প্রিয় পৌষমাস পর্ব-২৩+২৪

0
152

#প্রিয়_পৌষমাস ২৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

শান্ত দু’চোখ আরাভের। ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে আছে হাতে কিছু শপিং ব্যাগ নিয়ে। গায়ে সদ্য কেনা সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার। আর পরনে কালো জিন্স। আচমকাই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। দু’কদম পা এগিয়ে এল। শপিং ব্যাগ প্রিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ছোট আম্মু এগুলো রুমে নিয়ে রাখো তো। প্রিয়া হাতে নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। আরাভ পৌষীর পাশের সোফায় দপ করে বসল। তারপর সবার উদ্দেশ্য সালাম দিল সে। পাত্র তখনও দৃষ্টি সরাই নি। আনমনে বিড়বিড় করছে, ছেলেটার এত রূপ! বড্ড হিংসে হচ্ছে তার। আচমকাই পাত্র বলে উঠল,

‘ইউ আর সো গর্জিয়াছ।’

আরাভ মৃদু হাসল। নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কি লাভ বলুন এই সৌন্দর্য দিয়ে। বউ তো তাও পটে না।’
পাত্র বোধহয় মাত্রারিক্ত অবাক হল। বলল, ‘হোয়াট? আপনি বিবাহিত?’
‘ঐ আর কি, নাম মাত্র বিবাহিত। বউ নামে আছে কিন্তু কাজে নাই। এমনটাই ভাবুন।’

পাত্র থ হয়ে আছে তখনও। কি বলে এসব। তার মাথার উপর দিয়ে গেল বোধহয়। ফের জিজ্ঞেস করার জন্য কাচুমাচু করছিল সে। তখন তার বাবা বলে উঠল,
‘কিন্তু বাবা, আপনাকে তো চিনলাম না। কে আপনি?’

আরাভ জবাব দিতে উদগ্রীব হল মাত্রই কিন্তু সহসাই পৌষীর কন্ঠস্বর ভেসে এল,
‘আমার কাজিন।’
আরাভ অবাক হল না। উল্টো কুটিল হাসল। আকস্মিক এক অদ্ভুত কাজ করে বসল সে। নিজের দু’হাত উঠিয়ে পৌষীর দু’গাল জোরে খিঁচে ধরল। ন্যাকা স্বরে তখন বলল,
‘উলে লে, আমার ভীষণ আদুরে, ভীষণ প্রিয় একমাত্র বইন। আজ তো কত মিত্তি করে সাজুগুজু করেছে। কত কিউট লাগছে।’

আরাভের কান্ড দেখে সৌরভ গলা খাঁকারি দিল। আরাভ আবার আগের মত বসে পড়ল। তারপর সৌরভের উদ্দেশ্য বলে উঠল,
‘ছোট পাপাহ, এনাদের তো ঠিক চিনলাম না।’

সৌরভ জবাবহীন। চোখের মণি অস্থিরভাবে ঘুরছে তার। আরাভ ফের কিছু বলতে গিয়েও থামল। পাত্রের বাবা জবাব দিলেন তার,
‘আসলে আমরা তোমার বোনকে দেখতে এসেছি।’

আরাভ জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে আপনাদের?’

পাত্রের বাবা মৃদু হাসলেন। মাথা দুলিয়ে বলল,
‘জ্বী বাবা।’
আরাভ পাত্রের দিকে ঝুঁকলো এবার। বলল,
‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে?’
পাত্রের মুখে লাজুক হাসি। দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে। কিন্তু আঁড়চোখে পৌষীকে দেখে যাচ্ছে নিষ্পলক। মেয়েটা নীল শাড়ি পরেছে। মুখে কৃত্রিম প্রলেপ নেই। কত সাদামাটা। এমন মেয়ে আজকাল পাওয়া মুশকিল। তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটল। অথচ আরাভ তীর্যক দৃষ্টি ফেলছে পাত্র আর পৌষীর দিকে। দাঁতে দাঁত পিষলো। তবে ধৈর্য্য ধরল কিছু সময়ের জন্য। পাত্রের জবাবের অপেক্ষায় সে। পাত্র নরম সুরে জবাব দিল,

‘আলহামদুলিল্লাহ, হয়েছে।’

আরাভ নিজেকে সংযত করল আরও একবার। ফের সৌরভের দিকে তাকালো। বলল, ‘ছোট পাপাহ, তাহলে শুভ কাজে দেরি কীসের? কাজী ডাকো, আজই বিয়ে হবে ওদের।’

সৌরভ বোধহয় চমকালো ভীষণ। পৌষীর চোখমুখেও সেই চমকের রেশ ফুটে উঠল। কি বলছে আরাভ? সে কেন চুপচাপ মেনে নিচ্ছে? তার কি কিছুই বলার নেই। তাহলে সারা বিকেল ধরে যা করল, সবই লোক দেখানো শুধু। অস্থিরতায় হাসফাস করছে সে। আরাভ নিজের মুঠোফোন বের করল। পাত্রের বাবা খুশি হলেন বেশ। বলল,

‘আসলেই এমন কিছুই আমরা চাইছিলাম। কিন্তু তুমি বলাতেই সহজ হয়ে গেল আরও।’

‘আপনি একদমই চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি তো আছি আপনাদের জন্য।’

পৌষী থম মেরে বসে আছে। সত্যিই তার বিয়ে হয়ে যাবে। সে অসহায়ের মত তাকাল আরাভের দিকে। অথচ আরাভ ব্যস্ত অন্যকিছু নিয়ে। তাকে ফিরেও দেখল না। সে আশাহত হল। সে আজও বুঝল না, আরাভ কি চাই? সৌরভ রয়েসয়ে বলল,

‘আজ নয়, অন্যদিন আমরা বিয়ে নিয়ে কথা বলি। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’

আরাভ সৌরভকে থামাল। দৃঢ় গলায় বলল,
‘একদমই না, সময় না ফুরালেও মানুষের মন কখন আবার বিগলিত হয়ে যায়। বলা তো যায় না। তাই না ছোট পাপাহ? আমি কাজিকে কল করছি। এই তো মিনিট দশেক লাগবে, চলে আসবে।’

সৌরভ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি আসছি, আপনারা বসুন।’
পৌষীকে বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও পৌষী।’
আরাভ বাধা দিয়ে উঠল তখন। বলল,
‘ছোট পাপাহ, পাত্র-পাত্রীদের আলাদা কথা বলার ব্যবস্থা করুন। বিয়ের আগে একে অপরকে জানা-শোনা না থাকলে হয়।’

সৌরভ কপাল কুঁচকালো। আরাভ কি তার সাথে মজা করছে। তাকে এত শান্ত দেখে সে আরও তাজ্জব বনে গেল। কিছু আঁচ করতে পারল না। এত শান্ত দেখে সে ভাবনায় পড়ে গেল। মাথাভর্তি দুঃচিন্তা নিয়ে প্রস্থান করল সে। আরাভ নির্জীব নিষ্ক্রিয় শরীর নিয়ে সটান বসে আছে। পাত্রের চোখমুখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে তখন। মিটমিট করে হাসছে সে।

আরাভ আর নিতে পারল না, উঠে দাঁড়াল। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে তার। সে বোধহয় আজও বড্ড দেরি করে ফেলেছে। যেমনটা পাঁচ বছর আগে করেছিল। নিজের ইচ্ছে আর অনুভূতিকে তখন যেমন দমিয়ে রেখেছিল। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। সেই অনুভূতিকে চাপা দিয়ে দিল এই মুহুর্তে। ভালোবাসা যেমন একপাক্ষিক হয় না। তেমনি জোর করে বিয়ে হয় কিন্তু সংসার নয়। ভালো থাকুক তার ভালোবাসা। গুটিগুটি পায়ে সে নিজের অন্ধকার রুমে প্রবেশ করল। এখানে কতদিন মানুষের পা পড়েনি তা জানা নেই তার। দরজায় লক দিয়ে দিল। বিছানায় গা এলিয়ে নিজেকে সান্ত্বনার বানী শোনালো। তুমি তার না হলেও সে তোমার। চিরজীবন তোমার। আজকে আবার মুক্তি দিয়ে দাও। নিজের ফোন থেকে কাজীকে কল দিল। কয়েক মুহুর্ত যেতেই কাজী কল রিসিভ করে বলল, সে আসছে।

কিছু সময় কাটল এভাবেই। ফের দরজা খুলে বেরিয়ে এল আরাভ। বসার ঘরে আসতেই জটকা খেল ভীষণ। পাত্রপক্ষের চোখমুখে কেমন বিরক্তির ছাপ। রোষানলে ফেটে পড়ছে তারা। এর কারণ সে বুঝল না কিছুই। আসলে বসার ঘরে বেশ লঙ্কাকান্ড ঘটে গেছে কিছু মুহূর্তের মাঝে। যা আরাভের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। পাত্রপক্ষ চোখমুখ কালো করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখন। সে জিজ্ঞেস করল,
‘কি ব্যাপার! চলে যাচ্ছেন কেন?’
পাত্রের বাবা-মা নিশ্চুপ হলেও মামা কেমন ক্ষেপে উঠলেন। বললেন,
‘ফাইজলামী পাইছেন মিয়া? বিবাহিত মেয়েকে আবার বিয়ে দেন। ছিঃ কি নিকৃষ্ট পরিবারের মানুষ এরা।’

প্রিয়া বোধহয় জবাব দিল, ‘উত্তেজিত হবেন না বেশি। এতে হার্টএট্যার্কের ঝুঁকি থাকে। দয়া করে সাবধানে যান।’

আরাভ বেকুবের মত জিজ্ঞেস করে উঠল, ‘আপনাদের কে বলল এ কথা?’

পাত্রপক্ষ থেকে কোনো ফিরতি জবাব আসার আগেই পাশ থেকেই প্রিয়া জবাব দিল,
‘আমি বলেছি। কারণ, সত্যি কথা সবসময় তিক্ত হয় আরাভ। তবে তা বলার জন্য সৎ সাহস থাকা লাগে।’

আরাভ দৃষ্টি ঘুরালো। বিয়ে ভাঙলেও মন শান্ত হল না। কিছু একটা বড্ড ফোঁড়াচ্ছে তাকে। সে নিজের রুমে ফিরে যেতে চাইল। প্রিয়া ফের বলে উঠল,
‘আরাভ সোফায় গিয়ে বস। কাজী আসছে। তোমাদের আবার বিবাহ পড়ানো হবে।’

আরাভ এবার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। বলল,
‘কিন্তু ছোট আম্মু,
প্রিয়া আরাভকে থামাল, ‘তুমি বস এখানে। আমি আসছি।’
সৌরভ চুপচাপ বসে আছে সোফার এককোণে। হাতের মুঠোফোনে কিছু করছে বোধহয়। এর মাঝে কাজিও হাজির। প্রিয়া কিছুসময় বাদে হাজির হল। পৌষীকে নতুন করে সাজিয়ে এনেছে। আরাভের শপিং ব্যাগ থেকে একটা কালো শাড়ি নিয়ে তাকে পরিয়েছে। আরাভ একপলক তাকাল। কিন্তু চাউনিতে কোনো ভালোলাগা নেই তার। কেমন যেন অনুভূতি শূন্য লাগছে নিজেকে। পৌষীকে আরাভের পাশে বসানো হল। সৌরভকে ফের নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত দেখা গেল। আরাভ চুপচাপ হজম করছে। তার এই মুহুর্তে কি করা উচিৎ, বোধহয় তারও জানা নেই।

হঠাৎই ভিডিও কলে গৌরবসহ পুরো পরিবারকে দেখা গেল। সেন্টার টেবিলের মাঝে রাখল মুঠোফোন। তারপর ফোন থেকে গৌরবের উচ্ছ্বসিত গলার স্বর ভেসে এল।
‘কাজী সাহেব শুরু করুন। ছেলের বিয়ের দু’দুবার সাক্ষী হচ্ছি।’
তারপর হো হো করে হেসে উঠল। বিয়ে পড়ানো শুরু হতেই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল তারা। অথচ আরাভ পৌষী নিজেই জানে না কি হচ্ছে তাদের সাথে। পৌষী এখনও দ্বিধান্বিত। কিন্তু আরাভ অনুভূতিহীন। এত উৎকন্ঠা আর অনিশ্চয়তার মাঝে বিবাহ সম্পন্ন হল অবশেষে। দু’জনেই কাবিননামায় স্বাক্ষর করল। প্রিয়া আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। তখন মুঠোফোনের ওপাশ থেকেও গৌরবদের আলহামদুলিল্লাহ বলতে শোনা গেল। কিন্তু সৌরভ নিশ্চুপ। আনন্দিত না’কি নারাজ বোঝা গেল না।

চলবে,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ২৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

দীর্ঘসময় কাটল একাকী নিজের রুমে বসে। কিছুটা মায়ের ধমকে আবার কিছুটা নিজেকে ধাতস্থ করতে। কিন্তু শাড়ি পরে এভাবে বসে থাকাটা যেন গায়ে বিঁধছে পৌষীর। সেই কখন থেকে অপেক্ষারত আরাভের জন্য। অথচ সেই মানুষটা এখনো এলো না। তাদের বিয়ে সম্পন্ন হতেই নিজের রুমে খিল দিয়ে বসে আছে। না বের হয়েছে একবার, না তাকে দেখল একপলক। এই লোকের কি সমস্যা আজও জানা হয়নি। আক্ষেপের শ্বাস বেরিয়ে এল বক্ষপট থেকে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে সে? পেটের নাড়িভুঁড়ি জানান দিচ্ছে ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু তার মা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, আরাভ এলেই একসাথে খেতে দেবে। অধৈর্য্য হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। বারান্দায় গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিল, যদি একবার আরাভকে দেখতে পায়। সরাসরি কীভাবে দেখবে? লজ্জা করছে ভীষণ। তার এমন লম্ফঝম্পের মাঝে প্রিয়ার ডাক ভেসে এল। সে যেতেই দেখল মায়ের হাতে খাবার। তাকে দেখে বলল,

‘আরাভের ঘরে যা তো খাবার নিয়ে।’

পৌষী চমকে উঠল। ভীত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। তার লজ্জা-ভয় দুটোই করছে এখন। মিনমিনে জবাব দিল, ‘আম্মু তুমি ডাকো না।’

‘তুই যাবিই, না থাপ্পড় খাবি।’

প্রিয়ার কড়া কথায় পৌষী চুপচে গেল। প্রিয়া খাবারের ট্রেই তার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে। নিজের রুম ছেড়ে বেরুলো পৌষী। উদ্দেশ্য আরাভের রুম। পুরো ঘর আচমকাই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। বসার ঘর খালি, ড্রাইনিং রুম ফাঁকা। তার মাও কিচেন থেকে চলে গেছে। তার পাপাহ থম মেরে আছে। মুখে রা নেই। আরাভও কেমন নির্জীব। অথচ বিকেলেও তার দু’চোখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়তে দেখেছে। তবে কি পাত্রপক্ষের সামনে তাকে বসতে দেখে এমন হয়েছে তার। এজন্য বুঝি তার এত নীরবতা? এত চুপচাপ আরাভকে তার বড্ড ভয় লাগে। যেমনটা পাঁচবছর আগেও লেগেছিল। জবাবদিহিতার ভয়ে সে তার থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে ছিল প্রতি মুহুর্তে। আর সেই দূরত্বই ছিল তার জীবনের অভিশপ্ত কাল। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাও এত ভয় কেন হচ্ছে তার?

ত্রস্ত পায়ে আরাভের দরজার চৌকাঠে দাঁড়াল। মৃদু শব্দে করাঘাত করল দরজার মাঝে। বার কয়েক শব্দ করল, কিন্তু ভেতর থেকে জবাব এল না কিছুই। পৌষী ভয়ে তটস্থ। এই বুঝি আরাভ ধমক দিয়ে উঠে। এখানে কি? যা তো বিরক্ত করিস না। হাত দুটো ব্যথায় ককিয়ে উঠল তার। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিন্তু তার কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দরজার ওপাশ থেকে মলিন এক স্বর ভেসে এল।

‘দরজা খোলা আছে, নব ঘুরিয়ে ভেতরে এসো।’

সে পুরোই বেকুব বনে গেল। ছিঃ! কি লজ্জা! সে একবার চেক করেও দেখল না। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। কিন্তু ভেতরে যেতেই তার আক্কেলগুড়ুম। বাতিহীন বদ্ধ রুম। বারান্দারও কপাট দেওয়া। শুধু জানালা দুটো খোলা। জানালার সেই ফাঁক গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে আকাশের বুকে লেপ্টে থাকা চাঁদের উজ্জ্বল আলো। সেই আলোয় রুম পুরো আলোকিত। কিন্তু সে হতরুদ্ধ অন্যকিছু দেখে। পূর্বমুখী পা বিছানায় চিৎ হয়ে মাথা কিছুটা বাইরে ঝুঁকিয়ে আরাভ শুয়ে আছে। হাতের মাঝে তার জ্বলন্ত নিকোটিন। মুখে ধোঁয়া নিয়ে সেই ধোঁয়া আবার উপরের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে। এমন দৃশ্যই বক্ষস্থল কেঁপে উঠল তার। রুম জুড়ে নিকোটিনের কালো ধোঁয়া আর বিদঘুটে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। সে খুকখুক করে কেঁশে উঠল। নাক চেপে রেখেছে দুর্গন্ধে।

আরাভ একপলক তাকাল। সেই তাকানোতে ছিল বড্ড অসহায়ত্ব। কিন্তু মুখে জবাব নেই তার। পৌষী খাবার ট্রেই টেবিলে রাখল। আরাভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

‘আরাভ ভাই তুমি সিগারেট খাও?’

আরাভ রাশভারী কন্ঠে জবাব দিল, ‘হুমম।’

‘কখন থেকে?’
‘নিজের প্রিয় মানুষটা যবে থেকে অন্যের হয়ে গেছে।’

পৌষীর অস্থির লাগছে ভীষণ। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল। এমনটা না করলেও পারত সে। কিন্তু সে অপরাগ ছিল তখন। নিজের বান্ধুবীকে কষ্ট দিতে পারেনি। ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হল না। উল্টো পাঁচটা বছর ধরে সে লাপাত্তা। কতটা নিষ্ঠুর লোক! ফিরে এল তাও অন্য নারী নিয়ে। কই সে’তো কিছু বলেনি এসব নিয়ে। তাহলে সে কেন অতীতের সব মনে রেখে দিয়েছে। নিশব্দে আফসোসের শ্বাস ছাড়ল সে। বলল, ‘

‘কিন্তু তাই বলে সিগারেট খাবে?’

‘কি করব আর? তাকে তো ভুলতে পারব না, কিন্তু চাইলে নিজেকে তো ভুলতে পারব।’

‘অনেক রাত হয়েছে, খাবে না।’
‘নাহ, খিদে নেই।’
‘অল্প করে খাও।’
‘খাবারটা নিয়ে চলে যাও, আমি এখন ঘুমাব।’
‘আম্মু শুনলে কষ্ট পাবে কিন্তু।’

আরাভের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। বলতে ইচ্ছে করল, তুমি কষ্ট পাবে না পৌষমাস। আমার জন্য তোমার কি একটুও কষ্ট হয় না। বড্ড নিষ্ঠুর রমণী তুমি! কিন্তু মুখ ফুটে কোনো জবাব দিল না। পৌষী সটান দাঁড়িয়ে আছে সেই কখন থেকে। তার খুব বলতে ইচ্ছে করল, এত সিগারেট কেন খাচ্ছো? অসুস্থ হয়ে যাবে তো? কিন্তু আদৌ কি এই কথা সে বলতে পারবে। একটু চেষ্টা করলে ক্ষতি কি তবে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘আরাভ ভাই,
‘হুমম।
‘এত সিগারেট খেয়োও না, তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু।’

আরাভ আবারও মৃদু হাসল। হাসিতে কি মেশানো ছিল তার জানা নেই। আবারও এক পলক তাকাল পৌষীর দিকে। চাঁদের আবছা আলোতে মুখটা অস্পষ্ট। গায়ে এখনো সেই কালো শাড়ি। যে শাড়ি বেশ পছন্দ করে তার পৌষমাসের জন্য এনেছিল। সত্যিই অপূর্ব লাগছে তাকে। তবে মেয়েটার চোখমুখ কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। হয়ত কিঞ্চিৎ চিন্তার আভাস তাকে নিয়ে। সে মলিন গলায় ডাকল, ‘পৌষী, এদিকে এস।’

নিজের নাম শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠল পৌষীর। কত স্নিগ্ধতা মেশানো এই ডাকে। কেমন যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। সে সম্মোহিত হল নিজের অজান্তেই। আরাভ তাকে ডেকে নিজের পাশে বসার জন্য ইশারা করল। পৌষী পাশে গিয়ে বসল চুপচাপ। সে আবারও ইশারা করল পা তুলে বিছানায় বসার জন্য। অস্বস্তি ভুলে পৌষীও তাই করল। আরাভ তার দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। দৃষ্টির নড়চড় নেই তার। হঠাৎই আবদারের সুরে বলে উঠল, ‘তোমার হাতটা ছুঁতে পারি।’

পৌষী বোধহয় কয়েক মুহুর্ত ভাবল। তারপর নিজের হাত উঠানোর প্রয়াস করতেই ওপাশ থেকে আরাভের নিষেধাজ্ঞা জারি হল।

‘না থাক।’

নিজে শোয়া থেকে উঠে বসল। পৌষীর মুখ বরাবর করে দু’পা মুড়িয়ে বসল তার সামনে। পৌষীর গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে বলল,

‘ছোট আম্মু চড় মেরেছে তোমাকে। ইশশ, গালটা এখনো লাল হয়ে আছে। আমাকে বলতে পারলে না, তাহলে বিয়েটা সেখানেই বন্ধ করে দিতাম।’

পৌষী চমকালো। আরাভ কীভাবে বুঝল তাকে চড় দিয়েছে। তবে চড়টা বিয়ের জন্য নয়, পাত্রপক্ষের সামনে নতজানু হয়ে বসার জন্য। তার বাবাও মায়ের কটুবাক্য শুনেছে অনেক। সে অদ্ভুতভাবে তাকাল আরাভের দিকে। মনটা অনেক কিছু বলতে চাইছে আজ, কিন্তু অস্বস্তি যেন তার পিছু ছাড়ছে না। পুনরায় আরাভ অনুশোচনার সুর তুলে বলল,

‘সর‍্যিই, আমার জন্য মার খেতে হল। বিশ্বাস কর, আমি এমনটা কখনো চাইনি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি সুখী হতে চাই না।’

তারপর চুপসে গেল সে। চোখদুটো তার ছলছল। চোয়ালে জল গড়িয়ে যাওয়ার দাগ এখনো দৃশ্যমান। চোখমুখ ফ্যাকাসে অনুজ্জ্বল। ঠোঁটের কোণে হাসি নেই। বিবর্ণমুখ কিছু মুহুর্তের মাঝেই। আহত ছাতক পাখির মত উপরে মুখ তুলে রেখেছে। নিশব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তার। আবছায়া আলোয় পৌষী বুঝল না আরাভের নীরব আর্তনাদ। কিন্তু সে উদগ্রীব হয়ে আছে আরাভের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। কিছু সময় পর ফের আরাভ বলে উঠল,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সত্যি বলবে তো?’
‘হুমম।’
‘আমার ছোঁয়া কি খুব খারাপ পৌষী? তোমার কি খুব খারাপ লাগে?’

পৌষী থ হয়ে গেল। এটা কেমন জিজ্ঞাসা? জবাবটা কি দেয়া উচিৎ এখন তার। আরাভের ছোঁয়ায় তো তার খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু লজ্জা তো অবশ্যই পায় সে। এটাও কি মুখ ফুটে বলতে হবে এখন। কি এক লজ্জাকর মুহুর্ত! সে চরম অস্বস্তিতে হাসফাস করছিল। কোন সদুত্তর দিতে পারল না। আরাভ তাচ্ছিল্যের হাসি দিল মুখে তখন। বলল,

‘সর‍্যিই পৌষী, আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করব না। আমার এই হাত আর কখনো তোমাকে ছুঁতে যাবে না।’

পৌষী নিজের দৃষ্টি নীচে করে ফেলেছে। আমতা আমতা করে বলল,
‘আমি কখন বললাম, বি,,বিরক্ত হয়েছি। আর খা,,খারাপ কখন বললাম।’

‘তুমি সত্যিই বিরক্ত হও না। আমার ছোঁয়া খারাপ লাগে না তোমার। তাহলে ঐ সাফওয়ানকে কেন তোমার হাত ছুঁতে দিলে পৌষমাস? কেন তার কাঁধে হাত রাখলে? শুধুমাত্র আমাকে দেখানোর জন্য তুমি ঐ সাফওয়ানের সাথে প্রেমের অভিনয় করলে? তাকে তোমার কাছে আসার সুযোগ দিলে? আমি তোমার স্বামী হয়েও কখনো ঐ চোখে দেখিনি। কিন্তু ঐ সাফওয়ান তোমাকে দেখেছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। বিশ্বাস কর, এই বুকে এখনো সেই ক্ষত রয়ে গেছে। আজও শুকায়নি।
তারপর পাঁচটা বছর, আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। যাতে তুমি নিজেকে ভালো রাখতে পারো। তোমার অনুভূতিকে বুঝতে পারো। কিন্তু, আমি পারিনি তোমাকে ভুলতে। বিশ্বাস কর, প্রতি মুহুর্তে আমি তোমাকে অনুভব করেছি। ছটফট করেছি, নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। আমি ভালো ছিলাম না, তাই তো ছুটে এলাম আবারও তোমার কাছে। ফিরে এলাম আবারও আমার পৌষমাসকে পাওয়ার আশায়। কিন্তু তুমি আবারও একইরকম কাজ করলে। তবে এবার অভিনয় নয়, সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলে। একটা সুযোগ আমাকে দিলে না। আমার চোখের ভাষা কেন তুমি বুঝতে পারো না পৌষমাস। কেন অন্যের জন্য আমাকে ঠকালে? তুমি জানো, ঐ ডাক্তার ছেলেটা তোমাকে কীভাবে গিলে খাচ্ছিল। তার নজর তোমার শরীরের কোথায় কোথায় বুলিয়েছে তুমি টেরই পাওনি।

তুমি আমার হয়েও আমার নও পৌষমাস। বার বার আমি হেরে যাই, ভীষণ বাজে ভাবে হেরে যাই। আজো হেরে গেছি আমি পৌষমাস।’

নিদারুণ নীরবতা গ্রাস করল দু’জনকে। আরাভ চুপ হয়ে গেছে। হাতের জ্বলন্ত নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত এখন। অথচ পৌষী স্তব্ধ। সে তো শুধু রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু এত কিছু ঘটবে হয়ত কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। মুখের অভিব্যক্তি শূন্য। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘আপনিও তো হবু বউ নিয়ে এসেছেন? কই আমি তো জবাবদিহিতা চাইনি আপনার কাছে?’
আরাভ মৃদু হাসল। বলল, ‘আমাকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দাওনি।’
পৌষী আরও কিছু বলতে উদ্বত হল। কিন্তু আরাভ থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে পৌষমাস। যাও ঘুমিয়ে পড়।’
পৌষী নড়ল না। আরাভ পুনরায় একই কথা বলল। সহসাই তার নাকে পোড়া গন্ধ এসে ঠেকল। উঠে আশেপাশে খুঁজল এই গন্ধের উৎস কোথায়। কিছুসময় পর দেখল, একটা স্টিলের ঝুঁড়িতে কিছু পোড়া কাপড় পড়ে আছে। সে বাতি জ্বালিয়ে দেখে তো হতভম্ব। তার পরনের সেই নীল শাড়ী, ব্লাউজ ও পেটিকোট। আবার জুতাও আছে। পাত্রপক্ষের সামনে পরেছিল এই শাড়ি। কিন্তু পুড়লো কেন বুঝল না। সে কোপিত কন্ঠে বলল,

‘এসব কি আরাভ ভাই? শাড়িটা পুড়েছেন কেন?’

‘এই শাড়িতে অন্য পুরুষ আমার বউকে দেখেছে, তাই পুড়ে ফেলেছি।’

‘আর ইউ ম্যাড?’
‘ইয়েস, অ্যাই এম ম্যাড। নাও, প্লিজ লিভ মাই রুম।’

চলবে,,,,