রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৪১+৪২

0
167

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪১
জাওয়াদ জামী জামী

” গুড মর্নিং, দুলহা রাজা। ”

নিলাশার ঘুম ভাঙ্গলে ও রিফাতকে উইশ করল। কিন্তু পাশ ফিরে দেখল বিছানা ফাঁকা। রিফাতকে না দেখে ওর হৃদাকাশে মন খারাপের মেঘ জমল। রাতে ঘুমানোর আগেই ভেবে রেখেছিল সকালে চোখ খুলেই রিফাতের মুখ দেখবে। ওর প্রতিটা সকাল শুরু রিফাতকে দেখে। রাতটাও হবে রিফাতময়। অবশ্য সিদ্ধান্তটা রাতে নিয়েছে বললে ভুল হবে। ওদের বিয়ে ঠিক হবার পরই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল নিলাশা। ও রিফাতকে নিয়ে মনে মনে কতশত স্বপ্নের জাল বুনে রেখেছে সেটা কেবল নিলাশাই জানে। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম সকালেই ওকে নিরাশ হতে হল। তবে হাল ছাড়বার পাত্রীও নিলাশা নয়। ও আবারও বালিশে মাথা রাখল। যতক্ষণ না রিফাত রুমে আসবে, ততক্ষণ ও কিছুতেই বিছানা ছাড়বেনা কিংবা চোখ খুলবেনা। দরজার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে ফোন বের করল বালিশের নিচ থেকে। গ্যালারিতে গিয়ে রিফাতের একটা ছবি বের করে আপনমনে কথা বলতে লাগল।

” আমার জান্টুস জামাই কই আপনি? সকাল সকাল আমাকে ফাঁকি দিলেনতো? অবশ্য আপনি কিভাবে জানবেন আমার মনের কথা। যাহোক, যেখানেই থাকুননা কেন তাড়াতাড়ি চলে আসেন। আপনার সুইট, কিউট মুখখানা দেখে আমি আমার দিন শুরু করব। ”

নিলাশার কথা শেষ হতে না হতেই রিফাত রুমে আসল। হয়তো এটা কাকতালীয় নয়, তবে নিলাশার কাছে বিষয়টা কাকতালীয়র চাইতেও বেশি কিছু। ওর বিশ্বাস জন্মায় ওর ভালোবাসার জোড়েই এমনটা ঘটেছে। নিলাশা ফোন রেখে চুপটি করে শুয়ে থাকল।

” নিলাশা, উঠে পর। অনেক বেলা হয়েছে। বাহিরে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ” রিফাত নিলাশার দিকে ঝুঁকে মৃদু গলায় ডাকল।

রিফাতের ডাক শোনার সাথে সাথেই নিলাশা এক ঝটকায় উঠে বসল। হুট করে নিলাশাকে বসতে দেখে চমকায় রিফাত। তবে কি মেয়েটা জেগেই ছিল?

” দেখি চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুন। আগে কিছুক্ষণ আপনাকে দেখে নেই। আমি জানি অনেক বেলা হয়েছে। কিন্তু কি করব বলুনতো? আপনার চাঁদপানা মুখখানা না দেখে যে আমি বাহিরে যেতে পারছিলামনা। ”

” কি বলছ এসব! তোমার বাহিরে যাওয়ার সাথে আমার সম্পর্ক কি? ”

” শুনুন জনাব দুলহা রাজা, আমি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার প্রতিটা সকাল শুরু হবে আপনাকে দেখে। রাতটাও তাই। তাই নো হাংকিপাংকি। এরপর থেকে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত আপনি বাহিরে যাবেননা। হয়তো প্রথম প্রথম দুই-এক দিন আমার উঠতে দেরি হবে। কিন্তু তাই বলে রাগ করা চলবেনা মোটেও। খু্ব যদি বাহিরে যাওয়ার দরকার পরে, তখন আমাকে ডাকবেন। আমি আপনার মুখটা একটুখানি দেখেই আপনাকে ছেড়ে দেব। ডাকবেন তো? ” অনুনয় ঝরে পরল নিলাশার গলায়। কিছু একটা আছে নিলাশার গলায়। যা রিফাতের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ওর এই অনুনয় উপেক্ষা করার সাধ্য নেই রিফাতের।

” দেখা শেষ? এবার তাহলে বাহিরে যাও। ”

” আর একটু প্লিজ। ”

” সব মিলিয়ে পাঁচ মিনিট সময় পাচ্ছ তুমি। এরমধ্যেই শাড়ী ঠিকঠাক পড়ে বাহিরে যাবে। ”

রিফাতের কথায় চমকে উঠে নিজের দিকে তাকায় নিলাশা। আর সাথে সাথে লজ্জায় ওর মুখ রাঙা হয়ে গেল। শরীরের কোথাও শাড়ী জায়গামত নেই। আঁচল লুটাচ্ছে কোলের ওপর। ডান পা হাঁটু অব্দি বের হয়ে গেছে। লজ্জায় কাঁদতে ইচ্ছে করছে নিলাশার। তবে এই মুহুর্তে সেই ইচ্ছেকে বিসর্জন দিতে চাইছে সে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। এরপর বোমা ফাটাল।

” দুলহা রাজা, শুনুন আজকের এই কথাটা কি অদূর ভবিষ্যতে নাতি-নাতনীদের সাথে গল্প করবেন? আমি বলি কি, এসব কথা গোপন রাখবেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কতকিছুই তো হয়ে থাকে। আই মিন অনেককিছুই ঘটে। সেসব কথা কাউকে বলতে নেই। কিছু কথা গোপনই সুন্দর। প্রকাশেই তার মাধুর্য নষ্ট হয়। ”

রিফাত নিলাশার কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে। সেই সাথে বাকরুদ্ধও। একটা সমান্য বিষয়কে মেয়েটা কতদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, সেটা ভেবেই ওর মাথা ঘুরছে।

***

” কই গো নতুন বউ, এখানে আইসা বস। এই মাছডা কাইটা দেও। দেখি তুমি কাজকাম কিছু পার কিনা। বিয়ার পরদিনই বেলা নয়ডায় ঘর থাইকা বাহিরে আইছ, বাকি জীবন পইরাই রইছে। ” নিলাশাকে রান্নাঘরে ডাকল রিনা আক্তার। সেই সাথে খোঁচা দিতেও ভুললনা।

” বিয়ের পরইতো ঘুম থেকে দেরিতে উঠতে হয়, শ্বাশুড়িআম্মা। নতুন জামাই-বউয়ের কত কথা থাকে, সেগুলো বলতে বলতেই রাত পেরিয়ে যায়। আর এমনিতেও প্রথম প্রথম সবাই দেরিতেই ওঠে। এমনকি আপনিও দেরিতেই উঠেছেন। এটা কি অস্বীকার করতে পারবেন? অবশ্য পুরনো হয়ে গেলে আলাদা বিষয়। কই মাছটা এদিকে দিন। আমি সবই কাটতে পারি। তরকারি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এমনকি মানুষের মাথাও। আপনি শুধু হুকুম করবেন আর আমি ঘ্যাচাং করে কাটব। ”

রিনা আক্তারের মুখে যেন কালিমা লেপে দিয়েছে কেউ। নিলাশার কথাগুলো তার মনঃপুত হয়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সে নিলাশার কথার উত্তর না দিয়ে প্লাস্টিকের ডালা এগিয়ে দেয়। বড় মাছ রাখা আছে ডালায়। নিলাশা সামনে থাকা বটি নিয়ে মাছ কাটতে শুরু করল। অভ্যস্ত হাতে ও মাছটা কেটে ফেলল।

এদিকে রান্নাঘরে রত্না পারভিনও ছিলেন। তিনি নিলাশার কথাগুলো শুনে মনে মনে খুব হাসলেন। নতুন বউ যে রিনা আক্তারকে জব্দ করল সেটা তিনিসহ সেখানে উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারল। সবাই মনে মনে খুশিও হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে দিলনা কেউই।

***

” আসুন খেতে ডাকছে আপনাকে। ” আশফি পুলককে ডাকল। পুলক আশফির রুমে বসে ফোনে কিছু একটা করছিল।

” কে ডাকছে? ”

” কে আবার! আব্বা, বড় চাচা, ছোট চাচা সবাই। তারা কি আপনাকে ছাড়া খাবে নাকি! ”

” শোন বউ, তুমি এমনভাবে কথা বলছ কেন? আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি আগেরমত আমাকে আর ভালোবাসনা। দূরে দূরে থাক, আবার ঠিকমত কথাও বলনা। আমি কি খাচ্ছি না খাচ্ছি সেদিকেও লক্ষ্য করোনা। ” পুলক যথাসম্ভব মুখটা ভার করে বলল।

” ওমা, কিসের ভেতর কি বলছেন! আমি আবার এতকিছু কখন করলাম! বিয়ে বাড়িতে এসে কি সব কাজ ফেলে আপনার কোলের ওপর উঠে বসে থাকব? নাকি এতসব আত্নীয়দের মাঝেই আপনার সাথে খিলখিলিয়ে হাসব আর কথা বলব? আবার তিনবেলা নিয়ম করে খাচ্ছেনও দেখলাম। অপেক্ষা করুন, আমি শাহেদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করছি, আপনি পেটপুরে খাচ্ছেন কিনা। ” আশফি একটু বিরক্ত নিয়েই বলল।

” ও বাবা, আবার খোঁটাও দিচ্ছ? তোমার বাপের বাড়িতে এসে নাহয় তিনবেলা খাচ্ছি। তাই বলে খোঁটা দেবে! আমাকে আগে বললেই হত, আমি বাজার করতাম। তাহলে খোঁটা থেকে অন্তত রেহাই পেতাম। ” পুলক আগের থেকে আরেকটু মুখ ভার করে বলল। সেই সাথে তার গলার স্বরও নরম হয়েছে।

” আপনার কি হয়েছে বলুনতো? আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি আপনাকে খাবার খোঁটা দিচ্ছি? এমনতো ছিলেননা আপনি। ” আশফি এবার বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল। আর কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল পুলকের দিকে।

আশফিকে হাতের নাগালে পেতেই ওর হাত ধরে এক টানে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিল। পরপর অনেকগুলো চুমু দিল আশফির মুখ আর গলায়।

” কিছুই হয়নি আমার। কতদিন বউকে কাছে পাইনা, সেই হিসেব কি বউ রেখেছে? বউকে কাছে পেতেই এতসব ট্রিক্স করতে হল। ” পুলক চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে আশফিকে।

” এই ছাড়ুন। দরজা খোলা আছে তো। কেউ আসলে কি হবে? ” আশফি পুলকের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে।

” কি আর হবে। সবাই দেখবে পুলক মির্জা তার বউকে আদর করছে। দোষ তো তোমার বাপের বাড়ির সব আত্মীয়দের। তাদের জন্যই বউটাকে কাছে পাচ্ছিনা। ”

” ছিহ্ একটুতো লজ্জা করুন। গুরুজনদের নিয়ে কিসব বলছেন। আপনি দিন দিন খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছেন এটা কি জানেন? আমার আত্নীয়-স্বজনরা কয়দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে মাত্র। আর তাদেরকেই আপনি হিংসা করছেন? ”

” আমি মানুষ হিসেবে সব সময়ই খারাপ ছিলাম। তাই তোমার কথা আমার ওপর কোন প্রভাব ফেললনা। আর তোমার আত্নীয়-স্বজনদের হিংসা করবনাইবা কেন? তারা কি জানেনা, বিয়ের পর পুরুষরা কতটা বউ পাগল হয়? বউ ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে তাদের কষ্ট হয়? তোমার আত্মীয়দেরও তো বিয়ে হয়েছে। তাদের সাথে কি এমন কিছু হয়নি? আমি এই কয়দিনে তোমাকে পনের মিনিটের জন্যও কাছে পাইনি। এজন্য দায়ী তোমার খালা, ফুপু, চাচী, নানী, দাদী, ভাবী উপাধির ঐসব আত্মীয়রা। তারা সবাই আমার শত্রু। নিজেরা জামাইদের সাথে ভালো সময় পার করে এসে আমার রোমাঞ্চের চৌদ্দটা বাজাচ্ছে। ”

পুলকের কথা শুনে আশফি হাসি আটকে রাখতে পারলনা হো হো করে হেসে উঠল। পুলক মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার রমনীকে। সে প্রান খুলে হাসছে। হাসতে হাসতে তার রমনীর চোখের পাপড়ি আদ্র হয়ে গেছে। ছলছল করে আঁখিদ্বয়। পুলক তার রমনীর আঁখিতে দেখেছে ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় সে ডুবেছে হাজারবার। যে ভালোবাসার তল খুঁজতে যায়নি সে। সে শুধু ভালোবাসা পেয়েই সন্তুষ্ট। তল খুঁজতে যাওয়ার মত বোকামি করেনি আজও।

***

” আশফি মা, জামাইরা এসে গেছে, তুই রিফাত আর বউমাকেও ডাক। আজকে আমরা ভাইয়েরা মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউমাকে নিয়ে একসাথে খাব। এমন সুযোগ হাতছাড়া করবনা। ” আফজাল হোসেন মেয়েকে বললেন।

” ডাকছি, আব্বা। ”

আশফি বেরিয়ে গেলে তিয়াসা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিতে থাকে। আশফি ভাই-ভাবীকে ডেকে আনল।

” রিফাত, তুমি আমাদের সাথে খেয়ে নাও। বউমা, তুমিও বস। ” আফজাল হোসেন নিজের পাশে ইশারা করে রিফাতকে বসতে বললেন। রিফাত কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসল।

” বাবা, আমাকে মাফ করবেন। আম্মা, বড়মা, ছোট চাচী সবাইকে রেখে আমি কিভাবে খাই বলুনতো? তারা এখনো না খেয়ে আছে। তারচেয়ে আপনারা খেতে শুরু করেন, আমি আপনাদের খাবার পরিবেশন করছি। ”

আফজাল হোসেন বিষয়টা বুঝতে পেরে নিলাশার কথায় সম্মতি দিলেন।

***

” এই যে বউয়ের ভাই, আজ থেকে নিয়ম করে তিনবেলা আমাকে সালাম দেবেন। মনে রাখবেন, আমি আপনার বউয়ের বড় ভাই। ” খাবার পর বাগানে ছোটবড় সবাই মিলে আড্ডায় মেতেছে। আড্ডার এক পর্যায়ে পুলক রিফাতকে বলল।

” তুমি আমাকে প্রতিদিন কতবার সালাম দাও, পুলক? আমিও তোমার বউয়ের বড় ভাই। ”

” দেখুন ভাইয়া, আমি ত্যাড়া মানুষ সেটা সবাই জানে। কিন্তু আমি সালাম দেইনা বলে আপনিও আমাকে সালাম দেবেননা এটা হতে পারেনা। ”

” তিনবেলা নিয়ম করে সালাম নিতে গেলে সালাম দিতেও হবে, ভাইয়া। তুমি আমার জামাইকে বোকাসোকা পেয়ে দাদাগিরি করবে সেটি হচ্ছেনা। আর সেই হিসেবে ধরতে গেলে, শাহেদ ভাইয়াও তোমার থেকে নিয়ম করে তিনবেলা সালাম পায়। কারন তিয়াসা ভাবী তোমার বউয়ের বড় বোন। তাই সোজা হিসেবে তুমিও সালাম দেবে আর সালামের উত্তর দেবে। ”
ওদের আড্ডার মাঝে হঠাৎ করেই নিলাশা এসে উত্তর দিল।

” এই তুই না নতুন বউ? তুই বাড়ির বাহিরে কেন? কানের নিচে এমন চাটি দেবনা, নিজের নাম ভুলে যাবি। ” পুলক ধমক দিয়ে বলল।

” হুহ, আসছে আমাকে শাসন করতে। শোন সালা কিন্তু আমিও পাই। আমিও কিন্তু তোমার বড় ভাইয়ের বউ। তাই আজ থেকে আমাকেও সালাম দেবে। ” নিলাশা পুলকের ধমকে ভয় না পেয়ে উল্টো প্যাচঁ কষল।

” নিলাশা, তুমি তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে সালাম চাচ্ছ! তিয়াসা বইন, কয়দিন পর এই মেয়ে আমাদের বলবে তাকে সালাম দিতে। এগ্লা মানা যায়? ” আশফি কাঁদোকাঁদো হয়ে তিয়াসাকে বলল।

” সত্যিই নিলাশা, এটা কিন্তু অন্যায়। আমার বোনটাকে এভাবে না কাঁদালেই পারতে। বেচারি জামাই অন্তপ্রান। ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে, তুমি নতুন বউ বাড়ির বাহিরে কেন? তাড়াতাড়ি কয়েকটা পেয়ারা নিয়ে বাড়িতে চল। ” তিয়াসা খিলখিল করে হাসছে আর কথা বলছে।

” ও দুলহা রাজা, দেখেননা আপনার সামনে এরা আমাকে কেমন হেনস্তা করছে। আমার হয়ে একটু প্রতিবাদ করেন। থাক প্রতিবাদ করতে হবেনা বরং আমাকে কয়েকটা পেয়ারা নামিয়ে দিন। ” রিফাত নিলাশার কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়। ও দেখল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এমনকি তিয়াসাও হাসছে! হঠাৎই বুকের ভেতর ভারি অনুভূত হয় রিফাতের৷ জীবন ওকে নিয়ে এভাবে খেলছে কেন?

” চল। ” রিফাত আর কিছু না বলে পেয়ারা গাছের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

রিফাতের পিছুপিছু নিলাশাও হাঁটছে। আশফিও নিলাশার সাথে যেতে চাইলে পুলক ওকে ডাক দেয়।

” আশফি, কোথায় যাচ্ছ? ”

” পেয়ারা গাছের নিচে। ”

” দরকার নেই। এখানেই থাক। ওদের কিছুটা সময় একা কাটাতে দাও। ভালো কথা, বিউটিশিয়ান আসবেনা? নাকি সারাদিন পেয়ারা নিয়েই বসে থাকবে? ”

” এসব আমি জানিনা তিয়াসা জানে। ”

” আর এক ঘন্টার মধ্যেই বিউটিশিয়ানরা এসে যাবে, ভাইয়া। আমরা সাজুগুজু করব আর পেয়ারা খাব। চিন্তা করবেননা আপনাদেরও দেব। ”

” তুমিও সাজবে নাকি! ” শাহেদ জানতে চাইল।

” কেন আমার কি সাজা বারণ? ” তিয়াসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” বিয়ে নিলাশার, সাজবে ও। তুমি কেন? ”

তিয়াসা শাহেদের কথার উত্তর না দিয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ কটমটিয়ে তাকিয়ে থাকল। এরপর দুমদাম পা ফেলে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

” দিলি তো বউকে রাগীয়ে? আরে গাধা, মেয়েরা সাজতে ভালবাসে জানিসনা? যেখানে ওদের সাজতে কোন কারন লাগেনা, সেখানে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। আর ওরা সাজবেনা! ” পুলকও রেগে গেছে।

” সরি ভাই, বুঝতে পারিনি। আমি যাই বউয়ের রাগ ভাঙ্গিয়ে আসি। ” শাহেদও এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী জামী

গ্রাম থেকে ফেরার একদিন পরই তিয়াসারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পুরো রাস্তায় ওরা দাদুকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। দাদু জার্নি করতে পারেননা অনেক দিন থেকেই। রাস্তায় কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে দাদুর মাথায় পানি দিলেন খাদিজা আন্টি। তার প্রেশার বেড়ে গেছে। শাহেদ, তিয়াসাও তাকে সাহায্য করল। তাকে ঔষধ খাওয়াল। বাসায় পৌঁছেই দাদু বিছানায় গেলেন। এবং তিনি শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরলেন। দাদু ঘুমালেই তবে তিয়াসা ফ্ল্যাট দেখার সুযোগ পেল। হুট করেই ওর মন ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। প্রায় সাত মাসের পুরোনো সংসার ছেড়ে নতুন সংসারে পা রাখল মেয়েটা। ঘুরে ঘুরে পুরো ফ্ল্যাট দেখছে ও। চার রুমের ফ্ল্যাটে দুইটা বেলকনিও রয়েছে। ফার্নিচারগুলোও সব ঠিকঠাক মতই সাজিয়েছে শাহেদ। তিয়াসা আনমনে হাসল। স্বীকার করতেই হবে ছেলেটা করিৎকর্মা আছে।

” পছন্দ হয়েছে? ” শাহেদের গলা শুনে চমকে উঠল তিয়াসা। কখন যে শাহেদ ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ও দেখতেই পায়নি।

” খুউউউউব। ”

” থ্যাংকিউ। এবার বল রাতে কি খাবে? আমি খাবার নিয়ে আসব। ”

” খাবার নিয়ে আসবেন মানে! এখন সবে সন্ধ্যা। আপনি কাঁচা-পাকা সব ধরনের বাজার করে আনবেন। এরপর আমি রান্না করব। এখন থেকে বাহিরের খাবার টোটালি বন্ধ। ”

” সারাদিন জার্নি করে এসেছ। তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি টায়ার্ড। আজকে খাবার কিনে আনি। কাল থেকে রান্না কর। কালকে তোমার পছন্দমত কাঁচাপাকা সব ধরনের বাজারই করে আনব। ”

” গোসল করলে সব ক্লান্তি মুছে যাবে। আমি বরং আপনাকে লিষ্ট করে দেই, আপনি বাজার করে আনুন, ততক্ষণে আমি গোসলও সেড়ে নিব। ”

শাহেদ বুঝল এই মেয়ে রান্না না করে ছাড়বেনা। তাই ও বাধ্য ছেলের মত তিয়াসার করা লিষ্ট নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দেয়।

রাত দশটায় শাহেদ, তিয়াসা আর খাদিজা আন্টি মিলে খেতে বসেছে। দাদুকে ঘুম থেকে তুলে তিয়াসা একটু খাইয়ে দিয়েছে। দাদু কোনমতে খেয়ে আবারও ঘুমিয়েছেন।

” শাহেদ বাবা, কাল থাইকাই তুমি অফিসে যাইবা? ”

” হুম, আন্টি। অনেকদিন তো ছুটি কাটালাম। এবার অফিসে না গেলে, আমাকে সসম্মানে অফিস থেকে বের করে দেবে। ”

” কয়টার দিকে বাসা থেকে বেরোবেন? আর আসবেনই বা কখন? ”

” সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত নয়টা। এবং প্রতি শুক্রবার তোমাকে বাজার করে দেব। শুক্রবার ছাড়া আমাকে বাসায় পাবেনা খুব একটা। ”

” এ্যাঁ! সারাদিন বাহিরে থাকবেন? ”

” তুমি বললে সারাদিন বাসায়ই থাকতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাকে চাকরিটা ছাড়তে হবে। ”

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। শাহেদ তিয়াসার রাগী মুখখানা দেখে হাসল।

***

” এই যে শুনুন, জানালা খুলে ঘুমালে কোন সমস্যা হবে? দখিনের মৃদুমন্দ বাতাস পেলে মন্দ হতোনা। ফ্যান, এসি কিছুই লাগবেনা তাহলে। ” তিয়াসা রুমে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল শাহেদকে।

” কোনও সমস্যা নেই। শুধু পাশের ফ্ল্যাট থেকে তোমাকে দেখা যাবে এই যা। ” শাহেদ নির্বিকারচিত্তে জবাব দিল।

” আপনি সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে জানেননা? এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেন কেন! পেঁচুক লোক একটা। ”

শাহেদ চুপচাপ তাকিয়ে আছে তিয়াসার দিকে। মেয়েটাকে রাগাতে মন্দ লাগেনা। তার রাগী মুখখানা দেখলে আদুরে লাগে। ভিষণই প্রেম প্রেম পায়।

তিয়াসাও লক্ষ্য করছে শাহেদ ওকেই দেখছে। হঠাৎই একরাশ লজ্জা এসে রাঙিয়ে দিল তিয়াসার সর্বাঙ্গ। সেদিন সেই যে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তারপর থেকে একবারও তার বুকে যাওয়া হয়নি। আজ হঠাৎই বুকের ভেতর আবেগ উথলে ওঠে। হানা দেয় একরাশ লজ্জা আর ভালোবাসা। ইচ্ছে করছে মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পরতে। কিন্তু লজ্জার কাছে হার মেনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল তিয়াসা। মনে মনে অনেক কথাই বলছে। কিন্তু সেই কণ্ঠনালী ভেদ করে শাহেদের কানে পৌঁছায়না। হয়তো কখনো পৌঁছাবেওনা। কথাটা মনে আসতেই রাগ চিড়বিড় করছে। দোষী মনে হচ্ছে শাহেদকেই। কেন সে তিয়াসার মনের কথা বোঝেনা? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হাসছে সে। কেন সে জোড় খাটায়না? কেন দু’জনের মধ্যে এত দূরত্ব আসতে দিল? একগাদা প্রশ্ন মাথায় জমা হতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিয়াসা। চোখ মুছতে মুছতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরল।

শাহেদ হতভম্ব হয়ে গেছে তিয়াসাকে কাঁদতে দেখে। মেয়েটার কি এমন হলো যে এমন হুটহাট কেঁদে উঠল, সেটাই বোধগম্য হলোনা শাহেদের। ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল খাটের পাশে। মেয়েটা তখনো ফোঁপাচ্ছে। শাহেদ তিয়াসার কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে নিল। যদি তিয়াসা কিছু মনে করে? সেইদিন হয়তো আবেগের বশেই মেয়েটা জড়িয়ে ধরেছিল। সেদিনের পর একবারও সেই কাজ করেনি। আজ শাহেদের স্পর্শ পেয়ে সে যদি ভাবে, শাহেদ সুযোগ নিচ্ছে? নানান প্রশ্নের দোলাচালে দুলছে শাহেদের মন-মস্তিস্ক। তারপর অনেক ভেবে তিয়াসাকে ডাকল,

” তিয়াসা, এই তিয়াসা? কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ করে কাঁদছ কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি? ”

শাহেদের ডাক শুনে তিয়াসা এক ঝটকায় উঠে বসল।

” না আপনি ভুল করবেন কেন? আপনিতো সাধু-সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী পর্যায়ের ব্যাক্তি। আর সাধু-সন্ন্যাসীরা কোন ভুলই করতে পারেনা। যা ভুল করার করেছি আমি। ” কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে মেয়েটার।

” এই দেখ কি বলছে এসব! আরে বাবা তুমি ভুল করলে কখন? এইতো একটু আগেই হেসে হেসে কথা বলছিলে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি ঘটল বলতো? ”

” কিছুই ঘটেনি। দোষী আমি, তাই আমি কাঁদছি। ”

” কিছুতো একটা ঘটেছে। কিন্তু আমি সেটা ধরতে পারছিনা। একটু বলে দাও, বাকিটা আমি বুঝে নিব। তবুও কেঁদনা, প্লিজ। তোমার এক এক ফোঁটা চোখের পানি আমার বুকে পাথরের মত আছড়ে পড়ে। ” ব্যাকুল গলায় বলল শাহেদ।

” কান্না থামালেই তো আমি আর কাঁদিনা। ” তিয়াসা ফোঁপাচ্ছে।

শাহেদ ভেবে পাচ্ছেনা তিয়াসার কান্না কিভাবে থামাবে। ছোট বাচ্চা হলে কোলে নিয়ে, খেলনা কিংবা চকলেট, আইসক্রিম দিয়ে নাহয় কান্না থামানো যায়। কিন্তু বড় বাচ্চার কান্না কিভাবে থামাতে হয় সেটা শাহেদের জানা নেই। তবে হাল ছাড়লনা সে। কিছুক্ষণ ভেবে তিয়াসাকে বলল,

” শপিংয়ে যাবে? চল কাল সকালে তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাই। তোমার পছন্দমত শাড়ী, সালোয়ার-কামিজ, জুয়েলারি যা খুশি কিনবে। যাও কালকের দিনটা তোমাকে দিলাম। তোমার ইচ্ছেমত যা খুশি করবে। এবার কান্না বন্ধ কর। ”

” আপনার না কালকে অফিস আছে? অফিস বাদ দিয়ে আপনি শপিংয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন? চাকরি চলে গেলে তখন কি করবেন? ”

” আর একটা দিন ছুটি নিয়ে নিব। আর যদি ছুটি না দেয়, তবে আমিই চাকরি ছেড়ে দেব। একটামাত্র বউয়ের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য যদি ছুটিই না পাই, তবে সেই চাকরির নিকুচি করেছি আমি। ”

” চাকরি চলে গেলে বউকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়ার টাকা কই পাবেন? নাকি আমাকে না খাইয়ে মারার ধান্দা করছেন! কি সাংঘাতিক মানুষ আপনি। অথচ আমি আপনাকে ভালো মনে করে এসেছি এতদিন। ” তিয়াসা এবার উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। ওর উদ্দেশ্য শাহেদকে ভড়কে দেয়া।

” এই এই আস্তে। এত জোড়ে কাঁদছ কেন! আশেপাশের সবাই শুনলে মনে করবে, তোমাকে আমি মারছি। আর শোন, আমার চাকরি না থাকলেও তোমার কোন সমস্যাই হবেনা। যতদিন অন্য চাকরি না পাব, ততদিন আমাদের শপিংমল থেকে যে ভাড়া পাই সেটা দিয়েই আরামসে চলে যাবে। মনে রেখ, আমি নিজেকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে দিতে পারব , নিজে না খেয়ে দিনের পর কাটাতে পারব। কিন্তু তোমাকে না খাইয়ে কষ্ট দেয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা এমনকি ভাবতে চাইওনা। আমি মানুষটা এতটা দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীন, নিষ্ঠুর নই। ”

” জানিতো, আপনি অনেক ভালো একটা মানুষ। মাঝেমধ্যে মনে হয় আপনার পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাই আমার নেই। আমার জন্য আপনি দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছেন, তবুও কোন অভিযোগ করেননি, জোড় খাটাননি, আমাকে অপমান করেননি। কেন ঘৃণা করলেননা? কেন করেননি বলুনতো? এতটা ভালো হওয়ার কি কোন দরকার ছিল? আমার প্রাপ্য শাস্তিটাই নাহয় আমাকে দিতেন। ” তিয়াসা এবার কাঁদছে শাহেদকে কষ্ট দেয়ার জন্য।

” তুমিওতো ভালোবেসেছিলে , তিয়াসা। তুমি কি পারতে তাকে কষ্ট দিতে, আঘাত করতে, কিংবা অপমান করতে? পারতেনা। কারন যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো আঘাত, অপমান, কষ্ট দেয়া যায়না। ভালোবাসার মানুষের প্রতি অভিমান জন্মে কখনোসখনো। কিন্তু ঘৃণা কখনোই আসেনা। ” শাহেদ ভাঙ্গা গলায় বলল। ও বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর আদ্র চোখ তিয়াসাকে দেখাতে চায়না।

” আপনার ভালোবাসা একতরফা ছিল। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো সেটা ছিলনা। তাই আমি হাজার চেষ্টা করলেও যাকে ভালোবাসতাম তাকে আঘাত, অপমান, কিংবা কষ্ট দিতে পারতামনা। কিন্তু আপনার সেই সুযোগ ছিল। সেটা কেন হাতছাড়া করলেন? ” তিয়াসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে। ও শাহেদের মুখ থেকে কিছু একটা শুনতে চাচ্ছে। যেটা শুনতে চাইছে বেশ কিছুদিন থেকেই।

তিয়াসার কথা শুনে ওর দিকে তাকায় শাহেদ। তবে তার আগে ভেজা চোখ মুখে নেয়।

” একতরফা হলে কি ভালোবাসা কমে যায়? নাকি সেই ভালোবাসায় জোড় থাকেনা? শোন, একতরফা হলেও ভালোবাসা ভালোবাসাই। তুমি আর রিফাত ভাইয়া দু’জন দু’জনকে যতটা ভালোবেসেছিলে, আমার একার ভালোবাসাও তার থেকে বেশি বৈ কম ছিলনা। হৃদয়ে একবার কারও জন্য ভালোবাসা জন্ম নিলে সেটা একতরফা কিংবা দ্বিপাক্ষিক সেটা ম্যাটার করেনা। ভালোবাসা তুলনা শুধু ভালোবাসাই হয়। অন্য কিছুর সাথে এর তুলনা চলেনা। ”

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা চমকে উঠল। ওর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই মানুষটা রিফাতের কথা জানল কিভাবে?

” আপনি রিফাত ভাইয়ার কথা জানলেন কিভাবে? আমিতো আপনাকে তার কথা আগে কখনোই বলিনি। ” তিয়াসার ভয় হচ্ছে, শাহেদ যদি ওকে ভুল বোঝে।

” যেদিন আমার শ্বশুর বাড়িতে রিফাত ভাইয়াকে দেখলাম সেদিনই। আমার মত ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই যে বুঝতে পারে। সেদিন তোমার চোখ, থেকে থেকে তোমার আড়ষ্ট হওয়া, রিফাত ভাইয়ার সামনে গেলেই তোমার অপরাধী ভাব দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম। ” শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।

” বিশ্বাস করুন, তার সাথে আমার এখন কোন সম্পর্কই নেই। বিয়ের পর ভাইয়ার সাথে আমার শুধু দুইবার দেখা হয়েছে। একবার পুলক ভাইয়ার বাসায়। আর এবার তার বিয়েতে। আমরা আলাদাভাবে একটা কথাও বলিনি। ” তিয়াসার বুক কাঁপছে। শাহেদের মনে কি চলছে সেটা ও বুঝতে পারছেনা। এই মানুষটা ওকে ভুল বুঝলে ও নির্ঘাত মারা যাবে।

” অন্যায় করেছ। বড় ভাইয়ের সাথে ছোট বোন হিসেবে দেখা করলে, কথা বললে দোষের কিছুই নেই। আমাকে এতটাও সংকীর্ণ মনের মানুষ মনে না করলেও পারতে। তুমি আগে রিফাত ভাইয়ার কথা আমাকে বলনি। এমনকি আমিও জানতে চাইনি। কারন আমি প্রয়োজন মনে করিনি। যে কারোর জীবনেই অতীত থাকতে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির পক্ষপাতী আমি নই। আমি বর্তমান এবং ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। ”

শাহেদের কথা শুনে হাঁফ ছাড়ল তিয়াসা। মানুষটার জন্য নিজের মনে হুট করে একটা ভালোবাসার ঘর গড়ে উঠল। সেই ঘরের প্রশস্ততায় ঢাকা পরল রিফাতের জন্য সযতনে রাখা জায়গাটুকু। তিয়াসাও চাইলনা সেই জায়গাটুকু নতুন করে উন্মোচিত হোক। সেটা থাকুকনা সযতনে ঢাকা। ঘৃণার ভারে তো আর চাপা পরলনা জায়গাটুকু। ভালোবাসার ভারেই পূর্ণ হয়ে থাকল।

” এখন যদি আমি আরেকটু কাঁদি, তবে কি আপনি রাগ করবেন? ” তিয়াসা মুখ কাঁচুমাচু করে জানতে চাইল।

” আবার কাঁদবে কেন! তুমি এত ছিঁচকাদুনি সেটাতো জানতামনা। ” শাহেদ অবাক হয়ে জানতে চাইল।

” না কেঁদে কি করব। বউ কাঁদলে জামাইয়ের দ্বায়িত্ব জড়িয়ে ধরে তাকে থামানো। কিন্তু আপনি সেটা একবারও করেননি। তাই আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা না করবেন, আমি কেঁদেই যাব। ” লাজলজ্জা ভুলে তিয়াসা বলেই ফেলল।

তিয়াসার কথা শুনে একগাল হেসে শাহেদ ওকে জড়িয়ে ধরল। ও অনুমতি পেয়ে গেছে। এত বছরের অধরা ভালোবাসা স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চাইছে। তাই কোন ভুল করলনা শাহেদ। বুকের ভেতর মিশিয়ে নিল তার রমনীকে। ও বুঝতে পারছে, আজকের রাতটা হয়তো গত সাতমাসের রাতের মত হবেনা। আজকের রাত হবে হৃদয় রাঙানোর রাত।

” আমিতো জানতামনা আমার বউ আমার ছোঁয়া পেতে মরিয়া। জানলে কি আর তাকে কাঁদাই। দুনিয়ায় সব পুরুষই বউয়ের ন্যাওটা। সে যতই বীর হোকনা কেন। আর আমিতো সামান্য একটা মানুষ। আমি আমার বউয়ের ন্যাওটা হব এটাতো জানা কথা। ”

শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা ওর বুকে চিমটি কেটে বলল,

” হয়েছে এত তেল দিতে হবেনা। বউয়ের মনের কথা যে পুরুষ বোঝেনা, সে আসলে পুরুষই নয়। ” তিয়াসার কথা শেষ হতে না হতেই শাহেদের বুকের মধ্যে ও যেন নিষ্পেষিত হতে থাকে। শাহেদের পুরুষালী হাত যেন ওর শরীরের প্রতিটি হাড় চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তিয়াসার।

” সুযোগ পাইনি বলে প্রমান করতে পারিনি আমি পুরুষ নাকি কঠিন পুরুষ। ভেতরের সিংহকে দমিয়ে রেখেছিলাম ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে। সেই সিংহ যদি একবার জেগে ওঠে তবে, তুমি তিয়াসা রেহাই পাবেনা। এতদিনের দেখ শাহেদের থেকে ভেতরের সিংহকেই কামনা করবে বারবার। তাই আগেই বলছি, ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দিওনা। ” ঘোর লাগা গলায় বলল শাহেদ।

” আমি এই মানুষটাকেও দেখতে চাই আবার ঘুমন্ত সিংহকেও জাগাতে চাই। দেখতে সেই সিংহ তিয়াসার ভালোবাসায় জেগে ওঠে কিনা। ” কথাটা বলেই তিয়াসা মুখ গুঁজল শাহেদের বুকে। ওর ভিষণ লজ্জা লাগছে।

শাহেদ ঠোঁট কামড়ে হেসে তিয়াসার কপালে চুমু দিল। মেয়েটা অবশেষে ধরা দিয়েছে। অবশেষে রঙিন হতে চলেছে শাহেদের জীবনের প্রতিটি রাত। জীবন হতে চলেছে ভালোবাসাময়।

” কালকেও তাহলে অফিস মিস করতে হচ্ছে? ” দুষ্টু হেসে বলল শাহেদ।

” কেন? ”

” তোমার সিংহ সারারাত নিজেও ঘুমাবেনা আর তোমাকেও ঘুমাতে দেবেনা। রাতের ঘুম দিনে পুষিয়ে নিব। কি বল? ”

লজ্জায় তিয়াসা মুখ নিচু করে রাখল। শুধু ছোট্ট করে বলল,

” অসভ্য পুরুষ। ”

” পুরুষ নাকি কঠিন পুরুষ সেটা আজই প্রমান হয়ে যাবে। ”

তিয়াসা কোন উত্তরই দিতে পারলনা। আটকা পরল শাহেদের কঠিন বাঁধনে।

চলবে…