প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০৬

0
4

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৬

সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে লোকটি খাবার খেতে ডাকলো।চারজন খাবার খেতে চলে গেল।মাটিতে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে এর উপর খাবার খাওয়া হবে। লোকটি তাদের চারজন কে খেতে দিলো।আরাফ খাবার খেতে খেতে বলল ,
“আপনারা খাবেন না?”

লোকটি বলল,
“খাবো।আগে আপনারা খান। আমাদের এখানে আগে অতিথি খায়। অতিথির সাথে কিংবা অতিথির খাওয়ার আগে খেতে পারি না।”

বীর প্রতাপ বলল, “কেন?”

লোকটি বলল, “এটা কুসংস্কারের গ্রাম।মনে করুন সব কুসংস্কার এখানে জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর সব কুসংস্কার এখানে পাবেন”

রুদ্র বলল,“কুসংস্কারের সাথে অতিথির খাবারের কি সম্পর্ক?”

লোকটি বলল, “সম্পর্ক আছে।অনেক আগের কথা।এক ধনী পরিবারে একজন মেহমান এসেছে।বাড়িতে অনেক রান্না হলো।সবাই খাবার খেয়ে নিলো। কেবল অতিথি ব্যতিত। যথাসময়ে অতিথিকে খাবার দিতে গেলে দেখা গেল ঘরে কোন খাবার অবশিষ্ট নেই। অতিথি বেজায় রাগ করলো।রাগ করে চলে গেল না খেয়েই। এরপর থেকেই চালু হলো অতিথির খাবার খাওয়া শেষ হলে খাবার খেতে হবে। অতিথি না খেলে ঘরের কেউ খাবার খেতে পারবে না।অতিথির আগেও খাওয়া যাবে না।অতিথির সাথে একসাথে বসেও খাওয়া যাবে না।নাহলে সংসারে অভাব লেগেই থাকবে।কোন আয় উন্নতি করতে পারবে না”

বীর প্রতাপ বলল, “খুব অদ্ভুত তো। একদিন খাবার কমতি হয়েছে বলে তো প্রতিদিন এমন হবে তা তো নয়”

লোকটি বলল, “এটাই এখানকার নিয়ম হুজুর”

বীর প্রতাপ বলল, “চাকরদের খাবার দিয়েছেন?”

লোকটি বলল, “জী”

আরাফ বলল, “ এই গ্রাম সম্পর্কে বলার কিছু বলুন।এমন কিছু বলুধ যেটার মাধ্যমে পুরো গ্রাম সম্পর্কে জানবো”

লোকটি বলল, “‌লোকজন এই গ্রামকে কুসংস্কারের গ্রাম বলে।কুসংস্কার বললে শেষ হবে না। পৃথিবীর সব কুসংস্কার এখানে জন্ম নেয়। আমাদের জমিদার খুব কুসংস্কার মানে। আমাদের এত কিছু মানতে গিয়ে মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট হয়। অনেক সময় ভুল করে ফেললে বিশাল জরিমানা দিতে হয়।আপনারা খাবার খেয়ে নিন।পরে এক এক করে সব বলবো।যেসব আপনাদের না বললেই চলে না’

রুদ্র বলল, “আপনি বলুন আমরা শুনছি”

লোকটি বলল, “ কোন এক সময় গ্রামে এক ধনী ব্যক্তি বাস করতো।তার ছিল দুই বউ।ধনী লোকটির কোন সন্তান হলো না।তাই ধনী লোকটা ঠিক করলো আবার বিয়ে করবে।এই কথা শুনে দুই বউ মিলে ধনী লোকটিকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। এরপর থেকে প্রচলন শুরু হলো কোন খাবার এক লোকমা খেতে নেই তাহলে পানিতে ডুবে মারা যায়।”

আরাফ বলল, “এইগুলা ছোট বেলায় মায়ের মুখে শুনেছি। একবার খেতে নেই।দুই বার খেতে হয়”

লোকটি বলল, “এই গল্পে আরো একটা কুসংস্কার আছে। সেটা খুব হাস্যকর”

রুদ্র বলল, “সেটা কি?”

লোকটি বলল, “কেউ এক সাথে তিন বউ রাখতে পারবে না। তাহলে একশ রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা দিতে হবে।এমনকি তার স্ত্রী চাইলে তার স্বামীকে তৃতীয় বিয়ের করার জন্য পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলতে পারবে। শুধু পানিতে ডুবিয়ে মারতে হবে অন্য ভাবে করলে হবে না।”

বীর প্রতাপ বলল, “স্বামী কে মেরে ফেলবে?”

লোকটি বলল, “হ্যা। এখানে এটাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না”

আরাফ বলল, “বেশ হাস্যকর নিয়ম। আচ্ছা, কেউ যদি দুই বউ রাখে তবে?”

লোকটি বলল, “দুই বউ রাখার নিয়ম আছে। শুধু তিন বউ রাখতে পারবে না”

রুদ্র বলল, “আর কি কি কুসংস্কার মানা হয়?”

লোকটি বলল, “আরো অনেক আছে।যেমন রাতের বেলা চুল আঁচড়াতে নেই । তাহলে মেহমান আসলে।রাতে ময়লা হাড়িপাতিল জমিয়ে রাখতে নেই তাহলে অমঙ্গল হয়।রাতে নখ কাটলে স্বামীর আয়ু কমে যায়।নাকে নাকফুল হারিয়ে গেলে স্বামীর ক্ষতি হয়। এইরকম কত আছে”

হৈমু বলল, “গল্প গুলো দারুন কিন্তু”

লোকটির মা দুরেই বসে ছিল।হৈমুর কথা শুনে কাছে এসে বসলো।চুলে কয়েকবার হাত বুলিয়ে বলল , “তুমি ও রাজকন্যা তাই না”

হৈমু বলল, “আমি কোন রাজকন্যা না। আমার বাবা মা ছোট বেলায় মারা যায়। আমি আমার ভাইয়ের কাছে বড় হয়েছি। আমার ভাই অনেক গরিব ছিল”

মহিলাটি বলল, “এখন তো জমিদারের স্ত্রী”

হৈমু বলল, “হ্যা”

মহিলাটি বলল, “তোমার চুল তো বেশ সুন্দর। এক্কেবারে রাজকন্যার মতো লাগে।”

হৈমু বলল, “এই চুল দেখেই জমিদার বিয়ে করেছেন?”

মহিলাটি বলল, “তিনি হয়তো চুল দেখেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছে।চুল বাঁধো মেয়ে। খোলা চুল রাখা ঠিক না”

হৈমু চুলে খোপা বেঁধে বলল, “চুল খোলা রাখলে কি হয়?”

মহিলাটি বলল, “চুল খোলা রাখা অভিশাপ।এক পিশাচ আছে এদের খাবার হলো মেয়েদের লম্বা চুল।রাতে চুল খোলা রাখলে পিশাচ এসে চুল নিয়ে যায়। কোন মেয়ের চুল যদি পিশাচে নেয় তবে তার জীবন শক্তি কমে আসে।ওই মেয়ে মারা যায়। এইজন্য সবসময় চুল বেঁধে রাখতে হয়। বাঁধা চুলে ওরা নজর দিতে পারেনা”

বীর প্রতাপ বলল, “এই পিশাচ দেখতে কেমন?”

মহিলাটি বলল, “এরা মানুষের মতো রুপ নিতে পারে।এরা যেকোন রুপ নিতে পারে। বাস্তবে এরা অনেক ভয়ংকর”

হৈমু বলল, “বাস্তবেই কি চুল খোলা রাখলে এমন হয়?”

মহিলাটি বলল, “আমার ছেলে আলী।ওর বউ ছিল ছেলে মেয়ে সব ছিল। আমার ঘর এত ফাঁকা ছিল না।কেউ মারা গেছে অসুখে আর অভিশাপে।ওর বউয়ের অনেক লম্বা চুল ছিল ঠিক আপনার মতোই।চুল খোলা রেখেই চলতো।বললে কথা শুনতো না ।একদিন পিশাচের নজর পড়ে ওর চুলের উপর।সে রাতেই সে মারা গেল।পিশাচের হাতে মৃত্যু হওয়ার কারণে কেউ লাশ কবর দিতে আসেনি”

রুদ্র বলল, “কেন?”

মহিলাটি বলল, “কুসংস্কার কিংবা ভয়।এই সব পিশাচের হাতে মৃত্যু হলে কবর দেয়ার নিয়ম নেই।লাশ পুড়িয়ে ফেলতে হয়”

রুদ্র বলল, “আজ শহরে প্রবেশ করার সময় দেখলাম দুটো মেয়েকে পুড়িয়ে মারতে। শুনলাম ওরা নাকি জাদুকর”

মহিলাটি বলল, “এখানকার জমিদার অনেক ছেলেমানুষী।যা মন চায় করে। এরজন্য কালো প্রান গেলেও কিছু যায় আসে না। কিছু দিন আগে জমিদারের মেয়ে অদ্ভুত রোগে মারা যায়।পুরো শরীরে ফোঁড়ার হয়েছিল। জমিদার মনে করছে কোন জাদুকর কালো জাদুর মাধ্যমে মেরে ফেলছে।তাই সব জাদুকর কে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে।কেউ কেউ ভালো মানুষকেও জাদুকর সাজিয়ে মেরে ফেলছে।এই কদিনে যারা মারা গেছে তাদের অনেকেই নির্দোষ। জাদুকর সন্দেহে মেরে ফেলা হচ্ছে।কেউ কিছু বলতে পারছে না। কিছু বললেই তাকেও পুড়িয়ে ফেলা হবে”

হৈমু বলল, “পুড়িয়ে মারছে কেন?অন্য ভাবেও তো মারতে পারে?”

মহিলাটি বলল, “এইগুলো জমিদারের বলা নিয়ম। তিনি খুব কুসংস্কার বিশ্বাস করে।”

আরাফ বলল, “শহরে প্রবেশ পথে একটা মুর্তি দেখা মিললো।যার হাতে রুপোর কয়েন ভর্তি থালা ‌। কয়েকজন মানুষ আবার এখানে কয়েন ফেলছে।এটা কেন করছে?”

লোকটি পাশ থেকে উত্তর দিলো , “একটা জমিদারের মুর্তি।এটা হলো এই শহরের প্রথম জমিদার।”

লোকটা কিছুক্ষণ থামলো । কিছু সময় চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করলো, “এক সময় এই গ্রাম ছিল পাহাড় আর জংগলে পরিপূর্ণ একটা জায়গায়। বিভিন্ন হিংস্র জানোয়ারের বসবাস ছিল এই গ্রামে।একদল বেদুইন ছিল। এরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে বেড়াত।একটা জায়গায় বেশিদিন থাকতো না।এক জায়গায় বসতি স্থাপন করার কিছু দিন পর আবার অন্য জায়গায় চলে যেত। এখানকার প্রথম জমিদারের এইসব ভালো লাগতো না। তিনি ছিলেন দলের নেতা।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এমন জায়গায় বসতি স্থাপন করবেন যেখানে আজীবন থাকা যাবে । বেদুইনদের মতো ঘুরে বেড়াতে হবে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই জায়গায় বসতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।সবাই মিলে জংগল পরিষ্কার করে থাকার ব্যবস্থা করলো। পাশেই সমুদ্র বন্দর থাকার কারনের মাছ ধরেই জীবন নির্বাহ করা ছিল বেশ সহজ।
ধীরে ধীরে রাজ্য অনেক বড় হতে লাগলো। জমিদার বিয়ে করলেন এক সুন্দরী রমনীকে।একদিন জমিদার তার প্রথম সন্তানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো‌। জমিদারের একটি পুত্র সন্তান হয়।এরপর জমিদারের স্ত্রীর অনেক গুলো সন্তান হয়।কেউ কেউ বলে সাতটি কেউ বলে নয়টি কেউ বলে তেরো টি। তবে জমিদারের স্ত্রী সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো বড় পুত্র কে। কিন্তু বড় পুত্র ছিল খুব লোভী।জমিদারের কাছে ছিল একটা সোনার কয়েন যাকে বলা হতো উইশ কয়েন। ওই কয়েনের সামনে বসে মনে মনে কিছু চাইলে সেটা পূরণ হয়। একদিন জমিদার পুত্র সেই কয়েন চুরি করে নেয়।কয়েনের অভিশাপ ছিল এই কয়েন মনে লোভ নিয়ে ধরা যায় না আর নিজের জন্য কিছু চাইতে পারবে না।তাহলে এই কয়েনের অভিশাপ লাগবে। জমিদার পুত্র কয়েন ছোঁয়ার সাথে সাথে পাথরের মুর্তিতে পরিনত হয়। সেই সময় জমিদার শহরের প্রবেশ পথে তার ছেলের পাথরের মুর্তি রেখে দেয়। মানুষ এখানে রুপোর কয়েন দেয় যাতে এই অভিশাপ মানুষের মধ্যে না ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলে এই রুপোর কয়েনের মধ্যে সেই অভিশপ্ত কয়েন আছে। কিন্তু কেউ এই কয়েন ছোঁয়ার সাহস করে না।যেই এখানে হাত দিয়েছে সেই মারা গেছে”

বীর প্রতাপ বলল, “তোমার সামনে কেউ মারা গেছে?”

লোকটি বলল, “এখানে কেউ মরতে দেখেনি”

বীর প্রতাপ বলল, “তাহলে কি করে বুঝলে এই গল্পটা সত্যি। মিথ্যা ও তো হতে পারে”

লোকটি বলল, “মিথ্যা হতেই পারে।আমরা সবাই অন্য কারো মুখে এই গল্প শুনেছি। বাস্তবে কেউ দেখিনি”

আরাফ বলল, “ এখানে কয়েন রাখার সময় মানত করে কেন?”

লোকটা হেসে বলল, “এটাও কুসংস্কার। মানুষ মনে করে সেই অভিশপ্ত রাজকুমার মানুষের মনের ইচ্ছা পূরণ করে।যার ইচ্ছা পূরণ করে তার কয়েন নিয়ে যায়।থালায় সেসকল কয়েন রয়েছে যাদের ইচ্ছে পূরণ হয়নি।আপনারা তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি কখনো কয়েন দিয়ে মানত করেছ?”

লোকটি বলল, “প্রতিদিন”

বীর প্রতাপ অবাক হয়ে বলল, “এখানকার নিয়ম এটা। প্রতিদিন একটা করে কয়েন দিতে হবে। নাহলে মৃত্যু দন্ড।মানত করি আর না করি কয়েন দিতেই হবে। এইজন্যই এখান থেকে অনেক মানুষ পালিয়ে যায়।”

বীর প্রতাপ বলল, “এটা তো জোর জবরদস্তি”

লোকটি বলল, “হ্যা। কিন্তু কি লাভ জমিদারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারবে না। তাহলে মেরে ফেলবে।ভয়ের কারণেও মানুষ কিছু বলতে পারে না”

(চলবে)