আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০৩

0
75

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তিন

একটা দেহের খণ্ডাংশ অংশ রাস্তায় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। দেহটা একজন মেয়ের। দেহের উপরিভাগ পড়ে আছে রাস্তায় আর নিচুস্তর পড়ে আছে তার থেকে এক হাত দূরে। মেয়েটার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো চেয়ে আছে জাইহানের দিকে। একবার সে চোখে তাকিয়ে জাইহান দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। সহ্য করতে পারল না দৃশ্যটা। কী ভয়ানক! কোনো মানুষ কি কোনো মানুষকে এভাবে মা’রতে পারে? উত্তর, ‘হ্যাঁ’ পারে। তবে সত্যিকার অর্থে যারা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ তারা পারে না। আর যারা মানুষ রুপি জা’নো’য়ার তারা সব পারে। জাইহান একজনকে হুকুম দিয়ে বলল,
“লাশটাকে দ্রুত পোস্টমর্টেম করতে পাঠাতে বলো। অলরেডি পচন ধরেছে। বেশিক্ষণ এভাবে রাখা যাবে না। কাজ শেষ করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অফিসে জমা করবে।”
বলেই জাইহান সাথে নিলয়কে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। গাড়িতে বসে ফোন কলে ঢুকে ডায়াল করল আমির হোসেনের নাম্বারে। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে আমির হোসেন জিজ্ঞেস করলেন,
“ঘটনা কী বুঝলে?”
জাইহান খুব সর্তকীকরণ অবলম্বন করে জবাবে বলল,
“স্যার, এটাও রেপ কেস।”
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় বাক্যে বলল,
“মেয়েটাকে খুব জঘন্য ভাবে খু*ন করা হয়েছে, স্যার। চোখের সামনে এমন জঘন্য দৃশ্য দেখেও চুপ থাকাটা অন্যায়, স্যার। আমরা কী আইনের লোক হয়ে এতসব অন্যায় চুপচাপ মেনে নিব? নাকি উপর মহলের অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরো কয়েকজনের লাশ দেখব? এভাবে চললে সাধারণ জনগণ আমাদের উপর আস্থা রাখবে কী করে, স্যার?”
আমির হোসেন খানিকক্ষণ চুপ থেকে মোলায়েম স্বরে বললেন,
“আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, জাইহান।”
“সেটা কী স্যার?”
আমির হোসেন পুনরায় সন্দিহান স্বরে বলে উঠলেন,
“পুলিশ কেন চুপ? এই ঘটনা গুলোর জন্য কী তাদেরকে কোনোরকম তদন্তের ভার দেওয়া হয়নি? কেউ কি এখন অব্দি মিসিং ডায়রি বা হ*ত্যা মামলা করেনি?”
জাইহানের টনক নড়ল। অভিজ্ঞ স্বরে বলল,
“স্যার, রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন কী সেখানে বিচার পাওয়া যায়?”
আমির হোসেন নড়চড়ে উঠলেন। কথাটা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলেন,
“যেমন? কী বুঝাতে চাইছো তুমি?”
জাইহানের ঠোঁটের কোনে রহস্যময় এক হাসি ধরা দিল। শান্ত বাক্যে বলল,
“সামনা-সামনি এসে বলি, স্যার?”
ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত বাক্য শুনে জাইহান ফোন কেটে দিল। নিলয় এতক্ষণ সব কথা শুনে বিস্ময়ভরা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“স্যার, আপনি কি অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন?”
জাইহান নিলয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
“বুদ্ধি খাটাও, নিলয়। বুদ্ধির জোরে চাকরির এক বছরের মাথায় প্রমোশন পেয়েছি। দুই, তিনটা সাহসিকতার পদকও আছে আমার ঝুলিতে। আই থিংক, খুব শিঘ্রই আমি আরেকটা প্রমোশন পেতে চলেছি।”
বলেই গাড়ি স্টার্ট করল। নিলয় হা হয়ে তাকিয়ে আছে জাইহানের দিকে। বুঝার চেষ্টা করল জাইহানের কথাগুলো৷ কিন্তু আফসোস এত বুদ্ধি যদি নিলয়ের থাকতো! আফসোসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে নিজে বলল,
“নিলয় তোর কাজ শুধু বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো। এত কিছু তোর দ্বারা সম্ভব না।”



“বাবা, এই বিয়েটা আমি করব না।”
আমির হোসেন সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। হঠাৎ কানে এহেন শব্দ আসতেই দরজার দিকে চোখ গেল। তার আদরের কন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখে হাসি ফুটল। কিন্তু যখনি উপরোক্ত বাক্যটির কথা মনে পড়ল, তখনি কপালে দুটো ভাঁজ পড়ল। তিনি খুব বিচক্ষণ এক পুরুষ। কারোর চোখে তাকিয়ে মন বুঝতে বেশি সময় নেন না। তাই শান্ত বাক্যে বলল,
“তোমার মামনিকে বলো আমাদের দুজনের জন্য দুই কাপ গরম গরম কফি রুমে পাঠাতে।”
এমন কথা এই মুহূর্তে শুনলে সে কেউ বিচলিত হতো৷ কিন্তু জায়রা মোটেও বিচলিত হলো না। কারণ, সে তার বাবাকে খুব ভালো ভাবে পড়তে জানে। বুঝতেও পারে। তাই বাবার কথা মতো উচ্চ বাক্যে মা শাহানাজ বেগমকে কফির কথা জানান দিল। রুমে ঢুকে সোজা বেলকনিতে চলে গেল। বাহিরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ এই রোদ তো এই বৃষ্টি। আজকাল এভাবেই চলছে। জায়রা গ্রীলের ফাঁকা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল বৃষ্টি ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। বাতাসে বৃষ্টির ফোঁটা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে জায়রার চোখ, মুখ। জায়রা বৃষ্টি উপলব্ধি করতে চোখ দুটো বন্ধ করল৷ কিছু সময় কাটল এভাবেই নিরবে। কিছু মুহূর্ত পর হুট করে পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেতেই চোখ বন্ধ করা অবস্থায় প্রশ্ন করল,
“জিজ্ঞেস করলে না কেন বিয়েটা ভেঙে দিব?”
আমির হোসেন সাহেব অবাক হলেন না। সে জানেন তার মেয়ে তার উপস্থিতি চোখ বন্ধ করার অবস্থাও টের পায়। সেটা আজ নতুন কিছু না৷ জায়রা আর আমির সাহেবের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সুখ, দুঃখ ভাগ করে নেয় দুজন দুজনের সাথে। মায়ের সাথেও জায়রার বেশ ভাব। এক মাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন জায়রাকে এই বাড়ির সবাই মাথায় করে রাখে। আমির সাহেব জায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত বাক্যে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
“কখনো কোনো কারণ জিজ্ঞেস করি বুঝি?”
জায়রা চোখ খুলল। বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। প্রতিউত্তরে বাবার থেকেও হাসি উপহার পেলো। আমির সাহেবের হাতে দুই কাপ কফি। একটা কফির কাপ জায়রার দিকে এগিয়ে দিল। জায়রা কফির কাপটা নিতে নিতে শান্ত বাক্যে বিজ্ঞদের মতো উপদেশ দিয়ে বলল,
“বাবা, কিছু কিছু সময় কারণ খুঁজতে হয়। জানতে হয়। সবসময় অন্যকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হয় না। নিজের ছায়াও কিন্তু অন্ধকারে বেঈমানী করে।”
আমির সাহেব মেয়ের কথায় হাসলেন। বিশ্বস্ত স্বরে বললেন,
“তোমার বাবা এতটাও বোকা নয়, আম্মাজান। তোমার বাবার চোখ খাটি সোনা আর পাতি সোনার মধ্যে তফাৎ বুঝে। পরিবারের বাইরে তোমার বাবার বিশ্বাস এত বছর কেউ একজন অর্জন করতে পেরেছে।”
জায়রা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কে সে?”
আমির সাহেব বেশ গর্ব করে জবাব দিলেন,
“ক্যাপ্টেন জাইহান সিকদার।”
জায়রা নামটা শুনে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“নতুন কেউ?”
“না। তবে তুমি চিনবে না৷”
বলেই প্রসঙ্গ পাল্টে সন্দিহান চোখে জায়রা দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“রিজভানের মতো একটা ছেলেকে তুমি কিভাবে ভালোবাসলে, জায়রা?”
জায়রা এবার ভড়কে গেল৷ অবাক চোখে তাকাল আমির সাহেবের দিকে। তার মুখে লেগে আছে এক রাশ রাগ। জায়রা অবাক বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কিছু…?“
জায়রা কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই আমির সাহেব বলা শুরু করলেন,
“তোমাকে আমি খুব বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী মেয়ে ভাবতাম। তুমি আমার মেয়ে হয়ে মানুষ চিনতে ভুল করলে কিভাবে?”
জায়রা অপরাধী ভঙ্গীতে জবাব দিল,
“তোমার মেয়ে এই প্রথম মানুষ চিনতে ভুল করে ফেলেছে, বাবা। তোমার মেয়ের জীবনের প্রথম ভালোবাসা, অনুভূতি সব ভুল পাত্রে দান করেছে। ভীষণ বাজে ভাবে ঠকে গেছি, বাবা।”
জায়রার চোখে অশ্রুকণা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমির সাহেব মেয়ের চোখের পানি খেয়াল করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। স্বান্তনা বাক্যে বললেন,
“আমার ফুলকন্যার চোখে অশ্রু মানায় না। ভুল মানুষের জন্য তো একেবারে নয়। ভুল মানুষের জন্য অশ্রু বির্সজন দেওয়া অন্যায়। বড় রকমের অন্যায়। জেনারেল মেজর আমির হোসেনের মেয়ে অন্যায় করতে পারে না।”
জায়রা মুচকি হাসল। বাবা নামক মানুষটা ওর মন নিমিশেই ভালো করে দেয়। জায়রা অশ্রুটুকি মুছে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি সব জেনেও বিয়েতে মত দিলে কেন? নাকি মত দেওয়ার পর জেনেছো? আর জানলে যখন তখন আমাকে ব…?”
আমির সাহেব মেয়েকে থামিয়ে দিলেন। স্থির হয়ে বললেন,
“আম্মাজান, আপনি কি করে ভাবলেন, আপনার বাবা এত সহজে সব কিছু মেনে নিবে? আমার মেয়ে যে ছেলেকে ভালোবেসেছে, জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়েছে তার সম্পর্কে কোনোকিছু জানব না? সেই ছেলে সম্পর্কে কোনো খোঁজ নিব না?”
জায়রা হা হয়ে তাকাল। অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“তুমি সব আগের থেকে জানতে, বাবা?”
আমির সাহেব হেসে বললেন,
“হ্যাঁ, আম্মাজান।”
“তাহলে আমাকে কেন বললে না?”
জায়রার অভিমানী বাক্যে কথাটা বলতেই, আমির সাহেব হেসে পুনরায় বলে উঠলেন,
“আমি চেয়েছিলাম, আমার মেয়ে নিজের ভুল নিজে খুঁজে বের করুক। জীবনের শেষ অব্দি আমি বা তোমার মা তোমার পাশে থাকবে না। তখন তোমাকেই ঠিক, ভুল খুঁজে বের করতে হবে৷ কোন রাস্তায় হাঁটলে ভালো হবে, কোন রাস্তায় হাঁটলে খারাপ হবে সেটা তোমাকেই বুঝতে হবে মা। এই যে এখন এত বড় একটা ধাক্কা না খেলে তুমি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারতে? শক্ত মনোবল জোগাতে পারতে?”
জায়রা কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। মনের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। আমির সাহেব কিছুক্ষণ থেমে জিজ্ঞেস করলেন,
“যে আমার মেয়ের সাথে অন্যায় করেছে তাকে কি এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে?”
জায়রা এবার মুখ খুলল। দৃঢ় স্বরে জবাব দিল,
“তোমার মেয়ে সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একাই যথেষ্ট, বাবা। বিশ্বাস রাখো, তোমার মেয়ে অন্যায়কারীকে এমনি এমনি ছাড়বে না।”
আমির সাহেব কিছু বলবে তখনি ফোন বেজে উঠল। ফোন স্কীনে জাইহানের নামটা দেখে জায়রার থেকে বিদায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো।



“স্যার, ওটা জায়রা ম্যাম না?”
ভর সন্ধ্যা। নিলয় আর জাইহান একসাথে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ জ্যামের মধ্যে জাইহানের কানে উপরোক্ত কথাটা আসতেই জাইহান থমকে গেল। সাথে সাথে জাইহান নিলয়ের হাতের ইশারা বরাবর তাকাল। একটা মেয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়ে আসছে ফুটপাত দিয়ে। মাঝে মাঝে একেক জনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেও থামছে না। লম্বা চুলগুলো বাতাসের দাপটে খোঁপা ছেড়ে বেরিয়ে আসল। সাথে সাথে চুলগুলো দুইদিকে দোল খাওয়া শুরু করল। পায়ের গোড়ালি সমান চুলগুলো জায়রার জামার সাথে প্যাঁচিয়ে যেতেই জায়রা মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। জাইহান এই দৃশ্যটা দেখার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। জায়রা পড়ে যেতেই জাইহান দূর থেকে চিৎকার করে উঠল। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেলো সেদিকে। মিনিটের মাথায় ছোটখাটো একটা ভীর জমল সেখানে। ভীড় ঠেলে জাইহান সামনে যেতেই দেখল জায়রা জ্ঞান হারিয়েছে৷ ঠোঁট, মুখ, গলাসহ হাতের বেশ কিছু জায়গায় ক্ষত। জায়রার এহেন অবস্থা দেখে জাইহান কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। হৃদপিন্ডটা বোধহয় ঢিপঢিপ করে বাজছে নাকি থমকে আছে? মন প্রশ্ন করল, কি হয়েছে আমার রূপবতীর? কোনো অঘটন ঘটেছে নাকি?

#চলবে