প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০২

0
4

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_২

সারাদিন চলে গেল।হৈমু জল ছাড়া কিছুই খেল না। রাতেও হৈমু কিছু খেলো না। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লো।হৈমু লক্ষ্য করলো হঠাৎ কেউ একজন খটখট শব্দ করে দোতলায় উঠে আসছে।পায়ের আওয়াজ শুনে হৈমুর বুঝতে অসুবিধা হয়না দোতলায় কার আগমন ঘটছে।বীর প্রতাপ এসেছে।বীর প্রতাপ কে দেখে নিসা মাথা নিচু করে বলল, “গিন্নি মা আজ সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘরে মধ্যে বসে ছিল। সারাদিন কিছু খায়নি। অনেক চেষ্টা করেও মুখে কিছু তুলতে পারলাম না।”

বীর প্রতাপ বলল, “আমি এসেছি এই কথা যেন কেউ জানতে না পারে। তুমি আমাদের দুজনের জন্য খাবার নিয়ে এসো।আর কাউকে ডাকার দরকার নেই”

নিসা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।কোন কথা না বলে দ্রুত খাবার আনার জন্য চলে গেল।বীর প্রতাপ দরজায় দুটো কড়া নাড়তেই হৈমু বলল, “কে?”

বীর প্রতাপ নীচু গলায় বলল, “আমি এসেছি । দরজা খোলো”

হৈমু স্বামীর কন্ঠ শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। দরজার সামনে তার স্বামীকে দেখতে পেয়ে চোখের পানি আটকাতে পারলো না।তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।বীর প্রতাপ বলল , “শুনলাম সারাদিন না খেয়ে ছিলে?”

হৈমু কোন কথার উত্তর দিলো না।বীর প্রতাপ হৈমুর নিরবতার মাঝে বুঝতে পারল।বলল, “কিসের এত অভিমান?”

হৈমু বলল, “আপনি কি পারলেন আমাকে এই অপরিচিত জায়গায় একা ফেলে রেখে যেতে ?”

বীর প্রতাপ বলল, “আমার কাজ ছিল যে”

হৈমু বলল, “কাজে যাওয়ার সময় বলে গেলেই হতো। তাহলে কি আমার মন খারাপ হতো”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি ঘুমোচ্ছিলে তাই বিরক্ত করিনি। কাজের জন্য আমাকে দুইদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হতো তাও তোমার কাছে এসেছি শুধু তোমাকে না বলে চলে গেছি তাই।ভাগ্যিস আমি এসেছি। নাহলে তুমি এই দুইদিন না খেয়েই থাকতে”

হৈমু তার স্বামীর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়।হৈমু তার স্বামীর কাধে আলতো করে মাথা রাখে।বীর প্রতাপ , “আমি এখানে গোপনে এসেছি। শুধুমাত্র তোমার সাথে দেখা করবো বলে।কেউ যেন আমার আগমনের কথা জানতে না পারে”

হৈমু বলল, “আমি কাউকে বলব না”

হঠাৎ দরজায় কারোর আগমন টের পাওয়া গেল।হৈমু বলল, “ভেতরে এসো”

নিসা মাথা নিচু করে ঘরে খাবার নিয়ে এলো। টেবিলের উপর খাবার গুলো সাজিয়ে আবার মাথা নিচু করে চলে গেল। খাবার টেবিলে খেতে বসে বীর প্রতাপ বলল, “দাসী পছন্দ হয়েছে?”

হৈমু বলল, “জী”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি চাইলে এইরকম আরো অনেক দাসী তোমাকে উপহার দেব”

হৈমু লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল, “নিসাই ঠিক আছে।আর কাউকে লাগবে না”

হৈমু তার স্বামীর প্লেটে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে।বীর প্রতাপ বলল, “এর আগে আমি আমার কোন বউদের সাথে একসাথে বসে খাবার খাইনি। তুমি প্রথম যার সাথে একসাথে বসে খাবার খাচ্ছি”

হৈমু কিছু বলল না কেবল মাত্র চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো।

ভোররাত।বীর প্রতাপের জন্য ঘোড়ার গাড়ি এসেছে।বীর প্রতাপ স্ত্রী হৈমুকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে।হৈমু ঘুম ঘুম চোখে বলল, “কি হয়েছে?”

বীর প্রতাপ বলল , “আমি চলে যাচ্ছি। ঠিকমতো খাবার খেয়ে নিও। তোমার কিছু লাগলে বলো। আমি আসার সময় নিয়ে আসবো”

হৈমু বলল, “আমার জন্য কিছু বই আনতে পারবেন?”

বীর প্রতাপ বলল, “লেখাপড়া জানো ?”

হৈমু বলল, “জানি।মামা শিখিয়েছে”

বীর প্রতাপ বলল, “ইংরেজি পড়তে জানো”

হৈমু বলল, “জানি”

বীর প্রতাপ বলল, “জমিদারের স্ত্রীদের লেখাপড়া জানা ভালো। ইংরেজি জানলে তো আরো ভালো। আমি তোমার জন্য অনেক গুলো বই নিয়ে আসবো। এখন তবে আসি”

হৈমু কোন কথা বলল না।বীর প্রতাপ হৈমুকে বিদায় দিয়ে চলে গেল।হৈমু বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বামীর ঘোড়ার গাড়ি যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল।

রাতে লুকিয়ে বীর প্রতাপের জমিদার বাড়ি আসা গোপন থাকলো না।কোন না কোন ভাবে জমিদারের মাতার কাঁনে এই খবর পৌঁছে গেল।হৈমু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।নিসা বলল, “আপনি বলেছিলেন জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখবেন। জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখবেন না।”

হৈমু বলল, “যাবো।আজই পুরো বাড়ি ঘুরে দেখবো। উনি বলেছেন কাজ শেষ করে ফিরলে পুরো প্রতাপগড় ঘুরে ঘুরে দেখাবেন।”

নিসা বলল, “জমিদার বীর প্রতাপ তার সব স্ত্রীদের অনেক ভালোবাসে। তিনি অবশ্যই করবেন।বাকি সতীনের সাথে দেখা করবেন নাহলে সবাই অহংকারী ভাববে”

হৈমু বলল, “যাবো। তুমি এখন আমার চুল আঁচড়ে দাও”

নিসা ঘর চিড়ুনি নিয়ে হাজির হলো।হৈমুর খোপা খুলতেই হৈমুর লম্বা চুল হাঁটুর নিচে গিয়ে পড়ে।নিসা এত লম্বা আর সুন্দর চুল দেখে অবাক হয়।হৈমু নিসার নিরবতা দেখে বলল, “কি ব্যাপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো যে ?”

নিসা বলল, “ক্ষমা করবেন। আমি এক্ষুনি আপনার চুল আচড়িয়ে দিচ্ছি”

হঠাৎ দরজা খুলে বীর প্রতাপের মা ঘরে প্রবেশ করলো ।হৈমু তার শাশুড়ি কে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।হৈমুর শাশুড়ি বলল, “দাড়াতে হবে না বসো।নিসা বউমার চুল ভালো করে তেল লাগিয়ে আঁচড়ে দেও। আমার ছেলে লম্বা চুল অনেক পছন্দ করে। তোমার লম্বা চুল আর সৌন্দর্য দেখেই আমার ছেলে তোমাকে বিয়ে করেছে।সে যাই হোক যেটা বলার জন্য তোমার কাছে আসা”

হৈমু বলল, “বলেন আম্মা”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “শুনলাম কাল আমার ছেলে গোপনে তোমার সাথে দেখা করেছে”

হৈমু কোন ভনিতা ছাড়াই বলল, “উনি সকালেই চলে গেছেন”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “সে এসেছে এই নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাকে এইভাবে না খেয়ে থাকলে খলে চলবে না।আর ভুললে চলবে না আমার বংশের জন্য উত্তরাধিকার চাই। তুমি কাল না খেয়ে ছিলে বলেই সে এসেছে। সন্তান জন্ম দিতে গেলে তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে।তাই না খেয়ে থাকলে চলবে না। তাছাড়া আমার ছেলের অনেক কাজ সামলাতে হয়। এইভাবে কাজ ফেলে বউয়ের কাছে চলে আসলে কাজের ক্ষতি হবে।সে একজন জমিদার।ঘরের ভিতর বউয়ের সাথে গল্প করলে তার কাজ কে করবে? বুঝতে পেরেছ কি বলেছি”

হৈমু বলল, “জী আম্মা আমি সব বুঝতে পেরেছি”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “আমি গেলাম।ঘরে বসে থেকো না।বাড়ি ঘুরে দেখো।নিসা বউকে বউমাকে একটু পর পর ভালো মন্দ খেতে দিবি কিন্তু”

নিসা বলল, “মনে থাকবে গিন্নি মা”

হৈমু নিসাকে নিয়ে একে একে পুরো জমিদার বাড়ি ঘরে দরজা দেখাতে লাগল। নিচতলায় আসতেই হৈমু দেখলো তার দুই সতীন আয়েশ করে পান বানিয়ে খাচ্ছে।হৈমু কে দেখে বড় সতীন ডাক দিলো।বড় সতীন বলল, “নাম কি গো তোমার?”

হৈমু বলল, “হৈমন্তী”

হৈমুর বড় সতীন বলল, “ভালো নাম। আমি হলাম তোমার বড় সতীন আমার নাম হলো গিয়ে বকুল। আমি কিন্তু জমিদারের মেয়ে । অনেক বড় জমিদার আমার বাবা”

পাশ থেকেই হৈমুর মেজ সতীন বলল, “আর আমার নাম নয়নতারা। আমার বাবা অনেক বড় ডাক্তার বুঝলে। আমার বাবাও অনেক ধনী বুঝলে”

বকুল বলল, “শুনলাম রাতে উনি এসেছেন ?”

হৈমু বলল, “এসেছিল।শেষ রাতেই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে চলে গেছে”

নয়নতারা বলল, “তোমার গয়না টা বেশ তো। উনি দিলো বুঝি”

হৈমু বলল, “ কাল রাতে উনি আসার সময় এনেছেন। অনেক ভারী”

বকুল চোখ টিপে বলল, “এখন তোমারই দিন গো। আমার আর মেজোর দিন সেতো কবেই ফুরোলো”

হৈমু বলল, “কিযে বলো না।”

বকুল বলল, “পুরুষের ভালোবাসা বদলাতে সময় লাগে না বুঝলে।আগে ছিলাম আমি এরপর মেজো এখন তুমি। তবে তুমি বংশধর দিতে পারলে উনি তোমাকে মাথায় তুলে রাখবেন।”

হৈমু লজ্জায় কিছু বলতে পারলো না। নয়নতারা বলল, “পান খাবে ?”

হৈমু বলল, “না গো আমি পান খাই না”

নয়নতারা বলল, “পান হলো জমিদারি খাবার। আমাদের উনি পান অনেক ভালোবাসেন”

হৈমু বলল, “জানি।পালকিতে উনি অনেক পান খেয়েছেন।”

হৈমু বেশি সময় সতীনদের সাথে গল্প করতে পারলো না।বীর প্রতাপের আত্মীয় এসেছেন নতুন বউ দেখতে।প্রতাপের ফুফু এসেছেন। প্রতাপের মা মেহমানদের উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার কপাল কি ভালো দেখেছেন। আমার তিন বউ যেন হীরের টুকরো। ছোট বউ তো একেবারে রাজকন্যা। শুধু ভুল করে গরীব ঘরে জন্ম। নাহলে সৌন্দর্যের কোনদিকে কমতি নেই। আমার ছেলের বউদের মতো রুপবতী সুন্দরী বউ কয়েক গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে না”

প্রতাপের ফুফু খোঁচা মেরে বলল, “এই নিয়ে প্রতাপের তো তিনটি বিয়ে হলো। এবার যদি নাতি নাতনির মুখ দেখা যায়। বেচারা প্রতাপের কপাল খারাপ”

বকুল পাশ থেকে বলল, “ও মা ফুফু কপাল খারাপ হবে কেন ? জমিদারদের ওমন দু চারখানা বউ থাকবেই ।এমনি মানুষের তো ক্ষমতা নেই কতগুলো বউ রাখার।”

ফুফু বলল, “তা বউ কি কি পারো ?”

হৈমু বলল, “রান্না পারি”

ফুফু মুখ ভেংচিয়ে বলল, “ ওমা জমিদার বউ করবে রান্না।এ কি শুনছি জমিদার মাতা”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “এতে অবাক হওয়ার কি আছে।হৈমু নিজের স্বামীর জন্য করতেই পারে।আমরা কিন্তু আমাদের বউদের দিয়ে কাজ করাই না। তবে সে তার স্বামীর জন্য তার স্বামীর পছন্দ খাবার রান্না করলে তো ভালো। প্রতিদিন তো আর চুলার কাছে যাবে না। তাছাড়া অনেক দিন পর যখন আমার ছেলে বাড়ি ফিরবে তার বউ ভালোবেসে রান্না করবে আমার ছেলের জন্য।বউ আমার আবার নকশার কাজ জানে।সুই সুতো দিয়ে সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তুলতে জানে”

ফুফু বলল, “তবুও তোমার উচিত হয়নি এইরকম নিচু জাতের মেয়ে ঘরে তুলে আনা”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “উঁচু নিচু জাত আমার ছেলে দেখে না। আমাদের বীর প্রতাপ সবাইকে এক পরিচয়ে চিনে সেটা হলো আমরা সবাই মানুষ।হৈমুর পরিবার হয়তো গরিব হতে পারে কিন্তু এখন হৈমুর পরিচয় সে বীর প্রতাপের বিবাহিত স্ত্রী। একজন জমিদারের স্ত্রী।এটাই তার একমাত্র পরিচয়। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর পরিচয়ে সবার কাছে পরিচিত হয়”

ফুফু হৈমুর শাশুড়ি কথায় কোন কিছু বলল না কেবল চুপচাপ বসে রইলো।হৈমুর ফুফু শাশুড়ি হৈমুর হাতে কটা টাকা দিয়ে বলল, “কিছু কিনে খেও”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “আজকাল অভাবে আছেন নাকি ?নাকি গরীব হয়ে গেলেন”

ফুফু বলল, “না তো ?”

হৈমুর শাশুড়ি বলল, “জমিদার বাড়ির নিয়মে নতুন বউকে স্বর্ণ না দিয়ে মুখ দেখা যায় না।এই প্রথম কেউ সামান্য কটা টাকা দিয়ে জমিদারের বউয়ের মুখ দেখলো।যে কিনা আবার কোন এক জমিদারের বোন”

ফুফু কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। অগত্যা নিজের গলার থেকে মোটা চেইন খুলে চৈমুর হাতে দিয়ে বলল, “বেঁচে থাকো মা”

ফুফু আর এক মুহূর্তও দেরী করলো না।কাজের লোককে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি আনার ব্যবস্থা করলো। অল্প সময়ের মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ফুফু চলে যেতেই হৈমুর শাশুড়ি বলল, “এই মহিলা সুবিধার নয়।ওর থেকে দুরের থাকবে।”

হৈমু মাথা নিচু করে বলল, “জী মা”

(চলবে)