রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-১২

0
188

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাবী, আজ থেকে এটাই তোমার আপন ঠিকানা। আজ থেকে এই রাজ্যের তুমিই রানী। ” পুষ্পিতা আশফিকে পুলকের রুমে নিয়ে আসল।

পুষ্পিতার কথা শুনে আশফি ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটার কথার কি জবাব দেবে, অনেক হাতড়েও সেই জবাব খুঁজে পায়না। তবে মেয়েটার সম্পর্কে না জানলেও এটা বুঝতে পারছে ও এই বাড়িরই মেয়ে। আশফিকে নির্বাক থাকতে দেখে হাসল পুষ্পিতা।

” আমি তোমাকে নিজের পরিচয়ই দেইনি। কি বোকা আমি! বহুরানী, আমি তোমার একমাত্র ননদী। আজ থেকে আমার অত্যাচার, ঝামেলা এবং ভালোবাসা তোমাকে সহ্য করতে হবে। কি তুমি রাজি তো? ”

আশফি মাথা নাড়াল। এরপর কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,

” তুমি কিসে পড়? ”

” এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ম্যাথ এ। তবে থাকি কিন্তু বাসায়ই। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। আবার বাসায় ফিরি সন্ধ্যায়। সারাদিন আমার কোন ঝামেলা তোমার সইতে হবেনা। সন্ধ্যার পর থেকে ইচ্ছেমত জ্বালাব তোমাকে। ”

পুষ্পিতার সাথে কথা বললেও আশফির মন পরে আছে তিয়াসার কাছে। বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করেছিল। সারাটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। ওর সাথে কথা বলার সুযোগও পায়নি আশফি। তিয়াসা এখনও কি কাঁদছে? চিন্তায় আশফি স্থির থাকতে পারছেনা।

” আচ্ছা তিয়াসা কি ঐ বাড়িতে একা থাকবে? আজও কি সেখানে কেউ নেই? ”

পুষ্পিতা আশফির দিকে তাকায়। ওর চোখে চিন্তার ছায়া দেখতে পায়।

” বলতে গেলে একাই আছে। বাসায় শুধু শাহেদ ভাইয়ার দাদু থাকে। ভাইয়ার দুইটা চাচা তাদের পরিবার নিয়ে কানাডা সেটেল। ভাইয়ার একটা ফুপু। তিনিও পরিবারের সাথে অস্ট্রেলিয়া থাকেন। আম্মু চেয়েছিল শাহেদ ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে আমাদের বাসায় উঠুক। কিন্তু ভাইয়া রাজি হয়নি। তাইতো আম্মু তোমাকে এভাবে রেখেই ঐ বাসায় গেছে। ”

পুস্পিতার কথা শুনে আশফির চিন্তা বাড়ল বৈ কমলনা। ও ভালো করেই জানে, তিয়াসা একা একা থাকতে পারেনা। ওর আশেপাশে মানুষ না থাকলে ও হাঁপিয়ে যায়। মেয়েটা একা থাকবে কিভাবে? ওর তিয়াসার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু সংকোচের কারনে পুষ্পিতাকে সেকথা বলতে পারলনা। ওর নিজের ফোনও বাড়িতে রেখে এসেছে। বিয়ের টেনশনে ফোনের কথা মাথায়ই ছিলনা।

***

মল্লিকা মির্জা তিয়াসাকে নিয়ে শাহেদ রুমে এসেছেন। তিনি টুকটাক কথা বলছেন তিয়াসার সাথে। কিন্তু তিয়াসার সেদিকে মন নেই। ও রিফাতের কথা চিন্তা করছে। কি থেকে কি হয়ে গেল! ও কি কখনো রিফাতের জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দেয়ার কথা ভেবেছিল? ওদের সম্পর্কে ওরা দু’জনেই লয়াল ছিল। তবুও কেন একটা ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল! রিফাত হারানোর ব্যথা সইবে কেমন করে? নিজেকে কিভাবে প্রবোধ দিবে সে?

” বউমা, অবশেষে আমার বাড়িতে নাতবউ আসল! শাহেদকে যখনই বিয়ের কথা বলতাম, ও পিছটান দিত। আমিতো ধরেই নিয়েছিলাম আমার মৃ’ত্যু’র আগে ও বিয়ে করবেনা। ” একজন মধ্যবয়সী নারীর হাতের মাঝে বন্দী হয়ে রুমে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ। তিনি ঠিকঠাক হাঁটতে পারছেননা। তার হাতের লাঠিটা কাঁপছে। তিনিই মল্লিকা মির্জাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন।

মল্লিকা মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধের দিকে। তার হাত ধরে নিয়ে তিয়াসার কাছে বসালেন।

” তিয়াসা, ইনি তোমার দাদাশ্বশুর। ইনি শুধুমাত্র শাহেদের জন্যই দেশে আছেন। শাহানা আর জহিরের মৃ’ত্যু’র পর শাহেদের চাচা-ফুপু ইনাকে তাদের কাছে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইনি যাননি। তুমি আব্বাকে দেখে রেখ, মা। আব্বা আজকাল হাঁটতে পারেননা। স্মৃতিশক্তিও আগের মত নেই।”

বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তিয়াসার। মুহুর্তেই নিজের দাদুর মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। ওর দাদুও লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটত। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারেননি। অনেক কিছুই ভুলে যেতেন। দাদু কত ভালোবাসত ওদের। আশফি আর তিয়াসা ছিল দাদুর প্রান। এই অসময়ে দাদুর কথা মনে হতেই তিয়াসার চোখ ভিজে উঠল। মনে হচ্ছে দাদুই এসে বসেছে ওর পাশে।

” নাতবউ, তোমার নাম কি? ”

” তিয়াসা হোসেন। ”

” খুব সুন্দর নাম। খাদিজা, বাক্সটা আমার কাছে দাও দেখি। ” সেই মধ্যবয়সী মহিলার কাছ থেকে কিছু চাইলেন বৃদ্ধ।

তিয়াসা খেয়াল করল সেই মহিলা আবারও রুমে ঢুকছে। সে দাদুকে রুমে পৌঁছে দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। এবার সে কারুকার্য খচিত একটা বাক্স দাদুর হাতে দেয়।

” বউমা, এটা খুলে গহনাগুলো আমার নাতবউকে পরিয়ে দাওতো। দেখি আমার গিন্নির গহনায় নাতবউকে কেমন মানায়। ” দাদু মল্লিকা মির্জাকে বললেন।

মল্লিকা মির্জা খুশি হয়ে বাক্স খুললেন। বাক্সের ভেতরে চোখ যেতেই তিয়াসার মুখ হা হয়ে যায়। এত গহনা একসাথে ও কখনোই দেখেনি। মল্লিকা মির্জা মিটিমিটি হাসছেন। তিনি বেছে বেছে কয়েকটা গহনা বের করে তিয়াসাকে পরিয়ে দিতে শুরু করলেন।

” তিয়াসা, তোমার দাদি শ্বাশুড়ির কিন্তু অনেক গহনা ছিল। এখানে যা দেখছ সেগুলো দুই ছেলে আর এক মেয়েকে দেয়ার পর অবশিষ্টগুলো আছে। অবশ্য এরকম আরেকটা গহনা ভর্তি বাক্স আমার কাছে আছে। যেগুলো আম্মা শাহানার মৃ’ত্যু’র পর আমার কাছে রাখতে দিয়েছিল শাহেদের বউয়ের জন্য। ওগুলো কালকে আমি এসে তোমাকে দিয়ে যাব। ”

এদের কথা তিয়াসা যতই শুনছে ততই অবাক হচ্ছে।

***

রাত সাড়ে বারোটা। পুষ্পিতা যাবার পর থেকে আশফি একাই বসে আছে। মল্লিকা মির্জা সাড়ে এগারোটার পরে এসে ওকে মুখে তুলে খাইয়ে গেছেন। তিনি তিয়াসাকেও খাইয়ে এসেছেন। তিনি রুম থেকে যাবার সময় বলে গেছেন পুলকের জন্য অপেক্ষা করতে। তার কথামতই আশফি পুলকের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে ওর ভাষ্যমতে, ও বুড়ো শেয়ালের জন্য অপেক্ষা করছে।

অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে আশফি পুরো রুমে চোখ বুলায়। অনেক বড় একটা রুম। পুরো রুম সাদা। ফার্নিচারগুলোও সাদা। বড় বড় জানানায়ও সাদা পর্দা ঝুলছে। এমনকি রুমে একটা ডিভান আছে, সেটাও সাদা। শুধু দেয়ালে কয়েকটা ছবি আর ড্রেসিংটেবিলের ওপর পারফিউমের কয়েকটা বোতল না থাকলে, আশফি এটাকে রুম না বলে সাদার গোডাউন নাম দিত।

আশফি ঝিমাচ্ছে। ও প্রতিদিন বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু এখন রাত একটা বাজতে চলল, অথচ ও ঘুমাতে পারছেনা। দুঃখে ও ইচ্ছেমত কয়েকটা গালি দিল পুলক মির্জাকে।
গালব দিতে দিতেই খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরল।

রুমে এসে আশফিকে ঘুমাতে দেখে কাপাল কোঁচকায় পুলক। বাসর রাতে জামাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ না করেই যে কোন বউ ঘুমায় এটা ওর জানা ছিলনা। ও একটু আওয়াজ করেই দরজা বন্ধ করল। তবুও আশফির ঘুম ভাঙ্গলোনা।

আশফির মনে হচ্ছে কেউ বহুদূর থেকে ওকে ডাকছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকায় মেয়েটা। ঢুলুঢুলু চোখে দেখল পুলক মির্জা বসে আছে।

” এই বদলোক এখানে কেন? আশ্চর্য আমাকে কি শান্তিতে ঘুমাতেও দিবেনা! দিনের বেলা আমাকে বিরক্ত করে তার শান্তি হয়না, এখন এসেছে ঘুমের ভেতর বিরক্ত করতে! ” ঘুম জড়ানো গলায় বলল আশফি।

পুলক আশফির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তবে আশফি শোয়ার উপক্রম হতেই ওকে ধরে ফেলল। এতে আশফি ভিষণ বিরক্ত হয়।

” ঐ ছ্যাঁড়, তুই কি আমাকে ঘুমাতেও দিবিনা ? তোর জ্বালায় আমার দিনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আবার রাতের ঘুমটাও হারাম করতে চাস? দিনে তোকে গালি দিতে না পারলে কি হবে, রাতে তোকে ঠিকই গালি দেব। আর তুই শুনতেও পাবিনা। অবশ্য প্রতিরাতেই তোকে আমি ইচ্ছেমত গালি দিই। কিন্তু তুই জানতেও পারিসনা। ”

এবার পুলক রেগে যায়। এই মেয়েটা ওকে প্রতিনিয়ত গালি দেয়, এটা ওর হজম হচ্ছেনা। ও আশফির কাঁধে হাত রেখে জোরে ঝাঁকিয়ে দিল।

” ম্যাম, এটা আপনি স্বপ্ন দেখছেননা। আপনি আজ আমার রুমে আছেন। আর আপনি কথাগুলো আমাকেই বলছেন। একবার চোখ খুলে এই অধমের দিকে তাকান। আপনার সব ভুল ভেঙে যাবে। ”

পুলকের ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম ছুটে যায় আশফির। ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল পুলকের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে এই লোক ওর সামনে কেন। কয়েক মুহুর্ত পরই ওর সব মনে পরে যায়। ও আজ সন্ধ্যার পরই এই বাসায় এসেছে। তারমানে ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলনা! দুঃখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে আশফির। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু হতাশ হয়ে মাথা নিচু করল। মনে মনে ভাবল, প্রতিবারই সব সমস্যা থেকে তিয়াসা ওকে উদ্ধার করত। কিন্তু আজ তিয়াসাও নেই। কি করবে এখন ও? কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল আশফি। এরপর মুখ তুলে তাকায়।

” আ..আমার ঘুম পেয়েছে। প্রতিদিন বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই। এখনতো অনেক রাত হয়েছে। তাই কিছুতেই জেগে থাকতে পারবনা। এখন জেগে থাকলে ফজরের ওয়াক্তে উঠতে পারবনা। আমার চোখের পাতায় ঘুমেরা রাজপ্রাসাদ গড়েছে। তাই চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে গেছে। আমি ঘুমালাম। ” এক নিঃস্বাসে কথাগুলো বলে পুলকের উত্তরের আশায় না থেকে ধপ করে শুয়ে পরল আশফি।

পুলক বেকুবের মত তাকিয়ে থাকল আশফির দিকে। আজ রাতে ওর সাথে এমন কিছু ঘটবে সেটা ওর কল্পনায়ও ছিলনা। হতবাক পুলক উঁকি দেয় আশফির দিকে। ও চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা সেটা বুঝতে পারলনা।
রাগে-দুঃখে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিল।

” পুলক মির্জা, তোর বউ যদি ভবিষ্যতেও এমন ঘুম কাতুরে থাকে, তবে ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে পারবিনা আজীবন। অথচ তোর কত স্বপ্ন, এক ডজন ছেলেমেয়ে তোকে বাবা ডাকবে। এভাবে চলতে থাকলে তোকে সিঙ্গেল জামাই হয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। সেইম অন ইউ, ছোট মির্জা। বাসর রাতে বিড়াল মা’র’তে পারলিনা তুই। তোর বোকা বউই তোকে বিড়াল বানিয়ে মে’রে দিল! ” বিরবির করতে করতে আশফির পাশে শুয়ে পরল পুলক।

***

শাহেদ রুমে এসে দেখল তিয়াসা বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল একটা বিশ বাজে। শাহেদ তিয়াসার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় মেয়েটা আপসেট। তাই এই মুহুর্তে ওকে বিরক্ত করতে চাইলনা শাহেদ। ও তিয়াসার একপাশে শুয়ে পরল।

সারা রাস্তা তিয়াসা কেঁদেছে। কেউ ওর কান্না থামাতে পারেনি। এই বিষয়টায় খটকা লাগছে শাহেদের। একইদিনে আশফিরও বিয়ে হয়েছে। সে-ও কেঁদেছে, কষ্ট পেয়েছে । কিন্তু তিয়াসা যেন একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছে। ওর চোখমুখ জুড়ে বিষন্নতা বিরাজ করছিল। পুরোটা সময় ওকে নিস্প্রভ থাকতে দেখেছে শাহেদ। তবে কি ও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে! হুট করে মামা-মামীকে বিয়ের কথা বলা ভুল ছিল ওর?

চিন্তায় শোয়া থেকে উঠে বসল শাহেদ। আরও একবার তাকাল তিয়াসার দিকে। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে দেখে ডাকতে ইচ্ছে করলনা। কিন্তু ওর মনের ভেতর প্রশ্নেরা জমাট বাঁধছে ক্রমশই।

তিয়াসা জোর করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এই মুহুর্তে শাহেদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা মোটেও। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটা শান্তির ঘুম দরকার। কিন্তু ও জানে, ওর জীবন থেকে শান্তির ঘুম উবে গেছে। আর কখনোই চোখের পাতায় শান্তির ঘুম নামবেনা। সেখানে বিন্দু বিন্দু অশ্রুরা জমেছে বর্ষনের জন্য। আর এ বর্ষন আজন্মকাল ধরে চলতেই থাকবে।

চলবে…