রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-১০

0
188

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

” মল্লিকা, আতিক কোথায়? আর পুলককেও তো দেখছিনা সকাল থেকে। ” কামরান মির্জা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী’কে।

” ভাইজান, আপনার ভাই সিটিকর্পোরেশনের কোন একটা কাজের উদ্বোধন করতে গেছে। আর পুলক গেছে শহরের বাহিরে। একটা রাস্তার কাজ পেয়েছে, সেটারই তদারকি করতে গেছে। ”

” বাহ্ আমার ভাতিজা দেখছি কাজের মানুষ হয়ে গেছে। লোকজন ওকে ভালোই সমীহ করে শুনলাম। আমাদের এসপি বললেন, সে ইদানীং বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। ”

” কিজানি, ভাইজান কি সব করে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। আমার এসব ভালো লাগেনা। এত নিষেধ করি রাজনীতি করোনা, তবুও সে শোনেনা। আমি চাইনা আমার একটামাত্র ছেলে রাজনীতিতে জড়াক।” মল্লিকা মির্জার গলায় হতাশা।

” আমাদের রক্তেই রাজনীতি, বউমা। আমার দাদা, বাবা রাজনীতি করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমরাও এসেছি। এরপর আমাদের ছেলেরা করবে। এতে কোন অসুবিধা দেখছিনা আমি। ”

” আমার ভয় হয়, ভাইজান। দিনদুনিয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। পুলকই আমার ঘরের বাতি। দিনরাত ওকে নিয়ে চিন্তায় থাকি আমি। বাড়ির চিন্তা নেই, শুধু সারাক্ষণ বাহিরে সময় কাটায়। ”

” তোমার মনে না চাইলে, ওকে রাজনীতিতে আসতে দিওনা। এক কাজ কর, খুব তারাতারি আমার হিরোর বিয়ের ব্যবস্থা কর। সংসারের জোয়াল কাঁধে পরলেই দেখবে ঘরমুখো হয়ে যাবে। এরপর ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিব। ”

” পুষ্পিতাতো এসে গেছে। এবার আমরা বউমাকে দেখতে যাব। প্রয়োজনে সেদিনই সব ঠিকঠাক করে আসব। আগামী পরশু যেতে চাচ্ছি। সেদিনতো আপনার কোন কাজ নেই, ভাইজান? আর কাজ থাকলেও দু’ঘন্টার জন্য হলেও সময় বের করবেন। আমি আপনাকে রেখে বউমাকে দেখতে যেতে চাইনা। যেহেতু ভাবী দেশে নেই, সেহেতু আপনাকেই যেতে হবে। ”

” কখন যেতে চাচ্ছ? ”

” আপনি কখন সময় দিতে পারবেন? আপনার সময়ের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। ”

” বিকেলের দিকে কিছু সময় ফ্রি থাকব। ”

” তাহলে বিকেলেই যাব। আপনি সব কাজ সেড়ে বিকেলের আগেই বাসায় ফিরে আসবেন। ”

” আসসালামু আলাইকুম, বড় মামা। কেমন আছো? মামী তুমি ভালো আছো? ” কামরান মির্জার কথা শেষ হতেই বাসায় ঢুকল শাহেদ। সে সালাম দিল তার বড় মামাকে।

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আরে ভাগ্নে যে? কেমন আছো, ভাগ্নে? আজকাল মামার বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছ নাকি? ” কামরান মির্জা তার ভাগ্নের কাঁধে হাত রাখলেন।

” কি যে বলো, মামা। এই বাড়ির রাস্তা ভোলাও আমার পক্ষে সম্ভব! আমিতো সপ্তাহে তিনদিন এখানে আসি। তাইনা ছোট মামী? ” মল্লিকা মির্জার সমর্থনের আশায় তার দিকে তাকায় শাহেদ।

” তা আসিস। কিন্তু আমি চাই তুই এখানেই থাক। এতবড় বাড়ি ফাঁকা পরে থাকে। তুই থাকলে বরং আমার ভালোই হবে। ”

” আমি এখানে থাকলে দাদু কান্নাকাটি করবে, ছোট মামী। তার নাকি আমাকে না দেখলে ঘুম আসেনা। মামী, ভাই কি বেরিয়ে গেছে? সকালে আমাকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তাই মিস করে গেছি। ”

” হুম, অনেক আগেই বেড়িয়েছে। আচ্ছা শোন, আগামী পরশু তোর ভাইয়ের জন্য বউ দেখতে যাব। তুইও কিন্তু যাবি আমাদের সাথে। ”

” বউ দেখতে যাবে! কোথায়? ভাই জানে? ” শাহেদ অবাক হয়ে জানতে চায়।

” জানবেনা কেন! সে-ই তো আমাকে তার পছন্দের কথা জানিয়েছে। ঐ মেয়ে ছাড়া নাকি কাউকেই বিয়ে করবেনা। আমিও ভাবলাম, ছেলে যখন পছন্দ করেছে, এবার তাহলে বিয়ে করিয়েই দিই। ”

” মেয়ে কি ফুলপুর গ্রামে দেখতে যাবে? ” ইতিউতি করে জিজ্ঞেস করল শাহেদ।

” বাব্বাহ্, তুইও জানিস দেখছি! হ্যাঁ রে শাহেদ, তুই কি দেখেছিস আমার বউমাকে? ”

” হুম, প্রতিদিনই দেখি। ” শাহেদ হাসছে।

” কেমন রে আমার বউমা? ” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন মল্লিকা মির্জা।

” সেটা গিয়েই দেখ। মামী, তোমার কাছে একটা আর্জি ছিল। মানে তোমাদের দু’জনের কাছেই। ” মাথা চুলকে ইতস্ততভাবে বলল শাহেদ।

” বল। এত সংকোচ করছিস কেন? ” মল্লিকা মির্জা সবিস্ময়ে বললেন।

কামরান মির্জাও তাকিয়ে আছেন ভাগ্নের দিকে।

***

” ভাবী, এই যে আপনাদের সফ্ট ড্রিংকস আর পানি। সেই সাথে পিজ্জা আর আইসক্রিমও আছে। ” আশফি ক্লাস শেষে রুমেই বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। তখনই সাকিব নামের পুলকের গ্যাংয়ের একজন মেম্বার এসে ওর সামনে দুইটা প্যাকেট রেখে বলল।

” আমাদের এসব প্রয়োজন নেই। আপনি নিয়ে যান। আমি আপনার ভাইকে বলবনা আর আপনিও বলবেননা তাহলেই হবে। ” আশফি কাতর স্বরে বলল।

” এসব ফিরিয়ে নিয়ে গেলে ভাই আমাকে আস্ত রাখবেনা। ভাইয়ের মাথার চারপাশে চোখ আছে। না বললেও সে সব জানতে পারবে। আর একটা কথা ভাবী, সপ্তাহে দুইটা আইসক্রিমের পারমিশন আছে আপনার। ভাই আজকে একটা পাঠিয়েছে আবার তিনদিন পর একটা পাঠাবে। আপনার নাকি ঠান্ডার ধাত আছে? ”

সাকিবের কথায় আশফি চমকে উঠল। ও অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সাকিবের দিকে। সেই সাথে বাকিরাও বিস্মিত।

” আপনার ভাই কি আধ্যাতিক লেবেলের পাব্লিক নাকি! সে কি পীর দরবেশ পর্যায়ের লোক? অজানা কথা সে কিভাবে জানতে পারল? ” আশফির গলায় বিস্ময় চাপা থাকলনা।

” এগুলো নিন, ভাবী। আপনি নিতে দেরি করলে এর কৈফিয়তও ভাইকে দিতে হবে। ”

” মানে কি! সে কি গায়েবি ভাবে সব জানতে পারবে? আশেপাশে তো আপনার ভাইয়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছিনা। ” আশফি চারপাশে তাকিয়ে বলল।

” এদিকে নয়, ভাবী, ঐদিকে দেখুন। ” সাকিব রুমের জানালার দিকে ঈঙ্গিত করল।

জানালার দিকে তাকিয়েই আশফির মাথা ঘুরে উঠল। এই বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে। রাস্তার ওপাশে চারতলা ভবনের দোতলায় ইলেকট্রনিকস শো-রুম। সেই শোরুমের বিশাল খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুলক মির্জা। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশফির দিকে। হাতে থাকা সফ্ট ড্রিংসের বোতলে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।

” আপনার ভাই কি ঐ শো-রুমে চাকরি নিয়েছে? ” দাঁতে দাঁত পিষছে আশফি।

” ঐটা ভাইয়েরই শো-রুম। এবারতো এগুলো নিন, ভাবী। ” সাকিব আবারও প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিল আশফির দিকে।

আশফি উপায় না দেখে প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ায়। সেই সাথে মনে মনে হাজারটা গালি দিতে থাকে পুলককে।

***

শুক্রবার হওয়ায় আজ অনেকটা আরামেই কাটছে আশফির দিন। দুপুরেই রান্নাবান্না শেষ করে তিয়াসার সাথে বই নিয়ে বসেছে। ওদের পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। অথচ এখনও ওদের সিলেবাস কমপ্লিট হয়নি। ওরা রিফাতের রুমে বসে পড়ছে। রিফাত না থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় ওরা এই রুমেই কাটায়। দক্ষিনের জানালা দিয়ে রাস্তার পুরোটাই দেখা যায়। আবার এই বাড়িতে যে কেউ আসলেও ওরা জানালা দিয়ে দেখতে পায়। তাই পড়ার ঘর হিসেবে এই রুমটাকেই বেছে নিয়েছে।

গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেতেই ওরা দু’জন জানালার বাহিরে তাকায়। পরপর চারটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় ওদের বাহিরের উঠানে। ওরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ওরা আরও চমকালো যখন দেখল ওদের এলাকার এমপি কামরান মির্জাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখল। এর আগে ওরা কামরান মির্জার ছবি দেখেছে, তাই ওরা তাকে চিনতে পেরেছে। ওদের বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিয়ে আরেক গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসল মেয়র আতিক মির্জাসহ আরও দু’জন। একজন মধ্যবয়সী নারী, আরেকজন আঠারো থেকে বিশ বছরের মেয়ে। আশফি আতিক মির্জাকে দেখে ঘামতে থাকে। ওদের বাড়িতে মেয়রের আগমন ওর কাছে মোটেও কাকতালীয় মনে হচ্ছেনা। ওড়নার এক কোনায় কপালের ঘাম মুছে অসহায় চোখে তাকায় তিয়াসার দিকে। ওর ভয় হচ্ছে পুলক মির্জার ব্যাপারে আম্মা জানতে পারলে কি হবে?

আফজাল হোসেন বাড়িতে আগত মেহমানদের দেখে অবাক হয়ে গেছেন। তিনি সাথে সাথে তার বড় ভাই তোফাজ্জল হোসেনকে ডাকলেন।

” আরে তোফাজ্জল, তুমি? এটা তোমার বাড়ি? তাহলে আমরা তোমাদের সাথে আত্নীয়তা করতে চলেছি! ” কামরান মির্জা সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন।

তোফাজ্জল হোসেনও কামরান মির্জার মত অবাক হয়েছেন। তিনি ভাবতেই পারেননি তাদের এলাকার এমপি, মেয়র তাদেরই বাড়িতে এসেছে।

” স্যার, আপনাকে দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছি! কেমন আছেন আপনি? মেয়র স্যার ,আপনি কেমন আছেন? ” জানতে চাইলেন তোফাজ্জল হোসেন।

” আমরা ভালো আছি। কিন্তু তুমিতো দেখছি আমাদের মনে রাখনি। একবারের জন্যও যাওনা আমাদের বাড়িতে। ” কামরান মির্জা পুরো বাড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন।

” আপনারা ব্যস্ত মানুষ, তাই আপনাদের বিরক্ত করতে চাইনা। সেজন্যই যাওয়া হয়না। ”

” কিন্তু এবার থেকে তো নিয়মিত যেতে হবে। ”
কামরান মির্জার কথা তোফাজ্জল হোসেন আর আফজাল হোসেন বুঝতে পারলেননা। তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন এমপির দিকে।

কামরান মির্জা আর আতিক মির্জা এদের দুই ভাইকে দেখে মজা পাচ্ছেন। তারা এই দুই ভাইকে আর চিন্তার মধ্যে রাখতে চাইলেননা। তারা আফজাল হোসেনের মেয়েকে পুলক মির্জার জন্য চাইলেন।

আফজাল হোসেন সব শুনে নিরুত্তর থাকলেন। তার মেয়ের বিয়ের ব্যপারে কথা বলবেন কিন্তু তার ছেলে থাকবেনা এটা তিনি মানতে পারছেননা। কিন্তু তিনি এমপি আর মেয়রকেও অপমান করতে চাইলেননা।

” সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমার বড় ছেলে এই মুহূর্তে চিটাগং আছে। তাকে রেখে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিভাবে সিদ্ধান্ত নেই, স্যার? ”

” আপনি আপনার ছেলের সাথে কথা বলুন। আমরা বড় আশা নিয়ে এসেছি। আশফিকে আমার ছেলের জন্য নিতে চাই। ওকে ছাড়া আমার ছেলে বাঁচবেনা। প্লিজ আপনি না করবেননা, ভাই। আমাদের পরিবার সম্পর্কে আপনারা কেউই অজানা নন। ” মল্লিকা মির্জা অনুনয় করলেন।

” আপনি একবার আমাদের বউমাকে এখানে আসতে বলবেন? দেখি আমার ছেলের দিওয়ানা হওয়ার কারনকে। ” আতিক মির্জা আশফিকে দেখতে চাইলেন।

তাদের অনুরোধ ফেলতে পারলেননা আফজাল হোসেন। তিনি আশফিকে ডেকে পাঠালেন।

আশফিকে দেখা মাত্রই মল্লিকা মির্জা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। চুমু দিলেন আশফির কপালে।

” মাশা-আল্লাহ, আমার ছেলে দেখছি মায়াবতী পছন্দ করেছে! এজন্যই বলি আমার কাঠখোট্টা ছেলেটা বিয়ের জন্য এত উতলা হলো কেন! যাকে গত তিন বছর যাবৎ বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারিনি, সে হঠাৎ করেই বিয়ের জন্য আমার মাথা খাচ্ছে! শোন মা, তোমাকে আমার বাড়ির রানী করতে চায় আমার ছেলে। আমিও চাই তুমি সেখানে রানী হয়েই থাক। তোমার বাবা রাজি হচ্ছেনা, তুমি রাজি হলেই তিনি আর না করতে পারবেননা। এই মা’য়ের একটা কথা রাখ, মা। ”

আশফি ভদ্র মহিলার কথা শুনে যারপরনাই অবাক। মা’য়ের মৃ’ত্যু’র পর বড়মা আর চাচী ছাড়া কেউই ওকে এত আদর করে কথা বলেনি। একজন অপরিচিত মহিলা ওর সাথে এত মমতা নিয়ে কথা বলছে, এটা ওর কাছে আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু ও বাবা-র মতামতের বাহিরে কিছুই করতে পারবেনা। আবার যেখানে ওর ভাইয়া নেই, সেখানে এই বিষয়ে কথা বলার কোন প্রশ্নই আসেনা।

সবার অনুরোধে আফজাল হোসেন ফোন করলেন রিফাতকে। সব শুনে রিফাত কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল। ও সিদ্ধান্ত দেবে ভেবে পাচ্ছেনা। যেখানে একদিকে আশফির ভবিষ্যৎ ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ও চায় লেখাপড়া শিখে আশফি ক্যারিয়ার গড়ুক। সেখানে এমপির পরিবার থেকে ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাও স্বয়ং এমপি আর মেয়র এসেছেন প্রস্তাব নিয়ে। এখন তাদের ফিরিয়ে দেয়া মানে তাদেরকে অপমান করার সামিল। এদিকে রিফাত পুলক মির্জার সম্পর্কে ভালো করেই জানে। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই স্কলারশীপ নিয়ে সুইজারল্যান্ড যায়, কিন্তু সেখাসে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসে। এরপর আর পড়াশোনা করেনি। জড়িয়ে পরে রাজনীতিতে। এমন ছেলের সাথে ছোট বোনের বিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছেনা। কিন্তু তারা প্রভাবশালী পরিবার। রাজনীতিতে কামরান মির্জার যথেষ্ট প্রভাব আছে। তাদের ফিরিয়ে দিলে আশফির জন্য ভালো কিছু হবেনা। সবদিকে চিন্তা করে রিফাত পুলক মির্জার বাবা-মা’র সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। আফজাল হোসেন মল্লিকা মির্জাকে সে কথা জানালে তিনি হাসিমুখে কথা বলতে রাজি হয়ে গেলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী এবং কামরান মির্জাও কথা বললেন রিফাতের সাথে। এরপর রিফাত তাদের কাছ থেকে পুলক মির্জার নম্বর নিয়ে ফোন দিল তার কাছে।

পুলক ফুলতলার পাশের গ্রামের বাজারে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। ফোনের শব্দে ওদের আড্ডায় ছেদ পরল। অপরিচিত নম্বর দেখে কয়েক মুহূর্ত পর ফোর রিসিভ করল।

” হ্যালো, কে বলছেন? ”

” আমি রিফাত, আশফির ভাইয়া। ”

” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। কেমন আছেন? ” হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলল পুলক।

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। ভালো আছি আমি। আমি শুনলাম তোমার পরিবারের সবাই আমাদের বাড়িতে গেছে। আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। তুমি কি সত্যিই আশফিকে পছন্দ কর? নাকি শুধুই আবেগ? ”

” আবেগ হলে সেটাকে বিয়ের পর্যায়ে নেয়ার মক মানুষ আমি নই। আমি সত্যিই আপনার বোনকে ভালোবাসি। এখানে আবেগের ছিঁটেফোঁটাও নেই। ” কাটকাট গলায় বলল পুলক।

” দেখ পুলক, আমার বোনের বেড়ে উঠা আর পাঁচটা মেয়ের মত হয়নি। সৎ মায়ের সংসারে অবহেলা বৈ অন্য কিছুই জোটেনি ওর কপালে। তাই আমি চাইনা আমাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমার বোনটা আজীবন কষ্ট পাক। আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। যদি আমি তোমার কাছে আমার বোনকে দিতে রাজি না হই, তবে কি তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিবে? কিংবা আমার বোনকে হ্যারাজ করবে? ”

” দেখুন ভাইয়া, আমি ভালোবেসেছি শুধু। সেটা অবশ্য একতরফা। সেটা যতই একতরফা হোকনা কেন ভালোবাসার মানে আমি জানি। যদি আপনার সিদ্ধান্ত নেগেটিভ হয়, তারপরও আমি আপনার বোনের জন্য আজীবন অপেক্ষা করব। কিন্তু তাকে না পাওয়ার বেদনায় তাকে কিংবা তার পরিবারকে অসম্মানিত করার ছেলে আমি নই। হ্যাঁ কষ্ট হবে এটা ঠিক। কিন্তু সেই কষ্টকে জয় করে তার ভালোর জন্য দূরে সরে যাব। ”

” আমার বোন একটু বোকা এটা জানো? ”

” একটু না অনেকটুকুই বোকা। তাকে সামলানো চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ জয় করার সমান। ”

” ও লেখাপড়ায় খুব খারাপ নয়। পড়াশোনা করে জীবনে কিছু করতে চায় ও। ”

” ওর স্বপ্ন পূরণের সারথি হব আমি। ও চাইলে মরুভূমির বুকে পানির ফোয়ারা বইয়ে দেব। যদি চাঁদকে হাতের মুঠোয় আনা যেত, তবে সেটা পৃথিবীর বুকে আপনার বোনের হাতেই থাকত। ”

” তোমার পরিবারে আমার বোন হয়তো অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তোমাদের নিয়মকানুন ও জানেনা, হয়তো ভুল করবে। তখন কি হবে? ”

” স্বামী হিসেবে আমার স্ত্রী’র ভুল শোধরানোর দ্বায়িত্ব আমার। তবে স্ত্রী’কে পরিবারের নিয়মকানুনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে দেয়ার মত কাপুরষ আমি নই। সকল বিপদআপদ আর ঝড়ঝাপটা থেকে ওকে রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আমার। সেই সাথে সকল নিয়মকানুন শেখানোর দ্বায়িত্বও। ”

পুলক মির্জার কথা শুনে মুচকি হাসল রিফাত। ওর উত্তর পেয়ে গেছে।

মল্লিকা মির্জা খুশিতে কেঁদে উঠলেন। অবশেষে তার ছেলে পছন্দের নারীকে পাচ্ছে। তিনি আঁচলের কোনায় চোখ মুছলেন।

” যাক একটা প্রস্তাব অবশেষে আপনাদের সংসদে পাশ হলো। এবার আসি দ্বিতীয় প্রস্তাবে। তোফাজ্জল তুমিতো আমার বোন শাহানাকে চিনতে? ও মা’রা গেছে পাঁচ বছর আগে। ইনফ্যাক্ট শাহানা আর ওর হাজবেন্ড রায়হান দুজনেই একটা এক্সিডেন্টে মা’রা যায়। ওদের একটা ছেলে আছে। শাহেদ ওর নাম। ও এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। আপাতত এখানেই আছে। চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে ছেলেটা। শাহেদ তোমার মেয়ে তিয়াসাকে পছন্দ করে। ওকে বিয়ে করতে চায়। ” কামরান মির্জার কথা শুনে আশফি বড় চোখ করে তিয়াসার দিকে তাকায়। ওরা মল্লিকা মির্জার দু’পাশে বসে আছে।

এতক্ষন বাড়িতে যে খুশির আমেজ বইছিল, কামরান মির্জার কথায় সেটা নিমেষেই উবে যায়। তোফাজ্জল হোসেনের মুখ চুপসে গেছে। তিয়াসার মাথা ঘুরে উঠল। ওর বুক দুরুদুরু করছে। হাঁসফাঁস করতে থাকে চিন্তায়। এই মুহুর্তে রিফাতকে ফোন দিতে হবে।

চলবে…