নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৩

0
60

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৩]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“আ..আমি নিজের মেয়ের রে’ই’প কেস ক..কিভাবে লড়বো সারু?”(ক্রন্দনরত স্বরে)

কল্যাণীর মুখো নিঃসৃত এমন বাক্য শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো সারু। বড় বড় আঁখিতে হতভম্ব দৃষ্টিতে জেঠিমণির দিকে তাকালো সে। জেঠিমণি এসব কী বলছে? নিজের মেয়ের রে’ই’প কেস কিভাবে লড়বে মানে? স্নিগ্ধা! কিভাবে সম্ভব এসব। সারু অবিশ্বাস্য কণ্ঠ স্বরে বলে উঠলো,,

“এসব তুমি কী বলছো জেঠিমণি? স্নিগ্ধা!”

কল্যাণী কিভাবে কী বলবে বুঝতে পারছেনা না, প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। বসার ঘরে সবাই বসে কথা বলছিলেন, সারুও সেখানে ছিল। সে চুপচাপ নিজের শাশুড়ি মা, বড় পিসি শাশুড়ি, ছোট পিসি শাশুড়ির গল্প গুজব শুনছিল। এমতাবস্তায় কল্যাণী ক্রন্দনরত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে একথা বলতে বলতেই জোরে কান্না করা শুরু করলেন।
বসার ঘরে উপস্থিত সবাই এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

কিছুক্ষন আগে,

কোর্টে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী হচ্ছিলেন কল্যাণী। আজকে কোর্টে রায় দেওয়া হবে। যেই কেসের রায় দেওয়া হবে সেই কেস কল্যাণী লড়ছেন। সম্পত্তির লোভে ছোট ভাইকে খু’ন করেছেন বড় ভাই। যাকে খু’ন করা হয়েছে তার একটা মাত্র মেয়ে, খুবই ছোট বয়স। চার কী পাঁচ হবে। সম্পত্তি এমন একটা জিনিস, যার মোহে পরে মানুষ সর্বোচ্চ ঘৃনিত কাজ করে ফেলে। এমনকি মায়ের পেটের আপন ভাইকে অব্দি খু”ন করে। কল্যাণী পুরো দমে এই কেসটা নিয়ে তদন্ত করেছিলেন, সব প্রমাণ আজকে কোর্টে পেশ করবেন। তিনি পুরোদমে কনফিডেন্স রেখেছেন যে উনি ওই লোকটাকে ন্যায় পাইয়ে দিবেন। সত্যর জয় করবেন।
এমন আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে ফোন বেজে উঠলো ওনার। ফোনটা হাতে নিতেই ব্রু কুঁচকে গেলো কল্যাণীর। থানার পুলিশ অফিসার এস কে আহাজীব কল করেছেন। ব্রু কুঁচকে কলটা রিসিভ করলেন তিনি, ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠে অফিসার এস কে আহাজীব বলে উঠলেন,

“কল্যাণী ম্যাডাম, সিকদার শিহাবুদ্দিন সরকারি হসপিটালে(কাল্পনিক নাম)আসুন ইমার্জেন্সি। আপনার মেয়ের,,, আপনার মেয়ের রে’ই’প হয়েছে। মা’রা’ত্ম’ক সিচুয়েশন, দ্রুত আসুন।”

মুহূর্তেই বরফের ন্যায় জমে গেলেন কল্যাণী। থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন ফোন কানে দিয়ে। পৃথিবী যেন কল্যাণীর থমকে গেছে, একটা মাত্র মেয়ে তার। এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে অধ্যায়নরত।
কিভাবে কী হলো হিসাব মেলাতে পারছেনা কল্যাণী। মেয়েটাতো কালকেই মামা বাড়ি গেলো, তাহলে? তাহলে আজকে এমন খবর ওনার কানে কেনো আসলো?

হঠাৎ কল্যাণীর বোধগম্য হলো, অসহায় মাতৃকার মতো কেঁদে উঠলেন। তার ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটার সাথে যে কত বড় অন্যায় হয়েছে বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। ব্যাগের মধ্যে ফোনটা ঢুকিয়ে, ব্যাগটা হাতে নিয়ে কোনো মতো দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে বসার ঘরে নেমে আসলেন ভেজা আঁখিতে।

কল্যাণী হসপিটালে প্রবেশ করতেই যেন পরিস্থিতি গম্ভীর, ভারী হয়ে উঠলো কল্যাণীর অসহায় কান্নায়। হসপিটালের প্রতিটা মানুষ নির্বাক, নিশ্চুপ ভাবে একজন মায়ের অসহায় কান্না শুনছে। এই কান্না গায়ের পশম দাঁড় করানোর মতো ক্ষমতা রাখে।
কল্যাণী অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে আইসিইউ এর সামনে আসলেন। কল্যাণীর পিছু পিছু সারু, সারুর শাশুড়ি মিতালি এবং তার দুই ননদ ও ননস সাথে তাদের স্বামীরা আসলো। বাড়ির বাকি সদস্যদের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা পথেই আছে, আসছে।

“আ.. আমার মেয়ে মিতালি! আমার মেয়ের সাথে এ অন্যায় ক..কেনো হলো মিতালি? আমার বাচ্চা মেয়েটা, আমার মা টা!”(ক্রন্দনরত অবস্থায়)

মিতালি নিঃশব্দে কান্না করছে, কল্যাণীকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। যবে থেকে রায় বাড়িতে স্নিগ্ধার আগমন ঘটেছে, সেদিন থেকেই নিজের নাড়ি ছেঁড়া সন্তানদের থেকেও বেশি ভালোবেসেছে স্নিগ্ধাকে। বাড়ির সকলের চোখের মণি হচ্ছে স্নিগ্ধা। এই রায় পরিবারে স্নিগ্ধাই হচ্ছে একমাত্র মেয়ে।
সেই সকলের চোখের মণি, একমাত্র মেয়ের এই করুন পরিস্থিতিতে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেনা কেউ। কল্যাণী আইসিইউর দরজা জোরে জোরে ধা’ক্কা দিচ্ছেন আর কান্না করতে করতে বলছেন,,

“দরজা খোলো, আমি..আমি আমার মেয়েকে দেখবো। আমার স্নিগ্ধা, আমি আমার মাকে দেখবো। দরজা খোলো।”(চিৎকার করে)

সারু ফ্রীজড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চারদিকে কী হচ্ছে তার বোধগম্য হচ্ছেনা। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে কেউ সারুকে দেখলে মনে করবে সারু মানুষের মতো দেখতে এক ম্যানিকুইন। চোখের পলক পরছেনা তার, স্থির হয়ে চেয়ে আছে কল্যাণীর দিকে।
সারুর বড় পিসি শাশুড়ি এগিয়ে এসে কল্যাণীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠলেন,,

“একটু শান্ত হও বৌদি, এভাবে ভেঙে পরোনা। স্নিগ্ধার কিছু হয়নি, ওরা সবাই মিথ্যা বলছে।”

মাতৃকার মন, এত সহজে সন্তানের সাথে অন্যায় হওয়ার কথা শুনে শান্ত হতে পারেন না। কল্যাণীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে, তিনি কিছুতেই শান্ত হচ্ছেন না। কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই সাথে অসহায়ত্ব।

“জেঠিমণি!”

কল্যাণী তাকালেন, শেরহামকে দেখতে পেয়ে নিজেকে আরও বেশি অসহায় মনে করলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেরহামের বুকে, কান্নার বেগ বৃদ্ধি করে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,,

“আ.. আমার স্নিগ্ধা। ঐটুকু ব.. বাচ্চা মেয়েটা। আমার নিজেকে এ.. এতো অসহায় লাগছে শেরহাম। আমার ফ.. ফুলের মতো বাচ্চাটা!”

শেরহামের যেন মনে হলো কেউ তার কণ্ঠনালিতে পা চেপে ধরেছে। বুঁকের মধ্যে এক বিশাল পাথরের উপস্থিতি অনুভব হলো তার। চোখের কোণে অশ্রু জমতে শুরু করেছে তার। মায়ের পেটের বোন নেই, স্নিগ্ধাকে সেই মায়ের পেটের বোন ভেবে আসছে। স্নিগ্ধা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সবসময় তারা তার আবদার পূর্ণ করেছে। আজকে সেই বোনের এমন করুন দুর্দশা। মানতে পারছেনা শেরহাম।

আইসিইউর দরজা খুলে একজন বের হলো, ডাক্তার শাফান। মুখে মাক্স পরিহিত, মাক্স সরাতেই তার বিরস মুখশ্রী পরিলক্ষিত হলো।
গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,,

“পেসেন্টের সিচুয়েশন ভালোনা, অতিরিক্ত ব্লিডিং হয়েছে সেই সাথে প্রচুর ট’র্চা’র করা হয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করছি, এরপর বাকিটা আপনাদের প্রে ও সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করে। ভেতরে পুলিশ অফিসাররা আছেন, পেসেন্টের বয়ান নেয়ার চেষ্টা করছেন। আপনাদের মধ্যে দুইজন ভেতরে গিয়ে ওনাকে দেখে আসতে পারেন।”

ভেতরে যাওয়ার কথা শুনে কল্যাণী শেরহামকে ছেড়ে দিলেন, ছুট লাগালেন আইসিইউ এর ভেতরে। মুখে অক্সিজেন মাক্স পরা, শরীরে ব্যান্ডেজ। মুখে অজস্র আ’ঘা’তের চিহ্ন, চোখের এক পাশ ফুলে আছে। ঠোঁট কে’টে ফুলে নীল হয়ে আছে। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, স্নিগ্ধা কল্যাণীকে দেখলো। তার ছোট করে মেলা চোখ জোড়া মাকে প্রাণ ভরে দেখলো এক পর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো, মেয়ের এমন ডুকরে কেঁদে উঠা দেখে কল্যাণী নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি একজন উকিল, শক্ত মনের মানুষ।
মেয়ের এই অবস্থায় কিছুতেই তিনি ভেঙে পরবেন না, তিনি ভেঙে পরলে যে স্নিগ্ধাকে তিনি আগলাতে পারবেন না। মেয়েটা তো এমনিই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে।

“ম্যাডাম, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করুন। মেয়েকে অভয় দিন, অনেক বয়ান দিতে বলা হচ্ছে কিন্তু তিনি কিছুই বলছেন না থম মে’রে আছেন। আপনার মেয়ের এই কেসটা আপনাকে লড়তে হবে তাই দয়া করে ওনাকে সব সত্যিটা বলতে বলুন, ওনার এই বয়ানের জন্য আমরা সেই কালপ্রিট কে শাস্তি দিতে সক্ষম হবো। নয়তো সেই কালপ্রিটের দ্বারা আবারো কোনো নিষ্পাপ মেয়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।”

পুলিশ অফিসার এস কে আহাজীব থমথমে স্বরে বলে উঠলেন। কল্যাণী কিছু সময় নিলেন, এরপর স্নিগ্ধার পাশে গিয়ে স্নিগ্ধার হাতে হাত রাখলেন আলতো ভাবে। মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,,

“মা, ভয় নেই এইতো তোমার মা চলে এসেছে। আমি আছি তোমার পাশে, তোমার কিছু হয়নি মা। ভয় পেওনা, যা যা হয়েছে যারা এমন করেছে সবটা বলো। ভয় পেওনা, তোমার মা তোমার পাশে আছে মা।”(মৃদু স্বরে)

মায়ের এমন মৃদু স্বরের বাক্য বচন শুনে স্নিগ্ধা আরও বেসামাল হয়ে পরলো, কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেলো। মেয়ের এমন কান্না কল্যাণীর হৃদয়ে ঝড় উঠলো, সবটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটায়।
তিনি আলতো হাতে স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,,

“আমি আছিতো তোমার পাশে মা, কাঁদেনা। বলো সবটা।”

কল্যাণী থমথমে মুখে অফিসার এস কে আহাজীবের দিকে তাকালেন। ইশারা করলেন রেকর্ড শুরু করতে। স্নিগ্ধার কান্নার বেগ কমে এসেছে, মেয়েটার আর কাঁদার ক্ষমতা নেই। মেয়ের এমন করুন চেহারা সহ্য করতে পারছেন না আর কল্যাণী। কল্যাণীর পাশে শেরহাম এসে দাঁড়ালো। কল্যাণী ভেজা নেত্রপল্লবে শেরহামের দিকে তাকালো।

কল্যাণীর ফোনটা বেজে উঠলো। কল্যাণী ফোনটা হাতে নিলেন, দেখলেন আননোন নাম্বার। ঢক গিলে শেরহামের দিকে তাকালেন, এরপর অফিসারের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে।

কল রিসিভ করলেন কল্যাণী। কিছু বলার আগেই অপর পাশ থেকে হাসির আওয়াজ শুনতে পেলেন। হাসির মাঝেই তেজালো পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,,

“ভদ্র ভাবে বলেছিলাম হয় মেয়ে জামাই করুন নাহয় এই কেসটা থেকে সরে যান। কিন্তু কোনোটাই করলেন না, এখন মেয়ের মান সম্মানও হারালেন সেই সাথে কেসটা হ্যান্ডেল করার মানসিকতা। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করলাম, মাঝে মজাও নেওয়া গেলো।”(তেজালো কণ্ঠে)

কল্যাণী থমকালেন, ফোন কানে চেপে রেখেই দু পা পিছিয়ে গেলেন। বর্তমানে যেই কেসটা হ্যান্ডেল করছেন ওই কেসের প্রেক্ষিতে আজ তার মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ হয়েছে! ভাবতেই স্নিগ্ধার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষী দায়ী করলেন। ওনার জন্য আজ ওনার ফুলের মতো মেয়েটার সাথে এতো বড় অন্যায় হলো।

চলবে,,?