রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-০১

0
71

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নিজের স্বামীকে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পলক। আজ ছিল তাদের দ্বিতীয় বিবাহ-বার্ষিকী। পলকের স্বামী আরাফাত তাকে বলেছিল আজ তাকে অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ দেবে। অথচ সে আজ তার জন্য সতীন নিয়ে এলো। পলক আর কিছু ভাবতে পারল না। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ করেই পলকের মাথা ঘুরতে লাগল। চোখের সামনেটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠল। পলক তখনই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।

★★
চোখ মেলে তাকাতেই নিজের চোখের সামনে নিজের শাশুড়ী সালমা বেগমকে দেখতে পেল পলক। তাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল। এই মহিলা যে তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসে। সালমা বেগম পালকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আমার তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা নেই, মা। আমার ছেলে যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতে পারিনি। এসব কিছু তোমার শ্বশুর মশাই আর ওর পরিকল্পনা। ও যেই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে সে হলো তোমার শ্বশুর মশাইয়ের বন্ধুর মেয়ে। তোমার শ্বশুর মোটা অংকের যৌতুক নিয়ে এই বিয়েটা দিয়েছে।”

পলক ছটফট করতে লাগল। সালমা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে কাতর স্বরে বলল,
“আমাকে একবার আরাফাতের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন মা। আমার ওর থেকে অনেক কিছু জানার আছে।”

সালমা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার পূর্বেই সেখানে চলে আসে আরাফাতের নতুন বউ মালিহা। মালিহা সেখানে এসেই পলকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আরাফাতের সাথে তোমার আর কোন কথা থাকতে পারে না। আরাফাত আমায় কথা দিয়েছে, ও তোমাকে তালাক দিবে।”

পলকের পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গেলো। এসব কি বলছে এই মেয়েটা। পলক উঠে দাঁড়িয়ে মালিহার পাশে এসে বলল,
“আরাফাত সত্যিই এমন বলেছে!”

“আমি মিথ্যা বলি না। তোমার জন্য সত্যি আমার অনেক খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। নিজের সংসার বাঁচানোর জন্য যদি তোমার সংসার ভাঙাতে হয় তাহলে আমাকে তাই করতে হবে।”

“তুমি কিভাবে পারলে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার ভাঙতে?!”

মালিহা বিষন্ন সুরে বলল,
“আমি নিজেও ঠকে গেছি, পলক। আমার আর আরাফাতের বিয়ে কিন্তু আজ হয়নি। আমাদের বিয়ে হয়েছে আরো এক বছর আগে। আমি আমার আব্বু, আম্মুর সাথে লন্ডনে ছিলাম। আমি লন্ডনেই বড় হয়েছি। গত বছর সিলেটে ফেরার পরই আব্বু আমাকে বলে তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়। আমি তখন কোন আপত্তি করি নি। কারণ আমি সবসময় আমার পরিবারের পছন্দমতোই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আমার বাবার উপর আমার পূর্ণ আস্থা ছিল এবং আমার বাবার আস্থা ছিল তার বন্ধুর উপর। কিভাবে এভাবে যে বাজে ভাবে ঠকে যাব সেটা ভাবতে পারিনি। বিয়ের পর আরাফাত আমাকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে ওঠে। ওকে আমি অনেকবার বলেছি শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কথা কিন্তু ও বারবার এড়িয়ে গেছে। অবশেষে ধৈর্য রাখতে না পেরে ১ মাস আগে আমি আরাফাতের পিছু পিছু এই বাড়ি অব্দি চলে আসি। এখানে এসে আমার সালমা আন্টির সাথে কথা হয়..আর আমি সব জানতে পারি। জানো, আমি তোমার সংসার ভাঙাতে চাই নি। বরং নিজেই ভেবেছিলাম আরাফাতকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাব। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে যাব তার আগেই জানতে পারি, আমার গর্ভে আরাফাতের সন্তান বেড়ে উঠছে। আর তুমি তো জানো সিঙ্গেল মাদার হওয়া কতটা কষ্টের। আমি চাই না, আমার সন্তান বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক। আবার আমি এটাও চাই না যে, আমার সন্তান সৎ মায়ের সাথে এমন পরিবেশে বেড়ে উঠুক। তাই আমি আরাফাতকে শর্ত দেই..যদি নিজের সন্তান এবং আমাকে চায় তাহলে তোমাকে তালাক দিতে হবে।”

মালিহার কথা শুনে পলক হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল। সালমা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। পলক এলেমেলো পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

পলক কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই আরাফাতের মুখোমুখি হলো। আরাফাতকে দেখামাত্রই তার প্রতারণার কথা মনে পড়লো। রাগে, ক্রোধে আরাফাতের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
“কেন? কেন এমন করলে তুমি? আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম আরাফাত। আর তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে!”

আরাফাত পলককে নিজের থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে বলে,
“আমার কিছুই করার ছিল না। মালিহাকে আমি বিয়ে করেছিলাম বাবার কারণে। বাবা বলেছিল, মালিহাকে বিয়ে না করলে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে আমায় বঞ্চিত করবে। কিন্তু সত্যি বলতে, মালিহাকে বিয়ের পর আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। ও একদম নিঁখুত সুন্দরী। তোমার থেকে হাজারগুণ সুন্দরী।”

পলক চিৎকার করে বলে,
“আর আমাদের ভালোবাসা?! তার কি হবে আরাফাত?!”

আরাফাত বলে,
“ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না পলক। মালিহা আমার বাচ্চার মা হতে চলেছে। আর তুমি তো বিয়ের দুই বছর পরও আমায় সুখবর শোনাতে পারলে না। তাই আমি মালিহাকে বেছে নিলাম। তার জন্য যদি তোমাকে ত্যাগ করতে হয়, তাহলে সেটা করতে আমার বাঁধবে না।”

পলক ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দিল আরাফাতের গালে। চিৎকার করে বলল,
“ভুলটা আমারই ছিল। আমি নিজের পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমায় বিয়ে করি। আমার বাবা তো শুরু থেকেই এই বিয়েতে রাজি ছিল না। অথচ আমি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে রাজি করিয়েছি এই বিয়ে দিতে। কিন্তু আমার পরিবারের কেউই এই বিয়েতে মন থেকে রাজি ছিল না। আমারই ভুল ছিল তোমার মতো একটা ছেলেকে ভালোবাসা।।”

আরাফাত পলকের গলা চেপে ধরে বলে,
“কেন অন্য কোন নাগর ছিল নাকি তোমার?”

“আরাফাত! মুখ সামলে কথা বলো।”

“তোমার মতো মেয়ের সাথে এর থেকে ভালো ভাষায় কথা বলার ইচ্ছা নেই। আমি কিছু জানি না ভেবেছ? কলেজ,ভার্সিটিতে তোমার কতগুলো ছেলে বন্ধু ছিল৷ আর তাদের সাথে কতই না ঢলাঢলি। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার!”

“তুমি নিজে চরিত্রহীন। আমার জীবনে যদি আরেকবার সুযোগ পেতাম তাহলে তোমার মতো চরিত্রহীনকে আর কখনো সুযোগ দিতাম না। তুমি একটা জঘন্য মানুষ। যদি আমি আবারো অতীতের দিনগুলোতে একবার ফিরে যেতে পারতাম তাহলে নিজের সব ভুল শুধরে নিতাম। আমার এখনো ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে যে..আমি নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার মতো একটা খারাপ মানুষকে বেছে নিয়েছিলাম। আমি এটারই যোগ্য ছিলাম।”

আরাফাত ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
“এত কথা শোনার সময় নেই। এই যে ডিভোর্স পেপার। এখানে সই করে দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো। আমি তোমার কাবিনের ৫ লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি।”

পলক সটান ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয়। আরাফাত তার হাতে পাঁচ লাখ টাকার নোট তুলে দিলে পলক সেই টাকা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে,
“তোমার মতো জঘন্য লোকের দেয়া টাকা স্পর্শ করতেও আমার রুচিতে বাধবে। তোমাকে বিয়ে করা আমার সব থেকে বড় ভুল ছিল, যার মাশুল আমাকে এখন দিতে হচ্ছে। যদি সুযোগ পেতাম, এই ভুলটাই আর করতাম না।”

বলেই পলক চোখের জল মুছতে মুছতে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বাইরে আসতেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আমার জীবনে হঠাৎ করে এ কি ঝড় নেমে এলো! ভাগ্যের এ কি নির্মম পরিহাস। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে এই দিনটায় যে আশা নিয়ে আরাফাতের হাত ধরেছিলাম আজ সেই আশা পুরোপুরি ভঙ্গ হয়ে গেল। ওর সাথে আমি সুখী হতে পারলাম না। তোমার অবচেতন মনে দেওয়া অভিশাপই ফলে গেল বাবা।”

বলেই কোন একটা ভাবনায় মগ্ন হলো পলক। ভাবলো এবার বাবার বাড়িতে যাবে। এছাড়া যে তার যাওয়ার আর যায়গা নেই তার। কিন্তু তার ভাইয়া-ভাবি তাকে দেখে কি রিয়্যাক্ট করবে?! সংসারের দায়িত্ব যে পুরোপুরি এখন তার ভাইয়ের। তার মা তো কতবার তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে বলেছে যে, ভাইয়া-ভাবির আচরণ নাকি তাদের প্রতি বেশ রূঢ়। পলককে কি তারা মেনে নিবে!

চলবে…….✨