রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-০২

0
71

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সহায় সম্বলহীন পলক এসে দাঁড়ালো তার বাবার বাড়ির সামনে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই সে শুনতে পেল ভেতর থেকে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ এসব শুনে পলকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। তার মায়ের কাছে শুনেছে ইদানীং ভাবি নাকি তার মা-বাবাকে একদম সহ্য করতে পারে না। এসব ভেবে পলকের মনে হলো, সে কি এখানে নিজের মা-বাবার বিপদ বাড়ানোর জন্য এলো? কিন্তু সে-ই বা কি করবে। এছাড়া যে তার আর কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। এসব ভেবেই পলক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজায় নক করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই পলকের বড় ভাই পাভেল এসে দরজা খুলে দেয়। পলককে দেখে খানিকটা বিরক্তি ও বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তুই হঠাৎ?”

“ভেতরে আসতে বলবিনা?”

“ও,,,হ্যাঁ,,,আয়।”

পলক গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। পলক এককাপড়ে ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল৷ তাই পাভেল ভাবল সে হয়তো কিছু সময়ের জন্য এসেছে৷ এই ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এরইমধ্যে পলক শুনতে পেল তার ভাবি রুহানি জোর গলায় বলছে,
“কে এসেছে? যেই আসুক না কেন আমি কিন্তু এখন আর কোন রান্না করতে পারব না। আমি এখানে দাসীবাঁদী হয়ে আসিনি। তোমার মা সারাজীবন অসুস্থতার ভান করে ঘরে শুয়ে-বসে থাকবে আর আমি খেটে যাব? সেটি হচ্ছে না।”

বলেই রুহানি বাইরে এসে পলককে দেখে চমকে গেল। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“পলক তুমি? হঠাৎ করে কিছু না জানিয়েই চলে এলে?”

“কেন? আমি কি আসতে পারি না?”

“সেটা না,,আসলে,,বাদ দাও। এসেই যখন পড়েছ তখন ভেতরে এসো।”

পলক ভেতরে প্রবেশ কর। পলকের বাবা পারভেজ ইসলাম লাঠিতে ভড় দিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বলেন,
“কে এসেছে বৌমা?”

এসেই তিনি পলককে দেখতে পান। পলক নিজের বাবাকে দেখে আবেগঘন হয়ে পড়ে। বিয়ের দুই বছরে খুব কমই নিজের বাবার বাড়িতে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। সবশেষ এসেছিল ৬ মাস আগে। তখন তার বাবা একদম ঠিক ছিল। মায়ের কাছে শোনা কয়েক মাস আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে পারভেজ ইসলাম পায়ে আঘাত পান। ডাক্তার বলেছিলে পা ভেঙে গেছে চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রুহানির পাভেলকে এসবের পেছনে টাকা খরচ করতে নিষেধ করে দেয়। যার কারণে চিকিৎসার অভাবে তার পায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। তারপর থেকে লাঠিতে ভড় করেই হাঁটতে হয় ওনাকে। পারভেজ ইসলামকে দেখে পলক আর নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারে না৷ দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“এ তোমার কি হাল আব্বু?”

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

পলক উত্তরে আর কিছু বলতে পারে না। রুহানি খানিক ঠেস দিয়ে বলে,
“নিজের পছন্দমতো ছেলেকে যখন বিয়ে করে নিয়েছে তখন তো ভালোই থাকবে। তাই না পলক?”

পলক তখনো নিশ্চুপ। পারভেজ ইসলাম বলেন,
“তোর আম্মু আমাদের ঘরে শুয়ে আছেন। কিছুদিন ধরে তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। বিছানা থেকেও একদম উঠতে পারছে না৷ চল গিয়ে দেখে আসবি।”

পলক হতভম্ব হয়ে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তো ৩ দিন আগেই তার মায়ের সাথে কথা হলো। তার মা তো বলেছিল, তিনি একদম আছেন। তাহলে কি সেসব পলক যাতে দুশ্চিন্তা না করে সেই জন্য? পলক আর ভাবতে পারলো না। ছুটে চলে গেলো নিজের মায়ের কক্ষে।

পলকের মা নূর বেগম বিছানায় শুয়ে কাতড়াচ্ছেন। কয়েকদিন থেকেই কোমড়ের ব্যাথায় ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারেন না৷ পলক রুমে এসেই, “আম্মু, আম্মু” বলে ডাকতে শুরু করে। পলকের ডাক শুনে নূর বেগম উঠে বসার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। পলক নূর বেগমের পায়ের কাছে বসে কান্নার সুরে বলতে থাকে,
“এ তোমার কি হাল আম্মু?”

নূর বেগম হালকা হেসে বলেন,
“আমি একদম ঠিক আছি। তুই বল, তোর কি অবস্থা। হঠাৎ এভাবে চলে এলি।”

“একদম মিথ্যা কথা বলবে না। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি তোমরা একদম ঠিক নেই।”

পারভেজ ইসলাম পিছন থেকে বিষন্ন সুরে বলেন,
“কেন ঠিক থাকবো না? বয়স হলে সবারই এমন একটু-আধটু সমস্যা হয়৷ তুই একটু বেশিই ভাবছিস আমাদের নিয়ে। দেখছিস না পাভেলকে। ওর কি আমাদের নিয়ে কোন চিন্তা আছে? ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে আমাদের তেমন কিছু হয়নি,এমনি সেরে উঠব।”

পলক কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। তার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়তে লাগল। একটু থিতিয়ে নিলো সে৷ আর ভাবতে লাগলো এখনই কি মা-বাবাকে সব বলা ঠিক কিনা৷ তবে বাড়ির যা পরিস্থিতি দেখল তাতে তার পক্ষে এখানে টিকে থাকাটাও সহজ না। কিন্তু এছাড়া তার যে আর কোন যাওয়ার যায়গাও নেই।

পলক উদাস মনে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে চাঁদকে বেশ বড় দেখাচ্ছে। আর চাঁদ থেকে কিরকম জানি রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। পলকের মনে পড়লো আগামীকাল পূর্ণিমা। কাল হয়তো চাঁদের আলোর তীব্রতা আরো বাড়বে। কিন্তু সেই চাঁদের আলো কি পলকের জীবনের অন্ধকার দূর করতে পারবে? এসব ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল পলক।

এরইমধ্যে পারভেজ ইসলাম পলকের পিঠে হাত রেখে বললেন,
“সবকিছু ঠিক আছে তো। এই রাতের বেলা হঠাৎ তুই চলে এলি এটা আমার মনে কেমন একটা খটকা তৈরি করছে। বিয়ের পর তুই যে ক’বার এবাড়িতে এসেছিস জামাই তো তোর সাথে ছিল কিন্তু এবার..”

পারভেজ ইসলাম নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। তার পূর্বেই পলক পারভেজ ইসলামের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। পারভেজ ইসলাম চিন্তিত স্বরে বলেন,
“কি হলো পলক? তুই কাঁদছিস কেন? কিছু কি হয়েছে?”

পলক কান্নার গতি সামান্য কমিয়ে বলে,
“এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না আব্বু..আমি তো তোমার কথা শুনিনি। তুমি বলেছিলে…আরাফাত ভালো ছেলে নয়। আমি শুনিনি তোমার কথা। আত্মবিশ্বাসের সাথে তোমায় বলেছি, আরাফাত ভালো ছেলে। ও আমায় ভালো রাখবে। আমার জেদের কাছে হেরে গিয়ে তুমি আমায় বিয়ে দিলে কিন্তু..ও আমার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখল না। ও ঠকালো আমায়। তোমার কথাই ফলে গেল আব্বু।”

পারভেজ ইসলামের বুক ছ্যাত করে উঠল। বিয়ের আগে তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন আরাফাতের কিছু বাজে স্বভাব আছে। তাছাড়া আরাফাতের বাবাও সুবিধার লোক নয়। এজন্য তিনি বিয়েতে রাজি ছিলেন না। শেষ অব্দি পলকের জেদের কাছে হেরেই বিয়েতে মত দেন। বিয়ের পর তিনি লক্ষ্য করেন আরাফাত যথেষ্ট ভদ্র এবং তার সাথে পলক সুখেই আছে। এসব দেখে তার মনে হয়েছিল, তার ধারণা ভুল ছিল। কিন্তু আজ পলকের কথা শুনে আবারো তার মাথায় দুশ্চিন্তা ভড় করলো। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“কি হয়েছে পলক? তুই সবটা আমায় খুলে বল।”

পলক চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে,
“আরাফাত ঠকিয়েছে আমায়..ও আমার অগোচরে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে এবং সেই মেয়ের পেটে ওর বাচ্চা..”

পলকের কথা শুনে পারভেজ ইসলাম হতভম্ব হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লেন। পলক নিজের বাবার কাছে বসে বলে,
“ও আমায় ডিভোর্স দিয়েছে আব্বু। তারপর আমি ওবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।”

নূর বেগমও ডুকরে কেঁদে ওঠেন এসব শুনে। তার নিজের অসহায় মেয়ের কথা ভেবে রুহ কেপে উঠছে। তাদেরই তো এবাড়িতে শত গঞ্জনা সহ্য করে থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা কিভাবে নিজের মেয়ের পাশে দাঁড়াবে? নূর বেগমের চোখের সামনে যেন অমানিশার আঁধার নেমে এলো, চন্দ্রের আলোও যেন যথেষ্ট নয় সেই অন্ধকার দূর করতে!

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨