জায়া ও পতি পর্ব-২৪

0
207

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২৪
#ইসরাত_ইতি

রাতে সেভাবে টের না পেলেও সকালটায় জান্নাত বুঝলো তার খুব জ্বর। তাপমাত্রা প্রকট। ভীতসন্ত্রস্ত জান্নাত ঘাবড়ে গিয়ে শামিরকে কিছু জানায়না। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যদি জেনে নেয় কেন এতো জ্বর, ঠান্ডা লাগিয়েছিলো কিনা তবে কথা শুনিয়ে শেষ করে দেবে জান্নাতকে। এমনিতে কনসিভ করার পর থেকে কুসুম গরম পানি ছাড়া গোসল করতে দেয়না জান্নাতকে শামির। এতোটাই খুঁতখুঁতে লোকটা। অবশ্য জান্নাতের রোগশোকের শরীর যে! যদি শোনে জান্নাত এই শীত শীত মরসুমের বৃষ্টিতে গা ভিজিয়েছে ধেই ধেই করে, তাহলে গলাটাই টিপে ধরবে জান্নাতের।
পাশে শামির নেই,পরে আছে ম্যাগাজিনটা। জান্নাত জ্বর আর ঘুমের ঘোরে ম্যাগাজিনটা তুললো হাতে,পাতা উল্টে পাল্টে কিছুক্ষণ দেখে রেখে দিলো। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। হাই তুলে যেই না উঠে বসলো অমনি শুনতে পেল নিচে চেঁচামেচির শব্দ। অফিস টাইম হয়নি শামির রাজনের, সবেমাত্র সকাল আটটা। বাড়িতেই সবাই। তবে কি হলো? রুহী আপুকে নিয়ে কোনো ঝামেলা?

শারাফাত চৌধুরীর বুকে ব্যাথা উঠেছে। বুকে হাত চেপে রেখে গুঙ্গিয়ে যাচ্ছে লোকটা। সকালে রিজিয়া যখন চা নিয়ে নিয়ে এলো দেখলো শারাফাত চিৎ হয়ে পরে আছে মেঝেতে। কিছু বলতে চাইছে, পারছে না।

ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে জান্নাতের চোখের সামনে। শামির,রাজন দুই ভাই বাবাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ডক্টর না ডেকে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়েছে। বাড়ির গাড়ি দু’টো ওয়াশ করতে পাঠিয়েছে।
রিজিয়া স্বামীর পায়ের কাছে বসে চোখের জল ফেলছে, শামা মাকে ধরে রেখেছে।

জান্নাত কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না, গায়ে জ্বর নিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে, কোনো সাপোর্ট ছাড়া দাঁড়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ঘরে এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে সে প্রার্থনা করছে শ্বশুরের সুস্থতার জন্য।

সময় গড়াতেই পাড়া প্রতিবেশী থেকে লোক জড়ো হলো বাড়ির অন্দরমহলে। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি করছে বিধায় শামির ফোনে গালাগালি করতে ব্যস্ত। ঠিক তখুনি রুহী এলো ছুটতে ছুটতে। বাবার খবরটা সে পেয়েছে সুহানার থেকে।
সুতি শাড়ি পরিহিতা নববধূ রুহী, শাড়ির আঁচল খসে পরতে চাইছে ছোটাছুটিতে, তবে তাকে থামতে হলো সদর দরজাতেই। শামির ঢুকতে দিলো না, একটা ধাক্কা মেরে বের করলো বাড়ি থেকে। রুহীকে এসে ধরলো তন্ময়। শামির ওদের দুজনের ওপর বজ্রধমকে চেঁচায়,“এক্ষুনি এখান থেকে বের হ তোরা নয়তো মারা পরবি আমার হাতে।”

রুহী ডুকরে কেঁদে উঠে শামিরের পায়ে পরলো,“ভাইয়া দাওনা ক্ষমা করে। দাওনা বাবাকে দেখতে!”

রাজন এসে ওকে টেনে তুলে উঠিয়ে আবার বের করে ঘর থেকে,“না, সেদিন সব সম্পর্ক শেষ করলি না? আবার কি? এখন আবার কি?”

এভাবে বারবার রুহী মা’র খাচ্ছে দেখে তন্ময় নিজেকে সামলাতে পারলো না আর। জেদ দেখিয়ে রুহীর হাতটা ধরে বাড়ির ভেতরে এনে বলে,“এনাফ। অতিরিক্ত করছেন আপনারা। রুহীর অধিকার আছে ওর বাবাকে দেখার। একদম বাড়াবাড়ি করবেন না।”

নিমিষেই একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি লেগে গেলো। জান্নাত মাথায় ঘোমটা টেনে সিঁড়ির কাছে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখছিল তার স্বামীকে। রাগের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না ঐ লোকের, ওদিকে শারাফাত অসুস্থ। রিজিয়াও আসছে না,ও বাড়ি থেকেও কেউ আসছে না এই ঝামেলা থামাতে।
জান্নাত আশেপাশে তাকায়, সুহানাকে না পেয়ে সে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেই পা বাড়ায় শামিরের দিকে। গিয়ে ধরলো শামিরের হাতটা, টানলো ওকে,“আপনি থামুন। ওদিকে আব্বা….”

শামির কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়ে বিরাট একটা ধ’ম’ক দিলো জান্নাতকে,“ভেতরে যাও ফাজিল! এক্ষুনি!”

বলার কিছু নেই আর জান্নাতের,ঐ একটা ধমকই সবকিছু। ঐ একটা ধমকই সর্ব রোগের অব্যর্থ মাদুলির মতো কাজ করে জান্নাতের ক্ষেত্রে। চুপচাপ মাথা নুইয়ে জান্নাত অসুস্থ শ্বশুরের ঘরে ঢোকে। এবং শামির রুহীকে ঢুকতেই দেয়না বাড়িতে। তবে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয় শারাফাতকে,তখন রুহী দূর থেকে বাবাকে একপলক দেখে। তন্ময় ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।

_________

হার্ট অ্যাটাক হয়নি শারাফাতের। বুকে একটু চাপ পরেছে এই যা, তবুও শামির বা রাজন কেউ ঝুঁকি নেয়নি। অ্যাপোলোতে তিনদিনের জন্য সার্বিক পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ভর্তি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । শারাফাতের কাছে থাকছে রিজিয়া।

বাড়িটা এখন নিড়িবিলি, জান্নাত আর মাইমুনা ছাড়া প্রত্যেকেই হসপিটালে। এদিকে জ্বর বাড়ছে জান্নাতের, জ্বরকে বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না ভেবে প্যারাসিটামল নিয়েছে। তবে কমেনি জ্বর। প্রতিবার এই প্রবল জ্বর তার এন্টি বায়োটিকে থামে। দুপুর নাগাদ রাজন ব্যতীত প্রত্যেকেই বাড়িতে ফিরলো। জান্নাত তখন ছিলো ঘরে, হঠাৎ খুব লেবু খেতে ইচ্ছে করছিল দেখে লেবুর রস খাচ্ছে চিপে চিপে ডানহাতের তর্জনীতে লাগিয়ে লাগিয়ে।

শামির রুমে ঢুকতেই অগোছালো হয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকা জান্নাত সটান হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এটা তার অভ্যাস। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি শামিরকে ভোলাতে পারেনি সকালের ঘটনাটি, জান্নাতের ওপর ভীষণ রাগ আছে তার। বাইরে থেকে ফিরে ফ্রেশ না হয়েই এগিয়ে গিয়ে ক্ষ্যাপাটে স্বরে বলে,“সাহস কি করে হয় তোমার!”

ঘাবড়ে যায় জান্নাত, দু’বার ফাঁকা ঢোক গিলে বলে,“আমি কি করেছি?”

_কি করেছো? সকালে বাড়ি ভর্তি প্রতিবেশীর সামনে তুমি কোন দুঃসাহস নিয়ে গিয়ে আমায় বাঁধা দিয়েছো আমি যাতে তন্ময়কে ছাড়ি?

টলটলে চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাত, কাঁপা স্বরে বলে,“বাবা অসুস্থ ছিলো তাই….”

_সেটা আমার মাথায় ছিলো না? সবার সামনে গিয়ে আমাকে টানাটানি করে কি বোঝাতে চেয়েছো? শামিরের ঘটে বুদ্ধি নেই, ওর থেকে ওর বৌ বুঝদার। আমার সাথে তখন সবার সামনে উঁচু গলায় কথা বলে কি বোঝাতে চেয়েছো? তুমি খুব আমাকে নিয়ন্ত্রণ করো? শামির চৌধুরী বৌয়ের ন্যাওটা?

জান্নাত হাঁসফাঁস করছে,সে বলতে ভুলে গিয়েছে তার গায়ে জ্বর, উল্টো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে,“আপনি জটিল করে দেখছেন….”

_মোটেও জটিল করে দেখছি না। আমার ওপর পাবলিক প্লেসে এ ধরণের মাতব্বরি করতে আমি বারবার নিষেধ করি। বারবার আমি বলি ছোটো ছোটোর মতো থাকো, কিন্তু তুমি তো থাকার মানুষ নও!

চোখ বেয়ে পানি পরলো জান্নাতের,নিচু করে নিলো মাথা। শামির এইবার থামলো, মেজাজটাকে বহু কষ্টে বাগে এনে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে গেলো ওয়াশ রুমে।

শামিরের ব্যস্ততা বেড়েছে, এদিকে বেড়েছে জান্নাতের জ্বর। শামিরের রাগ দেখে আর জানাতে সাহস করেনি। ঐ লোকটা, নির্ঘাত গলা টিপে ধরবে জান্নাতের যদি শোনে জান্নাত বৃষ্টিতে ভিজেছিল, নির্ঘাত।

অবশ্য জান্নাতের অসুবিধা নেই এই জ্বরে। বাড়িতে রেনু আছে,তাকে দিয়ে পুরনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে পাড়ার ফার্মেসি থেকে জ্বরের এন্টি বায়োটিক আর কাশির ওষুধ আনিয়েছে। তিন দিনেই সব গায়েব হবে।

শামির আজ বাড়িতে ফিরলো বেশ রাত করে, রাত তখন একটা। হসপিটালে বাবার কাছ থেকে হয়ে এসেছে বিধায় এতো দেরি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলো শামির। সদর দরজা খুলেছে সুহানা। হাই তুলতে তুলতে দোতলায় উঠে ঘরে পা রাখতেই শামির থমকায়। চাদর মুড়ি দিয়ে জান্নাত ঘুমিয়ে আছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে শামির বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা দুধের গ্লাস দেখে। যেটা তখনো খায়নি জান্নাত। শামির এগিয়ে গিয়ে বিছানায় রাখা উপন্যাসের দু’টো বই তুলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে জান্নাতকে ডাকলো,“জান্নাতুল! উঠে দুধটা খেয়ে নাও। জান্নাতুল সোজা হয়ে শোও,এভাবে শুতে নেই এই সময়ে।”

বারবার ডাকার ফলে ঘুম ছুটে যায় জান্নাতের,এমনিতেও এই লোকটার একটা সাধারণ ডাক জান্নাতুলের কাছে ধ’ম’ক লাগে। ঘুম ভেঙে লাফিয়ে বসে জান্নাত কপাল চেপে ধরে, জ্বরে ভেতরের জ্বলুনি কমেনি উল্টো বেড়েছে। শামির কিছু পলক মেয়েটাকে দেখে রাগী রাগী গলায় জানতে চায়,“রাতে খেয়েছিলে?”

মাথা নেড়ে জান্নাত হ্যা বলে বিছানা থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে ঘরময় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,“একটা বেজেছে রাত?”

_হ্যা।
জবাব দিয়ে শামির ঢুকলো ওয়াশ রুমে, ফ্রেশ হতে। জান্নাত তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে তার ওষুধের ঝাপি খুঁজছে। রাত একটায় তার একটা এন্টি বায়োটিকের ডোজ নিতে হবে, এলার্ম দিয়ে রেখেছিল এজন্য।
ওষুধের ঝাপি খুজে পেয়ে পাতা থেকে ওষুধটা খুঁটে বের করেছে ঢুলতে ঢুলতে, ওষুধটা মুখেও পুরেছে। পানির বোতল তুলে আরকটু পানি খাবে তখনই শামির ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে জান্নাতের হাত দেখে বলে ওঠে,“কি খাচ্ছো ওটা? হাতে কি?”

জান্নাত খানিকটা চমকে ওঠে, ঘাবড়ে যায়। পরপর নিজেকে সামলে ওষুধ টা গিলে খেয়ে নিচু গলায় বলে,“জ্বর এসেছে। ওষুধে কমেনি, এন্টি বায়োটিক নিচ্ছি।”

চোখ দু’টো অকস্মাৎ বড় বড় হয়ে যায় শামিরের। হতবুদ্ধি হয়ে ছুটে এসে জান্নাতের হাত ধরলো। জান্নাত ঘটনার আকস্মিকতায় চমকাতেও পারলো না,দেখলো তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওয়াশ রুমে।
বেসিনের সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে শামির অস্থির গলায় চেঁচাচ্ছে,“বমি করো। বমি করো স্টুপিড।”

শামিরের এমন আকস্মিক অগ্নিমূর্তি দেখে জান্নাত কেঁদে ফেলে ভয় পেয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,“কেন?”

_তোকে বমি করতে বলেছি আমি!

বজ্রধমকে ঝাঝিয়ে উঠলো জান্নাতের কান, অন্তরাত্মা, সব। ওকে পেছন থেকে চেপে ধরে তাড়া দিচ্ছে শামির, ক্রমবর্ধমান অস্থিরতায় তাকে আর পাঁচদিনের থেকেও ভয়ানক লাগছে। জান্নাত দিশা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে সব ভাসালো। ওষুধটাও বেরিয়ে গেলো।

দুর্বল শরীরটা নিয়ে ঘুরে শামিরকে দেখে। জান্নাতের বমি হয়েছে,যেন শামিরের অস্থিরতাও কমেছে কিছুটা। তবে মুখটা থমথমে। জান্নাতের মুখে পানি ছিটিয়ে ভালো করে,ওকে কোলে তুলে এনে বিছানায় আধশোয়া করে রাখলো। জান্নাত কম্পিত স্বরে বলল,“কি হয়েছে?”

_তুই জানিস না কি হয়েছে আহাম্মক কোথাকার?

_আমি সত্যিই জানি না!

শামির ওষুধের ঝাঁপির কাছে যেতে যেতে বলে,“এন্টি বায়োটিক নিচ্ছিলে কোন আক্কেলে? বেকুবির একটা সীমা থাকে জান্নাতুল।”

_আমি তো আগেও নিয়েছি, আপনি জানেন।

ওষুধের ঝাঁপি হাতে নিয়ে শামির আবারও ধমকে বলে,“তুমি এখন প্রেগন্যান্ট। প্রেগন্যান্সিতে এসব ওষুধ নেয়া ঝুঁকি, জানো না?”

আচমকা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় জান্নাতুল। ছটফটিয়ে ওঠে তার ভেতরটা। শামির মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,“কি হয়েছে?”

কেঁদে ওঠে জান্নাত আবারো, হাঁসফাঁস করে উঠে বলে,“আমি তো দু’টো ডোজ নিয়ে ফেলেছি সকালে,বিকালে।”

হতভম্ব শামির কথা হারিয়ে জান্নাতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, পরপর অস্ফুটে বলে,“কি বললে?”

উপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে জান্নাত শুধু কাঁদে। শামির বড় বড় দু’টো শ্বাস ফেলে এক আছাড়ে ওষুধের ঝাঁপি ফেললো। তারপর ক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে বললো,“এতো বড় ব্লান্ডার করার আগে আমাকে জানাতে পারলে না?”

_আপনি ব্যস্ত ছিলেন।

অস্থিরতায়,রাগে নিজের চুল টানছে শামির। হাত নিশপিশ করছে,সে হাত দু’টো মুষ্টিমেয় করে রেখে বকতে থাকে,“এই সামান্য কথাটা তুই জানিস না যে এই সময়ে এতো কড়া ডোজের এন্টি বায়োটিকে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস? এটা তো ক্লাস এইটের মেয়েরাও জানে।”

জান্নাত এই ভয়টাই এতক্ষণ পেয়েছে,শামির তাকে এভাবে পাকড়াও করবে সে পাঁচ মিনিট আগেও ভেবেছে। থেমে থেমে জবাব দেয়,“আমি সত্যিই বুঝে উঠতে পারিনি এতকিছু। আমি সত্যিই এসব জানতাম না। অতটা খতিয়ে ভাবিনি।”

প্রচণ্ড রাগে শামিরের হাসি পেল,পর পর চেচালো,“কেন জানিস না এই সামান্য কথাটা? এখন তোর কমনসেন্স কোথায়? সব জানিস,সব বুঝিস,তবে এটা কেন জানবি না?”

জান্নাত বসলো ক্লান্ত হয়ে বিছানাতে, দুশ্চিন্তায় তার শরীর কাঁপছে। এই অবস্থায় এই লোককে কিভাবে শান্ত করবে সে।

শামির মুখে যা এসেছে তা-ই শুনিয়েছে জান্নাতকে। বিষয়টা এমন যে,শামিরের একার একটা খুবই মূল্যবান জিনিস জান্নাতকে শামির রাখতে দিয়েছে, জান্নাত গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে অযত্ন করেছে জিনিসটার। রাগের মাথায় কথা শোনাচ্ছে শামির। অথচ ঐ জিনিষটা যে অর্ধেকটা জান্নাতেরও, ওটাকে হারানোর ভয়ে, ওটার ক্ষতির ভয়ে যে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে এটা কি ঐ লোক বোঝে? ধূর্ত ব্যবসায়ী শামির চৌধুরী তো হিসেব নিকেশে পাক্কা। হিসেবে ডেবিট ক্রেডিটের ঘর সমান যেভাবে রাখে, নিখুঁত ভাবে। তেমনি ভাবে নিজের বাচ্চা হারানোর আতঙ্কে পুরুষ লোকটা রাগে অন্ধ হয়ে কড়ায় গন্ডায় জান্নাতের যেটুকু বকা পাওনা সেটুকু দিয়েই ক্ষান্ত হবে আজ। সমান সমান। জান্নাত একটা তথ্য জানতো না, সে জানতো না সত্যিই ঐ কথাটা। তার জীবনে ঐ তথ্যটা জানার অভিজ্ঞতা কি হয়েছে? জান্নাত সব বিষয়ে বেশি বুঝলেও ঐ তথ্যটাও জানার কথা ছিলো? ক’বার মা হয়েছে জান্নাত? ক’বার?

নীরব অশ্রু বিসর্জন করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই জান্নাতের, এদিকে গাঁয়ের জ্বর যেন পালিয়ে গিয়েছে শামিরের বকা শুনে।

অস্থির পায়চারি করে গজরাতে গজরাতে শামির হাতে ফোন নেয়,ঐ অতো রাতেই ডক্টর তানিয়াকে কল করে। ওপাশ থেকে তানিয়া শুনে ভরসা দেয় শামিরকে,“শান্ত হও। যেকোনো সুবিধা অসুবিধা আমাকে জানাবে, আমি জেগে আছি, হসপিটালে ডিউটিতে আমি।”

ফোন কেটে ফোনটাকেও একটা আছাড় মারে শামির। তারপর টকটকে দু’টো লাল চোখে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“সব ব্যাপারে উদাসীনতা মানা যায়, এই বাচ্চার ব্যাপারে শুরু থেকে তুমি কেয়ারলেস। যেন আমি জোর করে এই বাচ্চা তোমাকে ধরিয়ে দিয়েছি, তোমার ওয়েল পলিশড ক্যারিয়ার নষ্ট করেছি তাই তুমি এই বাচ্চাটার ওপর বিরক্ত। কোনোমতে জন্ম দিতে পারলেই বেঁচে যাও,এমন ভাব ধরে ঘুরতে। দুধ থেকে শুরু করে পানিটা অবধি আমি তাগিদ দিয়ে খাইয়েছি। ভিটামিন ক্যাপসুল রোজ আমি না বললে তো ছুঁতেই না। আর আজ নিজের জ্বর হয়েছে বলে সরাসরি এন্টি বায়োটিকে হাত দিলে?”

ভেজা চোখ তুলে তাকায় জান্নাত,বলে,“আপনি জানেন আমার জ্বর হলে কি অবস্থা হয়!”

_তো? দু’টো দিন দেখতে, মরে তো যেতে না। আমার বেবির তো কোনো যত্ন তুমি নাও না মন থেকে,যেই আজ নিজের জ্বর হলো অমনি এতো তৎপর হলে! স্বার্থপর কোথাকার!

বলার মতো কথা জান্নাত আসলেই খুঁজে পাচ্ছে না। এই লোকের সাথে তর্কে জড়ানো মানে নিজে বারবার দোষী হওয়া, বারবার। জান্নাত দোষী হতে চায়না, জান্নাত জানে এই বাচ্চাটা জান্নাতের কতটা আবেগের। জান্নাত স্বার্থপর নয়, স্বার্থপর ঐ নামে উচ্চশিক্ষিত লোকটা যে এই বাচ্চাটাকে কেবলই তার অংশ দাবি করে।

অস্থিরতায় কেউ ঘুমাতে পারে না, শামির চিবিয়ে চিবিয়ে বলে যেতেই থাকে,“আমার বেবির যদি কিছু হয় জান্নাতুল। সত্যি আমি জানিনা আমি তোমাকে কি করবো এই স্টুপিডিটির জন্য। আরে লোকে শুনলেও তো হাসবে, এই বিষয়টা একটা গর্ভবতী মা জানে না? সিরিয়াসলি?”

জান্নাত শুয়ে পরলো চুপচাপ,মনে মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই তার। ওদিকে শামির না ঘুমায়,না থামে। এই ঘটনার রেশ ধরে জান্নাতের প্রতি যত চাপা ক্ষোভ ছিল সব উগড়ে দিচ্ছে।

জান্নাতের আকুল প্রার্থনা হয়তো সে রাতে সৃষ্টিকর্তা রাখেননি কোনো কারণে, ঠিক ভোর রাত সাড়ে চারটার সময় জান্নাতের পেটে ব্যাথা শুরু হলো। এমন তীব্র ব্যথা, নিঃশেষে নিংড়ে নিচ্ছে জান্নাতের দম। ব্যাথা শুরু হবার সাথে সাথে শামির তানিয়াকে কল করলে তানিয়া হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে। শামিরকে দেখাচ্ছে উদ্ভ্রান্তের ন্যায়। শায়ন গত রাতেই এসেছে। পার্কিং এড়িয়ায় বাড়ির গাড়ি দাড় করানো। শামির শার্টটাও পাল্টালো না, এসে পাঁজাকোলা করে তুললো ব্যাথায় আধো অচেতন জান্নাতকে, মুহুর্তেই লাল লাল তরলে মেখে গেলো শামিরের হাত, শার্টের কিছু অংশ।

লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শামির। সে জমে গিয়েছে। চোখ মুখ কঠিন করে এগিয়ে যাচ্ছে।‌ জান্নাত জ্ঞান হারানোর আগে অবধি শামিরের কঠিন মুখটাই চেয়ে চেয়ে দেখলো।

চলমান……