#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১০
বিলাসি দেবী আরও এক দফা চমকালেন। চোখ জোড়া তার জ্বালা করে উঠলো ভীষণ। এসেছিলেন আঁখির খবর শুনে, কিন্তু ক্রমশ অবাঞ্ছনীয় কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে জাগ্রত তারপর ফাল্গুনী। ফাল্গুনী কেনো এসেছে? তার জন্যই কি এলো মেয়েটা? কিন্তু দুজনে একসাথে এক জায়গায় কি করে? তাও চার বছর পর। বিলাসি দেবী ঘরের ভেতরে ঢুকবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধাবোধ করে পা পিছিয়ে নিলে পিছনে এসে দাঁড়ায় জাগ্রত।
পিছনে কারো উপস্থিতি টের পান বিলাসি দেবী। পিছনে ফিরলে চোখে পড়ে জাগ্রতকে। বিলাসি দেবীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা রেখে দাঁড়ায়নি জাগ্রত। তাই শক্ত মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন বিলাসি দেবী। রাগে তার শরীর ঈষৎ কাঁপছে। প্রথমে ফাল্গুনীকে দেখে তার ভেতর থেকে মায়ের সত্তা আবেগ অনূভুতি নিয়ে উঁকি দিলেও এবার উপচে পড়ছে স্বামী হারা এক বিধবা স্ত্রীর হাহাকার আর কষ্ট।
জাগ্রত আশা নিয়ে এসেছে, অনেক কথা জানার আছে তার। মনটা তার কু গাইছে সাদা ধবধবে শাড়িতে বিলাসি দেবীকে দেখে। বুঝতে বাকি নেই ফাল্গুনীর বাবা আর বেঁচে নেই। মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই মানুষটার মুখাবয়ব। ফাল্গুনীর হাতে তার হাত রেখে বিয়ের দিন বলা সেই কথা। কিন্তু সে তো তার সেই কথা রাখতে পারে নি। আর না রাখতে পেরেছে ফাল্গুনীকে। নিজেকে সামলে নিলো এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, বিলাসি দেবীকে বলে উঠলো,
“ভেতরে যান মা। আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।”
জাগ্রতর মুখে মা ডাক শুনে ফাল্গুনীর দিকে তাকালেন বিলাসি দেবী। ফাল্গুনী জাগ্রতর দিকে তাকালো। জাগ্রত একরোখা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিলাসি দেবীর দিকে। এ যেনো দৃষ্টি সিকল এর এক অদম্য নজির। তিনজনের মনে চলছে জোরদার কিছু কষ্ট। কারো মনের খবর কারো কাছে নেই।
এর মাঝে নিসান এসে দাঁড়ালো জাগ্রতর পাশে। নিসান বিলাসি দেবীকে চেনেনা। তবে পরিস্থিতির গম্ভীরতা টের পেয়ে চুপ করে গেলো। আঁখি বুঝতে পারছে এখন এখানে কিছু একটা হতে চলেছে তাই সেও চুপ করে আছে।
বিলাসি দেবী নিজের জায়গা থেকে এক চুল ও নড়েননি। ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের সামনে। জাগ্রত বিলাসি দেবীকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বললো ভেতরে যাওয়ার কথা। জাগ্রতর পর আঁখি এবার মুখ খুললো। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সবসময়ের মতো ধীরেধীরে নরম কন্ঠে বললো,
“পিসি ভেতরে আসো না। এটা তো অন্যদের বাড়ি। বাইরে অনেক লোক আছে। আসো না পিসি।”
বিলাসি দেবী নরম হলেন কিছুটা। তার মুখাবয়বের কাঠিন্যতা দুর হলো। তা টের পেয়ে আঁখি বিলাসি দেবীর হাতে ধরে টেনে নিয়ে এলো ভেতরে। এই মেয়েটার কথা তিনি একটুও ফেলতে পারেন না। গলে যান আঁখির মুখটা দেখলেই। ঠিক যেমন ফাল্গুনীর মুখটা দেখলে একসময় ঠান্ডা হয়ে যেতো তার বুকটা।
জাগ্রত আর নিসান ও ভেতরে ঢুকে গেলো। জাগ্রত দরজার কপাট জোড়া আটকে দিলো নিঃশব্দে। তারপর কাল বিলম্ব না করে বিলাসি দেবীকে প্রশ্ন করলো,
“আপনারা এখন কোথায় থাকেন মা?”
“আপনারা নয়, বলো আপনি।”
জাগ্রতকে থামিয়ে দিয়ে বিলাসি দেবী বলে উঠলেন শেষ কথাটা। জাগ্রত চুপ করে গেলো খানিকটা। বিলাসি দেবী আবারও বললেন,
“আমি এখানে গত চার বছর যাবত আমার এক বৃদ্ধা মাসি কে সাথে নিয়ে থাকি। আর কিছু?”
‘আরও অনেক কিছু। অনেক কিছু জানার আছে আমার। আপনি এখানে থাকেন, ফাল্গুনী বরিশালে থাকে আর বাবা…. বাবা তো নেই। তাহলে এই বিচ্ছিন্নতার কি কারণ? আপনারা আলাদা কেনো আর আপনাদের কোন খোঁজ খবর কেউ কেনো জানে না? আপনাদের কত খুঁজেছি আমি। আপনারা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সে বাসায়, ফাল্গুনীর জেঠুমনির বাসায়, আপনার বাবার বাড়ি এমনকি বাবার সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌতম আঙ্কেল এর বাড়িতে, সব জায়গায় খুঁজেছি আমি। কোথাও কোন খোঁজ মেলেনি, কেউ দিতে পারেনি আপনাদের খোঁজ….”
“কোন অধিকারে খোঁজ করেছো জাগ্রত? অধিকারের কোন নাম দিতে পারবে?”
“মা অধিকার কি সবই শেষ হয়ে গেছে?”
“মা বলার অধিকার তো নেই। ওই শব্দটাকে কেনো টানছো?”
“মা প্লিজ। আমার কথাগুলো আগে শুনুন। তারপর আপনি যা বলবেন আমি সব শুনবো। যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো শুধু আমার কথাগুলো শেষ…”
“সব পারবে? আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে পারবে জাগ্রত?”
জাগ্রতর বুকটা কেঁপে উঠলো। ভেতরে ঢুকে গেলো এক অজানা ভয়। তার কথায় যেনো কিঞ্চিৎ দোষারোপ এর আভাস পেলো জাগ্রত। তাতেই কথার খেই হারিয়ে চুপ করে গেলো। ফাল্গুনী এবার এগিয়ে এলো খানিক। বিলাসি দেবীর পায়ের কাছে বসে পড়লো তারপর তার হাঁটুতে মাথা রাখলো আস্তে করে। কেঁদে দিলো গা কাঁপিয়ে নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ বাদে পাগলের মতো বলতে লাগলো,
“মা আমাকে ক্ষমা করে দাও না মা, আমায় এবার কাছে টেনে নাও তুমি। বাবা তো রাগ করে চলে গেছে তুমিও আমায় দূরে ঠেলে দিয়েছো। আমি যে আর পারছি না মা। আমার যে ভীষণ একা লাগে। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে একটু শাষণ তো করো। আমায় বকো, আমায় মারো, আমাকে একেবারে মেরে ফেলো তবুও এভাবে অপরাধী করে রেখো না।”
বিলাসি দেবী ফাল্গুনীকে উঠতে বললেন। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে লাগলেন বারংবার। ফাল্গুনী গায়ের জোরে শক্ত হয়ে ধরে রইলো মায়ের পা জোড়া। কাঁদতে কাঁদতে একভাবে বলতে লাগলো সেই এক কথা।
বিলাসি দেবীর চোখের দৃষ্টি আর মুখভঙ্গিতে বিস্তর ফারাক মনে হচ্ছে নিসান এর কাছে। মুখভঙ্গিতে যতোটা কঠোরতার প্রলেপ বুলানো দৃষ্টিতে ঠিক ততোটাই আকুলতা উতলে উঠছে। অশ্রুরা এবার বাধ ভেঙ্গে উপচে পড়লো বলে। নিসান এগিয়ে জাগ্রতের পিঠে হাত রাখলো। ইশারা করলো বিলাসি দেবীর কাছে যেতে। জাগ্রত এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লো বিলাসি দেবীর পায়ের কাছে। ফাল্গুনী টের পেয়ে মাথা তুলে তাকালো জাগ্রতের দিকে। অবাক নজরে চেয়ে থেকে মায়ের দিকে চেয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো তার অভিব্যাক্তি। জাগ্রত বিলাসি দেবীকে বললো,
“অতীতে কি হয়েছিলো কিভাবে হয়েছিলো সব ভুলে যান মা….”
“ভুলে গেলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? হবে না তো।”
“বাবার কি হয়েছিলো মা?”
“তোমরা কি দুজনে এক সাথে এসেছো ফাল্গুনী?”
জাগ্রতর প্রশ্ন এড়িয়ে ফাল্গুনীকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো বিলাসি দেবী। ফাল্গুনী মাথা সোজা করে বাধ্য ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
“আমার সাথে উনার বাসে দেখা হয়েছিলো মা। উনি আমার পাশের সিটে বসেছিলেন। সেখান থেকে আমার পিছু নিয়ে এই অব্দি চলে এসেছেন। গত চার বছরে উনার সাথে এই প্রথম দেখা আমার।”
বিলাসি দেবী এবার জাগ্রতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“উঠে দাঁড়াও।”
জাগ্রত উঠে দাঁড়ালো না। বিলাসি দেবী এবার নিজেই উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে জাগ্রতও উঠে দাঁড়ালো। বিলাসি দেবী এবার বললেন,
“তুমি ফাল্গুনীর পিছু নিয়ে এই অব্দি চলে এসেছো শুধু অতীতে কি হয়েছিলো আর আমরা কেনো নিখোঁজ হয়েছিলাম সেটা জানতে? নাকি আরও কোন কারণ আছে?”
“আমি আপনাদের খোঁজ না পেয়ে…”
“জবাবটা ছোট করে দাও জাগ্রত। আরও কোন কারণ আছে?”
“আমাদের সেপারেশন তো এক বছরের.. মানে তারপর তো যেকোন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিলো।”
“তো?”
“ফাল্গুনীর সিদ্ধান্ত তো জানা হয় নি..।”
“সিদ্ধান্ত জানতে এসেছো? মানে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটাই বলতে চাইছো তো, যেই ডিভোর্স এর সিদ্ধান্ত এক বছর পর হওয়ার কথা ছিলো তা যখন এক বছর পর হয়নি তখন সেটা এখন হয়ে যাক। আর তার জন্যই বোধহয় এতোদিন এতো খোঁজ করেছো?”
“না মা আমি তা বলি নি। আমি শুধু ফাল্গুনীর কথা জানতে চাইছিলাম, ওর সিদ্ধান্ত জানতে চাইছিলাম।”
“তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? তোমার সিদ্ধান্ত কি জাগ্রত?”
“আমি.. আমার সিদ্ধান্ত কি আর ফাল্গুনীর সিদ্ধান্ত হবে। হবে না মা। আর তাছাড়া আমরা তো এখনও আইনত স্বামী-স্ত্রী….”
“আপনি চুপ করবেন? তখন থেকে যা খুশি বলে যাচ্ছেন। আমরা সবাই নিরব শ্রোতা আর আপনি একমাত্র বক্তা তাই তো?”
জাগ্রতকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলো ফাল্গুনী। গর্জে উঠে বলে উঠলো কথাগুলো। জাগ্রত দৃঢ়ভাবে বললো,
“আমি ভুল কিছু বলি নি ফাল্গুনী।”
“আমাদের সেপারেশন হয়েছিলো ভুলে গেছেন?”
“সেপারেশন যে এক বছরের জন্য হয়েছিলো সেটা কি তুমি ভুলে গেছো?”
“পাশে যে তোমাদের মা বসে আছে সেটা কি দুজনেই ভুলে গেছো?”
বিলাসি দেবীর এক কথায় দুজনে শান্ত হলো। দুজনে দু’দিকে ফিরে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ। বিলাসি দেবী দুজনকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন তোমরা কি চাও?”
জাগ্রত আর ফাল্গুনী দুজনেই চুপ। দুজনের জবাবের খাতা শুন্য। নিসান এর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু অতীত সম্পর্কে কিছু না জানায় কিছু বলে উঠতে পারছে না। আঁখি চাইছে সব মিটে যাক। ঠিক হয়ে যাক তিনজনের সম্পর্ক। এক হয়ে যাক ফাল্গুনী আর জাগ্রত কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না। নিরবে উপরওয়ালার কাছে সব কিছুর জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছে শুধু। বিলাসি দেবী আবারও জিজ্ঞেস করলেন একই কথা। জাগ্রত এবার মুখ খুললো। আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি চাই আমি ফাল্গুনীকে ডিভোর্স দেবো না। কথা ছিলো এক বছর সেপারেশনে থাকবো দুজন। তারপর যদি মনে হয় দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারবো না তাহলে আবার এক হতে পারবো আর যদি এক বছর পরেও মনে হয় দুজনে একসাথে থাকা সম্ভব নয় তাহলে আমাদের ডিভোর্সের জন্য আবেদন করার কথা ছিলো। আমি এক বছর কেনো গত চার বছরেরও প্রতিটা মুহুর্ত অনুভব করেছি আমি ফাল্গুনীকে ছাড়া থাকতে পারবো না। পারবো না মানে পারবো না। আমি ফাল্গুনী চাই মা। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি ওকেই চাই। আপনি ওকে দিন আমায়। আমি কথা দিচ্ছি, ওর চোখে আমায় নিয়ে আর নতুন কোন আক্ষেপ এর অশ্রু বইতে দেবো না। এমনকি পুরোনো যত আক্ষেপ আর অভিযোগ আছে সব মুছে দেবো আমি, সব।”
~চলবে