#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
রুশাদ বিয়ের আসরে এসে বসে আছে। এখনো ফারিয়াকে বিয়ের আসরে নিয়ে আসা হয়নি। কিন্তু রুশাদের যেন আর তরই সইছিল না৷ সে বারংবার তার বন্ধু-বান্ধব আর কাজিনদের বলছিল,
“তোরা একটু খোঁজ নে না, ফারিয়ার আসতে আর কত সময় লাগবে।”
রুশাদের এক বন্ধু তো হেসেই ফেলে এহেন কথা শুনে। হাসতে হাসতে বলে,
“বাবাহ, তুই এত বিয়ে পাগল কি করে হলি? একদম তড় সইছে না দেখছি। এত চিন্তা করিস না, তোর বউকে কেউ নিয়ে পালাবে না।”
রুশাদ বলে,
“তুই কি বুঝবি আমার কষ্টটা। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যে আজকের দিনটা দেখতে পাচ্ছি সেটা কেবল আমিই জানি।”
এরইমধ্যে পলকসহ আরো কিছু মেয়েরা ফারিয়াকে ধরে নিয়ে এসে বিয়ের আসরে বসায়। রুশাদ তো ফারিয়াকে দেখে একদম হা হয়ে যায়। পলক এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলে,
“থাক, তোকে আর অপেক্ষা করতে হবে না। এই যে নিয়ে এসেছি তোর কনেকে। এখন বিয়েটা করে না, পরে ওকে প্রাণ ভরে দেখার অনেক সময় পাবি।”
বলেই হেসে ফেলে। ফারিয়া ও রুশাদকে সামনাসামনি বসানো হয়। অতঃপর কাজি সাহেব তাদের বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। রুশাদকে কবুল বলতে বললে সে তো কোন সময় না নিয়েই কবুল বলে এবং বিয়ের চুক্তিনামায় সই করে। অতঃপর ফারিয়ার পালা আসে। সে একটু সময় নিয়ে কবুল বলে। সই করায় সময়েও তার হাত কাপছিল। অনেক কষ্টে সে সইটা করে দিয়েই নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। পলক তাকে সামলানোর চেষ্টা করল।
ফারিয়া ও রুশাদের বিয়ে সকল নিয়ম মেনে সম্পন্ন হয়ে গেল। কবুল বলার মাধ্যমে তারা একে অপরের সাথে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো৷ যেই বন্ধন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বন্ধন। এখন থেকে তারা একে অপরের জীবনসঙ্গী। একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার।
বিয়ে শেষ হতেই এলো বিদায়ের পালা। ফারিয়া তার মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করল৷ তবে তার কান্নার গতি বাড়লো পলকের সাথে কথা বলার সময়। ফারিয়া পলককে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,
“তোকে অনেক ধন্যবাদ দোস্ত। আজ তুই ছিলিস বলেই আমি আর রুশাদ এক হতে পেরেছি। নাহলে না জানি, আমাদের এই ভালবাসার কি পরিণতি হতো…আমরা হয়তো কখনো একই হতে পারতাম না।”
পলক ফারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“ধন্যবাদ আমাকে না, মহান সৃষ্টিকর্তাকে জানা। তিনি চেয়েছেন বলেই আজ এত কিছু সম্ভব হয়েছে। আমি তোর ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করি৷ রুশাদ তোকে অনেক ভালোবাসে। আমি নিশ্চিত ও তোকে অনেক ভালো রাখবে। কি রুশাদ, আমার প্রিয় বান্ধবী ফারিয়ার খেয়াল রাখবি না?”
রুশাদ হেসে বলে,
“ওর খেয়াল রাখব না তো কার খেয়াল রাখব! এখন ঐ তো আমার সব।”
বিদায়ের কষ্টের মাঝেও ফারিয়া হেসে ফেলে রুশাদের এই কথা শুনে। অতঃপর ফারিয়া ও রুশাদ গাড়িতে উঠে বসে। পলক শেষবারের মতো গাড়ির জানালা দিয়ে ফারিয়াকে বলে,
“নিজের খেয়াল রাখিস। তোর নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আশা করি, এই নতুন জীবনে অন্তত তুই খুশি হতে পারবি।”
বলেই একটা হাসি দেয়। এই হাসির মাঝে লুকিয়ে ছিল অনেক রহস্য। ফারিয়াকে বরযাত্রীরা নিয়ে চলে যাবার পর বাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে যায়। তবে মেহরাজ ও পলক রয়ে যায়। মেহরাজ নিজের বাইক নিয়ে এসেছিল। তাই সে পলককে অফার করে,
“চলো, আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।”
পলকও আপত্তি না জানিয়ে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর মেহরাজ তার বাইক নিয়ে এসে পলককে বলে,
“উঠে বসো আমার বাইকে।”
পলক নিশ্চিন্তে উঠে বসে মেহরাজের বাইকে। মেহরাজ বলে,
“আমি কিন্তু একটু জোরে ড্রাইভ করি। তাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসো।”
পলকের কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। বুকের ধুকধুকানি বাড়ছিল। তবুও সে অনেক কষ্টে মেহরাজকে ধরে বসে। মেহরাজ জোরে গাড়ি চালানো শুরু করলে পলক তাকে জাপটে ধরে। দুজনে যেন অদ্ভুত এক ভালোলাগার দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। মেহরাজ হঠাৎ কি মনে করে যেন পলককে বলে,
“ঐ আরাফাতের সাথে যেন আর কখনো তোমায় না দেখি৷ তোমাকে অন্য কারো পাশে আমার সহ্য হয়না।”
পলক তো মেহরাজের কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পায়। কি উত্তর দেবে কিছু ভেবে পায়না। মেহরাজ হঠাৎ করে বাইকটা মাঝরাস্তায় থামায়। অতঃপর পলককে বাইক থেকে নামতে বলে। পলক বাইক থেকে নামার পর মেহরাজও বাইক থেকে নেমে পড়ে। অতঃপর মেহরাজ নিজের পকেট থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে পলকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
“জানি না কবে থেকে আর কিভাবে…কিন্তু আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি পলক। এটা আমি প্রথম বুঝতে পেরেছি যখন তুমি আরাফাতের সাথে রিলেশনে গেলে। এই চারটা মাস আমার কাছে বিষের মতো ছিল। একটা দিনও আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি বিশ্বাস কর। প্রতি মুহুর্তে শুধু তোমার চেহারাই আমার সামনে ভেসে উঠেছে। অতঃপর আমি বুঝলাম এর কারণটা। এর কারণ হলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
পলক এসব কথা শুনে একদম হতবাক হয়ে যায়। মেহরাজ আরোও বলে,
“আজ আমি তোমাকে নিজের সব অনুভূতির কথা জানাতে চাই। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পলক। আমি তোমাকে নিজের করে চাই। তুমি কি আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করবে?”
পলকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার মনেও তো মেহরাজের জন্য অনুভূতি আছি। আজ যেন সব অনুভূতি ডালপালা বিস্তার করতে চাইছে। পলক ফুলটা হাতে তুলে নেয়ার জন্য হাত বাড়ায় এমন সময় করে কোথা থেকে একটা গাড়ি চলে আসে। সেই গাড়ি থেকে ১০-১২ জন নেমে আসে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মেহরাজকে আটকে রাখে আর কয়েকজন পলককে টানতে টানতে গাড়িতে তোলে। পলক চিৎকার করতে থাকে। মেহরাজ পলককে বাঁচাতে চাচ্ছিল কিন্তু একা এত জনের সাথে পেরে ওঠে না।
মেহরাজকে মারতে মারতে আহত করে দিয়ে সবাই গাড়িতে উঠে পড়ে এবং পলককে নিয়ে যেতে থাকে। মেহরাজ এই আহত অবস্থাতেও অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় এবং পলককে বাঁচাতে চায়। সেজন্য সে গাড়ির পেছনে নিজের বাইক নিয়ে তাড়া করে।
এদিকে গাড়িতে বসা কয়েকজন লক্ষ্য করে মেহরাজ তাদের ফলো করছে৷ তাই তারা গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। এরমধ্যে একজন মুখোশ পড়া লোক তার মুখোশ খোলে। পলক অবাক হয়ে যায় কারণ এটা আর কেউ নয় জুয়েল। জুয়েল পলকের ওড়না টেনে ধরে এবং বলে,
“তোর জন্য আমি ফারিয়াকে পাইনি। এর মাশুল তোকে দিতে হবে। আজ তুই আমার বিছানা কাপাবি।”
বলেই পলকের কাছে আসার চেষ্টা করে। বাকি ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টিও পলকের দিকে। পলক এসব মেনে নিতে পারছিল না। জুয়েল তার স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিচ্ছিল। পলকের সাথে জোর জবরদস্তি শুরু করে। জুয়েলের দেখাদেখি বাকি ছেলেরাও পলকের পোশাক টেনে খোলার চেষ্টায় রত হয়।
পলক চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চায়। হঠাৎ করেই তার শরীরে অদ্ভুত শক্তি চলে আসে। সে এক ধাক্কায় সবাইকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অতঃপর গাড়ির দরজা খুলে রাস্তার মধ্যে একটা ঝাঁপ দেয়। এমন সময় সামন থেকে একটা গাড়ি আসছিল। পলক একদম সেই গাড়ির সাথে গিয়ে ধাক্কা খায় এবং রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে। জুয়েল ভয়ে বলে,
“এটা তো দেখছি মাডার কেস হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গাড়ি চালা নাহলে ফেঁসে যাব।”
এদিকে মেহরাজ এসে পলককে রাস্তায় এভাবে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখে অস্থির হয়ে যায়। সে পলকের পাশে বসে পড়ে বলে,
“এই পলক চোখ খোলো তাকাও আমার দিকে। কিচ্ছু হবে না তোমার।”
পলক অনেক কষ্টে বলে,
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি মেহরাজ ভাই…”
বলেই সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। মেহরাজ পলকের এই অবস্থা দেখে কাঁদতে শুরু করে। তাহলে কি সে পলককে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলবে?!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨