প্রাণসখা পর্ব-১০

0
5

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

১০.
বিকেলের মৃদু আলোয় পুকুরের পানি বেশ শান্ত ও উজ্জ্বল লাগছে। বাঁধানো পাড় জুড়ে লুটিয়ে আছে বাদাম গাছের লালচে সবুজ পাতা। রোজ নিয়ম করে ঝাড় দেওয়ার পরেও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় শান্ত পুকুরের জলে এবং তার পাড়ে।

‘গতকাল মায়ের আচরণের জন্য দুঃখিত।’

স্বচ্ছর কথায় মৃদু হাসলাম। দৃষ্টি স্থির রেখে লঘু গলায় বললাম,

‘এটা বলতেই ডেকেছেন বুঝি?’

‘ঠিক তা নয়।’

‘তাহলে?’

‘স্নিগ্ধা আপনার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছিল। তাছাড়া আমি সত্যিই মায়ের আচরণের জন্য স্যরি ফিল করছিলাম। কথা বলে যদি সবটা ক্লিয়ার করা যেত…!’

আমি মাথা ঘুরিয়ে পাশে ফিরলাম। জড়োসড়ো হয়ে মেয়েটা স্বচ্ছর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। মেয়েটা নিশ্চিত কারো সাথে সহজ ভাবে মিশতে পারে না। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে হয়তো আমি নিজেই ওর হাত টেনে পাশে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিতাম। কিন্তু এখন সেসব কেবল দিবাস্বপ্ন। আমাদের মাঝে বিশাল এক পাহাড় তৈরি হয়েছে। যা পার হওয়া সম্ভব নয়।

‘আমার পরিচয় দেওয়ার নতুন কিছু নেই। আপনার মা গতকাল যা বলেছেন তা যথেষ্ট আমায় জানতে।’

আমার এমন কথায় স্বচ্ছ খানিক রাগলো বোধহয়। তার শীতল চোখগুলো কেমন কঠিন হয়ে উঠলো। গলার স্বর ও খানিক কঠিন হলো।

‘মায়ের আচরণের জন্য দুঃখিত আদ্রিতা। সব সময় সব কথা আঁকড়ে ধরে বসলে চলে না। কিছু সময় তা যেতে দিতে হয়। আশা করছি আপনি সেসব ভুলে যাবেন।’

আমার এত হাসি পেলো! আমায় এতটা অপমান করার পর বলছে সেসব ভুলে যেতে! এটাই কি সেই স্বচ্ছ? যার প্রতিটা কথায় আমি নতুন ভাবে আকৃষ্ট হতাম? এটাই কি সে যাকে আমি অন্য দশটা পুরুষের থেকে ভিন্ন ভাবে আবিষ্কার করেছিলাম? আমার আবিষ্কার করা সেই অতুলনীয় মানব পুরুষটির সাথে এই পুরুষটির কোনো মিল পেলাম না। একই দেহে যেন দুটো সত্তা খুঁজে পেলাম। যার একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অন্যজন মায়ের হাতের ছোট্ট পুতুল!

আমি বড় করে শ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালাম। মুচকি হেসে বললাম,

‘আমায় মনে রেখেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। গতকালের পর আপনার দেখা পাব ভাবিনি। এখন যাওয়া যাক? মা নাস্তা রেডি করেছে আপনাদের জন্য।’

কথা শেষ করে দু পা এগোতেই পেছন থেকে স্বচ্ছ বলে উঠলো,

‘পালিয়ে যাচ্ছেন?’

আমি হাসি মুখে জবাব দিলাম,

‘কোনো অন্যায় করিনি আমি। তাই পালানোর প্রশ্ন আসছে না। আমি আপনায় এড়িয়ে যেতে চাইছি।’

আমি এভাবে বলবো তা হয়তো স্বচ্ছ বুঝতে পারেনি। কাজেই কিছুটা হেনস্থ হলো বলে মনে হলো। আর যাই হোক ছোট বোনের সামনে কোন মেয়ে এভাবে বললে সম্মানে আঘাত আসবে স্বাভাবিক।
বসার ঘরে আসতেই দেখলাম স্বচ্ছর বাবা-মা দুজনেই সেখানে। আমার পিছু পিছু স্বচ্ছ এবং স্নিগ্ধাকে দেখে স্বচ্ছর মায়ের কপাল কুঁচকে এলো। বাবা আমায় বললেন,

‘কোথায় গিয়েছিলে?’

আমি স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলাম,

‘পুকুর পাড়ে।’

বাবা এবার স্বচ্ছর দিকে তাকিয়ে স্বচ্ছকে ইশারা করে বললেন,

‘তোমরা?’

‘ওখানেই ছিলাম। আদ্রিতার সাথে কথা বলছিলাম।’

আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম। স্বচ্ছকে দেখেও মনে হলো না সে খুব একটা চিন্তিত। তবে স্বচ্ছর মা চুপ থাকলেন না। তিনি চুপ থাকবেন এমনটা আমি আশাও করিনি অবশ্য।

‘কাল সব ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার পর আর কি কথা তোমাদের? যা হয়েগেছে তা গেছে। ফের এমনটা যেন না হয়।’

আমি ভেবেছিলাম স্বচ্ছ হয়তো বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বলবে,’ আচ্ছা! তুমি যা বলবে!’
কিন্তু সে আমায় আশ্চর্য করে দিয়ে বলে উঠলো,

‘আদ্রিতার সাথে আমি কথা বলতে চাই ক্লিয়ারলি। অনেক কিছু ক্লিয়ার করার আছে। আজ চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমায় সময় দেননি। কালকের ঘটনার পর তিনি কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন তাই আমি তাকে নিজেকে সামলে নেওয়ার সময় দিচ্ছি। নেক্সট টাইম এই সুযোগটা আমি তাকে দিব না।’

স্বচ্ছ বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বসার ঘরের প্রতিটা মানুষের চোখ কপালে। এদিকে আমি তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছি। স্বচ্ছ কথা গুলো কাকে বললো? সে কি আমায় হুমকি দিয়ে গেল? তাও এতগুলো মানুষের সামনে? তবে স্বচ্ছর মায়ের ফ্যাকাসে মুখ দেখে কেমন যেন শান্তি লাগলো। নিশ্চিত ছেলে হাত ফোসকে বেড়িয়ে গেছে ভেবে আফসোস করছে! করুক। তবে উনার হাত ফোসকে বেড়িয়ে যাওয়া এই ছেলেকে আমি বিয়ে করছি না।

_______________

ভোর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ শীতল। ফ্যান চালিয়ে গলা সমান ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে আছি। ভাবী দুবার এসে ডেকে গেছেন। এ বাড়ির এক নম্বর আসামি বাড়ি ফিরে এসেছেন সকাল সকাল। বসার ঘরে তাকে নিয়ে বিচার বসেছে। আমাকেও সেই বিচারে অংশ নিতে ডাকা হচ্ছে। আমি আপাতত সেই মুডে নেই।
আমি উঠলাম আরো ঘন্টা তিনেক ব্যাবধানে। নিচে নেমে দেখি ততক্ষনে সকলের নাস্তা করা শেষ। বাবা বাজারের পথে গিয়েছেন‌। মা চাচিরা দুপুরের রান্নার তোরজোর করছেন। ভাবী ভাইয়ার জন্য টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছেন। স্বচ্ছরা ফিরে গেছে দুদিন হলো। ফিরে যেয়ে আমার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করেনি স্বচ্ছ। আমিও সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবছি না। একদম যে ভুলে বসেছি তা বললে ভুল হবে। আমার প্রথম দেখা সেই নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন স্বচ্ছকে ভেবে প্রায়ই উদাস হই। কাউকে এতটা আপন ভেবে ভুলে যাওয়া বুঝি এত সহজ?

‘ভাইয়া নাস্তা করেনি?’

‘আর করতে পারলো কই? এ বাড়িতে উঠতে বসতে বৈঠক ডাকা হয়। ঘুম থেকে উঠেই বৈঠকে বসতে হয়েছে। এদিকে অফিস টাইম হয়ে এলো বলে। কোনো রকম গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে।’

আমি আপেলে কামড় বসিয়ে মাথা নাড়লাম। কথা সত্যি। পরক্ষণে কৌতুহল নিয়ে বললাম,

‘মামার শাস্তির কি হলো?’

‘কি আর হবে? এ মাস থেকে ব্যাবসায় ঢুকতে বলেছেন বাবা। এ বাড়িতে থাকতে হলে প্রতি মাসে তাকে কম করে হলেও চল্লিশ হাজার কামাতে হবে। এই শর্ত রেখে তাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে‌।’

‘বেশ! মামা কি বললো?’

‘কিছুই না। দেখ গিয়ে আবার পালানোর রাস্তা খুঁজছে হয়তো।’

চলবে…..