞেস করেনি কিসের সারপ্রাইজ? আকসাই তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ। এর চেয়ে সারপ্রাইজ আর হতেই পারে না। গতকাল রাতে যখন আরাভের সাথে রাগের বশে সে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেছিল, পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে গিয়েছিল আরাভের রুমে। কিন্তু বিধিবাম আরাভকে তার রুমে পায়নি তখন। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল। পরে দেখল, আরাভ তার উডবি ওয়াইফ নিয়ে গল্পে মশগুল। বেশ হাস্যরসে মত্ত দু’জন, ভালোই লাগছিল। সে শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় ডুবে মরছিল তখন। আরাভ বুঝি খুব কষ্ট পেল। নিজের কাজের জন্য বিদ্রুপের হাসি ফুটল মুখের কোণে। নিজের রাগকে সংবরণ করে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসল। সে বসতেই আরাভও ছুটে এসে তার পাশে বসে পড়ল।

গাড়ি চলছে। দু’জনেই নিশ্চুপ। কারো মুখে কোনো রা নেই। এত কাছে তবু শত ক্রোশ মাইলের দূরত্ব তাদের মাঝে। পৌষী যেন নির্বাক অবরুদ্ধ। সে পালাতে চাইছে এই কষ্ট থেকে, অথচ কষ্ট পায়ে হেঁটে যাচ্ছে তার সাথে? তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আরাভ কি চাই? তাকে দু’দন্ড শান্তিতেও থাকতে দিবে না। নিশ্চুপ পড়ে রইল গাড়ির এককোণে। পৌষী চুপচাপ হলেও আরাভ এর মাঝে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু খাবে?’
মুখে জবাব না দিয়ে পৌষী এপাশ ওপাশ করে শুধু মাথা নাড়ালো। আরাভ দীর্ঘশ্বাস টানল বিনিময়ে।

দীর্ঘ দেড়ঘন্টার পথ একঘন্টায় এসে পৌঁছাল দু’জন। সামনের সিটে পাশাপাশি বসেছিল এতক্ষণ। গন্তব্য পৌঁছাতেই কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই পৌষী নেমে গেল। আরাভ পিছু ডাকল,

‘কতক্ষণ লাগবে তোমার?’

পৌষীর আজ অবাক হওয়ার দিন। তুই থেকে তুমিতে নেমেছে মহোদয়। আগেও এমন করত মাঝে মাঝে। তবে আজকের তুমি ডাকটা ছিল অন্যরকম। কেমন যেন অন্তঃকরণে আঘাত হানছে তার। তবুও সে পিছু তাকালো না। জবাব দিল সামনের দিকে তাকিয়ে,
‘ঘন্টা তিনেক লাগবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে আপনার কষ্ট হবে। আপনি বরং বাসায় চলে যান।’

আরাভ যেন কানে ভুল কিছু শুনেছে। তাকে আপনি ডেকেছে। সোজা তুমি থেকে আপনি? বাহ! কি পদোন্নতি তার? সে মৃদু হাসল। রাশভারী কন্ঠে জবাব দিল,
‘চিন্তা করতে হবে না তোমার, আমার আবার অনেক ধৈর্য্য। অপেক্ষা করতে পারব। তুমি সাবধানে যেও।’

পৌষী না চাইতেও একপলক তাকালো আরাভের দিকে। দ্রুতই আবার নিজের নজর অন্যদিকে ঘুরালো। কেমন যেন নিজেকে বেসামাল লাগছে। ঐ চোখে বেশিক্ষণ তাকানোর সাহস তার নেই। কি এক অদ্ভুত চাউনি! তাকে ঘায়েল করার জন্য ঐ চাউনিই যথেষ্ট। আর তাকাবে না সেই চোখের মাঝে। অথচ আরাভের স্থিরদৃষ্টি পৌষীর উপর। বলে উঠল,

‘কোনো সমস্যা হলে দ্রুত জানাবে। তোমাকে নিরাপত্তায় দেয়াই এখন আমার মূখ্য কাজ।’

পৌষী আরাভের জবাব দেয়ার প্রয়োজনবোধ মনে করল না। দ্রুত পায়ের কদম বাড়ালো ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। পিছু ঘুরে তাকানোর সাহস নেই আর। এই লোকটা ধূমজাল, তাকে মায়ায় বেঁধে রাখবে আবার। অথচ আরাভের দৃষ্টির নড়চড় হয়নি। সে অপলক তাকানো পৌষীর যাওয়ার দিকে। গায়ে ধূসর রঙা জামা, মাথায় কালো হিজাব, সাথে মুখে মাস্ক। এ যে তার প্রাণ সঞ্চারীনি।

সময় পেরুলো এক, দুই করে তিন ঘন্টা। কিন্তু পৌষীর ফেরার নাম নেই। আরাভ অস্থির হল। এত সময় হল ফিরছে না কেন মেয়েটা? সে ফটকের মাঝে এসে সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলল ভেতরের দিকে। না কোথাও নেই পৌষী। সময় গড়ালো আর কিছু সময়। হঠাৎই দৃষ্টিগোচর হল, দূরে দাঁড়ানো আছে পৌষীর অবয়ব। পাশাপাশি ছেলেও আছে। তাদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত সে। আরাভের শান্ত মস্তিষ্ক হুট করে অশান্ত হল। এই মেয়ের সাহসের তুলনা করতে হবে। সে ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। শান্ত, গম্ভীরস্বরে ডাকল,

‘পৌষী,

পৌষীর হুঁশ নেই। সে সবার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত তখন। সহসাই তার পেছন থেকে পরিচিত স্বর শুনে চমকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে আরাভকে দেখে শুকনো ঢোক গিলল। এখন তার ফেন্ডরা তাকে নিয়ে সন্দেহ করলে, আর যদি মজা উড়ায়। সে লজ্জায় শেষ। জলদি পিছু ঘুরে আরাভের জবাব দিতে উদ্বত হল, কিন্তু তার আগেই তার ফেন্ড একজন বলে উঠল,
‘কে রে উনি? আমাদের দুলাভাই?’

পৌষী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে না বলার আগেই তারা হায় হায় করে উঠল। আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস? এটা ভালো করিস নি কিন্তু। সে বেকুব বনে গেল। অথচ আরাভ ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে। সে পৌষীকে পর্যবেক্ষণ করছে শুধু। বেচারা পৌষীর কথা কানেই নিল না কেউ। তার রাগ বাড়ল হুট করে। সে আর কিছু না বলেই বেরিয়ে এল সেখান থেকে। পেছন থেকে তার বন্ধুরা ট্রিট চাইল। আরাভ তাদের কাছে এসে আশ্বস্ত করল, নেক্সটাইম অবশ্যই আমাদের দেখা হবে। আর ট্রিট সেদিনের জন্য তোলা থাক। আজ সময় নেই। আরাভের কথায় প্রসন্ন হল পৌষীর বন্ধুমহলও। তাই ছেড়ে দিল আজকের জন্য।

পৌষী গাড়িতে বসে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আরাভ তার দিকে পাইপ লাগানো একটা ডাব এগিয়ে দিল। পৌষী নিতে চাইল না। আরাভ হাতে তুলে দিতে দিতে বলল,
‘খেয়ে নাও, মাথা ঠান্ডা কর।’
পৌষী ফোঁস করে বলে উঠল, ‘হঠাৎ করে আমাকে তুমি করে ডাকছো কেন?’

‘জবাব লাগবে?’
পৌষী ছোট্ট করে বলল, হুমম।
‘ডাব খেয়ে নাও। আমরা না হয় যেতে যেতে বলি এসব।’

পৌষী মাথা ঠান্ডা করল। ডাবের মুখে লাগানো পাইপের মধ্যে নিজের ঠোঁট বসালো। পরম তৃপ্তিতে পান করছে ডাবের পানি। আরাভ আঁড়চোখে দেখল সব। ফের বলল,
‘খাওয়া শেষ হয়েছে?’
পৌষী হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো। আরাভ তার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল তখন। পৌষী অবাক হল। বলল,
‘এটা কি?’
‘তোমার প্রিয় খাবারের একটি আছে এখানে।’

পৌষী ঝটপট প্যাকেট খুললো। দেখল, হালিম এর বক্স ভেতরে রাখা। সে যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। আরাভ তাড়া দিল,
‘জলদি খেয়ে নাও, ঠান্ডা হওয়ার আগে।’

পৌষী আরাভের দিকে তাকালো এক ঝলক। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলল,
‘এত কিছু কেন করতে গেলে আরাভ ভাই?’
‘সেই সকালে এসেছো, এখন খিদে পেয়েছে। তাই নিয়ে আসলাম। আর কিছু?’

পৌষী চুপ হয়ে গেল মুহুর্তে। কি জবাব দেবে আর। আর কথা বাড়ায়নি সে। বাড়ি ফিরে দেখে হুলুস্থুল কান্ড। ঘরভর্তি অতিথিতে পূর্ণ।

চলবে,,,