জায়া ও পতি পর্ব-২৩

0
7

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৩
#ইসরাত_ইতি

অসময়ে শামিরকে বাড়িতে দেখে চোখ কপালে তোলে জান্নাত। এতো ব্যস্ত থাকছে ইদানীং লোকটা, লাঞ্চ বাড়িতে করেনা খুব একটা। আজ দিন দশেক পরে এলো।
ঘরে পরার সুতি শাড়ি গুলো ভাজ করতে করতে জান্নাত বলল,“আজ এলেন যে!”

কাজের চাপে তিতিবিরক্ত শামির, কর্কশ গলায় বললো,“আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে সে খেয়াল আছে?”

_ওহহ,মনে ছিলো না আমার।

জান্নাতের ভাসা ভাসা জবাবে আরো তেতে ওঠে শামির,
_আমার এই মাত্র মনে পরলো। ব্যবসায় প্রেশার যাচ্ছে খুব,এতো কিছু কিভাবে মনে রাখি আমি? আর তুমি! বাড়িতে বসে সারাটা দিন কি করো যে এই সামান্য বিষয়টা ভুলে যাও? আদৌও ধারণা আছে একজন পুরুষকে কতকিছু সামলাতে হয় বাইরে? জীবনটা পুরুষের হলে বুঝতে! এখন তো আরামে আছো।

জান্নাত শাড়িগুলো আলমারিতে তুলে রেখে মৃদু শ্বাস ফেলে বলে,“জি।”

_কি জি? খেয়ে রেডি হও। এতো উদাসীনতা ভালো নয় জান্নাতুল অন্তত নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। আমি না বুঝি না,লিটরেরি আমি বুঝিনা তোমার সমস্যাটা ঠিক কি! এইরকম মরা মরা হয়ে থাকো,এতো রানীর হাল পেয়েও। দিতো যদি কোন রেইন্টটেকারের কাছে বিয়ে দিয়ে তবে বুঝতে সংসারে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়া কাকে বলে। শুকরিয়া নেই! একটুও শুকরিয়া নেই!

জান্নাত এসব খোঁচা শুনে অভ্যস্ত,এসব তার কাছে নতুন নয়। তবে শামির ভুল বলছে। শুকরিয়া নেই আবার? জান্নাতের এই জীবনে শুকরিয়া আছে বলেই সে প্রার্থণায় সবসময় তার স্বামীর নেক হায়াত কামনা করে।

বেগুনী রঙের জামদানিটা নিয়ে চুপচাপ চেঞ্জিং কর্ণারের কাছে গেলে শামির বলতে থাকে,“বাচ্চাটা নিয়ে যে তুমি খুশি না সেটা আমি বুঝি! কিন্তু এটা তো আল্লাহর ইচ্ছা জান্নাতুল।”

_ভুল ভাবছেন। বাচ্চাটা নিয়ে আমি খুশি।
অস্ফুটে জবাব দেয় জান্নাত।

শামির বাঁকা হেসে ওর ত্যাড়া ত্যাড়া কথা অব্যাহত রাখে,“সে আমি জানি। তা তো দেখতেই পাচ্ছি দু’চোখে!”

“আপনি তো অনেক কিছুই দেখেন। আপনার মাথাভর্তি খালি চোখ আর চোখ। একটা চোখ দিয়ে সারাক্ষণ খালি দেখতে থাকেন বৌ ভেগে যাচ্ছে, আরেকটা দিয়ে দেখেন বৌ পরকীয়া করছে, আরেকটা দিয়ে দেখেন বৌ সোনা গয়না নিয়ে পালিয়েছে।”
জবাবটা মনে মনে দেয় জান্নাত। ইদানীং সে একটা বুদ্ধি শিখেছে। যে জবাব গুলো শামিরের মুখের ওপর দিতে পারেনা সেসব মনে মনে দেয়। এটা জান্নাতের একটা খেলা।

প্রেগন্যান্সির দেড়মাস চলছে। সে খুব একটা খেতেই পারে না, শুধু বমি পায়।
টেবিল ভর্তি মাছ, মাংস। শিং মাছের ঝোল, নারিকেল চিংড়ি, আস্ত কবুতর ভুনা, খাসির মাংস। দেখেই গা গুলিয়ে উঠলো জান্নাতের। শামিরের রাগারাগীতে খেতে হলো সেসব।

ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো চারটায়, ওরা বেড়িয়েছে আড়াইটা নাগাদ। বাইরে তখন ঠাঠা রোদ। গাড়ি নিয়ে সোজা শামির চলে গেলো ত্রিশ গোডাউন। বরিশালের অন্যতম সুন্দর একটি পর্যটন এরিয়া। জান্নাত বেশ অবাক হয়ে তাকায় বরের দিকে, শামিরের মুখে অস্পষ্ট হাসি,হালকা গলায় বললো,“এটা একটা সারপ্রাইজ। আমার সোনামনির জন্য! হাওয়া খাবে আমার সোনামনি।”

মলিন হাসে জান্নাত। এই এরিয়াতে লোকজন নেই এখন দুপুর বিধায়, জান্নাত বুঝতে পারে এই সময়টাতেই তার বর এখানে কেন এনেছে। এনেছে কারণ যায়গাটা নিড়িবিলি। তবে শামির চৌধুরী ফেইল, তার সোনামনি হাওয়া খাওয়ার বদলে এখন খাবে ঠাঠা রোদ। আফসোস!

“কি হলো নামো?”

_রোদ তো!

_যা বলেছো, চলো ছায়া দেখে বসি।

ভেতরের দিকে একটা ছায়াঘেরা বেঞ্চ পেলো ওরা। দু’জন পাশাপাশি বসলো ঠিকই,কথা বলে না কেউ। শামির ব্যস্ত ফোনে অফিসের কাউকে গালাগালি করতে। বিষয়টা স্বাভাবিক একটি ঘটনা জান্নাতের কাছে, ভীষণ ব্যস্ত মানুষ তার বর। তার সময় কই বৌয়ের সাথে প্রেম-পিরিতি করার প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে। হঠাৎ যখন হাত কচলাতে মন চাইবে তখন কচলায়, জান্নাতের মর্জি মাফিক থোরাই হবে এসব ! প্রেম পিরিতির আলাপ করে কি হবে? একটা দাম্পত্যে থোরাই এসব বাড়তি জিনিস প্রয়োজন। একটা দাম্পত্যে প্রয়োজন টাকা-পয়সা, রোজ একবার নিয়ম করে শারীরিক সম্পর্ক আর স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বাধ্যতা। ওসব বাড়তি চাহিদা জান্নাত বুঝ হয়েছে থেকে কখনো করেনা সংসারে, প্রেম কি সে তো বোঝেই না,প্রেমের আলাপ দিয়ে কি হবে? শামিরের ভাষ্যমতে, না না সবার ভাষ্যমতে জান্নাতের সাত জনমের ভাগ্য এমন বিয়ে হয়েছে তার, যেটুকু পেয়েছে সেটুকু নিয়ে যেন খুশি থাকে, কোনো কোনো মেয়ে তো এসবও পায়না। জান্নাত সরল মেয়ে,এই এতটুকু নিয়েই আপাতত খুশি, খুশি খুশি মুখটা ঘুরিয়ে সে নদী দেখে একা একা, মনে মনে অদৃশ্য কাউকে বলে,“দ্যাখ নদী দ্যাখ শামির চৌধুরীর সোনামনি। এখন আমার চোখ থেকে দেখছিস, এরপর নিজের চোখ থেকেই দেখবি। তখন আমার প্রয়োজন পরবে না।”

দীর্ঘসময় কথা বলে কল কাটে শামির, জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“কি হলো থম মেরে বসে আছো কেন?”

চমকে ওঠে জান্নাত,“কি করবো?”

_কি করবে মানে? হাটো! এটা তো হাঁটাহাঁটি করার যায়গা। আমি তো ফোনে কথা বলছি দেখে এখানে বসেছি। তুমি হাটো,বাতাস লাগাও গাঁয়ে।

_কয় পা হাঁটব?
জান্নাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে প্রশ্নটা ছুঁড়তেই শামির আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে বললো,“কয় পা হাটবে মানে? এটা কেমন প্রশ্ন?”

_মানে কতটুকু হাঁটব। কোনদিকে হাঁটব।

শামির কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জান্নাতের মুখের দিকে, জান্নাত যে তার সাথে ঠান্ডা বেয়াদবি করছে সে বোঝে,তবে বকে না এখন বৌকে। কান্নাকাটি করলে অসুস্থ হয়ে পরবে। শুধু একটা লম্বা শ্বাস ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,“এইজন্যই ,এই জন্যই তোমাকে এতটুকুও স্বাধীনতা দিতে বাধে আমার। তুমি দেখতে ভোলাভালা হলে কি হবে, ভীষণ জটিল মেয়ে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি! স্বাধীনতা পাচ্ছো না বলে স্বামীর সাথে সম্পর্কে যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তৈরি করছো, বা দুঃসাহস করছো। স্বাধীনতা পেলে তুমি আমাকে কি করবে তা ভালোই আন্দাজ করতে পারি আমি! দু পয়সারও দাম দেবে না আমাকে!”

জান্নাত জবাব দেয়না। শামির চাপা রাগটা চাপিয়েই রাখে। তবে শামিরের মাথায় তোলা আছে বিষয়টি, বাড়িতে গিয়েই ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের চ্যানেল গুলো কাটতে হবে সেট অব বক্স থেকে। ওইসব নাটকে থাকা “বালপাকনা” ফাজিল বেয়াদব প্রতিবাদী খ্যাত ফালতু নায়িকাদের দেখে দেখে এতো নাটক করতে শিখেছে এই এতটুকু মেয়ে।

জান্নাত তাকিয়ে আছে চুপচাপ, শামির ঘড়িতে সময় দেখে উঠল, বেজার মুখে বলল,“হাটতে হবে না, চলো ডাক্তারের কাছে।”

তানিয়া রহমান জান্নাতের চেকআপ করে হাসিহাসি মুখে শামিরের দিকে তাকায়,বলে,“দুই স্বামী স্ত্রীর চেহারার এ কি হাল? টেনশন করো খুব?”

শামির মাথা নাড়ায়। তানিয়া রহমান বলতে থাকে,“তোমার বৌ ফিট অ্যান্ড ফাইন। দেড় মাস পেরিয়েছে। সচরাচর ফার্স্ট টাইমিস্টারে শারীরিক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকি আমরা,দূরে থাকা বলতে একেবারেই যে না এমনটা নয়,তোমাদের দুজনের সম্মতিতে সাবধানে নিয়ম মেনে মিলিত হতে পারো। এতো দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।”

জান্নাত মাথা নিচু করে বসে থাকে,শামিরও চুপচাপ। ডক্টর জান্নাতকে কিছু ফলের নাম বলল যেগুলো জান্নাতকে বেশি বেশি খেতে হবে। জান্নাত মন দিয়ে শুনলো। এরপর শামিরকে বলল,“বৌ খুব মেজাজ দেখাবে ক’টা দিন। মানিয়ে নিও।”

শামির হাসলো,বলল,“আমার বৌ খুব শান্ত আপা! ওসব করবে না।”

_তাই নাকি!

_হুম, নিজের হাতে গড়েছি যে!

শামিরের কন্ঠে আত্মবিশ্বাসের সুর। তানিয়া রহমান হেসে ওঠে,“আচ্ছা বেশ যাও। আবার দুই সপ্তাহ পরে আসবে। কল করলে আমিই যেতে পারি ফ্রি থাকলে।”

_________

শারাফাতের শরীরটা ভীষণ খারাপ। শুয়ে থাকে শুধু। বুকে ব্যাথার রোগী এমনিতেই, ইদানিং ব্লাড প্রেসার জনিত সমস্যায় ভুগছেন, ঝিমিয়ে কাঁটায় দিন। বড় দুই ছেলের ওপর অফিসের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন।
বাড়িতে ফিরে শামির বাবার কাছে বসলো, রিজিয়া ও ঘরেই ছিলো, জান্নাতের কথা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো,“ডাক্তার কি বললো?”

_সব ঠিকঠাক।

রিজিয়া উশখুশ করছে,রুহীর কথা তুলতে পারছে না ভয়ে। মাঝে মাঝে রুহীর সাথে রিজিয়ার কথা হয় লুকিয়ে লুকিয়ে। হাওলাদার বাড়ি থেকে তিনদিন আগে সবাই মেনে নিয়েছে রুহীকে। তাসলিমা বেগমের শ্বাস টান ওঠায় ছেলে আর ছেলের বৌকে দেখতে চেয়ে বায়না করেছিলেন মোশাররফ হাওলাদার আর দুই ছেলের কাছে। রাগ থাকলেও মোশাররফ হাওলাদার নিজে গিয়ে রুহীকে এনেছে ও বাড়িতে। রুহী স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতেই থাকছে। রোজ ছাদে গেলে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটাকে মাথায় ওড়না টেনে স্বামীর সংসার করছে, অথচ একটু সামনে থেকে দেখতে পারছেন না রিজিয়া। ও বাড়ির পুরুষ গুলো যদি নিজেদের দেমাগ ভাঙতে পারে তবে চৌধুরীরা কেন পারবে না? তন্ময় বাড়িতে আসার পরেই বাবার কাছে হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে, মোশাররফ ক্ষমাও করেছে রাগ ভুলে। তাসলিমা স্বামীকে অনুরোধ করে জমিজমা ভাগ করে দিয়েছে, প্রত্যেক ছেলে চার শতাংশ করে জমি পেয়েছে। ঐ এক শতাংশ জমি তন্ময়ের ভাগের জমির মধ্যে পরেছে । তন্ময় রুহীর স্বামী, সে হিসেবে রুহীরই তো হলো শেষমেশ জমিটা। একটু এভাবে সরল করে কি সবটা দেখা যায়না? মেয়েটা একটা ভুল করেছে ঠিক,তবে তারাও তো খুব একটা ভালো করেনি রুহীকে জোর জবরদস্তি করে।

এসব কথা রিজিয়া মনে মনে সবসময় ভাবলেও স্বামী-ছেলেদের বলতে পারে না, মেজো ছেলেকে তো একদমই না। শামির মায়ের মুখ দেখে ভেতরটা পড়ে নেয়,“কি মেয়ের জন্য মন পুড়ছে?”

রিজিয়া চুপ করে রয়। উঠে দাঁড়ায় শামির,বলে,“এই ঘরে ঢোকানোর চেষ্টাও করবে না ওকে। রক্তারক্তি হয়ে যাবে বলে দিলাম। বাবাকে মরতে রেখে যেই মেয়ে পালিয়ে যায় তার কোনো স্থান নেই এখানে।”

_______

আকাশটা বেশ ডাকাডাকি করছে আজ, আজ বহুদিন পরে এমন মেঘ করেছে। ঐ মেঘ দেখে দেখে জান্নাতের ভীষণ তেষ্টা পায় বৃষ্টিতে ভেজার। শামির গিয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ অফিসে, সুযোগ পেয়ে জান্নাত সাহস করলো বৃষ্টিতে ভিজতে। ছোটোবেলা থেকে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, বৃষ্টিতে ভিজলে অল্পতেই ঠান্ডা লাগে তাই বৃষ্টি গায়ে মেখে জান্নাত খুশি হলেও বেশিক্ষণ ভেজেনি, পেটে থাকা কারো কথা চিন্তা করেই ছুটে এসেছে নিচে।
এসে শাড়ি পাল্টে দ্রুত একটু সরিষার তেল গরম করে হাতে পায়ের তালুতে মেখে নেয়, ছোটো প্রাণটাকে জান্নাত ভোগাতে চায়না ঠান্ডা লাগিয়ে।
রোজ নিয়ম করে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় জান্নাত সন্ধ্যাতে, রুহী এই সময়ে রোজ মেধার বেলকোনিতে আসে। আজো এলো। মুখটা মলিন তার। গায়ে সুতির একটা শাড়ি,গা ভর্তি সোনার গয়না। জান্নাত মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দেখে বলল,“তোমাকে রানীর মতো লাগছে রুহী আপু।”

রুহী চোখ মুছে বলে,“পুচকু কেমন আছে?”

_ভালো।

_আর বাবা?

শুকনো মুখে জান্নাত জবাব দেয়,“ভালো নেই।”

রুহী কাঁদছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“একটু এসে দেখবো ভাবী? একটু?”

জান্নাত জবাব দেয়না। দিতে পারে না। শামির বলেছে খুনাখুনি হবে, ভরসা নেই তো ঐ লোকটার! এমন কিছু ঘটালেও ঘটাতে পারে।

প্রসঙ্গ পাল্টে জান্নাত বলে,“ভার্সিটিতে যাও?”

উপর নিচে মাথা ঝাঁকায় রুহী। জান্নাতের চোখ চকচক করে,“তোমার বর তোমাকে খুব সাপোর্ট করে তাইনা?”

কাঁদতে কাঁদতে মুখে হাসি ফোঁটায় রুহি,বলে,“এতকিছুর মাঝে ওর ভালোবাসাই একটু মানসিক শান্তি দিচ্ছে।”

_ও বাড়ির লোক কেমন সবাই?

_মেধা আপু,আমার শাশুড়ি বাদে সবাই একটু রাগ রাগ,তবে কষ্ট দেয়না কেউ। যেটুকু সম্মান,আদর দেওয়ার, দেয়। মেকি নয় সেসব।

জান্নাত স্বস্তির শ্বাস ফেলে। রুহী বলে,“আজ নটার দিকে বারান্দায় একবার আসবে ভাবী?”

_কেন?

_তন্ময় স্যরি বলতে চায় তোমাকে। ও রোজ বলে আমায়।

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে জান্নাত বলে,“আরে ধূর। যাও তো। মন দিয়ে সংসার করো। অনেক অনেক দোয়া।”

শামির আসে রাত করে,জান্নাতকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলে,“কথা বলেছিলে নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে ও বাড়ির তন্ময়ের বৌয়ের সাথে আজ?”

জান্নাত চুপচাপ মাথা নাড়ে। মুখটাকে চোরের মতো করে রেখেছে। তবে শামিরের সন্দেহ হলো না। এতকিছুর পরেও যে জান্নাত এই সাহস করবে তার মনে হয়না।

“হুম। বাড়ির কেউ যেনো আমার আদেশ অমান্য না করে সেটাও দেখবে।”

খেয়ে দেয়ে শামির আজ ফুরফুরে মেজাজে বিছানায় ধপপ করে শুয়ে পরলো, জান্নাতকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ নরম আদর করে বলল,“বাড়িতে তোমার বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা দিলাম আজ!”

_কেন?

_চাইলো।

জান্নাতের ভীষণ রাগ চাপে মহাসিনের প্রতি। লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় জান্নাত। মামারা, কখনো কখনো মামীরা, আব্বা বেশ ভালোই টাকা-পয়সা চেয়ে চিন্তে নেয় শামিরের থেকে। এটা জান্নাত মোটেও পছন্দ করে না, নিজেকে কেমন বিক্রিত পণ্য মনে হয় ঐ সময়টিতে।

“দিলেন কেনো?”
মলিন মুখে জান্নাত জানতে চাইল। শামির হালকা গলায় বলল,“অসুবিধা কোথায়? শ্বশুর চেয়েছে! মুরব্বি মানুষ!”

চুপ হয়ে রয় জান্নাত। শামির মনে মনে সামান্য হাসে। সবাইকে টাকা দেওয়াটা যে সে খুব উপভোগ করে বিষয়টা তেমন নয়। তবে এদের হাতের মুঠোয় রাখা শামিরের প্রয়োজন। এরা এযাবৎ বহু উপকার করেছে শামিরের, প্রকৃতপক্ষে বৌয়ের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে শ্বশুর বাড়ির লোককে হাত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাই দু’হাতে টাকা ঢালতে রাজি সে।

জান্নাতকে ধীরে ধীরে বুকে টানে শামির। বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি। বুকের ভেতর একটা নরম শান্ত সুবাসিত শরীর। দু গালে চুমু খেয়ে আজ এই প্রথম শামির অনুমতি নিলো নরম গলায়,“ডাক্তার কি বললো শুনলে? আমি আদর করতে পারবো তোমায়।”

জান্নাত অবশ্য বাঁধা দেয়না, অতটুকু মস্তিষ্কে তার আরো একটা ব্যাপার ঢুকেছে। মাইমুনার কথা গুলো কানে বাজছে, স্বামী উপেক্ষা করলে এই স্বামী আরেক নারীর দ্বারপ্রান্তে যাবে। নারী জীবন বড় অনিরাপত্তার জীবন,অন্তত পুরুষের থেকে। পুরুষ নারীকে আগলায়,এই পুরুষই লাথি মারে। জান্নাত লাথি খেতে চায়না কখনো। মন উড়ো উড়ো করলেও সে বাস্তবতা বোঝে। তার বাস্তবতা এই লোকটা,এই সংসার,তার পেটের অনাগত সন্তান। দু’দিন উপেক্ষার পরিণামে যদি এই লোকটা বেঈমানি করে বসে? পুরুষের কাছে “সঙ্গম” অতি প্রয়োজনীয় কিছু তা জেনেছে জান্নাত, এরা এই ব্যাপারটিতে কেনো এতোদিন ত্যাগ স্বীকার করবে? পুরোটা সময় জান্নাত অসুস্থ শরীরে চুপ হয়ে থাকে,উল্টো সে নিজেই আঁচল সরিয়ে দেয়। কোনোভাবেই চায়না জান্নাত কপাল পোড়াতে। কোনোভাবেই না।

ঘুমের মধ্যে আজ জান্নাত খুব ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সে দেখেছে একটা ছোট বাচ্চা অন্ধকারে তাকে মা মা বলে ডাকছে। তবে জান্নাত বাচ্চাটাকে খুজে পাচ্ছে না কোথাও, তার দম ফুরিয়ে আসছে ছুটতে ছুটতে। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। অন্ধকারে ঐ মা মা ডাকটা তাকে আরো পীড়া দিচ্ছে। জান্নাত চেঁচায়, চেঁচাতে ঘুম ভেঙে যায় ওর। ধরফরিয়ে উঠে বসতেই শামিরও উঠে বসে, উঠে আগলে নেয় ওকে,“কি হয়েছে জান্নাতুল? আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”

টকটকে লাল দু’টো চোখে জান্নাত ঢুলু ঢুলু তাকায় শামিরের দিকে। শামির তৎক্ষণাৎ ওর কপালে হাত রাখলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে জান্নাতের।

চলমান…..