প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০১

0
4

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#সূচনা_পর্ব

গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে পালকি টা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে।পালকিতে বসে আছে সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ হৈমু। নতুন বউ পালকির পর্দা দিয়ে হাত সরিয়ে বাইরে উঁকি মারছে।পালকির ভেতর আরো একজন আছে।নব বিবাহিত স্ত্রীর স্বামী বীর প্রতাপ।নব বিবাহিত মেয়েটি তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবকিছু যেন কল্পনার মতো লাগছে।হৈমু একটা নিচু বংশের মেয়ে অন্য দিকে বীর প্রতাপ জমিদার।সেই হৈমু এখন এই প্রতাপ গড়ের জমিদার বীর প্রতাপের নব বিবাহিত স্ত্রী। জমিদারের বয়স চল্লিশার্ধো। অন্যদিকে হৈমুর বয়স মাত্র তেরো বছর।হৈমু একটু অবাক হয় এত বড় জমিদার তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে বলে।হৈমু ছেলেবেলায় বাবা মা কে হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে।মামির সংসারে মামির অত্যাচার সহ্য করেই হৈমুর বড় হওয়া‌।সেই হৈমু আজ জমিদার বাড়ির বউ জমিদার গিন্নি। ভাবলেই সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগে। হৈমু চাকরানীর মুখে শুনেছে বীর প্রতাপের কোন সন্তান হচ্ছে না।হৈমু বীর প্রতাপের তিন নম্বর স্ত্রী। জমিদার বাড়ির লোকজন কবিরাজের উপর বেশি বিশ্বাস অনেক বেশি।কবিরাজ জানিয়েছে তাদের পরিবারের উপর এক অভিশাপ আছে।তেরো চৌদ্দ বছরের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। অভিশাপে কথা শুনে কেউ মেয়ে দিতে রাজি হয় না বলে বীর প্রতাপ নীচু পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করছেন।হৈমু বেশ সুন্দরী ও দয়ালু।মেলায় মামা মামীর সাথে ঘুরতে গেলে হৈমু বীর প্রতাপের নজরে সহজে চলে আসে।হৈমু সুন্দরী হওয়ায় বীর প্রতাপের হৈমুকে পছন্দ করে ফেলে।এই ঘটনার দুইদিন পর বীর প্রতাপ আর হৈমুর বিয়ে হয়।

পালকি বাড়ির সামনে প্রবেশ করে।বীর প্রতাপ হৈমুকে হাত ধরে পালকি থেকে নামায়।হৈমু জমিদার বাড়ি থেকে চোখ কপালে উঠার উপক্রম।এত বড় বাড়ি হৈমু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।অথচ আজ হৈমু এই বাড়ির বউ।বাড়ির সামনে মানুষের এক অদ্ভুত মুর্তি রাখা আছে। মুর্তির মুখ শিয়ালের মতো আর নগ্ন পশ্চাৎ সাপের লেজের মতোন বেঁকে রয়েছে।হৈমুর কাছে মনে হয় মুর্তি গুলোর চোখ একদম জীবন্ত। কেমন যেন ধূসর বর্নের চোখ।বীর প্রতাপ হৈমুর হাত ধরে বলল, “চলো ভেতরে যাই”

হৈমু বীর প্রতাপের হাত ধরে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতে লাগলো। চারপাশে কাজের লোকেরা ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ বীর প্রতাপ থেমে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে হৈমুর শাশুড়ি।দূরে হৈমুর দুই সতীন দামী শাড়ি গয়না পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউ দেখার জন্য এসেছে।হৈমুর বুঝতে অসুবিধা হয় এরা দুজন কোন জমিদার পরিবারের মেয়ে।

বীর প্রতাপ বলল, “এই দুইদিন আমাদের অনেক ধকল গেছে।ওকে নিয়ে গেলাম আমাদের বিশ্রাম দরকার। তাড়াতাড়ি বধূ বরন সেরে নাও”

জমিদার মাতা কিছু বলল না।খুব অল্প সময়ের মধ্যে বধূবরণ সেরে নিলো।বধুবরন শেষে হৈমুকে নিয়ে আসা হলো দোতলায় এক বিশাল ঘরে।হৈমু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল করলো তার বাকি দুই সতীন তার দিকে হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হৈমু ভয় পেয়ে তার নব বিবাহিত স্বামীর হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দোতলায় বীর প্রতাপের ঘর।হৈমু এখন থেকে এখানেই থাকবে।বীর প্রতাপের ঘর হৈমুর পুরো মামার বাড়ির সমান।বিশাল ঘরটায় অনেক সুন্দর আসবাবপত্র আছে।ঘরের একপাশে বিশাল একটা ঝুলন্ত দোলনা রাখা আছে।তার পাশেই বিশাল বড় একটা বারান্দা। বারান্দায় পাশে একটা কদম ফুলের গাছ।তাতে অসংখ্য কদম ফুল ফুটে আছে।

হঠাৎ ঘরের ভেতর কয়েকজন চাকর প্রবেশ করলো।এদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বলল, “এখন থেকে আমি আপনার ব্যক্তিগত দাসী । আপনার যা লাগবে আমাকে বলবেন। আমার নাম নিসা। আপনি আমার নাম ধরে ডাকলে আমি চলে আসবো”

নিসার সাথে আরো কয়েকজন কাজের লোক ছিল। তাদের হাতে রুপার থালায় দামী কাপড় আর গয়না।নিসা হৈমুর পড়ার জন্য কাপড় রেখে বাকি জিনিস পত্র আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো। নতুন জমিদার গিন্নির জন্য নতুন আলমারি আগেই আনা হয়েছে।

নিসা বলল, “এখন আপনাকে জমিদারের জন্য তৈরি হতে হবে। আপনি অনেক দূর থেকে এসেছেন।আমরা গোসলের সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

হৈমু বলল, “হ্যা”

নিসা হৈমুকে গোসল খানায় নিয়ে এলো।গোসল খানা বেশ বড়।হৈমু গোসল খানার আশেপাশে ভালো ভাবে দেখতে লাগলো।
নিসা বলল, “এটা জমিদার বীর প্রতাপের ব্যক্তিগত গোসল খানা। প্রথমে বড় গিন্নি এরপর মেজো গিন্নি। এখন আপনি উনার ছোটো গিন্নি।এটা এখন আপনার। এখানে বাইরের কারোর আসার অনুমতি নেই।যেহেতু আমি আপনার ব্যক্তিগত দাসী তাই আমি শুধু আপনার গোসলের সময় অল্প সময়ের জন্য ভেতরে আসতে পারবো।আমি সব গুছিয়ে রেখেছি। আপনি গোসল করুন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিবেন”

নিসা বাইরে চলে গেল।এমনিতেও কারো সামনে হৈমু গোসল করতে পারবে না।

গোসল খানা খেতে বেরোতেই সব দাসীরা হৈমুর দিকে এগিয়ে এলো।দামী পোশাক আর অলংকার পড়িয়ে আজ রাতের জন্য তৈরি হতে হবে।

হৈমুকে সাজিয়ে দেয়া এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হৈমু নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না।হৈমু যেন কোন রাজ্যের রানী।নিজেই লজ্জায় আয়না থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। হঠাৎ দরজায় আরো উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।সব দাসী একে একে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার বাইরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।হৈমু খাটের উপর বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে দুরে একটা ময়লায় জরাজীর্ণ একটা পুকুর দেখা যায়।মনে হচ্ছে কয়েক যুগ হবে এটা এইভাবে পড়ে আছে। হঠাৎ হৈমুর কোমরে কোন পুরুষালির ছোঁয়া পাওয়া যায়।হৈমু বুঝলো এ তার স্বামী।হৈমু তার স্বামীর দিকে তাকায়।বীর প্রতাপ এক ঝটকায় বিছানা থেকে উঠে জানালা বন্ধ করে দেয়।বন্ধ করেই হৈমুর পাশে গিয়ে বসল।একটু লজ্জা পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল।বীর প্রতাপ হৈমুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই দিকের জানালার খোলা যাবে না।দিনে কিংবা রাতে।ওইযে ওখানে জরাজীর্ণ পুকুর দেখছো ওটা ভালো নয়।ওটা একটা অশুভ জায়গা।দিনের বেলায় মাথায় কাপড় দিয়ে বারান্দায় যাওয়া যাবে কিন্তু সন্ধ্যার হবার আগেই ঘরে ফেলত চল আসবে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিবে। সন্ধ্যার পর কোনভাবেই যেন বারান্দার দরজা খোলা না থাকে।মনে থাকবে তো?”

হৈমু বলল, “থাকবে”

বীর প্রতাপ বলল , “তোমাকে বিয়ে করেছি কেন জানো ?”

হৈমু তার স্বামীর মুখ পানে চেয়ে রইলো।বীর প্রতাপ বলল, “আমি তোমাকে বিয়ে করেছি সন্তানের জন্য। জমিদার পরিবারে তো সন্তান ছাড়া থাকতে পারে না। আমাদের উপর পুর্ব পুরুষের নাকি একটা অভিশাপ আছে।যেটা অনেক বছর ধরে চলে আসছে। আমার দুই স্ত্রীকে সাবধান করেছি তবুও তারা আমার কথা শুনেনি । নিষিদ্ধ স্থানে চলে গেছে। তুমি আমার শেষ ভরসা। আমি চাই তুমি আমাকে সন্তানের মুখ দেখাও।তাই সবসময় আমার কথা মেনে চলবে। তুমি সবসময় এই বাড়িতে থাকবে।বাড়ির বাইরে যাবে না
। কোথাও গেলে সাথে দাসী রাখবে।”

হৈমু বলল, “জ্বী মনে থাকবে”

পরদিন সকালে হৈমু ঘুম থেকে উঠে দেখে তার স্বামী বিছানায় নেই।হয়তো কাজে চলে গেছে।হৈমুর ঘরের একটা বড় ঘড়ি লাগানো ছিল কিন্তু হৈমু জীবনে এই প্রথম বার ঘড়ি দেখেছে তাই কয়টা বাজে বুঝতে পারছে না।হৈমু বিছানা থেকে নেমে নিসার নাম নিতেই ঘরে নিসা এসে হাজির।নিসা মাথা নিচু করে বলল, “বলুন গিন্নি মা”

হৈমু বলল, “উনি কোথায় গেছে।”

নিসা বলল, “জমিদার সাহেব কাজে গেছেন।খুব সম্ভবত দুইদিন বাড়ি ফিরবেন না।”

হৈমু বলল, “উনি কি সবসময় এমন করেন ?”

নিসা বলল, “হ্যা কাজের জন্য বেশিরভাগ বাইরে থাকতে হয়। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন
আমি আপনার খাবার নিয়ে আসছি”

হৈমু হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলো। দাসীরা হরেক রকম খাবার নিয়ে দাড়িয়ে আছে।এক এক করে টেবিলের উপর পরিবেশন করছে। দাসীরা খাবার পরিবেশন করে চলে যায়।নিসা এক এক করে হৈমুকে খাবার বেড়ে দেয়।হৈমু সবকিছু থেকে একটু একটু খাচ্ছে।এত ভালো খাবার এর আগে হৈমু কোনদিন খায়নি। খাবার খাওয়া শেষে হৈমু বলল, “এইগুলা নিয়ে চলে যাও। আমি ঘরেই থাকবো।কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না।”

নিসা বলল, “মনে থাকবে গিন্নি মা”

নিসা দাসীদের ডাক দিলো।এক এক করে দাসীরা মিলে পুরো টেবিল পরিষ্কার করে নিল। দাসীরা চলে যেতেই হৈমু মন মরা হয়ে দোলনায় বসে রইলো। সারাদিন আর হৈমু ঘর থেকে বেরোলো ও না। কিছু খেলো ও না।অথচ কাল রাতে ভেবেছিল দাসীকে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখবে।এর মধ্যে হৈমুর সতীনরা দেখা করতে এলেও দাসীরা ভেতরে যেতে অনুমতি দেয় না। বাইরে দুইজন দাসী সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে ।

(চলবে)