জায়া ও পতি পর্ব-১৮

0
10

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১৮
#ইসরাত_ইতি

“ভার্সিটিতে যাবো না মানে?”

ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি রুহী। মায়ের নিষেধ শুনে ভীষণ অবাক সে।
রিজিয়া ডাইনিং টেবিলের ওপর ফলের ঝাপিতে কিছু সবুজ আপেল রাখতে রাখতে বললেন,“তোর বাবা বারণ করছে আজ যেতে। যাস না।”

রুহীর মনটা কু ডেকে ওঠে, পুরো ঘরে সাবধানী নজর বুলিয়ে দেখতে পায় রেনু,জান্নাত আর সুহানা মিলে ঘরটাকে গোছগাছ করছে, শামাও ওদের সাহায্য করছে। শামা আড়ে আড়ে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেও আবার। বুকটা কাঁপছে রুহির। তার মানে গতকাল রাতে মেজো ভাইয়াকে করা অনুরোধ মেজো ভাইয়া রাখলো না?

রিজিয়া মেয়েকে একপলক দেখে,গলায় দরদ ঢেলে বলে,“জেদ করিস না।”

_আজ দেখতে আসবে তাইনা?

_হু। ছেলে, ছেলের পরিবার সবাই। এমনি দেখাদেখি করবে না, তানভীরের শ্বশুরবাড়ির লোক হিসেবে আসবে। এখনই বিয়ের কথা হবে না। আজ ছেলে তোকে দেখবে,তুই ছেলেকে দেখবি। প্রাথমিক পছন্দ হলেই বিয়ের কথা উঠবে।

রুহীর কান্না পাচ্ছে, মা ভাবীদের ওপর চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, সুহানা বোঝালো,“বললাম তো এমনি দেখতে আসবে, আর দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাবে না রুহী। অযথা বাবা ভাইয়াদের সাথে দ্বন্দ্ব করছো তুমি।”

_তো দেখতে আসারই বা প্রয়োজন কি? বললাম তো বিয়ে করবো না।

_কেন তোমার কি কোন সম্পর্ক আছে?

মুখটা শুকিয়ে যায় রুহীর। সুহানা বলতে থাকে,“সম্পর্ক নেই, ক্যারিয়ার নিয়েও তো সিরিয়াস না, কোনোমতে পড়াশোনা করছো, রেজাল্ট খারাপ করছো, তো বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ?

রুহী জবাব দিতে পারলো না, মলিন মুখে চলে গেলো নিজের ঘরে। জান্নাতের খুব খারাপ লাগছে রুহী আপুর জন্য, কিন্তু সেই বা কি করতে পারবে?

ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে শুনে তন্ময়ের “মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা”। বিকেল থেকে ছটফট করছে, চাকরির কনফারমেশন লেটার এখনও হাতে পায়নি,এই অবস্থায় বাবা ভাইয়ের কাছে কি বলবে বুঝতে পারছে না। শেষটায় গিয়ে মেধাকে ধরলো,“আপু আমি আজ আব্বুকে বলবো, আমি রুহীকে বিয়ে করবো। যদি উনারা না মানেন প্লিজ তুমি আমার সাথে থেকো।”

মেধার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। ভাইকে নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে। কোনোভাবে যদি মেধার বাবা ভাইয়েরা মেনেও নেন,ঐ পরিবারকে কি করে রাজি করাবে সে বুঝতে পারছে না, শামির যা বেয়াদব। খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বে তন্ময়ের।

সারাদিন জান্নাত রুহীর ঘরের সামনে ঘুরঘুর করেছে। রুহী আপুকে কিভাবে স্বান্তনা দেবে সে? বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল রুহী। তন্ময় ফোন দিচ্ছে, রিসিভ করতেই রুহী কান্নায় ভেঙে পরে,তন্ময় ওকে ঠাণ্ডা করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রুহি হাপাচ্ছে,“জানো তন্ময়,ভাইয়াকে কত বুঝিয়ে বললাম রাতে,ভাইয়া মেনেও নিলো। সকালে উঠেই দেখি এই অবস্থা। আমাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।”

_ভালো পাত্র পেয়ে মাথা ঠিক নেই তোমার বাপ ভাইয়ের। ডাক্তার,পরিবারের সবাই ডাক্তার,তাও আবার লন্ডনের,এতো সম্মানীয় ফ্যামিলি!

রুহী কাঁদতে কাঁদতে বলে,“আমি দু’টো ঘুমের ওষুধ খেয়ে পরে থাকবো, কিছুতেই যাবো না আমি পাত্রের সামনে।”

তন্ময় ওকে বোঝায়,“শোনো,লক্ষিটি। আজ সন্ধ্যায় তুমি চুপচাপ তোমার পরিবার যা বলে করো, আমি বাকিটা দেখবো। এখনই ঝামেলা পাকিয়ে শামির ভাইকে খেপিয়ো না।”

সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ আসে। শামির ঠিকই বলেছিলো, পাত্র অসম্ভব সুন্দর। এই পাত্র কোনো পরিবারই হাত ছাড়া করবে না। জান্নাত রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে সব দেখছে। রান্নাঘরে হরেক রকমের সন্ধ্যার নাস্তা এবং মেহমানদের জন্য ডিনার তৈরি হচ্ছে। সুহানা বিদেশি ছয়পদ রেঁধেছে, জান্নাতের হাতের মাছ ভাজা চমৎকার , শারাফাত চৌধুরী জান্নাতকে মাছ, মাংস এবং বাঙালি আইটেম গুলো রাধবার নির্দেশ দিয়েছে।

রুহীর তিনভাই অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। তিন ভাইয়ের পরনে পাঞ্জাবি। সুহানা,জান্নাত রান্না শেষ করে দ্রুত ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিচে নেমেছে। জান্নাত নিচে নেমে আড়ষ্টতায় অতিথিদের সামনে যায়নি, অনেক অচেনা পুরুষমানুষ, যদি শামির কথা শোনায়, সে রান্নাঘরে ঢুকে বসে ছিল।
খানিক বাদে শামিরই রান্নাঘরে ঢুকে ডাকলো,“জান্নাতুল।”

জান্নাত ঘুরে তাকায়। দু’জন দু’জনকে দেখছে। জান্নাতের পরনে হালকা বেগুনি রঙের একটি সিল্কের শাড়ি। শামিরের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। জান্নাত লোকটাকে দেখছে নিমেষ হীন। লম্বা, শ্যামলা, সুঠাম দেহের, গম্ভীর চেহারার লোকটাকে পাঞ্জাবিতে খুব কমই দেখে জান্নাত, লোকটাকে পাঞ্জাবিতে অন্যরকম লাগে, ভীষণ অন্যরকম।

_বসার ঘরে এসো। অতিথিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। শামিরের বৌকে দেখতে চাইছেন ওনারা।

_আমি যাবো?

_হ্যা। চলো, আর শোনো, ওখানে বেশিক্ষণ থাকবে না,সালাম দিয়েই চলে আসবে, একটু বাদে গিয়ে রুহীকে ডেকে আনবে।

জান্নাতকে দেখতে পেয়েই রুহী মুখ ভার করলো, চোখের কোণে পানি এসেছে। জান্নাত এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরে রুহীকে,“কেদো না আপু। আব্বা তো বললেন তানভীর ভাইয়ার শশুর বাড়ির লোক হিসেবে এসেছে। বিয়ের কথা তুলবে না তো।”

রুহী নড়ছে না,রাগী রাগী কন্ঠে বলে,“তো? তোমার স্বামী আমাকে নিতে পাঠিয়েছে? এখন কি করতে হবে? শাড়ি পরে তাদের সামনে গিয়ে হেঁটে দেখাতে হবে?”

_শাড়ি পরতে হবে না,সুন্দর একটা থ্রিপিস পরবে। আমি বের করে দিচ্ছি।

জান্নাত বেছে বেছে একটা আঘানূর থ্রিপিস বেড় করতেই রুহী এক ঝটকায় সেটা ফেলে দিলো। জান্নাত চমকে উঠে রুহীর মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে,“তোমার ভাইয়া বকবে।”

রুহী কাঁদতে শুরু করে। জান্নাত এগিয়ে গিয়ে রুহীর একটা গালে হাত রেখে বলে,“তোমার কি কারো সাথে সম্পর্ক আছে রুহী আপু?”

রুহী নিশ্চুপ, জান্নাত আবারো প্রশ্ন করে বসে,“তন্ময় ভাইয়া?”

হকচকিয়ে উঠে জান্নাতের চোখে চোখ রাখে রুহী, ঠিক তখনই শামির ঘরে ঢোকে। ওরা দুজনে চুপচাপ হয়ে যায়। একবার বোন, একবার মেঝেতে পরে থাকা থ্রিপিসটা দেখে শামির রুহীকে বলে,“চুপচাপ এটা পরে নিচে যা। চুপচাপ। উইদাউট এনি ওয়ার্ড।”

শামিরের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো, রুহী ভীষণ ভয় পেয়ে তৈরি হয়ে নিচে গেলো।

জান্নাত দাঁড়িয়ে আছে মুখটা মলিন করে, শামির ওকে বললো,“আর আপনি! ঢ্যাংঢ্যাং করে আর নিচে যেতে যেন না দেখি।”

________

মোশাররফ হাওলাদার। বরিশাল সদরে হার্ডওয়্যারের সফল বিজনেস তার। তায়েফ, মারুফ,মেধা আর তন্ময়ের বাবা। বেটে খাটো ও শান্ত স্বভাবের লোকটা হতভম্ব হয়ে তার ছোটোছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা তার সাথে রসিকতা করছে কি না বুঝতে পারছে না। তন্ময়ের চোখ মুখ স্বাভাবিক, বাবার দুই পাশে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা বড় দুই ভাইকে উপেক্ষা করে আবারো বলে ওঠে,“রুহীকে বিয়ে করতে চাই।”

_শোন তন্ময়, মজা করবি না।

তন্ময় তায়েফের দিকে তাকিয়ে বলে,“মজা না, আ’ম সিরিয়াস। আমরা একে অপরকে বিয়ে করতে চাই। পাঁচ বছর চার মাসের সম্পর্ক আমাদের!”

মেধা দাঁড়িয়ে আছে অদূরে, এখন বাড়িতে একটা ঝামেলা লেগে যাবে, সে কিভাবে সবটা সামাল দেবে বুঝতে পারছে না, আইঢাঁই করছে সে।

ঝামেলা লেগেছে চোখের পলকে, তবে তন্ময়কে দমানো যায়নি। মোশাররফ হাওলাদার অবাক হয়ে বলে,“তুমি এতকিছুর পরে কি করে ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারো?”

_সম্পর্ক পাচ বছরের আমাদের আব্বু, তোমাদের ঝামেলা শুরু হবার আগেই, ছোটোবেলায় শুনতাম তোমরাও তো চাইতে আমার আর রুহীর বিয়ে হোক!

_এটা এখন সম্ভব না। এই বিষয়টা আজ এখানেই থামিয়ে দেবে। আর কখনও বলবে না।

_বিয়ে আমি রুহীকেই করবো আব্বু। খুব শিগগিরই।

মোশাররফ হাওলাদার ছেলের ওপর উচ্চবাচ্য করলেন না,ছেলে যথেষ্ট বড়, একজন ছাব্বিশ বছর বয়সী ছেলেকে আর যাই হোক জীবন সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে জোর জুলুম করা যায়না। তিনি শুধু শীতল কন্ঠে বলেছে,“যদি ও বাড়ির সবাইকে মানাতে পারো তো মানিয়ে যা খুশি করো। আমরা এর মধ্যে নেই।”

তিনি খুব ভালো করে জানে তন্ময় পারবে না মানাতে,তাই বড় দুই ছেলেকে শান্ত করে বলেছে,“নিশ্চিন্ত থাকো, ও ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না।”

______

প্রকাণ্ড এক চ’ড় এবং চেঁচামেচির বিকট শব্দে দোতলা থেকে ছুটতে ছুটতে নামছে জান্নাত, মেহমান বিদায় করে কেবলমাত্র দোতলায় উঠে বিছানায় শুয়েছিলো সে। পিঠ ব্যথা করছিলো বিকেল থেকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করেছে বলে। নিচে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে ব্যাপারে অবগত নয় সে।

সিঁড়ির প্রত্যেকটা ধাপ যখন অতিক্রম করছিল,তার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছিল, বাড়িতে একটা ঝামেলা লাগবে জানতো, এতো তাড়াতাড়ি লেগে গেলো কি?

রিজিয়া কাঁদছে,বহু কষ্টে সে মেজো ছেলের হাতটা ধরে রেখেছে। শায়নকে চেঁচিয়ে বলছে,“এই রুহীকে সরা। এখান থেকে সরা।”

শায়ন কাউকে সরায়না,উল্টো চোখ লাল করে মেঝেতে পরে থাকা রুহীর দিকে তাকিয়ে আছে।

গালটা লাল হয়ে আছে রুহীর,এতো বড় চড়ের ধাক্কা নিতে পারেনি তার হালকা পাতলা শরীরটা। চড় খাওয়া গালে হাত রেখে ভেজা দু’টো চোখ তুলে সে শুধু বাবা আর ভাইয়াদেরই দেখছিলো, প্রত্যেকের দৃষ্টিতে ভীষণ রাগ এবং হতভম্ব ভাব। একইসাথে রাগে কাঁপছিল সবাই।

চড়টা খেয়েছে যথারীতি শামিরের হাতে রুহী। এমনটা পরিকল্পনা ছিলো না রুহীর, তবুও তাকে এই কদম ওঠাতে হলো। আজ তাকে বলা হয়েছিল তার বিয়ের আলাপ হবে না, অথচ মেহমানরা যাওয়ার আগে, তাদের মধ্যে মহিলা যে মুরব্বি ছিলেন রুহীকে কাছে টেনে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এবার আপনারা অনুমতি দিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে আসি?”

রুহীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল যখন শারাফাত চৌধুরীও হাসতে হাসতে সায় দিলেন, দিলো রুহীর ভাইয়ারাও। রুহী তড়পাতে লাগলো মেহমান বিদায় হবার আগ পর্যন্ত,বাড়ি খালি হতেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গিয়ে মাকে বলেছে তন্ময়ের কথা, সেখান থেকেই শুনে ফেলেছে শামির।

চ’ড় খেয়ে এখন আর নিজের জন্য ভয় লাগছে না রুহীর,তার শুধু ভয় তন্ময়কে নিয়ে,মেজো ভাইয়া কি করবে এখন? শায়ন এবং বড় ভাইয়াও আজ ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠেছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তারা জান দিয়ে দেবে,তবুও তন্ময়ের কাছে রুহীকে বিয়ে দেবে না তারা।

বাড়ির পরিবেশ থমথম। থমথমে হয়ে ছিলো শামিরের গর্জনের অপেক্ষায়, বাবা আর বড় ভাইকে ডিঙিয়ে এসে রুহীকে বলে,“হাত পা ভেঙে বোনকে আজীবন পালবো, তবু কুত্তার কাছে দেবো না কামড় খেতে।”

_তন্ময় ভালো ছেলে….

আরো একটা চড় পরলো রুহীর গালে,চড়টা দিলো রাজন।

সুহানা এগিয়ে গেলো,“পাগল হয়েছো তোমরা? এতো বড় মেয়েকে মারছো। আরে এভাবে মেরো না,চলো সবাই মিলে বোঝাই ‌। রুহী, তুমি এটা ঠিক করলে না। খুব বোকামি করলে।”

রুহী কাঁদতে কাঁদতে বলছে,“কোনো বোকামি করি নি, তন্ময় ভালো ছেলে। আমি ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না।”

শামির তেতে উঠলো,“করবি, এক সপ্তাহের মধ্যেই করবি।”

জান্নাতুল সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সবকিছু। আর একপা বাড়িয়ে সামনে আসার সাহস হচ্ছিল না তার। বাড়ির প্রত্যেকে রুহী আপুর উপর রেগে আছে, ওকে বাঁচানোর কেউ নেই এখানে।

শায়ন গিয়ে তুললো বোনকে, বরফ শীতল গলায় বললো,“জমি নিয়ে খুনাখুনি হতে যাচ্ছিল আর তুই চাইছিস সংসার করতে ও বাড়ির ছেলের সাথে?”

_তোদের ঐ জমি নিয়ে না আমার মাথাব্যথা,না তন্ময়ের ছোটোভাইয়া। আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করেছি তোদের ঐ জমি নিয়ে ঝামেলা শুরু হবার আগেই।

হতভম্ব হয়ে বাড়ির সবাই রুহির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তেজ দেখিয়ে কথা বলছে ঐ তন্ময়ের জন্য। শারাফাত চৌধুরী মেয়ের কাণ্ড দেখে বুকে হাত চেপে বসে রইলেন। রিজিয়া ছুটে গিয়ে স্বামীর পাশে বসে পরলো। শামির রুহীকে বললো,“ঘরে যা,ঘরে গিয়ে তোর ফোন ল্যাপটপ এনে আমার কাছে দে…”

কলিং বেল বেজে ওঠে হঠাৎ। বসার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি লোক নিজেকে সামলায়। শামির আশেপাশে তাকিয়ে জান্নাতকে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চেঁচায়,“ওকে নিয়ে ওপরে যাও।”

জান্নাত স্বামীর আদেশ পালন করতে তাই করলো,রুহীকে এসে ধরলো,পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে।
শামির গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

এক মিনিট পেড়িয়ে যায়, শামিরের মুখে কিছু গালাগাল শুনতে পেয়েই রুহী আর জান্নাত দু’জনে আবারো নিচে নেমে আসলো, তন্ময়কে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই চোখজোড়া কোটর থেকে বেড়িয়ে আসে জান্নাতের। অপরদিকে রুহী যেন এখুনি পরে যাবে নিচে,এমন ভাবে কাঁপতে শুরু করে দেয় সে।

তন্ময় এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, সরাসরি রুহীর বাবা ভাইদের কাছে। শামির আজ প্রচন্ড রাগে কিছুক্ষণ কাঁপে, তারপর হেসে ফেলে, প্রচন্ড রাগে মানুষ যখন উন্মাদ হয়ে যায় তখন যেভাবে হাসে ঠিক সেভাবে হেসে বলে,“তুই বোকা নাকি ওভার কনফিডেন্ট রে?”

শায়ন আসে,“এখান থেকে এক্ষুনি বেড় হ তন্ময়। এক্ষুনি!”

রাজন আসে,“আমার বোনকে তোকে দেবো না। দুনিয়া উল্টে গেলেও না।”

তন্ময় শামিরের গালাগাল হজম করে এগিয়ে যায় শারাফাতের কাছে, গিয়ে একেবারে পাশে বসলো সে! সবাইকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র শারাফাতের কাছ থেকেই রুহীর হাত চাইলো সে।

ওরা তিন ভাই টেনে হিচরে বাড়ি থেকে বের করতে চাইলো তন্ময়কে একপ্রকার। রুহী সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁদছিল। তন্ময় এ বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে এসেছে, মোশাররফ হাওলাদারের কানে যেতেই ছুটে আসে বড় দুই ছেলেকে নিয়ে, তন্ময় শামিরদের মার খাবে এটা ভেবে ভয় পেয়ে ছুটে এসেছে তারা। এসে হয়েছে অপমানিত। শারাফাত চৌধুরী সমস্ত দোষ তন্ময়কে দিয়ে যা নয় তাই বলে কথা শুনিয়েছে হাওলাদারদের। মোশাররফ হাওলাদারের ছেলেরাও ছাড়েনি, সমস্ত দোষ রুহীকে দিয়ে কথা শুনিয়েছে চৌধুরীদের।
শামিরের মেজাজ বিগড়েছে, শুরু করেছে ধাক্কা ধাক্কি,বাড়ি থেকে একে বার করছে,তাকে বার করছে।
জান্নাত শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে,মানুষটা এতো ভয়ংকর হয়ে ওঠে কেন? এতোটা ভয়ংকর হতেই বা হবে কেন!

কিছুক্ষনের মধ্যে বিরাট সিনক্রিয়েট হয়ে গিয়েছে, আশেপাশের বাড়ি থেকে ব্যারিস্টার সাহেব এলেন, ব্যবসায়ী রহমাতুল্লাহ এলেন গণ্ডগোলের শব্দে, ও বাড়ি থেকে মহিলারা ছুটে এসেছে , এসেছে তায়েফ মারুফের বৌরা। মেধা এসে মোশাররফ হাওলাদার,তন্ময় এবং তায়েফ,মারুফকে নিয়ে যায়।

এতকিছুর পর শামির রুহীকে ছেড়ে দেয়নি, ভীষণ ভয়ংকর ভাবে ধমকেছে,“যদি কখনো আর ঐ তন্ময়ের কথা ভাবতে দেখি তবে একেবারে হাত পা ভাঙবো তোর।”

রাত জাগছে রুহী,বাড়িতে আশেপাশের বাড়ি থেকে আসা লোকগুলো চলে গিয়েছে, রিজিয়া এসেছে মেয়ের কাছে ঘুমাতে। রুহীর ফোন জব্দ করেছে ওর ভাইয়েরা, শারাফাতের নির্দেশে রিজিয়া এখন থেকে রুহীর ঘরে থাকবে।

অনেক রাতে নিচতলায় চৌধুরী পুরুষদের গোপন বৈঠক বসেছে, এই বাড়ির মেয়েকে কলঙ্কিত করার জন্য হাওলাদারেরা তন্ময়কে ব্যবহার করেছে এটাই তাদের গবেষণার ফল। শামির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে,বোনকে সাতদিনের মধ্যেই বিয়ে দেবে, তাও ঐ তন্ময়ের থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তারের কাছেই, হাওলাদারদের পরিকল্পনায় পানি ঢালবে শামির।

রাতে যখন রিজিয়া রুহীর পাশে শুলো,রুহী মায়ের গলা জরিয়ে ধরে ফোপালো,“মা, মাগো। আমি মরে যাবো। তুমি কিছু করো।”

রিজিয়াও মেয়েকে ধমকালেন, এই বিয়ে কখনোই রুহীর জন্য ভালো হবে না, সারাজীবন কাঁদার চেয়ে রুহি কয়েকদিন কাদুক, মেয়ের কান্নাকে তাই পাত্তা দিলেন না তিনি।

রাত দেড়টার সময় শামির শোবার ঘরে ঢুকলো। জান্নাত তখনও জেগেছিলো,রুহীর জন্য তার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এ বাড়িতে রুহীকে সে সবসময় ননদ নয়, বরং একজন বোন হিসেবে পেয়েছে। জান্নাতের সবসময় খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে মেয়েটা,সব পরিস্থিতিতে। আজ জান্নাত বুক ভরে শ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছিলো শামিরের,শামিরকে বোঝানোর চেষ্টা করবে সে, লোকটা বকলে বকুক, প্রয়োজনে পা ধরবে। এটুকু সে তো করতেই পারে।

শামির জান্নাতকে জেগে থাকতে দেখে ঘুমাতে বলে, জান্নাত আইঢাঁই করে ওঠে,“একটা কথা বলবো?”

_কি?

_যদি রুহী আপুর কথাটা একটু ভেবে দেখতেন….আপু কষ্ট পাচ্ছে।

_যা করছি ওর ভালোর জন্যই। আর তুমি এসবে ঢুকো না।

_বলছিলাম,রুহি আপু…

_বললাম না তুমি এসবে ঢুকো না?

এই ধমকটা গায়ে মাখলো না জান্নাত, আবারো নির্লজ্জের মতো বলে,“আপু একজনকে ভালোবাসে…..”

_এই বেয়াদব কথা কানে যায়নি?

লাফিয়ে ওঠে জান্নাত। শামিরের দৃষ্টি পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমশ, চোখ পাথরের মত। খেকিয়ে ওঠে,“ছোটো ছোটোর মতো থাকবে, কেউ সাজেশন চেয়েছে তোমার থেকে? চেয়েছে?”

এই ব্যবহার এখন আর খুব একটা আঘাত করতে পারে না জান্নাতকে,সে অভ্যস্ত এতে, বলে,“আমি তো রুহী আপুর ভাবী। আমি সাজেশন দিতে পারিনা?”

চূড়ান্ত হতবাক শামির, বৌ তাকে প্রত্যুত্তর করছে দেখে,মাথাটা রাগে দপদপ করে উঠছে,“না পারবে না। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ দেখাচ্ছো?”

আজ এতক্ষণে ভীষণ আহত জান্নাত, সংসারের পাঁচ মাসে কথার মারপ্যাঁচ খুব ভালোই শিখেছে সে,শামিরের এই তাচ্ছিল্যে ভরা কথাটা মনে গেঁথে নিয়ে দু চোখের পানি ছেড়ে দেয়, ধীরে ধীরে কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,“আর যখন সংসারের শুরুর দিনগুলোতে আপনি শেখাতেন, জান্নাতুল আমার বোনদের দেখভাল করবে, তুমি ওদের ভাবী। সম্পর্কে ওদের বড়, ওদের যত্ন করবে তখন আপনি ভাবেননি মাসিকে এতো দরদ শেখানো উচিত নয়?”

শামির তাকিয়ে আছে, জান্নাত বলতে থাকে,“বৌ বোনদের খিদমত করলে খুশি হন,আর বৌ ওদের ব্যাপারে পরামর্শও দেবে না?”

_খুব কথা শিখেছো না? এসব কার কাছ থেকে শেখো তুমি?

খুব ঠান্ডা ছিল শামিরের গলা, ঝড়ের পূর্বাভাস। জান্নাত নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় । সে আর রাগাতে চায়না লোকটাকে । মাঝরাতে বাড়ির লোকগুলো চলে এলে লজ্জায় পড়তে হবে জান্নাতকে । সবার সামনে বেয়াদব, ফাজিল,এক চ’ড় মারবো,তুলে আছাড় মারবো এসব বলে বলে এক শেষ করে দেবে।

জান্নাত উঠলে শামির ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়, তবে চেঁচায় না শামির, আজ নিচে এতো হম্বিতম্বি করে মাথা ধরিয়েছে। জান্নাতের দিকে রাগী দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে বললো,“ঐ মেধা না? ঐ মেধার সাথে মিশে এতো কথা শিখছিস তুই?”

জান্নাত চুপচাপ শামিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

_এই চোখ নামা, তারপর জবাব দে। ঐ মেধা শেখায় তোকে এতসব?

জান্নাত চোখ নামায়,তবে জবাব দেয় না। শামির রাগে কাঁপছে, বিড়বিড় করে মেধাকে গালি দিচ্ছে,“বারোভাতারি একটা।”

জান্নাত আর সহ্য করতে পারলো না,আহত গলায় বললো,“ছিঃ এসব কি বলছেন!”

শামির তাকিয়ে আছে, জান্নাত আর নিজের মুখে লাগাম টানতে পারলো না,ভয় ডর ভুলে গিয়ে বলে দিলো,“ডিভোর্সী হলেই সে বারোভাতারি? আপনিও তো ডিভোর্সী ছিলেন তবে আপনিও কি বারোভাতারি…..”

_চুপ ! একেবারে চুপ অসভ্য ফাজিল মেয়ে!

জান্নাতের বুক কাঁপে প্রত্যেকটা ধমকে,সে স্থির হয়ে বসে থাকে। শামির ওর চোয়াল মৃদু চেপে ধরে, বিছানার চাদর খামচে ধরে জান্নাত। দাঁতে দাঁত চেপে শামির বলে,“খুব ক্লান্ত আমি। নয়তো আজ তোমার কপালে দুঃখ ছিলো। যা যা অপছন্দ করি,তুমি কোনো না কোনোভাবে সেগুলো করে আমাকে খোচাতে চাও,আমি বুঝি জান্নাতুল। এসব করে নিজের কপালে দুঃখ ডেকে এনো না।”

নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে জান্নাত। এই লোকটা, আজ দুপুরেও তো জান্নাতকে কত ভালোবাসা দিলো বদ্ধ ঘরে। দীর্ঘসময় জান্নাতকে ভালোবাসায় মত্ত থেকে কত আদুরে নামে ডেকেছে,কত আদর করেছে, এখন তবে এতো গালিগালাজ কি করে করতে পারছে?
জান্নাতের অবচেতন মনই উত্তরটা দেয়, পুরুষ মানুষ, স্বার্থের কারণে এরা নারীর পায়ে পরবে, সেখানে নির্বিঘ্নে জান্নাতকে ভোগ করতে চাইলে দুটো আদর মাখা কথা বলা খুব কষ্টকর কিছু না।
জান্নাত ভুল ভেবেছিল, এগুলো মানসিক রোগ নয়, কখনোই মানসিক রোগ নয়, এগুলো নিজস্বতা এই মানুষটার। হ্যা নিজস্বতাই।

জান্নাত আস্তে করে বললো,“লাগছে।”

শামির ওর চোয়াল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। জান্নাত চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা গোছাতে শুরু করে। শামির কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢোকে। রুহীকে নিয়ে এমনিতেই ভীষণ চিন্তিত,তার ওপর দাম্পত্যে ঝামেলা তৈরি করার প্রশ্নই ওঠে না, জান্নাত তো পুরোটাই তার নিয়ন্ত্রিত। ওকে নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কিছু নেই।

ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে শামির দেখলো জান্নাত বিছানা থেকে একটা বালিশ ওঠাচ্ছে।

চেঁচিয়ে উঠলো শামির,“এসব নিয়ে মেঝেতে শোয়ার চিন্তা ভাবনা করলে থাপড়ে সবগুলো দাঁত খুলে ফেলবো।”

জান্নাত বালিশের কাভার খুলতে খুলতে ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দেয়,“বালিশের কাভারটা পাল্টে দিচ্ছিলাম, আমার মাথা থেকে তেল লেগে গিয়েছে।”

চলমান…..