প্রাণসখা পর্ব-০৫

0
1

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.
কিছু সময় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে হাজারো বুঝতে চেষ্টা করলেও কেন যেন বোঝা হয়ে ওঠে না। আমিও তেমনি স্বচ্ছকে বুঝতে পারি না। তার ঐ গাঢ় চোখের চাহনির পেছনের গোপনতা ধরতে পারি না। দীর্ঘদিন তাকে দেখতে না পেরে যে ব্যাথা অনুভব হয়েছিলো তাকে দেখা মাত্র তা আরো গাঢ় হলো। তার এই‌ নির্লিপ্ততা আমায় পোড়ালো খুব। তিনি তখনো নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে।

‘ভেতরে আসবেন নাকি এভাবেই যুগ পার করবেন?’

আমি তার দিকে ঝাঁপিতে ঢাকা প্লেটটা এগিয়ে দিলাম। মুখে বললাম,

‘আন্টি পাঠিয়েছে। তার বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে।’

স্বচ্ছ প্লেটটা নিলো না। কেমন ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। হঠাৎ করেই সে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দরজা পুরোপুরি ভাবে খুলে দিলো।

‘ভেতরে চলে আসুন। আম্মু কিচেনে আছে তার কাছে দিয়ে দেন। অবশ্যই তাকে নিজের পরিচয় দিতে ভুলবেন না। অপরিচিত মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করার চমৎকার অভ্যাস আছে তার।’

কথা শেষ করে স্বচ্ছ উল্টোপথে হেঁটে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। একটু অপমান বোধ করলাম। আমি তার বাসায় প্রথম পা রেখেছি তার অন্তত্য আমাকে আপ্যায়ন করা উচিত ছিলো! এভাবে মুখের উপোর উল্টোপথে হেঁটে দরজা আটকে দেওয়া কেমন সভ্যতা? স্বচ্ছর এই আচরণে সবথেকে আহত হলো আমার ব্যক্তিত্ব। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইলো। তার প্রতি ভালোলাগা ইতিমধ্যে ইগোর কাছে মাটিচাপা পড়েছে।

স্বচ্ছদের বাসায় বেগুন ভাঁজা হচ্ছে। সাথে চিনি গুঁড়া চালের পোলাও। ঘ্রাণে পুরো ঘর ভরে উঠেছে। রান্নাঘর থেকে টুং টাং শব্দ আসছে। আমি অস্বস্তি অনুভব করলাম। এভাবে অজানা কারো রান্নাঘরে চলে যাওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর। আমি খুক খুক করে কেশে উঠলাম। রান্নাঘর থেকে স্বচ্ছর মা বলে উঠলেন,

‘কে ওখানে? কে এসেছে ঘরে?’

বলতে বলতেই তিনি খুন্তা হাতে বেড়িয়ে এলেন। গেরুয়া রঙের ছাপার একটা শাড়ি পড়নে বেশ স্বাস্থ্যবান একজন মহিলা তিনি। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও বেশ উজ্জ্বল। বোঝাই যাচ্ছে স্বচ্ছ তার গায়ের রং পায়নি। চেহারায় ও তেমন মিল নেই। স্বচ্ছর ভাস্যমতে তার মা অপরিচিত কাউকে দেখলে চিৎকার চেঁচামেচি করেন। কিন্তু তেমন কিছুই তিনি করলেন না। তবে বেশ বিরক্ত হলেন বোধহয়। আমায় দেখতেই তার চোখমুখে কেমন বিষাদ নেমে এলো। তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,

‘তুমি এখানে কেন? কিভাবে ঢুকলে?’

এতক্ষণের অস্বস্তিবোধের পারদটা এবার একবারে স্কেল ছাড়ালো। প্রথম দেখায় বুঝি কেউ কাউকে এমন প্রশ্ন করে? নাকি এটা এদের পারিবারিক সমস্যা? কিছুক্ষণ পূর্বে স্বচ্ছ অমানবিক আচরণ করলো আর এখন তার মা! এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজের পরিচয় দিতে হয় জানা নেই আমার। তবুও দেওয়ার মতো উপযুক্ত কোনো উত্তর খুঁজতে লাগলাম। এসবের মাঝে স্বচ্ছ কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি আমি।

‘আম্মু তিনি তৃতীয় ফ্লোরের রিক্তা আন্টির বাসার অতিথি। আজ আন্টির বিবাহ বার্ষিকী। আন্টি খাবার পাঠিয়েছেন। সেটাই দিতে এসেছে।’

স্বচ্ছর প্রতি কৃতজ্ঞ অনুভব করলাম। একবার তার দিকে ফিরে দেখলাম সে ডায়নিংয়ের চেয়ারে বসে ফোনে কিছু একটা করছে। ভিষণ মোনযোগে চেয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনে। এভাবে যদি একবার আমায় দেখতো! নিশ্চিত তার ঐ গভীর চোখ জোড়া আমার ভেতরের তোলপাড় দেখতে পারতো।

‘ওটা টেবিলে রেখে দাও। রিক্তা আপা কি হন তোমার?’

আমি পুনরায় ঘুরে স্বচ্ছর মায়ের দিকে তাকালাম। কেমন কঠিন করে রেখেছেন তিনি চোখ মুখ। আমি প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম,

‘তিনি সম্পর্কে আমার বাবার কাজিন। আমি আন্টি বলে ডাকি।’

আমার কথার পিঠে তিনি আর কিছু বললেন না। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। পোড়া গন্ধ আসছে। বেগুন ভাঁজা হয়তো পুড়ে গেছে।

‘স্বচ্ছ অতিথিকে দাঁড় করিয়ে না রেখে সোফায় বসতে দে। এই দুপুরে তো চা দেওয়া যাবে না। আমি শরবত বানাচ্ছি। চিনিটাও শেষ। দোকান থেকে এক কেজি চিনি আন। তোর বাপটা সকালে বের হলো আর খোঁজ নেই। বাজার করতে হবে যে সে চিন্তা আছে তার?’

ভদ্রমহিলা আরো কিছু বিলাপ করলেন। আমি চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এখান থেকে চলে যাওয়ার বাহানা খুঁজলাম। এতটা অস্বস্তিতে এর আগে কখনোই পরিনি। স্বচ্ছ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।

‘চলে আসুন মিস অতিথি। আপনায় আপ্যায়ন করার সামান্য সুযোগ দেন এই মানবকে।’

বলেই তিনি হেসে হাতের ইশারা করলেন বসার ঘরের দিকে। আমি কথা না বলে তাকে অনুসরণ করলাম। আমায় বসার ঘরের সোফায় বসতে বলে স্বচ্ছ বেরিয়ে গেল। হয়তো দোকানে গেছে চিনি আনতে। এতো বড় ফ্লাটে আমি আর কোনো জীবন্ত প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করতে পাররাম না। এ পরিবারের সদস্য সংখ্যা কি কেবল তিন জন?
মাথার উপরের ফ্যানটা বেশ শব্দ করে ঘুরছে। বেশ পুরোনো হলেও নতুন করে রং করা হয়েছে ফ্যানের গায়ে। কথায় আছে পুরোনো জিনিস খাটি হয় বেশ। ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরলেও বাতাস হয় দারুন। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে আশপাশে তাকালাম। ঘরের আসবাবপত্র গুলো সবই বেশ পুরাতন। সোফার পাশেই চার তাকের ছোট একটা সোকেজ। তাতে কেবল পুরোনো সময়ের ক্যাসেট সাজিয়ে রাখা। এ পরিবারের কেউ একজন রয়েছেন যিনি সংগতি প্রিয়। সোকেজের উপরেই রয়েছে ক্যাসেট প্লেয়ার। সোফার অন্যপাশে ছোট টেবিলে রয়েছে একটা ফুলদানি। তার পাশেই টেলিফোন। আজকাল খুব কম বাড়িতেই টেলিফোনের ব্যবস্থা রয়েছে। বুঝলাম এ যুগে এসেও স্বচ্ছদের জীবন ধারণা বেশ পুরতন ধাঁচের।

স্বচ্ছ ফিরে এলো মিনিট দশেক পর। আমাকে দেখেই মুচকি হেসে বললো,

‘অনেক অপেক্ষা করালাম নাকি? রাগ করবেন না অতিথি। দোকানপাট সব প্রায় বন্ধ এসময়ে। তাই দেরী হলো।’

দেখলাম স্বচ্ছ বেশ ঘেমে গেছে। মেরুন রঙের টি শার্টটার পিঠের দিকটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে। মুখেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। চোখ থেকে চশমা খুলে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো। এই প্রথম আমি তার চোখ জোড়া চশমা বিহীন দেখলাম। বাদামী রঙের চোখ জোড়া কি ভয়ংকর সুন্দর! স্বচ্ছ পুনরায় চশমা পড়তে নিলে আমি ব্যস্ত গলায় শুধালাম,

‘পড়বে না! এভাবেই থাকুন না! আপনার চোখ জোড়া সুন্দর।’

চশমা হীন চোখে স্বচ্ছ আমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। আমি বোধহয় বেহায়ার হলাম। লজ্জা ভুলে গিয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। স্বচ্ছ বেশ গম্ভীর গলায় বললো,

‘এভাবে চেয়ে থাকলে প্রেমে পড়ে যাবেন। আমার প্রেম ভয়কর। সেখান থেকে নিস্তার নেই। পরে বলবেন না যে আমি আপনায় সাবধান করিনি।’

কি হলো আমার কি জানি। তবে সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো আমি এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে কিছু অনুচিত ঘটনা ঘটবে। সেই অনুচিত ঘটতে যাওয়া ঘটনাকে থামাতে আমি ছুটে পালালাম। এক ছুটে তৃতীয় তলায় এসে রুমে ঢুকে দরজায় খিল আটলাম। আন্টি তখন রান্নাঘরে। আমার দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে রান্নাঘর থেকেই গলা উঁচিয়ে বললেন,

‘কি হলোরে? এত শব্দ করে দরজা লাগালে কেন?’

কার জবাব দিবে কে! আমি তখন আমার বুকে আচরে পড়া সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসছি। কখনো ডুবে যেয়ে নোনাজল খাচ্ছি। মনের ভেতর তৈরি হওয়া অনুভূতিকে বুঝতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম আমি প্রেমে পড়েছি। স্বচ্ছ নামক ঐ গা ছাড়া মানুষটার প্রেমে পড়েছি। আমার মস্তিষ্ক এই প্রেম মানতে চাইলো না। এমন নির্লিপ্ত মানবকে প্রেমিক রূপে সে মোটেও পছন্দ করছে না। কিন্তু মন কি মস্তিষ্কের কথা শোনে? সে তো চলে তার নিজস্ব তালে। নিজস্ব স্রোতে। আমার মন ও তাই করলো। মস্তিষ্ককে তুচ্ছ করে স্বচ্ছর প্রেমে ডুব দিলো। তবে আমার ভয় হলো। যদি কিনারা খুঁজে না পাই? তবে উপায়?

চলবে…..