রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৬১

0
152

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৬১
জাওয়াদ জামী জামী

” বেটা, আমাকে ঢাকা যেতে হবে। পুষ্পিতার শ্বশুর এক্সিডেন্ট করেছে। আইসিইউতে রাখা হয়েছে তাকে। ”

মল্লিকা মির্জার কথা শুনে পুলক বেশ চমকায়।

” কি বল, আম্মু! কখন এক্সিডেন্ট হয়েছে? আমিতো কিছুই জানিনা। ”

” আমিও মাত্রই শুনলাম। পুষ্পিতা ফোন দিয়েছিল। ওরা ও জানতনা। রাস্তা থেকে লোকজন তাকে মেডিকেলে নিয়ে গেছে। তারাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। বেয়াইয়ের ফোনে পাসওয়ার্ড দেয়া থাকায় তারা কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেকক্ষণ পর পুষ্পিতার শ্বাশুড়ি তাকে ফোন দিলে কেউ একজন রিসিভ করে তাকে জানায়। ”

” তুমি তাড়াতাড়ি যাও, আম্মু। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। আমার এদিকের ঝামেলা মিটলে আমিও গিয়ে আংকেলকে দেখে আসব। ”

” ওকে, বেটা। তুমি আমার সোনামণির খেয়াল রেখ। ওকে রেখে বেশিক্ষণ বাহিরে থাকবেনা কেমন? আর বউমা, আমি যে কয়দিন না আসব, তুমি রুম থেকে বাহিরে যাবেনা। আমার কলিজার দিকে নজর রাখবে। গোসল, খাওয়াদাওয়া ছাড়া পানি নাড়বেনা। নিজের যত্ন নিবে। ”

মল্লিকা মির্জা আয়াসকে আদর করলেন। আশফি ওর শ্বাশুড়িকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। কোন শ্বাশুড়ি এতটাও ভালো হয়!

” আপনি চিন্তা করবেননা, মা। আমি আপনার ছেলের, নাতির এবং নিজের খেয়াল রাখব। আংকেল যতদিন সুস্থ না হয়, ততদিন আপনি পুষ্পিতার কাছেই থাকবেন। ”

” তোমরা দুই বোন মিলেমিশে থেক। আমি না আসা পর্যন্ত তিয়াসাকে যেতে দিওনা। আমি তিয়াসাকে বলে যাচ্ছি। শাহেদকেও বলব। ”

মল্লিকা মির্জা আধাঘন্টা পরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

***

” বডির ব্যবস্থা করেছিস, শাহেদ? ”

” হুম। ওকে পুঁতে দিয়েছি, ভাই। ”

” কেউ দেখেনিতো? ”

” চিন্তা করোনা। শালা পঁচে মাটিতে মিশে সার হয়ে যাবে। শুধু সময়মত কংকাল তুলে বঙ্গোপসাগরে ফেলে আসলেই হবে। আমরা তিনজন ছাড়া এই খবর কেউই জানবেনা। ”

” গুড। শোন, তুই কয়েকটা দিন সাবধানে থাকবি। আর আমাদের ছেলেদেরও চোখ-কান খোলা রাখতে বলবি। আমরা কেউই নিরাপদ নই। ”

” তুমি আমার কাছে কি লুকাচ্ছ, ভাই? আমার মনে হচ্ছে তুমি অনেক কিছুই জানো। কিন্তু আমাদের কাছে প্রকাশ করছনা। অথচ ভেতরে ভেতরে ঠিকই গুমরে মরছ। ”

” সব কথা শুনতে নেই রে। এমন অনেক কথা আছে যেগুলো শুনলে শুধু কষ্টই বাড়বে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবেনা। মনে হবে, এসব না ঘটলেই ভালো হত। ”

” ভাই! এসব কি তুমিও ভাব? তারমানে শত্রু সাধারণ কেউ নয়! ”

” কোন শত্রুই কখনো সাধারণ হয়না। তারা হয় দুর্দান্ত মেধাবী আর প্রতিহিংসাপরায়ন। তবেইনা হাসিমুখে কারও বুকে আঘাত করতে পারে। আবেগের ধারেকাছেও যায়না তারা। তারা নিজের স্বার্থে একের পর এক নিকৃষ্ট সব গেইম খেলে থাকে। আর সেই গেইম শেষ হয় কারও অন্তের মধ্যে দিয়ে। এই গেইমে বিজয়ী শুধু একজনই হয়। আর এখানে বিজয়ী হব আমি। তুই দেখে নিস। ”

” তুমি এখনও আমার কাছে সবকিছু গোপন করবে? একা একা আর কত কষ্ট ভোগ করবে, ভাই? তোমার দিকে তাকালে আমার খারাপ লাগে। ”

” বাদ দে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই তিয়াসাকে নিয়ে ইন্ডিয়া কবে যাবি? এক কাজ করিস, আম্মু ঢাকা থেকে ফিরলেই যাস। আশফি ছেলেকে নিয়ে একা একা সংসার সামলাতে পারবেনা। ”

” মামী ফিরলেই যাব। তুমি কি করে ভাবলে, ভাবীকে একা রেখে আমি বউ নিয়ে ইন্ডিয়া যাব! আমি চিন্তা করছি তিয়াসা চ্যাম্পকে না দেখে কিভাবে থাকবে। ”

” তুই চাকরি ছাড়লেও পারিস। এখানে এসে ফুপার বিজনেজ দেখলেই কিন্তু হয়। সে তো আর কম প্রপার্টি রেখে যায়নি। ”

” এবার মনে হচ্ছে সেটাই করতে হবে। তিয়াসা ক্লিয়ার বলে দিয়েছে চ্যাম্পকে না দেখে ও থাকতে পারবেনা। এখন থেকে আমাকে নাকি একা থাকতে হবে ঢাকায়। ”

শাহেদের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল পুলক। বেচারা বউ ছাড়া থাকতে হবে ভেবে এখন থেকেই চিন্তিত।

***

” বউমা, আমাদের জুনিয়র মির্জা কোথায়? তাকে দেখার জন্য আমি ছুটে এসেছি। ”

হুট করেই কমরান মির্জাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে আশফি। তিনি আসবেন অথচ কাউকে জানাননি!

” চাচ্চু, আপনি! ”

” হুম আসলাম। এতদিন অসুস্থ ছিলাম, সেজন্য আমাদের জুনিয়রকে দেখতে আসতে পারিনি। তাই সুস্থ হয়েই ছুট লাগালাম। পুলক কোথায়? ”

” আপনার জুনিয়র ঘুমাচ্ছে। আর উনি বাসায় নেই। আপনি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি। ”

” আমার সাথে কয়েকজন কর্মী দেখা করতে আসবে। তুমি তাদের আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা করো। অনেকদিন পর দেশে এসেছি, তাই ওরা বাসায়ই আসবে। ”

কামরান মির্জা রুমে গেলে আশফি ওদের হেল্পিং হ্যান্ডকে খাবার তৈরী করতে বলল। নিজেও রান্নাঘরে গেল। তিয়াসা বাসায় নেই। ও শাহেদের সাথে কোনও এক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনে গেছে। ওদের ফিরতে রাত হবে। তিয়াসাকে ছাড়া ওর একা একা কাজ করতে বেশ কষ্টই হবে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর ১০ জন কর্মী আসল কামরান মির্জার সাথে দেখা করতে। আশফি ততক্ষণে রান্না শেষ করে ফেলেছে। কামরান মির্জা আয়াসকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। কর্মীরা আসলে তিনি আয়াসকে আশফির কাছে দিলেন।

***

আশফি মেইডদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে রুমে এসেছে। ও বাহিরের লোকজনের সামনে যেতে চাচ্ছেনা। মেইডরাই খাবার পরিবেশন করবে।
রুমে এসে পুলককে ফোন দিল। কিন্তু তার ফোন সুইচড অফ থাকায় কথা বলা হলোনা। মন খারাপ করে ছেলের সাথেই একতরফা গল্প করতে শুরু করল।

রাত আটটার দিকে পুলকের গাড়ি বাসায় ঢুকল। ও গাড়ি থেকে নেমে দরজায় এসে কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর একজন অচেনা লোক এসে দরজা খুলে দেয়। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় পুলক।

” এই আপনি কে? বাসায় ঢুকেছেন কেন? ” চারপাশে তাকিয়ে আশফিকে খোঁজার চেষ্টা করল পুলক।

” ওয়েলকাম, বেটা। এ আমারই লোক। ”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকায় পুলক। কামরান মির্জাকে বেশ অবাক হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।

” তুমি? কখন আসলে? জানাওনি যে? ”

” এসেছি আরও ঘন্টা তিনেক আগে। তোমাদের সারপ্রাইজ দেব বলে আগে জানাইনি। ”

” এখন সুস্থ আছ তো? ” পুলক ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেছে।

” একদম ফিট আছি। ”

” ওকে, তুমি তাহলে রেষ্ট নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। বাই দ্য ওয়ে, মেইডরা সবাই কোথায়? কাউকে দেখছিনা যে? ”

” ওদেরকে ছুটি দিয়েছি। অনেকদিন নাকি ছুটি পায়না ওরা? ”

পুলক কিছু না বলে দ্রুত গতিতে সিঁড়ি ভেঙে নিজের রুমে যেতে থাকে।

নিজের রুমে আশফি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ওর সামনে পিস্তল নিয়ে বসে আছে রাকিব। যাকে পুলক আপন ভাইয়ের মতই ভাবে। যে পুলকের গ্যাংয়ের একজন সদস্য।

” রাকিব, তুই! তোর এতবড় সাহস আমার স্ত্রী-সন্তানের দিকে পিস্তল তুলেছিস? অথচ এতবছর তোকে আমি আপন ভাইয়ের মতই ভেবে এসেছি! আজ তোর এই দুঃসাহস তোরই মৃত্যু ডেকে এনেছে । ” কথাটা বলেউ পুলক এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। সেখানে ওর ওয়ালথার পিপিকে রাখা আছে।

” এক পা-ও নড়োনা, পুলক মির্জা। কাম ডাউন। এত রাগ করছ কেন? জানো তো দুনিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু হচ্ছে টাকা? কামরান মির্জা আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে। তোমার থেকেও বেশি। আর সেজন্যই তোমার স্ত্রী-সন্তানের দিকে আমার পিস্তল উঠেছে। ”

” বেইমান। তোর পরিবারের জন্য আমি কি করিনি? তোর তিনটা বোনকে আমার পরিচয় দিয়ে বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছি, তোর ভাইরা আজ ভালো পজিশনে আছে শুধুমাত্র আমার জন্য।
তোর বাবা-মা কে আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে সমাজের উঁচু স্থানে বসিয়েছি আমি। আর তুই বলছিস আমি কিছুই করিনি! ”

” এসব তুমি আমার বাবা-মা, ভাইবোনদের জন্য করেছ। আমার জন্য কি করেছ? বছরের পর বছর তোমার সাথে গুন্ডামী করে গেছি বিনিময়ে কয়টা টাকা ছাড়া কি দিয়েছ? কিন্তু তোমার চাচ্চু আমার দু হাত ভরে দিয়েছে। ”

” তোকে আমি কিছুই দেইনি! তোর বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংকে ডিপোজিট এগুলো কোথায় থেকে এসেছে? আরে বেইমান তুই এটা স্বীকার কর যে, একসাথে অনেকগুলো টাকা দেখে তোর মনে লোভ জেগেছিল। আজ তোর বেইমানীর শাস্তি ঠিকই পাবি। শত্রুকেও আমি ক্ষমা করে দেই কিন্তু বেইমানকে নয়। ” গর্জে উঠল পুলক।

” কুল কুল কুল। এই রাগই তোমাকে ডোবাবে আমার প্রিয়, ভাতিজা। অথচ তোমার জানা নেই তোমার রাগই আমার অস্ত্র। ”

কামরান মির্জাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাঁকা হাসল পুলক।

” অবশেষে নিজের জাত চিনিয়ে দিলে, কামরান মির্জা? তুমি তো দেখছি তোমার পূর্বপুরুষের মতই বেইমান! তোমার দাদু তার ভাইদের সাথে যেটা করেছিল, তুমিও সেটাই করলে! আসলে তোমার রক্তেই বেইমানী আছে বুঝলে? আহা তোমার রক্ত বলছি কেন? আমিও তো তোমার বংশের রক্তই বহন করছি। এজন্য মাঝেমধ্যে নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে, বুঝলে? ”

পুলক এত তাড়াতাড়ি সব বুঝতে পারায় একটু অবাকই হলেন কামরান মির্জা। তিনি চেয়েছিলেন পুলককে চমকে দিতে, কিন্তু সেটা আর করা হযে উঠলনা।

” নিজের লক্ষ্যের পথে বাঁধা থাকলে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী থাকলে সেটা অতিক্রম করতে হয়, বেটা। আর সেই পথ অতিক্রম করতে গেলে অনেক সময় কিছু কিছু কাঁটা উপড়ে ফেলতে হয়, আমি সেটাই করেছি। আর ভবিষ্যতেও করব। ভালো কথা, তুমি এই অসময়ে আমাকে দেখে অবাক হওনি? কিংবা আমার এই নতুন রূপ দেখে চমকাওনি? ”

” একটুও অবাক হইনি। আমি জানতাম তুমি দেশে আসবে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা বুঝতে পারিনি। এবার মূল কথায় আসা যাক, আমার আব্বু তোমার পথের কাঁটা ছিল? আর আমিও? কিন্তু আমার জানামতে, আমি কিংবা আব্বু কেউ তোমাকে প্রতিদ্বন্দী মনে করিনি। আমি চিরকাল তোমাকে আমার হিরো বলে মেনে এসেছি। কিন্তু তুমি! তুমি কখনোই ভালবাসনি আমাদের। আচ্ছা আব্বু নাহয় তোমার প্রতিদ্বন্দী ছিল, কিন্তু আমি? আমিতো ছিলামনা। তবে কেন তুমি আমার ভবিষ্যৎ, ক্যারিয়ার সব নষ্ট করে দিলে? স্কলারশিপ নিয়ে বাহিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি রাহুর মত আমার কাঁধে ভর করে থাকলে। সেখানেও নিজের লোক দিয়ে আমাকে নষ্ট করতে চাইলে। মদ, জুয়ায় আসক্ত হয়ে দিনরাত পরে রইলাম বারে। স্কলারশিপ আর হলোনা। কেন, এমন করলে? ”

” বাহ্ সব জেনে গেছ দেখছি! আ’ম ইমপ্রেসড। তা আর কি কি জানো, বেটা? ” কামরান মির্জার মুখ থেকে হাসি সরছেনা।

” আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি, কামরান মির্জা। ” থমথমে গলায় বলল পুলক।

” ওহ হ্যাঁ, আমি চাইনি তুমি আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে যাও। ছোট থেকেই তুমি ওর থেকেও ট্যালেন্ট ছিলে। আর এটা নিয়ে আমি সব সময়ই দুশ্চিন্তা করতাম। আর ঐ স্কলারশিপটা তোমার লাইফ পাল্টে দিত, তাই আমি চাইনি তুমি সেটা শেষ কর। এজন্য ডিয়েগোকে তোমার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, এটাতো কারও জানার কথা নয়! তুমি কিভাবে জানলে? আবার আতিকের মৃত্যুর কারন যে আমি এটাও জেনে গেছ! কিভাবে? ”

” তুমি তো অসুস্থ ছিলেইনা। কানাডা থেকে আমাকে মারার প্ল্যান করছিলে মাত্র। তোমার পারসোনাল ডক্টর লিন্ডা জেসনের সাথে আমার সুসম্পর্ক আছে এটা বোধহয় তোমার জানা নেই। দু-চার মাসে এক-আধবার তার সাথে কথা হয় আমার। আর এভাবেই আমার এক্সিডেন্টের কথা সে জানতে পারে। আমাকে নক দিয়ে সে জানতে চাইলে, কথার মাঝেই আমি জানতে পারি তুমি পুরো সুস্থ আছ। কোন অসুখই তোমার হয়নি। সন্দেহ জিনিসটা খুব খারাপ এটাতো জানো? তাই আমি বন্ধুর বিয়ের নাম করে জোহানসবার্গ গেলাম। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ড। সেখানে গিয়ে সেই বারে খোঁজ নিলাম, একে একে খুঁজে বের করলাম পুরোনো বার মেম্বারদের, পুরোনো সব বন্ধুদের। এভাবেই ডিয়াগোর খোঁজ পেয়ে গেলাম। এরপর একে একে সবকিছুই জানতে পারলাম। আর এ-ও জানলাম, আব্বুকে মারার জন্য মাহমুদকে তুমিই কন্ট্রাক্ট দিয়েছিলে। এবং মাহমুদকে তুমিই মেরে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছ। এরপর সুযোগ বুঝে আমি তোমার ফোন, ইনসট্রা, ফেসবুক, ব্যাংক একাউন্ট সব হ্যাক করলাম। ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। কিন্তু তুমি সেটা জানতেও পারলেনা। এভাবেই সুজনের খোঁজ পেলাম। তুমি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলে তোমার ভাতিজা একজন হ্যাকার। তোমার মত পঞ্চাশটা এমপির সবকিছু হ্যাক করতে আমার কয়েক মিনিট সময় লাগবে মাত্র। ”

” চমৎকার! এই না হলে আমার ভাতিজা! তুমি সুপার ট্যালেন্টেড সেটা আমি জানতাম। আজ আবারও আমার ধারনাকে সঠিক প্রমান করলে তুমি। কিন্তু তোমার এই প্রতিভাই তোমার মৃত্যুর কারন হবে, পুলক মির্জা। আমি তোমার পুরো পরিবার শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস মল্লিকা আর পুস্পিতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবে ওদেরকেও মারব ঠিকই। কিন্তু একটু দেরি হবে এই যা। ” কামরান মির্জা এমনভাবে বললেন যেন তিনি ভিষণ মজা পাচ্ছেন।

” আমার পরিবারের ওপর তোমার এত রাগ কিসের? ” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল পুলক।

” রাগ নয় ঘৃণা। আমার শ্রদ্ধেয় আব্বা আমার থেকে আতিককে বেশি ভালোবাসত। আমার স্ত্রী-সন্তানদের থেকে তোমাদের বেশি ভালোবাসত। দিনে দিনে আমার রাগ ঘৃণায় পরিনত হয়েছে। ”

” আমার আম্মু চিরকাল দাদুদের সেবা করেছে। কখনো তাদের সাথে অসম্মানজনক কথা বলেনি। কিন্তু তোমার স্ত্রী বিয়ের ছয়মাস পর থেকেই কানাডা থাকত। দাদুর প্রতি সম্মানের ছিঁটেফোঁটাও তার মধ্যে ছিলনা। দাদু বিপদআপদে আমার আম্মুকে পাশে পেত। আমি ছিলাম দাদুর ভরসার হাত। কিন্তু তোমার ছেলেমেয়েরা কখনো দাদুর পাশে বসে দুদণ্ড হেসে কথা বলেছে? তুমি কখনো দাদুর পাশে বসে তার শরীরের কেমন জানতে চেয়েছ? নিজের বিবেকবোধ মজবুত থাকলে তোমার মনে এত নিকৃষ্ট চিন্তা আসতনা। একটু গভীরভাবে ভাবলেই বুঝতে দাদু কেন আমাদের দিকে ঝুঁকেছিল। ” পুলক রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ও পারলে এখনই কামরান মির্জার বুকে বুলেট ঢুকিয়ে দিত। কামরান মির্জার ভাগ্য ভালো পুলকের হাতে এখন কোন পিস্তল নেই। পুলকের আফসোস হচ্ছে ভিষণ।

” বাহ্, চমৎকার ভাষণ দিয়েছ। এখনতো দেখছি তোমার কাছ থেকে ম্যানার্স শিখতে হবে আমাকে! ” হাততালি দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন কামরান মির্জা।

দু’জনের কথপোকথন শুনে আশফি অবাক হয়ে গেছে। এই মানুষটাকে চিন্তে ও ভুল করেছে! যাকে এই বাড়ির সবাই বাবার শ্রদ্ধা করেছে, সেই মানুষটাই ওর সংসারে অশান্তির জন্য দায়ী! এবার আর সহ্য করতে পারলনা আশফি
একরাশ ঘৃণা নিয়ে কামরান মির্জাকে বলল,

” ছিহ্ আপনি এতটা জঘন্য? নিজের ভাইকে মারতে আপনার একটুও বুক কাঁপেনি? যে ভাতিজা আপনাকে বাবার চোখে দেখে সেই ভাতিজাতেও মারতে চেয়েছেন আপনি। আপনি কি মানুষ? আপনাকে মানুষ বললেও সমগ্র মানবজাতিকে অপমান করা হয়। মানুষের চেহারায় একটা জানোয়ার আপনি। আপনার মত সন্তান যেকোনও পিতামাতার জন্য অসম্মানের
। আপনার মত মানুষের দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। ” আশফি এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিল কামরান মির্জাকে লক্ষ্য করে।

আচমকা থুথু শরীরে লাগায় রেগে গেলেন কামরান মির্জা। তিনি কোনকিছু না ভেবেই গুলি চালান আশফিকে লক্ষ্য করে। কামরান মির্জার এমন কাজে প্রচন্ড অবাক হয় পুলক। ও ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে আশফির দিকে। বিষয়টা ওর বোধগম্য হয়নি। কয়েক মুহুর্ত পর স্বম্বিৎ ফিরতেই পাগলের মত ছুটে যায় আশফির দিকে। আশফি পেট চেপে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর শরীর সেই সাথে মেঝেও।

” চু চু চু চু সরি, বেটা। তোমার স্ত্রী একটু বেশিই বলে ফেলেছিল। তার জানা নেই কামরান মির্জা নিজের নামে দূ্র্নাম শুনতে অভ্যস্ত নয়। এমনিতেই তাকে মরতে হত। কয়েক মিনিট আগে মরেছে এই যা। ” কামরান মির্জার কথায় অনুশোচনার লেশমাত্রও নেই।

কামরান মির্জার কথাগুলো পুলকের কানে যায়না। ও আশফিকে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে।
চুমু দিল তার চোখেমুখে। কান্না জড়ানো গলায় ব,

” আশফি, এই আশফি, চোখ খোল। কথা বল আমার সাথে। তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা? তোমার কথা রাখার দিন এসেছে আজ। ”

কিন্তু আশফি পুলকের কথার কোনও জবাব দিলনা। ওর দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। কয়েকবার ঠোঁট নাড়াল কিন্তু কোন শব্দ বের হলোনা। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। শুধুমাত্র একবার হাতের ইশারায় আয়াসকে দেখাল।

আশফিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে পুলক।

” গেট আপ, পুলক মির্জা। এবার তোমার পালা। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। তবে আগে তোমার সামনে তোমার ছেলেকে মারব, এরপর তোমাকে। স্ত্রী’র জন্য তোমার চোখের পানি দেখলাম। এবার সন্তানের জন্য কতটা কাঁদতে পার সেটাই দেখতে চাই। ”

সন্তানের কথা শুনে হুঁশ ফিরল পুলকের ও আশফিকে রেখে দ্রুত পৌঁছে যায় আয়াসের কাছে। ছেলেটা পিটপিটিয়ে তাকিয়ে আছে। জগৎ-সংসারের কোন কিছু সম্পর্কেই তার ধারনা নেই। ও বুঝতেও পারলনা, একটু আগেই সে মা’কে হারিয়েছে। হয়তো আর কিছুক্ষণ পর সে নিজেও অতীত হয়ে যাবে।

পুলক ছেলেকে কোলে নিয়ে কামরান মির্জার দিকে ফিরল।

” তুমি কাপুরষ। আর কাপুরষরাই কোন নিরস্ত্র মানুষকে আচমকা আক্রমন করে। কি ভেবেছ, আমার স্ত্রীকে মেরেছ আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব? আমার সন্তানের দিকে নজর দিয়েছ, তুমি রেহাই পাবে আমার হাত থেকে? আরে কাপুরষ সবাই তোমার মত ভীতু নয়। তুমি ভীতু বলেই দলবল নিয়ে ঢুকেছ নিজেরই বাড়িতে। পেছন থেকে আক্রমন করেছ। ”

পুলক এগিয়ে যায় কামরান মির্জার দিকে। ও কামরান মির্জাকে গলা টিপে মারতে চাইছে। কিন্তু রাগের বশে করা ভুলটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কামরান মির্জা ওর পায়ে গুলি করল।

” এবার তোমার পালা। গুড বাই , বেটা। হ্যাপি জার্নি। ” ঠিক তখনই কামরান মির্জার ফোন বেজে উঠল। বিরক্তিকর একটা শব্দ বেরিয়ে আসল মুখ থেকে।

” তোমার জীবনের মেয়াদ আর কিছুক্ষণ বাড়ল, বেটা। ততক্ষণ তুমি মৃতা বউয়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাও। আমি একটা কাজ সেরে আসছি। তখন তোমার সব হিসেব মিটিয়ে দেব। ”

” তুমি আমাকে বেটা বলে ডেকোনা। এতে পৃথিবীর সকল বাবার অসম্মান হবে। ”

কামরান মির্জা পুলকের কথার উত্তর না দিয়ে বাঁকা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার পিছুপিছু রাকিবও বেরিয়ে গেল।

চলবে…