#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী জামী
গোধুলির আলো-আঁধারের আবছায়ার মাঝে দু’জন নর-নারী জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। পুরুষটি সূদুরে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে। তার পাশে বসা তরুণী একটু পরপরই তার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। তরুনী এই মুহুর্তে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। পুরুষটির চোখে সরাসরি তাকানোর ক্ষমতা সে হারিয়েছে। বারবার তার মন বলছে, মানুষটা তাকে বেহায়া ভাবছে নাতো?
এই মুহূর্তে পতেঙ্গা সৈকতে বসে আছে রিফাত, নিলাশা। এদিকে আজকে লোকজন কম। গত দুইদিন থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। নিলাশা গতকালই চিটাগং এসেছে। রিফাত ওর সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চেয়েছে। ওর খালামনি চেয়েছিলেন ওরা কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করুক। কিন্তু রিফাত সেটা চায়নি। রিফাতই দেখা করার জন্য এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছে। তাই বৃষ্টি ছাড়তেই ওরা দু’জনেই বেরিয়ে পরেছিল। এখন আকাশ একটু পরিষ্কার। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
রিফাত তাকিয়ে আছে বিশাল সমুদ্রের দিকে। ওরা এখানে এসেছে পনের মিনিট মত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রিফাত নিলাশাকে কি বলবে সেটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মেয়েটা উসখুস করছে সেটা রিফাত বুঝতেই পারছে। এবার কিছু একটা বলা দরকার।
” আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? ” রিফাতই শুরু করল।
” উঁহু। ”
” আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য এখানে আসতে বলেছি। আর সেই কথাগুলো বলার জন্য নির্জন জায়গার প্রয়োজন ছিল। যেটা রেস্টুরেন্টে পেতামনা। ” রিফাত আবারও গুরুগম্ভীর গলায় বলল।
নিলাশা দম বন্ধ করে রিফাতের কথা শুনছে। তার বলা প্রতিটি কথা নিলাশার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে। কি ধীর ভঙ্গিতে কথা বলছে সে! আওয়াজ একটুও উঁচুনিচু হচ্ছেনা। আগেও মানুষটাকে দেখেছে নিলাশা। সব সময়ই তাকে ধীর আর শান্ত মনে হয়েছে। তাকে কখনোই কারও সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি।
” আমার এখানে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। ” কোনমতে বলল নিলাশা।
” শুনেছি আমার সম্পর্কে সবকিছুই জেনে নিয়েছেন আপনি। আর কিছু কি জানার আছে? ”
” নেই। ” রিফাতের সরাসরি এমন প্রশ্নে লজ্জা পায় নিলাশা। লজ্জায় ওর শরীর কাঁপছে।
” কিন্তু আমার কিছু বলার আছে। শুনবেন আপনি? অবশ্য না চাইলেও আপনাকে শুনতেই হবে। ”
রিফাতের কথা শুনে চমকে উঠল নিলাশা। কি বলতে চায় সে? ভয়ে কেঁপে উঠল নিলাশার বুক।
” আমি শুনব। ” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মেয়েটা।
” যদি বলি, আপনাকে ভালোবাসতে আমার সময় লাগবে, মানতে পারবেন? যদি কখনো শোনেন, আমার একটা অতীত ছিল, আর সেই অতীতের কেউ এখনো মনের একটা অংশ দখল করে আছে তবে কি বিয়ে করতে চাইবেন আমাকে? ” রিফাত সরাসরি তাকিয়ে আছে নিলাশার দিকে।
নিলাশা শক্ত পাথর আঁকড়ে ধরার বৃথা চেষ্টা করছে। ওরা একটা বোল্ডারে বসে আছে। রিফাতের কথা শুনে নিলাশার পুরো শরীর কেঁপে উঠল। যেটা রিফাতের চোখ এড়ায়নি। ও শুকনো ঢোক গিলল। শুকিয়ে গেছে ঠোঁট। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। এই মানুষটাকে ও বড্ড বেশি ভালোবেসেছে। যাকে পেতে সে মরিয়া। যার অপেক্ষায় নিলাশা অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে কয়েকটা জীবন।
” যদি প্রশ্ন করি , সেই অতীতের অতিথির সাথে এখনও যোগাযোগ আছে কিনা, তবে কি উত্তর পাব? ” নিলাশা উদাস গলায় জানতে চাইল।
” প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন! ” রিফাত একটু অবাকই হয়েছে।
” আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত। উত্তরটা কি পেতে পারি? ” এবার নিলাশা একটু স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল।
” তার সাথে যোগাযোগ নেই। সে এখন অন্যের বুকে মাথা রেখে নিজের শান্তি খোঁজে। তবে হয়তো বছরে এক-আধবার দেখা হবে তার সাথে। হয়তো তখন কথাও হবে। কিন্তু সেই অতীত আর বর্তমানে ফিরে আসবেনা কখনোই। ” রিফাত মলিন হেসে বলল।
” আপনার অতীতের অতিথিকে যেই মনের একটা অংশে ঠাঁই দিয়েছেন, সেই মনের কিছু অংশে আমাকেও ঠাঁই দিয়েন, আমি আর কিছুই চাইবনা। সময় নিন ভালোবাসতে আমার আপত্তি নেই। একজনকে ভালোবাসলে যে আরেকজনেক ভালোবাসা যাবেনা এটা কিন্তু নয়। দেরিতে হলেও ভালো আপনাকে বাসতেই হবে। আমি আদায় করে নেব ভালোবাসা। ” রিফাতের উত্তর শুনে খুশি হয়ে গেছে নিলাশা। তাই ও খুশিমনেই কথাগুলো বলল।
” ভবিষ্যতে আবার কথায় কথায় অতীত নিয়ে আসবেননাতো? একই কথা আমি বারবার শুনতে পছন্দ করিনা। কিংবা অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেও পছন্দ করিনা। ” রিফাত এবার নিলাশার দিকে তাকিয়ে বলল।
” যদি আপনি সেই অতীতকে আবারও জীবনে ফিরিয়ে আনতে চান তখন আমি প্রতিবাদ করব, এবং সেই অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও করব। তার আগে নয়। আমিও অযথাই খোঁচাখুঁচি পছন্দ করিনা। ” নিলাশা সোজাসাপটা উত্তর দিল।
” আমি আগেই বলেছি অতীত কখনো বর্তমানে আসবেনা। সে তার জায়গাতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। ” রিফাত এই মুহুর্তে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিলাশার দিকে। মেয়েটা যে সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করে এটা বেশ বুঝতে পারছে।
” ঘাপটি মেরে বসে থাকুক অসুবিধা নেই। মাথাচাড়া না দিলেই হবে। আশা করছি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার আপনার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ” নিলাশা চাচ্ছেনা রিফাতের অতীত নিয়ে কথা বলতে। তাই কথার মোড় ঘোরাতে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল।
” আপাতত মনে কোন প্রশ্নই আসছেনা। ” রিফাত একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।
” তা আসবে কেন? মনটাতো পরে আছে অন্য কারও কাছে। সেই ভালোবাসার মানুষ রেখে কি এখন আমাকে চোখে পরবে। ” নিলাশা বিরবির করে বলল।
রিফাত নিলাশার কথা শুনতে পেলোনা। শুধু মেয়েটাকে ঠোঁট নাড়তে দেখল।
” কিছু বললেন? ” রিফাত জানতে চাইল।
” উঁহু। একটা প্রশ্ন করতে পারি? ”
” করুন। ”
” আপনি কি এই মুহুর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নন? না থাকলে বলতে পারেন। যদি আপনি সময় চান সেটাও বলতে পারেন। ” নিলাশা প্রশ্নটা না করে পারলনা।
” পড়াশোনা শেষ করে জীবিকার অন্বেষনে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। তাই বিয়ের কথা মাথায় আনিনি। চাকরিটা হয়ে যাওয়ার পর ভিষণ খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভালোবাসার মানুষটাকে এবার বুঝি আপন করে পাব। কিন্তু হুট করে সে-ও অন্যের হয়ে গেল। কষ্ট পেয়েছি ভিষণ। এই আঘাত সামলাতে সময় লাগবে এটাও জানি। কিন্তু এরইমধ্যে হুটহাট বিয়ের কথা হবে এটা বুঝতে পারিনি। নিজের ভাঙ্গাচোরা জীবন অন্য কেউ এক তাড়াতাড়ি আসবে এটা আমার কল্পনায়ও ছিলনা। তাই একটু অপ্রস্তুতবোধ করছি এই আর কি। ”
রিফাতের কথা শুনে মায়া লাগল নিলাশার। মানুষটা যে বুকভরা কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করছে এটা ও বেশ বুঝতে পারছে। তার জন্য নতুনভাবে জীবন শুরু করা বেশ কষ্টের হবে, এটাও বুঝতে পারছে নিলাশা। তবে ও নিজের জীবন নিয়ে একটা জুয়া খেলতেই চায়। এই সুযোগে নিজের ভালোবাসাও পরীক্ষা করে দেখতে চায়। ওর হিংসা হচ্ছে রিফাতের অতীতের সেই অতিথির প্রতি। নিলাশা রিফাতের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ হয়ে সেই রিফাত আর তার না পাওয়া মানুষটাকে দেখাতে চায়, প্রথম ভালোবাসাই সব নয়। অনেক সময় মানুষকে পূর্ণ করতে পারে শেষ ভালোবাসাও।
” আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাননা! কোন প্রশ্নই মাথায় আসছেনা আপনার! আপনি জানেন আমি কোথায় পড়াশোনা করি? কোন সাবজেক্টে পড়ি? আমরা কয় ভাইবোন? ” নিলাশা বাহানা খুঁজছে রিফাতের সাথে সময় কাটানোর। তাই ও চাইছে রিফাত ওকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করুক।
” আপনারা কয় ভাইবোন এটা জানিনা। বাকিগুলো জানি। আশফি বলেছে। ”
রিফাতের উত্তর শুনে নিলাশা নিরাশ চোখে তার দিকে তাকায়।
” আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জানতে চাইলেননা যে! ”
নিলাশার কথা শুনে হাসল রিফাত। নিলাশা মেয়েটার মনে কোন প্যাঁচ নেই এটা বুঝতে বাকি থাকলনা ওর।
” বয়ফ্রেন্ড থাকা অবস্থায় কোন মেয়ে অন্য একজনকে পছন্দ করে, তাকে বিয়ে করতে চাইবে এটা হতে পারেনা। তাই ধরে নিয়েছি আপনার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। এবং অতীতেও যে ছিলনা এটাও আমি নিশ্চিত। ”
রিফাতের উত্তর শুনে নিলাশা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কি করে নিশ্চিত হলেন! সত্যিই আমার কখনো কোন বয়ফ্রেন্ড ছিলনা। ”
” প্রথমত, আপনি যে সোসাইটিতে বিলং করেন, আমি তার আশেপাশেও নেই। আপনার সোসাইটির ছেলেমেয়েরা আমার মত সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েকে কখনোই বিয়ে করতে চাইবেনা। আর তারা পছন্দ করলে তাদের সমকক্ষ কাউকেই পছন্দ করবে। আই মিন তাদের সোসাইটিতে যায় এমন কাউকেই পছন্দ করবে। দ্বিতীয়ত, অতীতে আপনার কোন বয়ফ্রেন্ড থাকলে সে-ও হাই সোসাইটির হত। তাই বিয়ে করার জন্য আপনি আমাকে বেছে নিতেননা। কারন সোসাইটি সম্পর্কে আপনার ধারনা আছে। আপনি ভালো করেই জানেন, আমাকে বিয়ে করলে আপনি সেই আয়েশি জীবন পাবেননা যেটায় আপনি এত বছর অভ্যস্ত ছিলেন। তাই আমি ধরে নিয়েছি, আপনার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। বয়ফ্রেন্ড থাকলে আপনি স্বেচ্ছায় গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করতে চাইতেননা। ”
” বাব্বাহ্, আপনি দেখছি সোসাইটি বিশেষজ্ঞ! যাহোক আপনার গবেষণায় ভুল নেই। সন্ধ্যা নেমেছে। এবার আমাকে যেতে হবে। আশা করছি, আপনি আমাকে যা জানাতে চেয়েছিলেন সবই জানিয়েছেন। আপনার বোধহয় আর কোন কথা নেই। আপনি কি এখানে আর কিছু সময় বসবেন? ”
” আর পনের মিনিট সময় আমাকে দিতে পারবেন? রাস্তার ওপরপাশে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, ওরা কফি ভালো বানায়। ”
” আজকে আপনাকে সঙ্গ দিতে হবে? ”
” আজকে যখন সঙ্গী হয়েছেন, তখন সঙ্গ দিলে ক্ষতি কি। ”
” আমি আপনার আজন্মকালের সঙ্গী হতে চেয়েছি, একদিনের নয়। ” নিলাশার চোখে বিষাদ। ওর ভয় হচ্ছে রিফাতকে হারানোর।
” এই একদিন থেকেই তো আজন্মকালের শুরু হয়, তাই নয় কি ? ”
নিলাশা এই প্রথমবার রিফাতের চোখে চোখ রাখল। ছেলেটা হাসছে। তার হাসি যে এত নির্মল সেটা আগে লক্ষ্য করেনি নিলাশা।
***
” ভাবী, তাড়াতাড়ি তৈরী হও। ভাইয়া এক্ষুনি জিপ নিয়ে চলে আসবে। আমরা কিন্তু অলরেডি তৈরী হয়েছি। ” ফিহা এসে তাড়া দেয় তিয়াসাকে।
তিয়াসার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। ও বাহিরে যাওয়ার অবস্থায় নেই। এদিকে ফিহাকে না-ও করতে পারছেনা। তারপরও একটা শেষ চেষ্টা করল।
” আমার না গেলে হয়না, ফিহু? ”
” এটা তুমি কি বলছ, ভাবী! আমরা তোমাকে ছাড়াই লং ড্রাইভে যাব! তুমি আমাদের একটামাত্র ভাবী, আর সেই তোমাকে ছাড়াই আমরা বেড়াতে যাব! ” ফিহা মন খারাপ করে বলল। ওর চোখে পানি টলমল করছে।
ফিহার দিকে তাকিয়ে তিয়াসা আর না করতে পারলনা। এই মেয়েটা কয়েকটা দিনে তিয়াসাকে আপন করে নিয়েছে। তাই ওর সকল কষ্ট ভুলে লং ড্রাইভে যেতে রাজি হল।
” থাক এত মন খারাপ করতে হবেনা, ননদীনি। আমি যাব তোমাদের সাথে। আমাকে দশ মিনিট সময় দাও, আমি তৈরী হয়ে নিচ্ছি। ”
তিয়াসার কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল ফিহা। ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পরছে।
” থ্যাংকিউ, মেরি জান। তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসা। ” নিজের দু-হাত প্রসারিত করে দেখাল ফিহা।
***
তিয়াসা তৈরী হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে আশফিকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। আশফি ওকে দেখে দৌড়ে আসল।
” তোকে কি সুন্দর লাগছে, বইন। একদম বউ বউ লাগছে। ” আশফি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল।
” এই তুমি কি আমাদের পুলক ভাইয়ার বোকা পাখি! ” ফিহা এগিয়ে আসল আশফির কাছে। ও আশফিকে দেখে অবাক হয়েছে।
ফিহার কথা শুনে আশফি পুলকের দিকে তাকায়। ও বুঝতে পারছেনা ওকে কেন বোকা পাখি বলছে। এই মুহুর্তে আশফিকে দেখে মজা পাচ্ছে তিয়াসা। পুলকও আশফির অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছে।
” ফিহা শোন, তুই আমার বউ হোস নি ক্ষতি নেই, তাই বলে কিন্তু আমার বউকে হিংসা করতে পারিসনা। সেদিন কতবার বলেছিলাম, তোকে বিয়ে করব, তুই সেদিন আমার কথা রাখিসনি। সেদিনের প্রতিশোধ নিতেই বুঝি আজকে আমার বউকে বোকা বলছিস? ” পুলক আশফির সাথে মজা করতেই ফিহাকে খোঁচা দিল।
এদিকে পুলকের কথা শুনে আশফির আক্কেলগুড়ুম। আশফি মনে মনে ভাবছে, এসব কি বলছে সে!
” কি বললেন আপনি! এই বাচ্চা মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন! আপনার মত বুড়োধামড়া একজন মানুষের একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ের কথা ভাবতে লজ্জা করেনি! এদিকে দিনে একশো দশবার আমাকে ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তোলেন! ” আশফি রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে।
আশফির কথা শুনে ড্রয়িংরুমের সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। পুলক কপাল চাপড়ে সোফায় ধপ করে বসে পরল। তিয়াসা হাসতে হাসতে তাকায় শাহেদের দিকে। সে-ও হাসছে। তিয়াসা অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকল শাহেদের দিকে। মানুষটার হাসি এত সুন্দর কেন? কোন পুরুষের হাসি কি আদৌও এত সুন্দর হতে পারে!
” ওরে আমার কিউট, ভাবী রে। তুমি সারাজীবন এমনই থেক। কিছু কিছু মানুষকে বোকাই মানায়। বোকামিতেই তাদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। চালাক হলেই স্বকীয়তা হারিয়ে যায়। আজ বুঝলাম ভাইয়া তোমাকে এত ভালোবাসে কেন। ” ফিহা আশফির গাল টেনে বলল।
ফিহার কথা শুনে আশফি লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। ও কারও দিকে তাকাতে পারছেনা। ও বেশ বুঝতে পারছে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
***
শাহেদ ড্রাইভ করছে। ওর পাশে বসে আছে তিয়াসা। পেছনে আছে ফিহা, কায়া আর ওর ছোট চাচার মেয়ে কিয়ারা। কায়ার বড় বোন ছায়া’র বিয়ে হয়েছে। ও স্বামীর সাথে সুইজারল্যান্ড থাকে। কায়ার ছোট চাচারও দুই মেয়ে। কিয়ারা আর কৃতি। কৃতি ভ্যাকেশনে বন্ধুদের সাথে আইসল্যান্ড গেছে। তাই ও আসতে পারেনি। শাহেদের ফুপু ফাতিমা জান্নাতেরও দুই মেয়ে। ফিমা আর ফিহা। ফিমা’র বিয়ে হয়েছে। সে-ও অস্ট্রেলিয়া থাকে।
রাতের মৃদুমন্দ সমীরণ ছুঁয়ে দিচ্ছে তিয়াসার তনু। মাথা ব্যথা থাকায় চুল ছেড়ে রেখেছে। ওর খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে দিগবিদিক ছড়িয়ে পরছে। কতগুলো আবার শাহেদের চোখেমুখে হুমড়ি খেয়ে পরছে। শাহেদ ড্রাইভ করতে করতে পরশ নিচ্ছে তিয়াসার এলোকেশের। একটা মিষ্টি সুবাস পাচ্ছে ও। শাহেদ করুন চোখে তিয়াসার দিকে তাকায়। একটা সময় এই মেয়েটার জন্য কতইনা পাগলামি করেছে। আজ সেই মেয়েটাই ওর কত কাছে, কিন্তু তাকে ছোঁয়ার অধিকার নেই শাহেদের। সে এমন এক চাঁদ যাকে ধরা কিংবা ছোঁয়ার অধিকার নেই তার। শুধু দূর থেকেই সেই চাঁদের আলো দেখেই যাবে চাতকের মত। এই চাঁদ বিহনে ওর বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হবে। প্রতিটা ক্ষন হবে বিভীষিকাময়। শাহেদ হঠাৎই আবিষ্কার করল, সামনের সবকিছু ঝাপসা লাগছে। তবে কি কাঁদছে! কোন এক মহামানব বলেছিলেন, পুরুষের চোখে অশ্রু বড়ই বেমানান। সেই কথাটা শাহেদের কাছে আজগুবি মনে হয়। শাহেদের মনে হয়, অশ্রু পুরুষ কিংবা নারীর চোখ আলাদাভাবে বুঝতে পারেনা। ওরা তো ঝরে পড়ার জন্যই প্রস্তুত থাকে সর্বদা।
” ভাইয়া, তুমি পুলক ভাইয়া আর কিউটি ভাবীকে আমাদের সাথে নিলেনা কেন? ভাবীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর করে কথা বলে। ওরা আসলে মজা হত। ” বরাবরের মতোই ফিহা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।
” তোর কি মনে হয়, ভাই আমাদের সাথে আসত? ভাই জানে তোরা সারারাত হৈচৈ করবি। এসবে তার পোষাবেনা। তাছাড়াও আজকে ভাই-ভাবী’র দাওয়াত আছে। সেখানেই চলে গেছে এতক্ষণ। ” ফিহার ডাকে সম্বিৎ ফিরলে উত্তর দেয় শাহেদ।
” আমরা কোথায় যাচ্ছি, ভাইয়া? ” অনেকক্ষণ পর কায়া কথা বলল।
” হাইওয়ে ধরে কিছুদূর গেলেই একটা রাস্তা হয়েছে। রাস্তাটা বেশ নির্জন। তোদের ভালো লাগবে। ”
” কোন রেস্টুরেন্ট নেই আশেপাশে? আমার ক্ষুধা লেগেছে। ” কিয়ারা চারপাশে তাকিয়ে বলল।
” কাম অন, কায়রা। এই রাতবিরেতেও তোমার ক্ষুধা লাগে! একটু আগেই না খেলাম সবাই? ” ফিহা ধমক দিয়ে বলল।
” দেখ ফিহুপু, তোমার ক্ষুধা না-ই লাগতে পারে। কিন্তু আমার লেগেছে। ও মিষ্টি ভাবী, তুমি ভাইয়াকে বলতো কোন রেস্টুরেন্টের সামনে জিপ থামাতে। ”
তিয়াসার কিছুই বলতে হলোনা। শাহেদ সামনে একটা দেখে সেখানে জিপ থামিয়ে কিয়ারাকে নিয়ে ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পর দু’জনে দু-হাত ভর্তি করে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে আসল।
” কায়া, ফিহা, এই নে তোদের জন্য বার্গার, স্যান্ডউইচ, ডোনাট আর সফ্ট ড্রিংকস। আইসক্রিমও আছে। এটা তোমার জন্য। এতে শুধু নান রুটি আর সস আছে। মাথা ব্যথা করছে আইসক্রিম খেওনা। কড়া করে কফির অর্ডার দিয়েছি। এখনই চলে আসবে। এই অসুস্থ শরীরে না আসলেও পারতে। ” কাজিনদের হাতে প্যাকেট দিয়ে তিয়াসাকে দুইটা প্যাকেট দিল শাহেদ। কাজিনরা সাথে থাকায় তিয়াসাকে তুমি করেই বলল শাহেদ।
শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা হা করে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। ও চিন্তা করছে শাহেদ কিভাবে জানল ওর অসুস্থতার কথা! তবে প্রশ্নটা মনে লুকিয়ে রাখলনা।
” আপনি কিভাবে জানলেন আমার মাথা ব্যথা! আমিতো কাউকেই বলিনি। ”
” তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। একটু পরপর কপালে হাত দিচ্ছ। তাতেই ধারনা করেছি। ”
” আহারে প্রেম তুই কেন আমার জীবনে আসলিনা। আমিও আমার নিব্বার দিকে সেকেন্ডে দশবার তাকাইতাম আর তার অসুস্থতা খোঁজার চেষ্টা করতাম। ” ফিহা জোরেসোরে বলল। ওরা তিনজন হাসতে হাসতে একে-অপরের ওপর গড়িয়ে পরছে৷
তিয়াসা ওদের হাসি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করল। শাহেদ শুধু ওদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। কিন্তু ওরা কেউ শাহেদের চোখ রাঙানিকে পাত্তা দিলনা।
চলবে…
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী জামী
” আপনি স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুম হলে মাথা ব্যথা কমতেও পারে। এত সমস্যা নিয়ে বাহিরে না গেলেও পারতেন। ” বাসায় এসে শাহেদ তিয়াসাকে স্লিপিং পিল দিয়ে কথাগুলো বলল।
” কেন আমি যাওয়াতে সমস্যা হয়েছে বুঝি? কথাটা আগে বললেই পারতেন, আমি যেতামনা। ”
তিয়াসার কথা শুনে শাহেদ স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তিয়াসার দিকে। ও বোঝেনা মেয়েটা মুখ খুললেই কেন এমন ত্যাড়াব্যাকা কথা বলে!
” আমি আমার সমস্যার জন্য কথাটা বলিনি। আপনি মাথা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন সেজন্য বলেছি। ”
” এইতো তিনঘন্টা আগেও আমাকে তুমি করে বলছিলেন। এখন আবার কি ঘটল যে আমাকে আপনি আপনি করছেন? ” তিয়াসা মুখ কালো করে জিজ্ঞেস করল। ওর এই মুহুর্তে ভিষণ রাগ হচ্ছে।
” বিচ্চু বাহিনীর সামনে আপনাকে ‘ আপনি ‘ করে ডাকলে ওরা সন্দেহ করত। অকারণেই আপনাকে ওদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। সেজন্যই তখন ‘ তুমি ‘ করে বলেছি। ‘ তুমি ‘ ডেকেছি জন্য রাগ করেছেন বোধহয়? আর ডাকবনা। ” শাহেদ ম্লানমুখে বলল।
শাহেদের কথা শুনে রাগে তিয়াসার শরীর চিড়বিড় করছে। মনে চাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই বেকুব মানুষটাকে তুলে আছাড় মারতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ও চাইলেও এই দশাসই দেহের মানুষটাকে দু’হাতে তুলতে পারবেনা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” এভাবে ‘ তুমি ‘ ‘ আপনি ‘ করার দরকার নেই। তারচেয়ে বরং আমাকে ‘ তুমি ‘ ই ডাকবেন। প্রতিনিয়তই বাসায় মেহমান আসে। তারাও যদি আপনার মুখে আপনি ডাক শোনে তবে আমাকেই কথা শুনতে হবে। ” তিয়াসা আর কিছু বললনা। স্লিপিং পিল খেয়ে বিছানায় উঠল।
শাহেদ আবারও স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও তাকিয়ে আছে তিয়াসার দিকে। একটু আগে মেয়েটা কি বলল, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওর মুখে হাসি ফুটল। ও হাসিমুখে সোফায় গিয়ে শুয়ে পরল।
***
নিলাশার বাবা আবারও এসেছেন। তিনি মল্লিকা মির্জা আর আতিক মির্জাকে নিয়ে আশফিদের গ্রামে গেলেন। তারা রিফাত আর নিলাশার বিয়ে নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করলেন। এবং সিদ্ধান্ত নিলেন আগামী মাসের শেষের দিকে ওদের বিয়ে হবে। এবং সম্ভাব্য একটা ডেইটও ঠিক করলেন।
রিনা আক্তার রিফাতের বিয়ের কথা শুনে রাগে ফেটে পরল। রিফাতের বিয়ের কথা হচ্ছে অথচ কেউ তার মতামত নিচ্ছেনা এটা সে মানতে পারছেনা। তার ইচ্ছে ছিল তার বোনের মেয়ের সাথে রিফাতের বিয়ে দিবে। খালা-বোনঝি মিলে পুরো বাড়িতে রাজত্ব করবে। রিফাতকে তাদের হাতের পুতুল বানাবে। রিফাত ভালো চাকরি করছে, বেতনও পায় অনেক টাকা। অনেকগুলো টাকা মাস শেষে তার হাতে আসবে। কিন্তু এখন সেসবের কিছুই হবেনা ভেবেই তার রাগ হচ্ছে।
” আম্মা, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে আজকের রাতটা এখানে থাকতে বলবে? উনারা এখন পর্যন্ত এই বাড়িতে এসে রাতে থাকেননি। ” আশফি রিনা আক্তারের কাছে এসে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল।
” কমুনা কেন! তর বাপের রাজকোষ উপচায় পরতাছে। হেয় সরাইখানা খুইলা বসছে। যে যখন আসব তাদেরই সরাইখানায় নিয়া আপ্যায়ন করন লাগব। তার উপ্রে তর শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলা ভিআইপি মেহমান। তাদের আপ্যায়ন না করলে আমার গর্দান থাকব! আমার ঘাড়ে কয়ডা মাথা তর কথা অমান্য করি! ” আশফির কথা শুনে রিনা আক্তার খিটমিট করে বলল।
আশফি কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে থাকে রিনা আক্তারের দিকে। এই মানুষটা কেন আশফিকে অপছন্দ করে তা আজ-অব্দি জানতে পারেনি আশফি। ওর শ্বশুর বাড়ির কাউকেও যে ছোটমা পছন্দ করেনা সেটাও বোঝে আশফি। অথচ তারা এই বাড়িতে আসার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসে। আজকেও নিয়ে এসেছে। তবুও কেন ছোট মা এত দূরছাই করে?
” এভাবে বলছ কেন, আম্মা? তারা তো প্রতিদিন এখানে থাকতে আসেনা। তারা একদিন এখানে থাকলে আব্বার কোন ক্ষতি হবেনা। আর তাছাড়া আব্বাও তো সম্মান আছে। ” আশফি একটু ঝাঁঝ নিয়েই বলল।
” বাপের সম্মান রক্ষার দ্বায়িত্ব কি তরে দিছে? তর বাপের ক্ষতি হইব কিনা সেইডা আমি বুঝমু। তরে বুঝবার কইছে কেডা? শ্বশুর বাড়িতে যত খুশি মাতব্বরি কর কেউ মানা করবনা। কিন্তু আমার বাড়িতে কোন মাতব্বরি করবার আইবিনা। ”
রিনা আক্তারের কথা শুনে আশফির কান্না পায়। ও চোখ মুছে চলে যায় বড়মার কাছে।
সেদিন সন্ধ্যার দিকেই আশফিরা বাড়ি ফিরে যায়।
***
” ভাইয়া, কোথায় যাচ্ছ? আমাদের নিয়ে বেড়াতে যাবেনা? ” শাহেদকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেই জিজ্ঞেস করল কায়া।
” আজকে তোরা নিজেরাই বেড়িয়ে আয়। আমার এতটু কাজ আছে। আজ সারাদিন বাসায় থাকতে পারবনা। ”
” কাজ পরে কর। আগে আমাদের বাহিরে নিয়ে চল। ”
” এত সকালে কিসের বাহিরে যাওয়া! বিকেলে যাবি। আমি ভাইয়ার জিপ ড্রাইভারসহ পাঠিয়ে দেব। তখন ইচ্ছেমত বেড়াস। ”
শাহেদের কথা শুনে কায়া মুখ ভার করল। এদিকে শাহেদও বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে।
তিয়াসা সকালের নাস্তার পর রেডি হয়ে নিচে আসল। কায়া তখনো ড্রয়িংরুমে বসে আছে।
” কোথাও যাচ্ছ নাকি, ভাবী? ”
” কলেজে যাচ্ছি গো। ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে। ”
” কখন আসবে? তোমাকে ছাড়া ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। ”
” দুই ঘন্টার মধ্যেই ফিরব। ততক্ষণ তোমরা তিনজনে আড্ডা দাও। আমি এসে তোমাদের সাথে আড্ডা দেব। আমি আসছি। দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই। ” তিয়াসা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।
ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছে তিয়াসা। আজকে ও গাড়িতে আসেনি। রিক্সায় ওঠেনি অনেকদিন। তাই রিক্সা করেই কলেজে এসেছিল। কলেজ থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল রাস্তার একপাশে মানুষের ভীড়। একদল মানুষ গোল হয়ে কিছু একটা দেখছে। ভীড়ের কাছে রিক্সা যেতেই কারও আর্তনাদ শুনতে পায় তিয়াসা। রাস্তায় অনেক রিক্সা, গাড়ি জমে গেছে। সেজন্য ওকে বহন করা রিক্সাকেও দাঁড়াতে হয়। রিক্সাওয়ালা পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল একজনকে কয়েকজন ছেলে মিলে বেধরক পেটাচ্ছে। আর তারই আর্তনাদ ভেসে আসছে। কথাটা শুনে তিয়াসা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কি হচ্ছে। কিন্তু দেখতে পায়না। আশেপাশের রিক্সায় সবাই দেখছে। ওদের দেখে তিয়াসারও কৌতুহল হলো। সে-ও রিক্সায় দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর ও ধপ করে রিক্সার সিটে বসে পরল। ওর মাথা ভনভন করে ঘুরছে। রাগে শরীর কাঁপছে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর রিক্সাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলে নেমে আসল রিক্সা থেকে। ভীড় ঠেলে ঘটনাস্থলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেক চেষ্টার পর সফলও হয়।
সামনে একটা ছেলে আর্তনাদ করেই চলেছে। দশ জন ছেলে মিলে তাকে মারছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে হকিস্টিক। রক্তে ছেলেটার পুরো শরীর মাখামাখি। ছেলেটা সবার পায়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছে। কিন্তু তার কথায় কেউই কান দিচ্ছেনা।
” আমারে ছাড়েন, ভাই। আমার ভুল হইছে। আর মারবেননা। আমারে ক্ষমা করেন। ” ছেলেটা একজনের পা দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরে আকুতি করছে।
” ভুল করার সময় তোর মনে ছিলনা? সজ্ঞানে ভুল করে ক্ষমা চাচ্ছিস? তোকে ক্ষমা করার দায় আমাদের নেই। ” শাহেদ হকিস্টিক উঁচিয়ে বলল। সে ছেলেটার পায়ে আঘাত করতে গেলেই কেউ তার হকিস্টিক ধরে ফেলল।
রাগে শাহেদ পাশ ফিরে তাকাতেই তিয়াসাকে দেখে থমকে যায়।
” আপনি ক্ষমা করার কে? নাকি ক্ষমার ঠিকাদারি নিয়েছেন? জরুরী কাজ আছে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এই আপনার জরুরী কাজ? মানুষটাকে এভাবে জানোয়ারের মত মারছেন কেন? ভদ্র-সভ্য হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করেনা বুঝি? রাস্তার সবাই দেখছে আর ভাবছে একদল টোকাই একজন মানুষকে জানোয়ারের মত মারছে। এটা খুব শোভনীয় তাইনা? ”
তিয়াসার রাগ দেখে শাহেদ বেশ অবাক হয়েছে। ও তিয়াসার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা। আঁড়চোখে বারবার পুলকের দিকে তাকাচ্ছে। এদিকে পুলকের হাতেও হকিস্টিক। তার পুরো শরীর ঘামে জবজব করছে। সে হাঁপাচ্ছে। তিয়াসাকে দেখে দলের বাকি সবাই থেমে গেছে। সবাই পুলকের দিকে তাকিয়ে আছে। তিয়াসা এবার ফিরল পুলকের দিকে।
” আমি কি আশফিকে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বলব, ভাইয়া? ও বেশিদূর যায়নি বোধহয়। আমি ফোন দিলে দশ মিনিটেই চলে আসবে। কি পান এসব করে? ”
” তুমি আমাদের ভুল বুঝছ, তিয়াসা। এই জানোয়ার একটা অসহায় মেয়েকে রেপ করেছে। বাচ্চা মেয়েটা ফুল বেঁচত। সে এখন হসপিটালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তুমিই বলো একে কিভাবে ছেড়ে দিতাম? ” পুলক হাঁপাচ্ছে আর কথা বলছে।
” এর জন্য আইন ছিলনা দেশে? একে আপনারা পুলিশের কাছে দিতেন। মেয়েটার পক্ষ থেকে লড়তেন। একে সারাজীবন জেলে পঁচিয়ে মারার কিংবা ফাঁসিতে ঝোলানোর ক্ষমতা আপনার ছিল। কিন্তু সেটা না করে এভাবে মারছেন কেন? সব সময় আইন নিজের হাতে তুলে নিলেই বাহাদুর হওয়া যায়না। আমি আপনার ভাইকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। আর বাসায় গিয়েই আশফিকে ফোন দিচ্ছি। ” তিয়াসা কথা শেষ করে এগিয়ে যায় শাহেদের দিকে।
” আসুন। ” শাহেদের হাত শক্ত করে ধরে ওকে টানতে টানতে এগিয়ে যায় ভীড়ের দিকে। ওদের আসতে দেখে কয়েকজন মানুষ দুপাশে সরে গিয়ে ওদের রাস্তা করে দেয়। তিয়াসা শাহেদকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল।
পুরো রাস্তা কেউ কোন কথা বললনা। তিয়াসা রাগে কাঁপছে এটা শাহেদ বুঝতে পারছে। ওর একটু ভয় হচ্ছে। বাসায় গিয়ে তিয়াসা কি করবে সেটাই ভেবে চলেছে একমনে ।
বাসার সামনে রিক্সা থামতেই তিয়াসা নেমে গেল। ও গটগটিয়ে গেইটের ভেতরে ঢুকল। শাহেদ ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তিয্সার পিছুপিছু ভেতরে ঢুকল।
শাহেদ রুমে আসতেই তিয়াসা ওর হাত ধরে ওয়াশরুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। শাহেদকে ভেতরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল বাহির থেকে।
” গোসল করে নিন। গোসল ছাড়া এই রুমে আপনার জায়গা হবেনা। শুধু রুম বলছি কেন! ইনফ্যাক্ট এই বাসাতেই আপনার জায়গা হবেনা। ”
হতভম্ব শাহেদ তিয়াসার কথামত কাজ করল। গোসল শেষ করার পর ওর মনে হল টাওয়েল কিংবা পোশাক কিছুই নেয়নি। বাধ্য হয়ে দরজায় টোকা দিল।
” কি হয়েছে, ঠোকাঠুকি করছেন কেন? ” তীক্ষ্ণ গলায় বলল তিয়াসা।
” টাওয়েল, ট্রাওজার আর টি-শার্ট লাগবে। ” শাহেদ ভেতর থেকে জবাব দিল।
তিয়াসা জিনিসগুলো আলমারি থেকে বের করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে শাহেদের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
চলবে…