প্রিয়৷ পৌষমাস পর্ব-৩১+৩২

0
157

#প্রিয়_পৌষমাস ৩১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সময়গুলো যেন বড্ড এলোমেলো। না খেতে ভালো লাগছে, না ঘুমাতে। নিজের রুম যেন নিজেরই মনেই হচ্ছে না পৌষীর। একটা মানুষের শূন্যতা এমন পোড়াবে তার জানা ছিল না। বিছানার দিকে তাকালে আরাভের স্মৃতিই রোমন্থন হয় বেশি। তার কথা, হাসি, খুনসুটি ও তার ভালোবাসার একান্তই ছোঁয়া। কি যে ইন্দ্রজাল জানে! মাত্র তিনদিনে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে তাকে ছাড়া। নিজের উপর বিরক্ত হল সে। রুম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বসার ঘর থেকে তার দাদুর হাসির শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ করে এত উচ্ছ্বসিত তার দাদু? কারণ খুঁজতে সে পা বাড়াল। চৌকাঠে পা রাখতেই শুনতে পেল কারো সাথে মুঠোফোনে কথা বলছে। তাও আবার বেশ রসিয়ে রসিয়ে। সে আড়ি পাতলো শুনার জন্য।

নাজমা বলল, ‘কিছু লোক কথা শুনে না, তাদের জোর করে বেঁধে নিতে হয় দাদু ভাই।’
অপর পাশে কি বলল সে শুনেনি। তবে সে বোধহয় মজার কিছু বলেছে। তখন তার দাদু হেসে উঠল বেশ উচ্চস্বরে। পৌষী অবাক হল। সে বুঝতে পারল এ লোক আরাভ ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু তার মনে একটাই প্রশ্ন, আরাভ তাকে মাত্র দু’বার কল দিয়েছে তিন দিনের মধ্যে। আর কল দেয়নি কেন? অথচ সবার সাথে ঠিকই ফোনালাপ করে, শুধু তাকে ছাড়া। মনটা বিষিয়ে গেল বিষাদের নীলচে বেদনায়। আরাভের উপর অভিমান জমল। দাঁড়ালো না আর, নিজের রুমে ফিরে এল আবার।

পৌষী যেতেই নাজমা আবার হেসে উঠল। ফিসফিস করে বলল, “কেন শুধু শুধু বউকে কষ্ট দিচ্ছো, নিজেও কষ্ট পাচ্ছো?”
আরাভ রগড় গলায় বলল, “দাদু এবার তোমার নাতনি আসবে আমার কাছে, আমি যাব না কিন্তু বলে দিলাম।”
নাজমা হতাশ হলেন। বলল, “কেন জেদ ধরে বসে আছো?”
আরাভ বলল, “দাদু জেদ নই, তোমার নাতনী আমাকে কেমন ভালোবাসে এটা তার পরীক্ষা মাত্র।”

নাজমা বুঝলেন না এত কঠিন ভাষা। তার কাছে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর এত দূরত্ব পছন্দ নয়। আর ভালোবাসা? বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমনিতেই ভালোবাসা হয়ে যায়। মেয়ে’রা চাপা স্বভাবের হয়। তাই মুখ ফুটে সব জাহির করতে পারে না। কিন্তু স্বামীদের তাদের আচরণ দেখে বুঝে নিতে হয়। এই সহজ ভাষা সে তার নাতীকে বুঝাতে অক্ষম। সে বরাবরই হতাশ। তবে সে চাই পৌষী একটু বুঝদার হোক। আরাভের মনের ভাষা বুঝুক। দুজনই একে অপরকে বুঝক। তাদের পথচলা দীর্ঘায়িত হোক, আমৃত্যু পর্যন্ত একসাথে চলুক তারা।
________

সারাদিন ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে পৌষী। পড়ন্ত বিকেল। শীতের প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছে। সাথে কুয়াশার তীব্রতাও। কিন্তু হিমেল হাওয়ার কিছুটা রেশ রয়ে গেছে। সে হিমেল হাওয়ার পরশে বারান্দায় দোলনায় বসে দুলছে। আনমনে অনেক কিছুই ভেবে চলেছে। এই দোলনায় দু’জনের অজস্র স্মৃতি জমা আছে। তাদের প্রথম কাছাকাছি আসা, একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করা। এসব তো এই দোলনা থেকেই শুরু হয়েছিল। ভাবতেই লজ্জায় লাল হল তার দু’গাল। সে আরাভকে নিয়ে গভীর ভাবনায় মশগুল। হঠাৎই কারো কড়া ধমক ভেসে এল। তার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকসা। চোখমুখ কেমন মলিন হয়ে আছে। তাকে দেখে বলল,

‘একা একা কি করছো?’

পৌষী হতবাক। আকসাকে এই সময় একদমই আশা করেনি সে। তাই চোখ পিঠ পিঠ করে বলল,

‘তুমি, কখন এলে আপু?’

‘কিছু সময় হয়েছে। কিন্তু তোমার নজর অন্য কোথাও ছিল, তাই খেয়াল কর নি আমাকে।তারপর বল দিন কেমন যাচ্ছে তোমার?’

পৌষী হা করে থাকল কিছু মুহুর্ত। তারপর বলল, ‘আপু, তুমি রিসিপশনে আসো নি কেন?’

আকসা মৃদু শব্দ তুলে হাসল। তার পাশে দোলনায় বসতে বসতে জবাব দিল, ‘কিভাবে আসব? আমার জায়গাটা তুমি ছিনিয়ে নিলে। সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। আমার বুঝি কষ্ট হয় না।’

‘আপু, সর‍্যিই! আসলে আমি এমনটা চাইনি কখনো?’

‘দূর, বোকা মেয়ে! আমি তো মজা করছি তোমার সাথে। আমার যে বাগদান হয়েছিল, কীভাবে আসবো বল?’

‘তোমার বাগদান হয়েছে আপু? কার সঙ্গে?’

‘আমার কাজিন মামাতো ভাইয়ের সাথে। ছেলেটা আমাকে ছোট থেকেই পছন্দ করত। যদিও আমি তেমন একটা পাত্তা দিতাম না তাকে। পরে আরাভ আমাকে বোঝালো, যে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করা উচিৎ। তাহলে না’কি সুখী হওয়া যায়। আগামী সপ্তাহে আমাদের বিয়ে। তার জন্যই নিমন্ত্রণ করতে এলাম সবাইকে। তা তোমার বরের কি খবর পৌষমাস? ‘

‘কানাডায় আছে, হয়ত ভালোই আছে।’

‘কে বলেছে তোমাকে, সে ভালো আছে?’

‘ভেবে নিয়েছি।’

‘পৌষী, সে কখনই ভালো থাকবে না তোমাকে ছাড়া। ওকে এভাবে একা ছাড়া উচিৎ হয়নি তোমার। ভালোবাসলে তাকে আঁকড়ে রাখতে হয়। তার সুবিধে-অসুবিধে সবই দেখতে হয়। আরাভ কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ। সে চাইলেই যখন-তখন বাংলাদেশে আসতে পারবে না, কিন্তু তুমি তো যেতে পারবে। তোমার উচিৎ ছিল এখন তার সাথে থাকা।’

‘কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ মানে?’

‘তোমার জামাই বাংলাদেশ কেন আর কোথাও চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে না। সে কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এই মর্মে, সে কখনো এই প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যহতি নেবে না। যদি নেয়, তবে তাকে বাংলা টাকায় প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা জরিমানা বাবত প্রদান করতে হবে। কোম্পানি থেকে তার ছুটি প্রতি ছ’মাসে ঊনত্রিশ দিন করে দেয়া হয়েছে। এর আগে নতুন কোন ছুটি নেই। কিন্তু কানাডায় থাকলে প্রতি মাসে সে সাত দিন করে ছুটি পাবে। বউ-বাচ্চা থাকলে তাদের জন্য আলাদা ভাতাও দেওয়া হবে। কোম্পানি ওকে বাড়ি গাড়ি সব দিয়েছে। তোমাকে আরাভ এসব কিছু বলেনি?’

নিরুত্তাপ পৌষী এতক্ষণ আকসার সব কথায় শুনল। কিন্তু তার কিছু একটা খটকা লাগল। আরাভ তাকে সবকিছু খুলে কেন বলেনি। কেন মনে হচ্ছে, আরাভ অনেক কিছু লুকিয়ে গেছে তার কাছে। সে ফোৎ করে শব্দহীন নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘আপু, তুমি এতকিছু কীভাবে জানো?’

আকসা হাসল। কিন্তু মুখের কোণে কিঞ্চিৎ হতাশা দেখা গেল তার। বলল,

‘জানার জন্য আগ্রহ থাকা লাগে পৌষী। শুধু স্ত্রী হলে হয় না, তার প্রতিও তোমার অনেক দায়িত্ব আছে। যা তুমি পালনে ব্যর্থ। তোমার জায়গায় আমি হলে কবে তার সাথে ছুটে যেতাম। কানাডার পাঁচ বছরের জীবনে আমি আরাভের এলোমেলো জীবন দেখেছি। কীভাবে একাকিত্বের যাতাকলে পড়ে অসহায় ভাবে ধুঁকছিল। সে সময় তার সাথে আমার খুব বেশি বন্ধুত্ব ছিল না। তবে ওকে দেখতাম মাঝে মাঝে ভার্সিটি আসতে। কেমন উদাসীনতা লেপ্টে থাকত তার চোখমুখ জুড়ে। ক্লাসের এককোণে বসত চুপচাপ। কারো সাথে কথা বলতে চাইতো না। সুদর্শন হওয়াতে মেয়েদের প্রপোজালের লিষ্টে থাকত সবার উপরে। ওর জন্য কত শতাধিক মেয়ে পাগল ছিল। তা গুণে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তার একটা স্পষ্ট বাক্য ছিল, অ্যাই এম ম্যারিড। অ্যাই হ্যাভ এ সুইট ওয়াইফ। সো প্লিজ লিভ মি। বিশ্বাস কর, এই বাক্যে বলার সময় তার চোখমুখ তখন উজ্জ্বল হয়ে যেত। আমি বেশ অবাক হতাম। অথচ দিনের শেষে লেকের ধারে দেখতাম সিগারেট ফুঁকতে। একদিন তাকে সাহস করে অনেক কথা জিজ্ঞেস করি। নিজ থেকে খুব কমই জবাব দেয় সে। কিন্তু সেদিন বলেছিল তোমার কথা। সেদিন অনেক ব্যাকুলতা ছিল তার কথার মাঝে। তার পৌষমাস তাকে কখনো ভালোবাসবে তো? এই বাক্যেটাই ছিল তার সবচেয়ে বলা বাক্যের মধ্যে একটি।’

আকসা কিছুসময়ের জন্য থামল। হঠাৎই তার চোখ পড়ল পৌষীর উপর। সে বলে উঠল,
‘পৌষী।

পৌষীর চোখদুটো ছলছল। বোধহয় আর একটু হলেই টুপ করে নোনাজল নিচে নেমে পড়বে। আকসা অবাক হল না। বলল,

‘এভাবে বিরহে না পুড়ে তার কাছে ছুটে যাও। মন ভালো থাকবে। তারও দহন কমবে।’

পৌষী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আপু তোমার সাথে আরাভের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছিল, তা কি সত্যি নয়?

আকসা শব্দ করে হাসল এবার। বলল, ‘পুরোটাই গুজব। আরাভ তোমাকে ভালোবাসে, বউ হিসেবেও মানে, কিন্তু বার বার অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল তোমাদের বৈবাহিক সম্পর্ককে। সে এই বিয়ে খারিজ করলে তুমি ভালো থাকবে। এসব প্রলাপবাক্য বকতো সবসময়, যার কারণ আমরা কেউই জানি না। সেটা উদঘাটন করতে গৌরব আঙ্কেল আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আর আমিও তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ব্যস, এইটুকুই।’

পৌষী নিরুত্তোর। কি জবাব দেবে এখন। মনটা আকুপাকু করছে আরাভকে দেখতে। কিন্তু এখন কীভাবে দেখবে সে। লোকটা তাকে কলই দেয় না। আকসা পৌষীর বিচলিত মুখ দেখে হাসল। বলল,

‘এত ভেবে কি লাভ? স্বামীর পাশে থাকো। ভালোবাসা উজাড় করে পাওয়ার এই তো সময়। চলে যাও দু’একদিনের মধ্যে।’

পৌষী ভাবছে। সত্যি সে কানাডা যাবে? কিন্তু একা কিভাবে যাবে। তার ভয় হচ্ছে। আকসা উঠে দাঁড়াল। বলল, পৌষী ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। আজকে আমি আসছি। পৌষী হতবাক হল। বলল, এই সময় কোথায় যাবে তুমি? আকসা আবারও হাসল। বলল, আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। যেতে হবে। আমার হবু জামাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। পৌষী বাঁধা দিল না আর। আকসা চলে গেল নিজের গন্তব্য। পৌষী আবার একা। তাকেও তার গন্তব্যই ফিরতে হবে।

রাতে খাওয়ার মাঝে আরিবা বলে উঠল, সে কানাডায় ফিরে যাবে। তার ভার্সিটি মিস হচ্ছে। কিন্তু আলিশবা তাকে একা দিতে নারাজ। তখন আরিবা বলে উঠল,
‘আমি একা কোথায়? আমার সাথে ভাবীও যাবে।’

সবার চোখমুখে উচ্ছ্বাস। অথচ পৌষী পুরো থ! সে কখন বলল, কানাডায় যাবে। অথচ গৌরবের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। অবশেষে তার ছেলের বিবি রাজী। সে কালকেই টিকেট কেটে নিবে। খাওয়া শেষ হতেই পৌষী অস্থির হয়ে পায়চারি করছে রুম জুড়ে। হঠাৎ তার মনে হল আরাভ যাওয়ার আগে তাকে একটা খাম গিফট করেছিল। যেটা সে খুলে দেখেনি। তাই চট করে সেই খাম হাতে নিল। খাম খুলতে যা দেখল, তাতে চোখ কপালে।

‘মাই সুইট ওয়াইফ,
আপনাকে স্বাগতম কানাডায় আসার জন্য। এখানে আপনার জন্য ভিসা, পাসপোর্ট ও টিকেট বুক করা আছে। যখনই মনে পড়বে আপনি আমার কাছে ছুটে আসবেন। আমার রুম ফুল দিয়ে সাজানো হবে দ্বিতীয় বাসরের জন্য। জলদি আসুন। আপনার অপেক্ষায় আছে আপনার লাভলি হ্যাজবেন্ড।

চলবে,,,,,

#প্রিয়_পৌষমাস ৩২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

ম্যাপল পাতার দেশ। কমলা আর হলদে পাতায় কানাডার রাস্তাঘাট ভরে থাকে অন্যান্য ঋতুগুলোতে। কিন্তু শীত এখনো বিরাজমান অন্টারিওর শহরে। তাই তুষারে আবৃত এখন গাছ থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটও। মার্চ এলেই বসন্তের আগমন হবে। সকালের আলো ফুটতেই তারা কানাডার অন্টারিও এসে পৌঁছাল। এখানের সূর্যের আলোর দেখা মিলল না। কিন্তু অচেনা নগরীতে পা রাখতেই যেন অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি হল পৌষীর। হিমেল বাতাসে গা শিউরে উঠল। মন বলছে, এ যে তার স্বপ্নের শহর। এই শহরে তার প্রিয় মানুষ থাকে। তাই বুঝি এই শহরের বাতাসেও তার সুগন্ধি ভেসে বেড়ায়। লম্বা করে শ্বাস টানল সে। মুখের কোণে লাজুক হাসি। আরাভ নেই সামনে, তবুও লজ্জা’রা আনাগোনা করছে তার শরীর জুড়ে। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি! এটাই বুঝি ভালোবাসার টান?

আরিবা নিজের লাগেজ টানতে ব্যস্ত। হঠাৎই চোখ পড়ল পৌষীর উপর। সে এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর বাহিরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। আরিবা হাসল। সে জানে এই হাসির কারণ। বিমানে কতবার জিজ্ঞেস করেছে, আর কত সময় লাগবে যেতে। সে ধৈর্য্য ধরে কতবার বলেছে, ভাবী আর কিছু সময়। তার ভাইকে বলা হয়নি তারা কানাডায় আসছে। এটা তার ভাবীর আইডিয়া। সে সারপ্রাইজ দেবে তার একমাত্র জামাইকে। অবশ্য সেও মনে মনে ভীষণ খুশি। তার ভাই চমকাবে ভীষণ। সাথে সেও একজনকে সারপ্রাইজ দেবে। গত বিশদিন বেশ কষ্টে ছিল। এবার আর নয়। সে বাসায় ফিরে বিকেলের মধ্যেই তাকেই সারপ্রাইজ দেবে।

গায়ে শীতের পোশাক, তাও জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়। এখানে তাপমাত্রা সবসময় মাইনাস পনেরো ডিগ্রি থাকে। এটা পৌষীর জানা না থাকলেও আরিবার সবকিছুই জানা। তাই তো নিজের শীতের পোশাক পরিয়ে দিয়েছে পৌষীকে। তাও কাঁপছে। এত শীতলতা আর কখনো অনুভব করেনি সে। আরিবা হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো। গরম গরম কফি নিয়েছিল সপ থেকে। গাড়িতে বসে পৌষীকে বলল, ভাবী কফি খেয়ে নাও। শরীরে আরাম অনুভব করবে কিছু সময়ের মধ্যে। পৌষীর ঠান্ডায় শরীর নুইয়ে পড়েছে। তাই আর দ্বিরুক্তি না করেই কফি পান করতে লাগল।

সময় যেন ফুরাচ্ছেই না। গাড়িতে বসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক। অথচ বাড়িতে কখন পৌঁছাবে তার ঠিক নেই। গাড়ির ভেতর হিটার অন করা। নয়ত বরফ হয়ে যেত এখনিই। প্রায় দশ ঘন্টার জার্নি শেষে তাদের আসল ঠিকানায় এসে পৌঁছাল। সাদা আর ধূসর বর্ণের দ্বিতলা বিশিষ্ট বাড়ি। সামনে সুবিশাল জায়গা। ফুল, ফল ও একপাশে সবজি বাগান করা আছে। রাস্তার পাশে ম্যাপল গাছে ভরপুর। বাড়ির দ্বি তলায় খোলা বারান্দা। এখানে অবশ্য গোলাকার টেবিল রাখা আছে। অন্যপাশে ঝুলন্ত দোলনা। তবে বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। দরজা-জানালা আঁটোসাটো করে বন্ধ রাখা আছে। ঘরের ভেতরও হিটার অন করা। ভেতরে প্রবেশ করে পৌষীর মন খারাপ হয়ে গেল। আরাভ নেই, তার অফিসে চলে গেছে। আরিবা তাকে সান্ত্বনা দিল। চিন্তা কর না ভাবী, আমি আছি না। তার কাছে বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। সেটা দিয়ে দু’জনেই ভেতরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পৌষীর মন খারাপ যেন তরতর করে বেড়েই চলেছে। এত দিন পর এসেও সে আরাভকে দেখল না।

কিচেন রুমে এসে পৌষীর চোখ কপালে। দুপুরের খাবার রান্না করা আছে। সে আরিবাকে ডাক দিল। আরিবাও হতবাক। এত রান্না করেছে কার জন্য? আরাভ কি কোনভাবে জেনে গেছে তারা কানাডায় আসছে। পৌষী ভাবনায় পড়ল। কিন্তু আরিবার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে, তার ভাই অবশ্যই জানে। দু’জনে হালকা কিছু খেয়ে রুমে ফিরে এল। পৌষী আরাভের রুমে প্রবেশ করতে গিয়ে আরেক ধাক্কা খেল। রুম লক করা। সে আবারও আরিবাকে ডাক দিল। আরিবা এসে দেখে আসলেই তার ভাই রুম বেশ ভালোভাবে লক করে গেছে। সে হতবাক। কিন্তু পৌষীর মন বলছে অন্যকিছু। দরজা লকের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? আরিবা বলল, ভাবী তুমি আমার রুমে এসে বিশ্রাম নাও। ভাইয়া এলে জিজ্ঞেস করা যাবে তখন?

পৌষী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি হচ্ছে তার সাথে বুঝতে পারছে না। সে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাচ্ছে। আরাভ ফিরবে বিকেল ৩টার দিকে। এখনো ৪ ঘন্টা সময় আছে সে ফিরতে। আরিবার সাথে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। কালক্ষেপণ করল না তার ঘুমও। মুহূর্তে রাজ্যের ঘুম নামল দু’চোখ জুড়ে।

ঘুম ভাঙলো বিকেল ৪টায়। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে অবাকই হল বেশ। এত ঘুমিয়েছে সে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নামল। প্রথমে আরিবাকে ডাক দিল। কিন্তু তার কোন সাড়া-শব্দ নেই। কিছুটা অবাক হল। মেয়েটা গেল কোথায় তাকে রেখে। তারপর নীচে নামতেই চমকে উঠল আরেক দফা। আরাভ চলে এসেছে। মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করে টেবিলে পরিবেশন করে রাখছে সে। কি বলবে এখন। ধরা পড়ে আমতা আমতা করে সালাম দিল,

‘আসসালামু আলাইকুম।’

আরাভও ফিরতি জবাব দিল, ‘ওয়াইলাকুম আসসালাম।’

এরপর পৌষী চুপ করে গেল। কি বলবে আর। নিজের ওড়না এক হাতে ধরে আঙ্গুল দিয়ে মোচড়ামুচড়ি করছে সে। আরাভ একপলক তাকাল। বলল,
‘খেতে এসো, ঘুমাচ্ছো দেখে আর ডাকিনি তখন।’

পৌষী ভাবনায় পড়ল। আরাভ কি জানত, তারা আসবে? কিন্তু কীভাবে জানল সে? আর আরিবা কোথায়? সে আবারও আমতা আমতা করল,

‘আরিবা কোথায়?’
‘তোমার ননদ তার ফেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে। চলে আসবে কিছুক্ষণ বাদে।’

পৌষী না চাইতেই মুখ ফুলালো। তার ভীষণ মন খারাপ। সে এখনো সটান দাঁড়িয়ে আছে। আরাভ মৃদৃস্বরে ডাকল,
‘চেয়ারে বস। খাবার কিন্তু তাড়াতাড়ি খেতে হবে। এখানে খাবার দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায় কিন্তু।’

পৌষী মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। আরাভের পাশাপাশি চেয়ারে বসল সে। দু’টো আলাদা প্লেট রাখা তার সামনে। তার খুব বলতে ইচ্ছে হল, আমাকে খাইয়ে দাও সেদিন রাতের মত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেখল তার জন্য প্লেটে আলাদা করে সব খাবারই পরিবেশন করা আছে। খিদে পেয়েছে ভীষণ। তাই কোনো রকমে সেই খাবার গিলছে সে। কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ। আরাভ তাকে দেখে একটুও চমকালো না। না জিজ্ঞেস করল, কেমন আছে সে? কীভাবে এত জার্নি করে এতদূর আসল? না একটু কাছে টানল, না বুকে জড়িয়ে ধরল। সে বড্ড হতাশ হল। আড়চোখে আরাভকে দেখল। সে নিশ্চিন্তে খাবার গিলছে। তা দেখে মনটা আরও হতাশ হল। আরাভের কাছে যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই। সে খাবারটা দ্রুত শেষ করে বলল,

‘শরীরের ক্লান্তিবোধ এখনো যায়নি। আবার একটু শুয়ে থাকব। যাব উপরে?’

আরাভ হুম বলে মাথা নাড়াল। পৌষীর মনটা যেন বিষিয়ে গেল এবার। কেমন মানুষ সে? কোনো হেলদোল নেই। সে এতদূর কার জন্য পাড়ি দিয়ে এসেছে। উপরে উঠছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। পা দু’খানাও কেমন ভার হয়ে আছে। পেছন থেকে তার জন্য একটা ডাক এল,

‘কফি খাবে? তাহলে শরীরটা আরাম পাবে।’
সে না বলে আরাভের আবদারটা নাকোচ করে দিল। আরিবার রুমে এসে আবারও শুয়ে পড়ল। এবার দু’চোখে ঘুম নেই। জলে টইটম্বুর তার চোখজোড়া। হঠাৎই দরজায় শব্দ হল। ভেবেছে আরিবা এসেছে। তাই বলল,

‘ভেতরে না এসে শব্দ করছো কেন আরিবা?’

বিপরীতে এক নমনীয় স্বর ভেসে এল, ‘আরিবা নই, আরাভ।’

পৌষী আর জবাব দিল না। ফাঁটা বেলুনের মত মুখ চুপসে আছে তার। আরাভের উপস্থিতি টের পেয়ে সে বিছানার অন্যদিক ঘুরে শুয়ে আছে। আরাভ ধীর পায়ে তার পাশে এসে বসল। পৌষীর বাহুতে হাত রাখতেই সে তেতে উঠল,

‘ডিষ্টার্ব করো না’তো। আমার ভালো লাগছে না।’

আরাভ ‘হুমম’ বলে শব্দ করে সুর টানল। কিঞ্চিৎ শব্দে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘কেউ চাইলে আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে কিন্তু। কত দূর থেকে এসেছে স্বামীকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য। অথচ কাছে এসেও তার দূরত্ব বাড়িয়েই চলছে। আমি কিন্তু কিছু মনে করব না। সে যেন ঝটপট আমাকে জড়িয়ে ধরে।’

পৌষী আগের মতই শুয়ে আছে। আরাভ কপট রাগ দেখাল। তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। দু’গালে নিজের দু’হাত রেখে বলল, ‘কাছে এসেও এত অভিমান কর কেন? নিজ থেকে কি একবারও জড়িয়ে ধরতে পারো না। নিজের স্বামীকে একবার ভালোবাসিও বলতে পারো না। কেমন বউ তুমি? আমি দুপুর ১টায় বাসায় এসেছি। সেই তখন থেকে কিন্তু দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি। তুমি ক্লান্তিতে ঘুমে বিভোর। তাই আমি ইচ্ছে করে ঘুম ভাঙ্গায়নি তোমার। এত দূর জার্নি করছো দেখে। কাছে এসেও নিজ থেকে কাছে আসো না কেন? তুমি না আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার কথা ছিল?’

‘কিসের সারপ্রাইজ দেব? তুমি তো জেনেই গেছো আমরা আসব?’

‘কীভাবে জানলাম, জিজ্ঞেস করবে না?’
‘কীভাবে?’
‘তোমার টিকেট ভিসাতে লাগতেই অটো মেসেজ এসেছে আমার ফোনে। সেভাবেই জেনেছি। তুমি আমাকে বলনি যখন, ধরেই নিলাম সারপ্রাইজ দেবে। আচ্ছা, ঠিক আছে এবার তো একটু হাসো। আমি কিন্তু সত্যি সারপ্রাইজ হয়েছি। যখন মোবাইলে মেসেজ দেখেছি। কখন আসবে সেই অপেক্ষায় রাত কাটিয়েছি এই তিনদিন।’

পৌষী চোখ তুলে একপলক তাকিয়ে আবার মাথা নীচু করে নিল। আরাভ ফের বলে উঠল, ‘চল তোমাকে আমি আসল সারপ্রাইজটা দেখাই। এইটুকু বলে পৌষীকে কোলে তুলে নিল। পৌষী লজ্জায় আরাভের গলা চেপে ধরল। আরাভ নিজের রুমে নিয়ে এসে বলল, এবার চোখ তুলে তাকাও তো পৌষমাস।

পৌষী তাকাতে চমকে উঠল। ফুলের গন্ধে পুরো রুম মৌ মৌ করছে। হরেক রকমের গোলাপ দিয়ে সাজানো রুম। আছে সাদালিলি ফুলও। সে শুকনো ঢোক গিলে বলল, ‘তুমি ফুল দিয়ে রুম সাজিয়েছো কেন? আমি ভেবেছি নিছকই মজা করছো আমার সাথে?’

আরাভ মৃদু হাসল। পৌষীকে পেছন থেকে আলগোছে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার কাছে প্রতিদিনই স্পেশাল। তাই আজকের দিনটাও স্পেশাল ভাবে মনে রাখতে চাই। বুঝেছো মিসেস আরাভ।’

চলবে,,,,,