জায়া ও পতি পর্ব-০৫

0
18

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৫
#ইসরাত_ইতি

মেয়েটাকে একপাশে হঠাৎ হেলে পড়তে দেখে শামির ত্বরিত তার হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। ছোটোখাটো শরীরটা মুহুর্তেই শামিরের বৃহৎ বাহুতে স্থান পেলো।
শামির তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা চ’ম’কেছে। লাল বেনারসীর ঘোমটা খুলে নিচে পরেছে জান্নাতের, নিকষ কালো ঘন চুলে মাঝ বরাবর সিঁথিতে ঠাঁই পেয়েছিলো একটা স্বর্ণের ছোটো ফুলের টিকলি,সেটা হেলে গিয়েছে একপাশে।
শামির চৌধুরীর মুখ গাম্ভীর্যতায় ঠাশা, কিন্তু সে চলে গিয়েছে ঘোরের মধ্যে,বাকিসব রেখে জান্নাতের টিকলিটা ঠিক করতে লাগলো, টিকলিটাকে সঠিক স্থানে রাখতেই তার ঘোর কাটলো,ঘোর কাটাতে গলা খাঁকারি দিলো, আবারও তাকালো জান্নাতের মুখশ্রীতে। সাজ বলতে চোখে কাজল ছিল সম্ভবত,যা চোখের কোণে লেপ্টে আছে, এই মেয়েটার চেহারায় একটা কিছু আছে যেটা শামিরকে আকর্ষণ করে খুব, চুম্বকের মতো, শামির খেয়াল করেছে,নয়তো কম তো মেয়ে দেখে না রোজ,দেখলেই কেমন পাজি পাজি লাগে মেয়েগুলোকে, ধূর্ত লাগে, বেয়াদব লাগে আর লাগে কুচুটে। শামিরের মুখ বিকৃত হয় এসব মেয়ে দেখলেই। এই মেয়েটার চলনে,বলনে,তাকানোতে,কথা বলায় এমনকি ভয় পেয়ে কাপাকাপি করার মাঝে একটা ব্যাপার রয়েছে,যেটা শামির চৌধুরীর মনে লেগেছে, ভাবনা এনেছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার।
সময় গড়ায়,ছোটো নরম শরীরটা নিজের বাহুর মধ্যে থাকায় পুরুষালি মনটা বিগলিত হবার পূর্বেই শামির চৌধুরী চির গম্ভীর কন্ঠে ডেকে ওঠে,“জান্নাতুল। ক্যান ইউ হিয়ার মি!”

জান্নাত জবাব দেয়না,শুধু কপালে দেখা যায় ঈষৎ রেখা। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শামির। ভিরমি খেয়েছে নার্ভাসনেসে বুঝে যায়, নয়তোবা পুরুপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে রাত বিরেতে ডাক্তার ডাকতে হতো, বাসর ঘরে বৌ জ্ঞান হারিয়েছে এই বিষয়টি বিব্রতকর হতো খুব শামিরের জন্য।
শামির আবারও ডাকলো,“জান্নাতুল!”

এবার নাক চোখ ঈষৎ কুঁচকে ফেলে জান্নাত। শামিরের ডাক তার কানে বাজছে,তবে সে চলে গিয়েছে অন্যরকম ঘোরে।

শামির এবার দুহাতে আগলালো জান্নাতকে,গা থেকে মিষ্টি ধরণের ঘ্রাণ আসছে মেয়েটার, শামির আর এক মুহূর্তও নিজের সাথে না রেখে সুন্দর মতন শুইয়ে দেয় জান্নাতকে।
এরপর বসে বসে গম্ভীর মুখে দেখে মিনিট দুয়েক। উঠে সাইড টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে এসে অল্প অল্প করে ছিটিয়ে দেয় জান্নাতের মুখে। খানিক বাদেই হুঁশ ফিরতে দেখা যায় জান্নাতের। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝতে চায় পরিস্থিতি। কিন্তু দেখলো সেই রাগী চোখের মানুষটা কৌতুহলী হয়ে তাকেই দেখছে, স্থির হয়ে রইলো জান্নাত। আতঙ্ক খেলা করছে দু’চোখে, শামিরের বুঝতে বাকি নেই, কিছুটা সরে বসে শামির। সময় দেয় জান্নাতকে ধাতস্থ হতে, জান্নাত বড় বড় কয়েকটি শ্বাস ফেলে কপালে হাত রেখে ধীরে ধীরে উঠে বসে, তারপর ক্ষীণ আওয়াজে বলে,“মামী।”

শামির ওকে দেখে বলে,“ডাক্তার ডাকতে হবে?”

কথাটাতে না ছিল দরদ,না ছিল রাগ,না ছিল অন্যকিছু। শুধু ছিল মেঘ সমান গম্ভীরতা। জান্নাতের চোখ ঝাপসা হয় আবারও, তার মনে হচ্ছে সে ভীষণ অসহায়, তার দিন দুনিয়ায় কেউ নেই আর সে আটকা পরেছে একটা জেলখানায়।
শামিরের কথার জবাব না দিয়ে শুধু বিছানার চাদর খামচে ধরে। শামির ফোনটা হাতে তুলে নেয় এই বাড়ির জামাই রাজিবকে কল করতে, এতো রাতে ডক্টর পাওয়া যাবে কিনা বাজারে সেটা জানতে হবে।

জান্নাত হঠাৎ মাথা নিচু করে বলে ওঠে,“আমি ঠিক আছি। ডাক্তার আনবেন না।”

শামির ওর দিকে একপলক তাকিয়ে ফোনটা রেখে দিলো, বাড়িয়ে দিলো এসির পাওয়ার। অতঃপর চলে গেল ফ্রেশ হতে।

পাঞ্জাবি খুলে নরমাল টিশার্ট পরে,ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো জান্নাত জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে একই রকম ভাবে।

শামির এগিয়ে যায় জান্নাতের কাছে, এগিয়ে গিয়ে বসলো মুখোমুখি। জান্নাতের দৃষ্টি নত,সে টের পাচ্ছে সে আবারও কাঁপতে শুরু করেছে।
আচ্ছা এই রাত শেষ হচ্ছে না কেন? এই লোকটা কোনো জাদুবলে ঘুমিয়ে পরতে পারেনা এখন? এই লোকটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে না? তবে বেশ হয়, এমন নানা ভাবনা আসছে জান্নাতের মাথায়। জান্নাত মনে মনে দোয়া পড়তে থাকে ভয় কাটানোর, এই লোকটা যদি সুরভীর স্বামীর মতো তার ওপর হামলে পরে এখন তবে কি করবে জান্নাত? চেঁচাতে জান্নাত পারবে না, তবে জান্নাত মরে যাবে লজ্জায়, মরে যাবে কষ্টে। মুহুর্ত গুনছে জান্নাত, এইতো লোকটা খুব কাছে চলে এসেছে, এইতো আরো কাছে। এখন কি করবে? টানা হেচড়া করবে নাকি! শাড়ি খুলবে? বারংবার ঢোক গিলছে সে। এবার অতি আতঙ্কে দু’চোখ বুজে দোয়া ইউনুস পরতে শুরু করেছে জান্নাত,“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।”

ওর বিড়বিড়ানি কর্ণগোচর হতে ফ্যালফ্যাল করে ওকে কয়েক মুহূর্ত দেখলো শামির। তারপর বললো,“জান্নাতুল ফেরদৌস?”

আবারও ধমকের মতো ডাক, জান্নাত চকিতে চোখ মেলে তাকাল। চোখ নামিয়ে বললো,“জি।”

_আমি শামির চৌধুরী। তোমার স্বামী!

জান্নাত ডরের চোটে উল্টো পাল্টা বকতে লাগলো মনে মনে, বললো “স্বামী তো? কি করবো এখন? নাচবো? আপনি দূরে যান আল্লাহর দোহাই লাগে।”

মুখে কিছু বললো না। শামির যেন ওর অনুরোধ শুনলো,সে কিছুটা দূরে সরলো। আসলে হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে একটা বক্স উঠিয়ে সেখান থেকে একটা আংটি বের করে নির্দ্বিধায় ধরলো জান্নাতের হাত, জান্নাত শ্বাস আটকে বসে রইল শক্ত হয়ে। শামির আংটিটা জান্নাতের বাম হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো,“তোমার সম্পর্কে কিছুই জানবার নেই আমার। আমার যেটুকু জানার জেনেই আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। তুমি কিছু জানতে চাইলে বলো।”

জান্নাত কি জানতে চাইবে? সবই তো জানে, লোকটা শামির চৌধুরী,তার অনেক টাকা আছে,তার একটা ফোনের দাম দেড় লাখ টাকা,তার আগে একটা বৌ ছিল,সেই বৌ বেয়াদবি করতো বলে বনিবনা হয়নি, লোকটার খুব রাগ,রাগলে ইংরেজি বাংলা গালি দেয়, মারামারি করে কিনা এটা জান্নাত শোনেনি,ও হ্যা, লোকটা খুব ভালো ফুটবল খেলে,এইতো! সব তো জেনেই সবাই তাকে বিয়ে দিয়েছে লোকটার কাছে। আর কি জানতে চাইবে?

শামির ওর ছটফটানি দেখে ওর কাছে এগোয় আবার, এবার বলে,“জানতে চাইলে বলো, বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবো না।”

জান্নাতের মুখটা ফ্যাকাসে হয়, চোখ ঝাপসা হয় কথাটি শুনে। শামির তা খেয়াল করে, সে চুপচাপ জান্নাতকে কাছে টেনে কপালে চুমু খায়।
দমবন্ধ করা পরিস্থিতি, জান্নাত কাঁপছে ঠকঠক করে, কিছু বলতে নিলেও বললো না। চুপচাপ নিজেকে ছেড়ে দিল লোকটার কাছে।

শামির ওর কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে দেখলো একপলক ওকে, তারপর বলল,“কাল সকালে আমার সাথে তুমি যাবে, তোমার শশুর বাড়ীতে, মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও। তোমাকে অসুস্থ লাগছে। ঘুমিয়ে পরো, কাল সকালে কথা হচ্ছে।”

জান্নাত অবিশ্বাসের নজরে শামিরের দিকে তাকায় আচানক। শামিরের গম্ভীর মুখভঙ্গি। তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জান্নাত বুঝতে পারছে না কিছু,লোকটা তাকে ঘুমিয়ে পরতে বলেছে? আসলেই?

কথাগুলো বলেছে শামির আদেশের সুরে, আদেশ করেই উঠে গিয়ে সে এ ঘরের টেবিল চেয়ারে বসলো ল্যাপটপ নিয়ে,মুখে তার বক্র হাসির রেখা জান্নাতের কৃতার্থ মুখটা দেখে। সে ব্যস্ত হয়ে পরলো ল্যাপটপ নিয়ে, টের পেলো জান্নাত নিজের যায়গাতেই বসে আছে, তাই আবারও রাশভারী আওয়াজে বললো,“ঘুমিয়ে পরো।”

আবারও ধমকের মতো আদেশ, জান্নাত চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পরলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না সে আজ রাতটা সত্যিই বেঁচে গিয়েছে, সুরভীর মতো কিছু হয়নি তার সাথে। সপ্তদশীর মনে কিছু মূহুর্তের জন্য কিঞ্চিত ভালোলাগা তৈরি হয় ঐ গমগম কন্ঠের স্বামীর জন্য, লোকটা সুরভীর স্বামীর মতো নয় তবে! কিন্তু কেমন তবে? কাঁপা কাঁপা হাতে জান্নাত নিজের কপাল ছোঁয় যেখানে ঐ লোকটা ঠোঁট ছুইয়েছে। জান্নাতের জীবনে প্রথম চুমু, বিবাহিতা বান্ধবীরা যখন তাদের স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম চুমুর আলাপ পাড়তো ক্লাসরুমে, জান্নাত আড়ষ্ট হতো লজ্জায় এটা ভেবে যে তার কেমন লাগবে। কিন্তু আজ যখন সত্যিই সে চুমু পেলো,একটা অচেনা অজানা লোকের থেকে, তখন জান্নাত কিছু অনুভব করতে না পারলেও এখন লজ্জায় মরি মরি হচ্ছে, তার রাগ হচ্ছে না,লজ্জা লাগছে উল্টো, কেন? মানুষটা স্বামী বলেই কি?

শামির ল্যাপটপ নিয়ে অযথা কিছুক্ষণ বসে থাকে, সে চাইছে মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে কিছুটা সময়, অন্তত ঘুমানো অবধি। শামিরের গম্ভীর মুখে, ঠোঁটে লেপ্টে আছে অস্পষ্ট হাসি। আজ যদি মেয়েটা গাইগুই শুরু করে দিতো শামির চৌধুরী হয়ত নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারতো না, কিন্তু মেয়েটা যে প্রথম রাতে স্বামী বলে তাকে দাম দিয়ে চুপ থেকেছে এটা দেখে শামির চৌধুরী যথেষ্ট সন্তুষ্ট। আর স্বামী হিসেবে তার ইচ্ছে করেছে বৌকে কিছুটা সময় দিতে, এটা জান্নাতের নয়, তার ইচ্ছাতেই হচ্ছে। পুরুষ বুঝবে তার বৌয়ের সাথে কি করতে হবে,কোনটা ভালো হবে। যা হবে সব পুরুষের ইচ্ছেতেই হবে। বাসর হলেও পুরুষের ইচ্ছেতে হবে,বাসর বাতিল হলেও পুরুষের ইচ্ছেতেই হবে।

সময় গড়ায়, শামির উঠে চলে যায় বিছানার কাছে। গিয়ে দেখলো এক পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পরেছে জান্নাত। সেও বেশি রাত জাগলো না, বাতি নিভিয়ে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পরলো,জানালা থেকে আসা চাঁদের রূপালী আলোয় জান্নাতের ফরসা মুখটা ঝকমক করছে আধো অন্ধকারে, দীর্ঘক্ষণ শামির তা দেখে ঘুমিয়ে পরলো।

সকালে খুব ভোরেই উঠতে হয়েছে জান্নাতকে। বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে শান্তা। জান্নাত উঠে দেখলো শামির তার খুব কাছেই ঘুমিয়ে আছে, গাঁয়ে গা লেগেছে এমন। এবার আরও বেশি লজ্জা পেলো জান্নাত। যখন বুঝতে পারলো গোটা রাত এই লোকের সাথে একই বিছানায় ঘুমিয়েছে, যাকে সে দু’দিন আগে চিনতো অবধি না, তবে এখনও তো চেনেনা, কিন্তু জান্নাতের খারাপ লাগছে না কেন? আর কান্না পাচ্ছে না কেন? লোকটা স্বামী বলেই কি?

লোকটা ঘুমিয়েও আছে নাকমুখ কুঁচকে। আচ্ছা এই লোকটা এমন কেন? এ কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্বপ্নে সবাইকে ধমকায়?

উঠে গিয়ে দরজা খুললো জান্নাত। ঘরের বাইরে শান্তা, সুহানা দাঁড়িয়ে, জান্নাতকে দেখছে পা মাথা। বেনারসী ঠিকঠাক, শাড়ির পিনগুলো ঠিকঠাক। সুহানা জান্নাতের হাতে একসেট শাড়ি ব্লাউজ ধরিয়ে দিয়ে বললো,“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো বাইরে, আমরা খেয়েই বেরোবো জান্নাত। শামির ভাইয়াকে উঠাও ঘুম থেকে।”

_আমি উঠাবো?

সুহানা হেসে বলে,“এখন থেকে তুমিই উঠাবে।”

_বকবে না তো?

_তুমি বকা দেওয়ার মতো মেয়েই নও জান্নাত।

জান্নাত মাথা হেঁট করে নেয়। সুহানা হেসে বলে,

_ যাও ওঠাও।

সকাল ঠিক আটটার আগেই সবকিছু গোছগাছ করা হয়ে গিয়েছে চৌধুরীদের।
মেয়ে বিদায়ের আগে আগে আকন্দ বাড়ি থেকে জান্নাতের মামা,বাবা এলেন। বিদায় হবে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে।

নতুন বর শামির চৌধুরী কানে ফোন গুজে অফিশিয়াল কথা বলতে বলতে তৈরি হয় দ্রুত। সাদা শার্টের ওপরে ধূসর রঙের ব্লেজার চাপিয়ে সাহেব বাবু হয়ে গেল একেবারে। ফোন রেখে আশেপাশে চোখ বোলালো জান্নাতকে খুঁজতে, জান্নাত কোথাও নেই,বিছানার ওপর জান্নাতের লাগেজ খোলা পরে আছে।
গম্ভীর কন্ঠে ডাকলো নীড়াকে। নীড়া আসতেই বললো,“জান্নাতুল কোথায়?”

_বলেছে তো আকন্দ বাড়িতে যাচ্ছে,কি জানি জরুরি কিছু রেখে এসেছে হয়তো।

জান্নাত তখন ছুটছে, চেয়ারম্যান বাড়ির রসুইঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তেঁতুল তলা হয়ে ছুটে আকন্দ বাড়িতে ঢুকলো। এটুকু ছুটেই বুক কাঁপছে তার, চোখে মুখে বিরক্তি ভাব। মামী কি করে জান্নাতের লাগেজে জান্নাতের একাডেমিক কাগজপত্র গুলো দিলো না? ওখানে কলেজে ভর্তি হতে এসব লাগবে তো নাকি! কি করে এতো বড় ভুল হলো মামীর? ভাগ্যিস জান্নাত চেক করেছিল,নয়তো শহরে চলে গেলে কাকে পাঠাতো এসব নিতে?

শাহীনুর নতুন একটা হলুদ জামদানি পরিহিতা জান্নাতকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললো,“এইটা পরলি! তোকে রানীর মতো লাগতাচে রে জান্নাত। তা আইলি ক্যান? আমিই তো ঘরে তালা লাগাইয়া যাইতাম অখনই চেয়ারম্যান বাড়িতে। হাঁস মুরগিরে আদার দিতে আচালাম।”

জান্নাত অভিমানের সুরে বললো,“আমি আমার কাগজপত্র নিতে এসেছি মামী,তুমি দাওনি কেন? ওখানে কলেজে ভর্তি হতে লাগবে তো নাকি।”

শাহীনুরের মুখটা হঠাৎ শুকিয়ে যায়। জান্নাত আলমারি থেকে তার একাডেমীক কাগজপত্র গুলো বের করে নেয় ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ও বাড়িতে তার খোজ পরেছে কি না কে জানে!

শাহীনুরের হঠাৎ করে মেয়েটার জন্য একটু খারাপ লাগছে। সরল মেয়েটা জানেনা এখনও ওর বর ওকে আর পড়াবে না, শাহীনুর কথাটা লুকিয়ে গিয়েছে জান্নাতের থেকে। একটা অন্যায় করেছে শাহীনুর। কিছুক্ষণ অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে শাহীনুর গা ঝাড়া দেয়,নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“না দিলে না দিক পড়তে, কষ্ট পাইলে পাউক। বর রাণীর মতো জহরতে সাজাইয়া রাখলে ঐ ছেমরি নিজেই আর পড়তে চাইবে না। এতো সাচ্ছন্দ্যের জীবন থুইয়া কে এতো কষ্ট কইরা পড়াশোনা করতে চায়? বোকদা নাকি!”

কনে বিদায়ের সময় চেয়ারম্যান বাড়ির গেটে জান্নাতের তিন মামীর আহাজারি দেখলো গ্রামবাসী, জান্নাতুল জানে মামীরা যতটা না কষ্ট পাচ্ছে তার বিদায়ে তার থেকেও বেশি দেখাতে চাইছে সবাইকে, তবুও জান্নাতের চোখে পানি এলো, মামীদের সাথে গলা মিলিয়ে কাঁদল।
জান্নাতের হাতের মুঠিতে কড়কড়ে দুই হাজার টাকা, এটা কিছুক্ষণ আগে শামির চৌধুরী দিয়েছে তাকে। ঘরে ডেকে নিয়ে আদেশের সুরে বলেছে,“এই টাকাটা তোমার কাছে রাখো,তোমার ভাইবোনদের চকোলেট খেতে দিও।”

জান্নাত অবাক চোখে কিছুক্ষণ দেখেছে টাকাগুলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জান্নাত নিজের জন্মদাতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। না রাগ তার কন্ঠে,না অভিমান, স্বাভাবিক গলায় তার থেকে বিদায় নেয়, ছোটো ভাই দুটির জন্য দুই হাজার টাকাও দেয় জান্নাত,যেটা তার স্বামী তাকে দিতে বলেছে। যা হয়েছে সব কিছু ভাগ্যে ছিলো বলে,জান্নাত এই কথায় বিশ্বাসী, জান্নাত কোথাও শুনেছে,তোমার জন্য আল্লাহ্ যাকে লিখে রেখেছেন,সে যদি সুদূর কাজাকিস্তান থাকে তবুও তাকে আসতে হবে, হয় আজ, আজ না হলে কাল।

জান্নাতের জন্য আল্লাহ যাকে লিখে রেখেছিলেন তাকে হয়তো আল্লাহ অনেকটাই আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন, জান্নাতের কলেজে ভর্তি হবার আগেই, সবই আল্লাহর ইচ্ছে, জান্নাত মেনে নিয়েছে।

গাড়ি গ্রামের রাস্তা পেড়িয়ে, মফস্বলের ভাঙ্গা রাস্তা পেরিয়ে যত হাইওয়ের দিকে এগোচ্ছিল,তত তার বুক ঢিপঢিপ বাড়ছিল। সে একা,আর তার বিপরীতে এতো গুলো অচেনা মানুষ, আচ্ছা কেমন হবে জান্নাতের শহুরে জীবন? জান্নাতকে রোজ কলেজে যেতে দেবে তো? ফুল,সুরভী ওদের বরেরা তো প্রবাসী,তাই জন্য ফুল,সুরভী বাপের বাড়িতে থাকে,আর নিয়মিত কলেজেও যেতে পারবে। কিন্তু জান্নাত? জান্নাতকে রোজ যেতে দেবে কলেজে ও বাড়ির মানুষ গুলো? সাইন্স নিয়ে পড়তে পারবে জান্নাত,নাকি মানবিক বিভাগে যেতে হবে? শশুর বাড়িতে কাজ থাকবে তো ! আর রোজ রাতে পড়তে বসলে ঐ লোকটা বই সরিয়ে রেখে বিছানায় টানবে না তো? যেমনটা কাকলির স্বামী করে?

এমন অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করে জান্নাতের মনে। অন্যমনস্ক ছিলো তাই টের পাচ্ছে না কিছু, ঘোর কাটে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে । ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে আতংকে আঁতকে উঠতে চাইলো জান্নাত। পরমুহূর্তেই সে টের পেলো তাকে ধরে রেখেছে তার ননদ রুহি।
গাড়ীটা হুট করে ব্রেক কষায় এমন হয়েছে। জান্নাতদের গাড়ীতে ছিল জান্নাত,শামির,শায়ন,রুহি এবং শামা।
রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ করে এক পাগল চলে আসায় ব্রেক কষতে হয়েছে শামিরের হুট করে।

মেজাজ বিগড়েছে শামিরের, ভয়ংকর একটা ধ’ম’ক দিলো পাগলটাকে, ধমকে কেপে উঠল জান্নাত। পাগলটা ধমক খেয়ে উল্টো হাসতে থাকে হা হা করে, যা দেখে শামির আরো ক্ষেপে গিয়ে গাড়ি থেকে নামে।

আতঙ্কিত জান্নাত খামচে ধরে রুহির হাত। সামান্য পাগলের সাথে কেউ রাগ দেখায় এমন করে?
শায়ন অবশ্য অনুরোধ করে বলেছে,“ভাইয়া কুল ডাউন। ওটা পাগল!”

কে শোনে কার কথা, শামির নেমেই ঠাঁটিয়ে এক চ’ড় মেরে পাগলটাকে রাস্তার মাঝখান থেকে সাইডে সরিয়ে দেয়। শামিরের অগ্নিমূর্তি দেখে জান্নাত ভয়ে সিটিয়ে যায় তখনই। লোকটার এতো রাগ! এতো বেরহম হয়ে একটা পাগলকে চ’ড় মারে!

গাড়িতে বাকি সবাই নির্লিপ্ত, কারণ তারা এসবে অভ্যস্ত, একফাকে সবাই ঘুরে জান্নাতকে দেখেছে মলিন মুখে, নতুন বৌয়ের সামনে ভাইয়া অন্তত এমনটা না করলেও পারতো, তাদের খুব লজ্জা লাগছে। শামির চ’ড় মেরে এসে গাড়িতে বসে হাতটাকে স্যানিটাইজ করতে থাকে চুপচাপ।

আর জান্নাত কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে দেখতে থাকে লোকটাকে।

চলমান…..