#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১১
#ইসরাত_ইতি
লম্বা,চওড়া, সুদর্শন এক লোক। গাত্রবর্ণ শ্যামলা। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। আজ দু’দিন হয় জান্নাত দেখছে। বখাটে লাগলো জান্নাতের কাছে, দাঁত বের করে হেসে হাত নাড়ছে তাই।
গতকাল জান্নাত গায়ে মাখেনি ব্যাপারটা, আজ হতবাক সে, চৌধুরী আর হাওলাদার বাড়ির মধ্যবর্তী আঙিনাতে ঢোকার সাহস করেছে, এ কে? দিন দুপুরে বখাটে পনা!
কপাল কুঁ’চ’কে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাত,মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো শামিরকে ডাকার, তখনো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, দোতলার পেছনের বেলকোনির দিকে দৃষ্টি দিয়ে।
জান্নাত বেশি দেরি করলো না, শুনেছে এলাকায় বখাটে বেড়েছে, রুহি আপু অথবা শামাকে বিরক্ত করতে আসেনি তো? জান্নাত কাঁপা কাঁপা গলায় শামিরকে ডাকতে লাগলো,“শুনছেন….এখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে…..”
অমনি পেছন থেকে কেউ একটা মুখ চেপে ধরলো তার। নিমিষেই জান্নাতের বুকটা কেঁপে উঠলো। ঘুরতেই দেখলো রুহিকে। হাপাচ্ছে রুহি। জান্নাত নিজের মুখটা রুহির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,“কি হয়েছে রুহি আপু?”
_চে-চেচাচ্ছিলে কে-কেন? ভাইয়াকে ডাকছিলে কেন?
বুকে হাত চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো মুখ করে রুহি জানতে চাইলো।
_ঐ দেখো,ঐ লোকটা। আজ দু’দিন ধরে এখানে ঢুকে দোতলার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। আমাকে দেখে হাসে। খারাপ লোক নিশ্চয়ই। তোমার ভাইয়াকে বলি?
রুহি বাগানে উঁকি দিয়ে ঢোক গিললো। ছেলেটা তখনও দাড়িয়ে, রুহি ঘুরে জান্নাতের ওপর চেঁচিয়ে উঠলো,“এই না!”
_কি না?
_ভাইয়াকে বলবে না।
_কেন? খারাপ লোক হয় যদি!
_খারাপ লোক নয়, উনি মেধা আপুর ছোটো ভাই, তন্ময় ভাইয়া। তুমি যাও ভাবী। ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।
জান্নাত ঘুরে আবারও লোকটাকে দেখলো, এই তবে তন্ময় হাওলাদার! মেধা আপুর কাছে যার কথা সবসময় শোনে জান্নাত।
জান্নাত আমতা আমতা করে,“কিন্তু লোকটা ওভাবে হাত নাড়ে কেন?”
_হয়তো ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছিলো। ভুল টুল দেখো খুব তুমি ভাবী,রাতে না ঘুমানোর ফল, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করবে আজ থেকে, ভাইয়া জাগিয়ে রাখতে চাইলে শুনবে না।
জান্নাত লজ্জা পেয়ে ভ্রু কুচকায়,রুহি হাসছে।
_আচ্ছা যাও,আর শোনো, তন্ময় ভাইয়া মোটেও বখাটে নয়।
বলতে বলতেই রুহির গাল দু’টো গোলাপের মতো লাল লাল হলো, সে রহস্য বোকাসোকা জান্নাত ধরতে পারলো না। এর মাঝেই তার শমন এলো,“অ্যাই জান্নাতুল! কোথায় গেলে?”
জান্নাত ছোটে শামিরের কাছে। রুহি ঘুরে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে কানে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“পাগল তুমি? যাও এখান থেকে! ভাবীকে টিজ করছো! ভাইয়া পুতবে তোমাকে জানতে পারলে!”
ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা যায়, পরপর বলে,“এই বুঝি তোমাদের ভাবী! আমি যার ননদাই হবো! কি মিষ্টি দেখতে!”
_হ্যা,স্বপ্নে হবে! দুবাড়িতে জানাজানি হলে ঐ এক শতাংশ জমিতেই কবর দিয়ে দেবে আমাদের দুজনকে। এখন যাও, এখান থেকে কেটে পরো, বিকেলে ছাদে থাকছি! বাই!
◻️
একটা সাদা রঙের তোয়ালে কোমরে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শামির, উন্মুক্ত শরীর। দুগালে শেভিং ক্রিম লাগানো। জান্নাত ঘরে ঢুকেই ওয়াশ রুমের দিকে উকি দিলো, ওকে দেখতে পেয়েই শামির চেচালো,“কই গিয়েছিলে? ছাদে? এতো কি ছাদে? সুযোগ পেলেই ছুটে যাও।”
জান্নাত সে কথা পাশ কাটিয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো,“আমি আপনার পোশাক বের করে দিচ্ছি। ইস্ত্রি করে তুলে রেখেছিলাম।”
পোশাক বের করে দিয়ে জান্নাত ওয়াশ রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। শামির ওয়াশ রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করতে করতে তেরছা নজরে জান্নাতকে দেখে। মুখচোখ ভাবলেশহীন যার। সেদিন রাতে ধমকাধমকির পরে খুব একটা হাসতে দেখেনি জান্নাতকে।
বাইরে ভাবান্তর নেই দেখালেও শামিরের মনে একটু একটু করে রাগ জমছে, তার ইচ্ছেকে মন থেকে এই মেয়ে মানতে নারাজ, এই বিষয়টিই তার রাগের কারণ। তবে বলে না শামির কিছুই, স্ত্রী সম্পূর্ণ রূপে নিয়ন্ত্রণে আসুক, রাগ ঝাড়ার বহু টাইম পাওয়া যাবে।
এক হাতে শেভ করতে করতে আরেক হাতে ধরলো জান্নাতের হাত, টেনে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে, জান্নাত তাকাতেই দেখলো খুব নিকটে শামিরের। ধরে রেখেছে,অথচ মনযোগ পুরোটা শেভ করাতে। একটু নড়েচড়ে উঠতেই ভারি গলা গমগম করে উঠলো,“নড়ো না,গাল কাটবে আমার।”
জান্নাত আর নড়েনা।
শামির বলে ওঠে,“আগামী বৃহস্পতিবার সিলেট যাচ্ছি।”
আজ শনিবার,হাতে আর মাত্র ক’টাদিন বাকি। শামির জান্নাতের এখন অবধি হানিমুনে যাওয়া হয়নি, যদিও বিয়ের পরের মাসেই যাওয়ার কথা ছিলো। শারাফাত চৌধুরীর হঠাৎ একটা মাইল্ড স্ট্রোক হওয়াতে সেটা আর হয়ে ওঠেনি, তারপর একের পর এক ব্যস্ততায় শামির আটকে গিয়েছিল।
“গুছিয়ে নিও প্রয়োজনীয় যা কিছু। গরম কাপড় নিও, ঠান্ডা পরেছে খুব।”
মাথা নেড়ে বরের কথায় সায় জানিয়ে জান্নাত আমতা আমতা করে উঠলো,“আপনার বন্ধুরাও কি যাবেন?”
শেভ করতে থাকা শামিরের হাত থামলো, ভ্রু কুঁচকে তাকায় জান্নাতের দিকে,বলে,“হ্যা। কিন্তু তুমি ওদের কথা জানতে চাইছো কেন? ওদের দিয়ে তোমার কি?”
কথার সুরটা জান্নাতকে ভয় পাওয়ায়,এই খুঁতখুঁতে লোকের সাথে কথাও বলতে হয় মাপজোখ করে,জান্নাতের মাথায় রাখা উচিত ছিলো।
“আমার কিছু না, আপনিই তো সেদিন জানালেন সবাই মিলে যাবেন, তাই জানতে চাইলাম।”
_হ্যা,তো বন্ধু পত্নীরাও তো যাবে আমার। তুমি তো তাদের কথা জানতে চাইলে না। শুধু আমার বন্ধুদের কথাই জানতে চাইলে কেন?
ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জান্নাত। তার ইচ্ছে করলো কপালটাকে একটু দেয়ালে ঠুকতে। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল শামিরের থেকে, ওয়াশ রুম থেকে বেরোতে বেরোতে নিচু গলায় বললো,“কথার ভুল আমার। আমি সবার কথা জানতে চেয়েছি। দুঃখিত।”
শামির তখনও ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ বললো,“জান্নাতুল।”
_হু?
_গালীব আর জাহিদের সাথে হিসেব করে কথা বলবে, যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবে। আমি পছন্দ করবো না তুমি যদি ওদের সাথে কথা বলো হেসে হেসে এই ট্রিপে। ঠিকাছে?
জান্নাতের খুব বলতে ইচ্ছে করলো,“তো যাবেন কেন এমন বন্ধুদের সাথে? যাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়!”
তবে বললো না জান্নাত, কথায় কথা বাড়বে,সে শুধু ছোট করে বললো,“জি আচ্ছা।”
শামিরই উত্তর টা দিলো,“ওরা অবিবাহিত। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, অতি আধুনিক। সবার বৌয়ের সাথে মাখো মাখো সম্পর্ক দেবর হিসেবে, আমি চাইনা তুমি আমার বাকি বন্ধুদের বৌয়ের মতো হও। বিবাহিতদের ট্রিপ এটা, ওদের দুটোকে আমার নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, বন্ধুদের চাপে নিতে হচ্ছে। এটাই সমস্যা, একটা সোস্যাল লাইফ মেইনটেইন করতে গেলে অনেক কিছু টলারেট করতে হয়…..”
জান্নাত জবাব দেয়না, চুপচাপ শামিরের কথা শুনে যাচ্ছে। আর আলমারি থেকে ব্লেজার স্যুট বের করছে।
“বাই দ্য ওয়ে,আজ একটু মার্কেটে যাবো ফেরার পথে। কি কি লাগবে বলো। কি কি ফুরিয়েছে?”
জান্নাত রোবটের মত বলতে লাগলো,“কিছুই লাগবে না।”
_সে কি কথা? ঘরে পরার সুতি শাড়ি লাগবে জানি। মুখের ক্রিম আছে?
মাথা নাড়ে জান্নাত।
_হেয়ারওয়েল?
_নেই।
_স্যানিটারি ন্যাপকিন?
না সূচক মাথা নাড়ে জান্নাত। শামির বলে,“আবার বলছো কিছু লাগবে না। এতো উদাসীন হলে তো চলবে না জান্নাতুল। আচ্ছা একটা লিস্ট করে দাও, ফটাফট, কাম অন।”
ঘরে আসে তখন রিজিয়া বণিক। নক করে ঘরে ঢুকেই জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“নিচে যাও বৌমা, দরজি এসেছে। ব্লাউজের মাপটা দিয়ে এসো।”
ওয়াশরুম থেকে মাথা বের করে উকি দিলো শামির, মাকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,“দর্জি ছেলে না মেয়ে?”
রিজিয়া বণিক একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বিরক্ত হয়ে বলে,“মেয়ে দর্জি রে বাবা, এখন যেতে দে মেয়েটাকে।”
নিচে এসে জান্নাত দর্জির কাছে মাপ দিলো ব্লাউজের, পাশের বাড়ি থেকে মেয়ে বৌরা এসেছে সুহানার সাথে গল্প করতে। জান্নাতকে দেখে দু চারটে মশকরা করে দিলো। জান্নাত বিনিময়ে হাসলো ম্লান। এরপর চলে গেলো রান্নাঘরে, শামিরের স্ন্যাকস গোছাতে, টিফিন বক্সে কিছু ড্রাই ফ্রুটস আর একটা বড় স্যান্ডউইচ ভরে দিয়ে শামিরের হাতে তুলে দিলো। শারাফাত চৌধুরী চিকিৎসার জন্য একটু ঢাকা গিয়েছেন রাজনকে নিয়ে, শায়ন খুলনাতে। শামির অফিসে চলে গিয়েছে। আপাতত বাড়িটা পুরুষ বর্জিত।
রেনুকে নিয়ে সুহানা রান্নার যোগার করছে,রুহি শামা স্কুল-ভার্সিটিতে। রিজিয়া ড্রয়িং রুমে বসে ছোটো বাচ্চাদের জন্য নকশিকাঁথা সেলাই করছে। এটাই ভদ্রমহিলার নিত্যদিনের দুপুরের কাজ।
ঘরে এসে জান্নাত একটু শু’লো, ফজরের আজানের সময় ওঠে রোজ, সকাল নয়টার দিকে চোখে ঘুম চলে আসে এমনিতেই। সুহানাকে বলে এসেছে মাছের তরকারিটা সে রাঁধবে, আপাতত একটু জিরিয়ে নিতে চায়।
চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট জান্নাত তন্দ্রার ঘোরে ছিলো, হঠাৎ বাইরে হৈচৈয়ের শব্দে জান্নাত ধরফরিয়ে উঠে বসলো।
এটা ব্যবসায়ী পাড়া, ছুটির দিন বাদে বাকি দিনগুলোতে এই সময়টাতে কোনো পুরুষ মানুষ খুজে পাওয়া যায় না এ পাড়ায়,সবাই কাজে বেরোয়। নিচে নেমে জান্নাত জানতে পারলো হাওলাদার বাড়িতে মেধার মা তসলিমা চাচীর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল, পাড়ার সব মহিলা ভিড় করে দেখে এসেছে, রিজিয়া বণিকও গিয়েছিলেন, এমনকি সুহানাও। আপাতত শ্বাসকষ্ট নেই, ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন।
জান্নাত বিস্তারিত জানতে দোতলার পেছনের বেলকোনিতে গেলো,যদি মেধার দেখা মেলে, কিন্তু কোথাও মেধা নেই।
বাড়িতে বসে আরো আধঘন্টা জান্নাত ছটফট করে অবশেষে নিজের শাশুড়ির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, রিজিয়া বণিক হা করে জান্নাতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,“হাওলাদার বাড়িতে যাবে?”
_জি।
_তোমার মাথা ঠিক আছে? শামির জানতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছো?
_যাই না আম্মা। উনি জানবেন না। যাবো আর আসবো, একটু দেখেই চলে আসবো। যাই?
জান্নাতের কন্ঠে আকুতি ছিলো, রিজিয়া বণিক কিছুক্ষণ ছেলের বৌকে দেখে বললেন,“বেশি সময় করো না, খবরদার।”
মলিন মুখে হাসি ফোটে জান্নাতের, মাথা নেড়ে ছুটে যায় রান্নাঘরে, মেধার কাছে শুনেছে চাচী আম্মা দধি খুব পছন্দ করে, জান্নাত গতকাল রাতেই দই পেতেছিলো, একটা বাটিতে তুলে নিয়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে বাড়ির সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।
হাওলাদার বাড়িতে আপাতত ভিড় নেই, গেটের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাচ্ছে । বুক কাঁপছে জান্নাতের,একা একা পুরো আমবাগান,জামবাগান চষে বেড়ানো মেয়েটা এ কদিনে খুব ভীতু হলো, এতটুকু পথ অতিক্রম করতেও অস্বস্তি হচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে গেটের ভেতর পা ফেলতেই আচমকা লাফিয়ে উঠলো জান্নাত, এ বাড়ির পোষা কুকুরটা জান্নাতকে দেখেই ডাকতে শুরু করলো। কুকুরটার নাম ট্যাঙ্গি।
ভেতর থেকে লম্বা কদমে ছুটে এলো তন্ময় হাওলাদার। বুকে হাত চেপে জান্নাতকে গেটের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপতে দেখে তন্ময় ট্যাঙ্গিকে ধমকে ওঠে,“ট্যাঙ্গি কাম অন!”
ট্যাঙ্গি হাকডাক রেখে মনিবের কাছে গিয়ে লেজ নাড়তে থাকে। জান্নাত তন্ময়কে দেখতে পেয়ে তার ঘোমটা একেবারে নাক বরাবর টেনে নেয়। তন্ময় জান্নাতকে দেখে কিছু মুহূর্ত, তারপর হালকা হেসে বলে,“আরেহ পাশের বাড়ির বৌটি যে! ভাবী আসসালামুয়ালাইকুম।”
জান্নাত অস্বস্তি নিয়েই সালামের জবাব দেয়। তন্ময় বলে,“তা ভাবী কি মনে করে? আপনার বর জানে তার বৌ চৌকাঠ পেরিয়ে এবাড়ি ওবাড়ি অসুখ দেখতে যায়?”
জান্নাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তন্ময় আরো কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে মেধার ধ’ম’ক,“তন্ময় নট উইদ হার! ওর তোর মশকরা বোঝার বয়স হয়নি,লিভ হার এলোন।”
তন্ময় সাথে সাথে হেসে জান্নাতের পথ ছেড়ে দিয়ে বলে,“ভেতরে যান ভাবী।”
মেধা সদর দরজার কাছে চলে এসেছে,জান্নাতকে দেখে ভীষণ অবাকও সে। জান্নাত এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললো,“চাচী আম্মাকে দেখতে এলাম।”
_তোমার বর জানে?
_উনি অফিসে।
_এটা ঠিক নয়,বরকে না বলে এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়া যাবে না,এটা তো শামির চৌধুরীর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করা হলো।
কথাটা জান্নাতের পেছন থেকে বললো তন্ময়, ওকে চোখ রাঙানি দিয়ে মেধা জান্নাতকে নিয়ে তসলিমার ঘরে গেলেন, জান্নাত দেখলো বাড়ির বাইরেটার মতো এ বাড়ির ভেতরটাও কমলা রঙের রোদের মতো ডেকোরেশন, মেধা ওর কৌতুহল বুঝতে পেরে বললো,“শারাফাত চাচা আর বাবা দুজন একসাথে বাড়ি তুলেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার একই, ডিজাইন এক।”
বাড়ির ভেতরে মেধার বড় দুই ভাইয়ের বাচ্চারা হৈ হল্লা করছে। জান্নাতকে নিয়ে মেধা তসলিমার মাথার কাছে বসালো, তসলিমা বেগম জান্নাতকে দেখে যতটা খুশি হলেন তার থেকেও বেশি আতঙ্কিত হয়ে বললেন,“বৌমা তুমি এলে! বকা খাবে যে!”
_উনি অফিসে। এখন কি অবস্থা চাচী?
মৃদু হেসে তসলিমা বললেন,“ভালো। হাতে কি?”
_দই। আপনার জন্য এনেছি।
_দাও খাই।
খুবই উৎসাহী হয়ে খেলো জান্নাতের আনা দই ভদ্রমহিলা। জান্নাত চুপচাপ দেখলো, তন্ময় ঘরে ঢুকতেই জান্নাত জড়োসড়ো হয়ে আবারও ঘোমটা টানলো, তন্ময় হেসে মেধাকে বলল,“আপু ভাবীকে আপ্যায়ন টাপ্যায়ন কর। শামির চৌধুরীর বৌ বলে কথা!”
তসলিমা সায় দিয়ে মেধাকে বলে,“হ্যা ওর জন্য একটু সেমাই কর না।”
_এই না না,আমি উঠবো।
মেধা জান্নাতকে চোখ রাঙিয়ে বলে,“চুপ করে বসো। বললে না বর অফিসে? এসেছো যখন একটু বসেই যাও। এসো গল্প করি।”
মেধার ভাবীকে সেমাই রাঁধতে বলে মেধা জান্নাতকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো। খুব কাছ থেকে জান্নাতকে দেখে মেধা, গালে হাত ছুঁয়ে বললো,“কি ভালো স্কিন তোমার, একেবারে একটা পুতুল যেন। খুব যত্ন করতে বুঝি বিয়ের আগে?”
জান্নাত হাসে, নম্রস্বরে বলে,“যত্ন? মামী খুব যত্ন করাতো, কাঁচা হলুদ মাখাতো সপ্তাহে দুইবার, আর জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে জামের রস লাগিয়ে বসিয়ে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা আমাকে আর পরশিকে। এভাবে যত্ন করাতো।”
_জাম? জাম দিয়েও রূপচর্চা? এতো রূপচর্চা কেন করাতেন তোমার মামী?
_খুব ভালো ঘরে যেন বিয়ে হয় আমাদের। খুব ভালো বর হয় যেন।
হাসতে হাসতে বলে জান্নাত। মেধাও কিছুক্ষণ হাসলো ওর সাথে, কি সরল মেয়ে! কি সরল স্বীকারোক্তি! অতঃপর বললো,“তা হয়েছে খুব ভালো বর?”
জান্নাত চুপ হয়ে গিয়ে মুচকি হাসে। মেধা বলে,“পড়াশোনা কেনো করছো না জান্নাত?”
তখন আসে তন্ময়,জান্নাতকে কিছু বলতে না দিয়ে দুষ্টুমির ছলে মেধাকে বলে,“আরে শামির চৌধুরীর বৌ এতো পড়াশোনা দিয়ে কি করবে? বেকার খাটনি!”
জান্নাত মেধাকে বলে,“পড়তে ইচ্ছে করে না আপু।”
শামির যে পড়ায়নি জান্নাতকে এই সত্যটা কাউকে বলতে ইচ্ছে হয়না জান্নাতের। তাই মিথ্যা বলে। মেধা বলে,“কেন? পড়তে ইচ্ছে হয়না কেন? নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে না?”
জান্নাত নিশ্চুপ। তন্ময় আড়চোখে দেখলো বার কয়েক মেয়েটিকে। মেধা তখন জ্ঞান দেওয়ার মতো করে জান্নাতকে বলে,“স্বামীর অনেক টাকা, সুখে আছো বলে পড়েছো না? পরনির্ভরশীলতার যাঁতাকলে পিষ্ট না হলে আত্মনির্ভরশীলতার গুরুত্ব কি বোঝা যায়না জান্নাত। পারলে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাও।”
দু চোখে পানি আসে জান্নাতের,সেটুকু লুকাতে তাড়াহুড়ো করে বলে,“আমি আজ উঠছি আপু।”
_সে কি! সেমাই খাবে কে!
জান্নাতকে জোর করে বসিয়ে দিলো মেধা,হাতে ধরিয়ে দিলো এক বাটি সেমাই। জান্নাত সেমাই খেতে খেতে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,“জমিটা নিয়ে এতো ঝামেলা কেন আপু?”
_তোমার স্বামীর কাছে শোনোনি?
মাথা নাড়ে জান্নাত,“উনি আমার সাথে এ নিয়ে কথা বলে না।”
মেধা বলতে থাকে,“দু পক্ষই টাকা দিয়ে কিনেছি। যার কাছ থেকে আমরা জমি কিনেছি সে ভুল দাগ আর খতিয়ান নাম্বার দিয়ে ঝামেলা বাধিয়েছে।”
_তো আপনারা সার্ভেয়ার অফিসার নিয়ে বসেননি?
_হু বসেছিলাম, তোমার স্বামীর জন্য কোনো সুরাহা হয়নি। রাগের মাথায় সার্ভেয়ার অফিসারকে চ’ড় মেরেছে। এরপর দুই পক্ষের মাঝে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিলো।
কথাটা শুনে মুখটা মলিন হলো জান্নাতের,“উনি জেল খেটেছিলো?”
_আরে না না, এসব মামলায় জেল খাটেনা কেউ। দু পক্ষ দুমাস অন্তর অন্তর কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসে। আমাদের বাড়ি থেকে বাবা,বড় ভাইয়া,মেজো ভাইয়া। তোমাদের বাড়ি থেকে শারাফাত চাচা,রাজন ভাইয়া আর শামির। এরাই যায়। শায়ন আর তন্ময় এসব ঝামেলা থেকে দূরেই থাকে।
দেয়াল ঘড়ি দেখলো জান্নাত,সাড়ে এগারোটা ছাড়িয়ে গিয়েছে, এবার উঠতে হবে। গিয়ে বাকি রান্নাটা সারতে হবে। মেধাকে বলে জান্নাত তসলিমার থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াহুড়া করে ও বাড়ি থেকে বেরোয়। ওর যাওয়ার পরে তন্ময় বিরক্তি নিয়ে মেধাকে বলে,“কি একটা অবস্থা আপু,একটা বাচ্চা মেয়ে! ওই শামির ভাইয়ের আক্কেল নেই আসলে!”
_যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার ভাই।
_হু,তবে ভীষণ বুঝদার মনে হলো মেয়েটিকে, কথাবার্তা শুনে। রুহি শামার থেকে বুঝদার। আর রুহি তো একটা গাঁধী।
_হবে না? বিয়ে নামক ব্যাপারটা দুম করে মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে দেয়। তোর রুহির বিয়ে হলে সেও বুঝদার হবে। চিন্তা করিস না।
সূর্যটা আজ তেতেছে খুব, দ্রুত পা চালিয়ে চৌধুরীদের এরিয়ায় ঢুকেই পা থামে জান্নাতের, পোর্চের নিচে শামিরের গাড়ি দাঁড়িয়ে।
মুহুর্তেই জান্নাতের মাথায় একটা ছোটোখাটো বাজ পড়লো যেন। তবে কি শামির বাড়িতে? কিন্তু কিভাবে? তার তো অফিসে থাকার কথা!
বুক কাপছে সবেগে, বারবার ঢোক গিলে ধীরপায়ে সদর দরজার ঢেতরে ঢুকলো সে। মাথা তুলে দেখলো শামির ড্রয়িং রুমের বড় সোফাটায় পায়ের ওপর পা তুলে চুপচাপ বসে আছে, দৃষ্টি শান্ত, নিক্ষেপিত জান্নাতের মুখবিবরে, ঐ দৃষ্টি যেন বলছে,“আজ তুই শেষ জান্নাতুল ফেরদৌস।”
জান্নাত এগিয়ে যায়, একপাশে তার শাশুড়ি আর সুহানা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের খুবই শঙ্কিত, আতঙ্কিত লাগছে। স্বাভাবিক ভাবেই,শামির যে তাদেরও ছাড়বে না।
জান্নাত আরো দুকদম এগিয়ে গিয়ে কাঁপা গলায় বলে,“আপনি?”
শামির তখনও খুবই শান্ত, অপলক তাকিয়ে ছিল জান্নাতের দিকে, আচমকা ধীরে ধীরে, খুবই শান্ত স্বরে বললো,“তো আমি সারাদিন বাড়িতে না থাকলে আর কোথায় কোথায় যাওয়া হয়?”
চলমান……