নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৭

0
60

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৭]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“আমার স্নিগ্ধার এমন করুন অবস্থা দেখে আমি প্রতিনিয়ত ভেঙে পরছি, দয়া করে ‘সৎ কখনো আপন হয়না’ আবারো এটা বলে আমাকে আরও ভাঙবেন না। দয়া করে এখান থেকে চলে যান, আপনাকে বা আপনার বাবাকে আমি আমার চোখের সামনে দেখতে চাইনা আর না চাই আমার মেয়ের আশে পাশে দেখতে।”(কঠোর কণ্ঠস্বরে)

আদিত স্থির হলো, অতীতের করা বোকামি.. উহু বোকামি না ঠিক মানসিক আ’ঘা’তের ফলে আজ তাকে এইরকম একটা পরিস্থিতিতে পরতে হচ্ছে। আদিতের নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে, একদিকে মায়ের তার প্রতি এমন অপরিচিতদের মতো আচরণ অপরদিকে নিজের বোনের এমন করুন দুর্দশা। আদিতের কেনো জানি মনে হচ্ছে স্নিগ্ধার এমন অবস্থার জন্য সে দায়ী। সেদিন যদি মাকে ঐভাবে মানসিক আ’ঘা’ত না করতো, তিক্ত কথার বাণ না ছুড়তো তাহলে আজকে এমন কিছুই হতোনা। তার বোন প্রাণবন্ত হয়ে এদিক সেদিক সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াতো। মাকে মা বলে হাজারবার ডাকতে পারতো।
আদিত ঢোক গিলে, বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,,

“আ..আপনি আপনি করে কেনো বলছো মা? শে.. শেষ বারের ম.. মতো ক্ষমা করে দাও না মা। কোনোদিন ত..তোমায় আর আ’ঘা’ত দিয়ে কথা বলবোনা, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।”

কল্যাণী দমলেন না। কঠোর হয়ে রইলেন, সেদিন তিনি শুধু আ’ঘা’তই পাননি পুরো দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলেন। মাতৃত্ব পালনের দিকে আঙ্গুল, চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলেছিলেন বিপুল রায়। এমনি বাচ্চা মেয়েটাকেও আ’ঘা’ত করেছিলেন তিনি। এসবের রেশ আজ অব্দি কাটিয়ে উঠতে পারেননি কল্যাণী। দিন শেষে ঘুরে ফিরে আপন নীড়ে আসার পর এসব কথা ওনার ঘা গুলোকে তাজা করে তুলে।
দিনের বেলায় তিনি সবার সামনে নিজেকে শক্ত ব্যাক্তিত্বের দেখালেও রাতের বেলায় তিনি অসহায়। নিজের কাছে অনেক অসহায় অনুভব করেন নিজেকে। যে ছেলেকে নিজের পেটের ছেলের মতো ভালোবেসে আগলে রেখে বড় করেছিলেন সেই ছেলে ওনাকে তিক্ত কথার আ’ঘা’ত করেছে, সৎ মা কখনো আপন মা হয়ে উঠতে পারেনা বলেছে মুখের উপর, এতো কিছু করার পরেও। ছেলের লালন পালনে ত্রুটি হবে দেখে বিয়ের দশ বছর পর কনসিভ করেছিলেন। নিজের চাইতেও আদিতকে আগলে রেখেছিলেন ভালোবেসে। এসব কিছুই বিপুল রায়ের চোখে পরেনি, মিথ্যা কথার জেরে ওনার গায়ে হাত তুলেছিলেন, চরিত্র ও মাতৃত্বে আঙ্গুল তুলেছিলেন, স্নিগ্ধাকে আ’ঘা’ত করেছিলেন। এসব,, এসব তিনি ভুলবেন কিভাবে? উহু, কিছুতেই এইসব কিছু ভুলবেন না তিনি।

“জেঠিমণি।”

শেরহামের কণ্ঠস্বর পেয়ে আদিত কল্যাণীকে ছেড়ে দিলো। কল্যাণী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন। শেরহামের উদ্দেশ্যে বললেন,,

“সারু ও তোমার বাবা বাড়িতে গিয়েছেন?”

শেরহামের নজর আদিতের উপর নিবদ্ধ। আজ চার পর আদিতকে স্বচক্ষে দেখছে শেরহাম। আদিতের চেয়ে এক বছরের ছোট শেরহাম। শেষ যখন শেরহামের আদিতের সাথে দেখা হয়েছিল তখন শেরহাম সবে মাত্র তেইশ পা রেখেছিলো আর আদিত চব্বিশে।
শেরহাম হালকা কেঁশে বলল,,

“হ্যা জেঠিমণি বাবা ও সারু বাড়ি গিয়েছে। তুমিও যাও, আমি এখানে আছি স্নিগ্ধার পাশে। তোমার এখন ফ্রেশ হওয়া দরকার, আজকে প্রচুর প্রেসার গিয়েছে তোমার উপর। এখনো অব্দি কিছু খাওনি, বাড়ি যাও।”(হালকা কেঁশে)

কল্যাণী একনজর স্নিগ্ধার দিকে তাকালেন। মেয়েটার মলিন মুখশ্রী। বুকের ভেতরটা অনেকটা শুন্য অনুভব হলো কল্যাণীর। ধীর পায়ে কেবিন থেকে যাওয়ার জন্য এগোলেন। আদিত চেয়ে আছে কল্যাণীর যাওয়ার পানে এই আশা নিয়ে যে কল্যাণী একবার তার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরবে। কপালে চুমু খেয়ে ভালোবেসে ডাকবে “আদি”।
কল্যাণী তাকালেন না, শক্ত পায়ে বেড়িয়ে গেলেন কেবিন থেকে।
আদিত দৃষ্টি স্নিগ্ধার উপর নিবদ্ধ করলো।

“জেঠিমণি রিসেন্ট যে কেসটা জিতেছেন, সেটা চলাকালীন জেঠিমণি যাতে কেসটা না লড়েন এর জন্য ফুলের আজকে এই পরিস্থিতি। ওই রেপিস্ট এখনো সুস্থ সবল ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেঠিমণি চাচ্ছে ওর সহজ মৃ’ত্যু ফাঁ’সি। কিন্তু আমি তো তা চাইনা, আমি চাই যেভাবে আমার ফুলকে কষ্ট দিয়েছে তার তিন গুণ বেশি কষ্ট দিয়ে ওই রে’পি’স্টকে মা’রতে।”

ভাবলেশহীন ভাবে বললো শেরহাম। আদিত প্রতুত্তরে কিছু বললোনা, নিশ্চুপ হয়ে স্নিগ্ধার মুখশ্রী দিকে তাকিয়ে রইলো। শেরহাম নির্লিপ্ত কণ্ঠে আবারো বলে উঠলো,,

“মিষ্টার হিটম্যান, আজকের রাতটা তোমার। এনজয় টুনাইট।”(নির্লিপ্ত কণ্ঠে)

আদিত সরু ও কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো শেরহামের দিকে। এরপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। আদিত যেতেই শেরহাম ঠোঁট কা’ম’ড়ে হাসলো। বিপুল রায়ের বিজনেসের বিস্তার কানাডায়ও ছিল বিধায় তিনি ছেলেকে নিয়ে কানাডা পাড়ি দেন। সেখানে তিনি বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকেন কাজের জন্য। আদিত তখন মায়ের সাথে করা ব্যবহারের জন্য ভারী অনুতপ্ত ছিল। বিষন্নতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছিলো প্রায়, সেই সময় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এক অপকর্মের সাথে। টাকার বিনময়ে মানুষকে খু’ন করা। ভদ্র মুখোশধারী মানুষ যারা টাকার বিনময়ে মানুষকে খুন করায় তাদের কাছে নিজেকে একজন হিটম্যান হিসেবে গড়ে তুলেছে আদিত। প্রতিটা খু’নে এক বিন্দু প্রমাণ রাখেনি আদিত সেই সাথে নিজেকে সেফ রাখার জন্য যারা তাকে খু’ন করার জন্য টাকা দিয়েছিলো তাদের কাছে অব্দি নিজের চেহারা উন্মুক্ত করেনি কখনো। প্রায় দু বছরের মতো এসবের সাথে জড়িত ছিল সে, প্রায় শয়ের মতো মানুষকে খু’ন করেছে সে। এরপর তার হঠাৎ বুঝ হলো তার মা তাকে তো এমন আদর্শ দেয়নি। তাহলে সে কেনো এমন অপকর্ম করছে। এই অপকর্মে জড়িত হয়ে সে কিছু কীটদের সরিয়েছে আবার কিছু নিরীহদেরও সরিয়েছে। আবারো অনুতপ্তবোধ করতে শুরু করেছিল সে, এক পর্যায়ে এসব ছেড়ে দিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে শুরু করেছিল। যেসব মানুষ তাকে খু’ন করার জন্য হায়ার করেছিল সেসব মানুষদের কাছে নিজেকে আড়াল করে রাখার ফলে কেউ তাকে শনাক্ত করতে পারেনি। বিপুল রায় আদিতের ব্যাপারে সবই জানতেন, কিন্তু কিছু বলার মতো মুখ ওনার কাছে ছিলোনা। বাবার দায়িত্ব তিনি ঠিক মতো পালন করতে পারেননি তার ফলেই আদিত এই অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো শেরহাম। স্নিগ্ধার পাশে চেয়ার টেনে বসলো, স্নিগ্ধার মাথায় আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। শেরহাম অনুভব করলো তার অনুভূতি গুলো ভারী হয়ে আসছে। স্নিগ্ধার ওই করুন মুখশ্রী গুমোট অনুভূতির সৃষ্টি করছে শেরহামের মনে। স্নিগ্ধাকে শেরহাম অনেক ভালোবাসে। বোনের এমন করুন পরিস্থিতি বারবার ওকে দুর্বল, নিষ্প্রভ করে তুলছে।
শেরহামের চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করতে শুরু করলো। শেরহাম নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। কাঁধে কেউ হাত রাখতেই শেরহাম চোখের কোণের অশ্রু মুছে উঠে দাঁড়ালো। পেছনে ডাক্তার শাফান দাঁড়িয়ে আছে। শেরহামকে নিজেকে দিকে তাকাতে দেখে ডাক্তার শাফান বলে উঠলেন,,

“নিজেকে শক্ত রাখুন শেরহাম। আপনাদের কাঁধে এখন অনেক বড় একটা দায়িত্ব আছে। পেসেন্ট অনেক তিক্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে গেছেন, ওনাকে খুশি রাখার দায়িত্ব আপনাদের। এই পরিস্থিতি ফেস করা খুব কম সংখ্যক মেয়েরা লাইফে এগিয়ে যেতে পারে আর নয়তো প্রায়ই মেয়েরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে সু’ইসা’ইড এটেন্ড করে। নিজেদের শক্ত করুন। পেসেন্টকে খুশি রাখার চেষ্টা করুন, চোখে চোখে রাখবেন।”(দৃঢ় কণ্ঠস্বরে)

শেরহাম ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো। স্নিগ্ধার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে। ডাক্তার শাফান নীরবে কিছুক্ষন স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে চলে গেলেন।


রাতে,,

কল্যাণী মেয়ের পাশে বসে আছেন। গুমোট অনুভূতি, বিষণ্ণ হৃদয়ে মেয়ের মলিন মুখখানি পর্যবেক্ষণ করছেন। কিছুক্ষন আগেই স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙার পর স্নিগ্ধা একবারও কল্যাণীর দিকে তাকায়নি। কল্যাণী নিষ্প্রভ কণ্ঠে বার কয়েক স্নিগ্ধাকে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কিন্তু স্নিগ্ধা কিছু বলেনি। চুপ করে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিল, এখনো তাকিয়ে আছে।
কল্যাণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলেন স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে। মনে মনে আওড়ালেন,,

“প্রকৃত পক্ষে তো আমি সবটা হারিয়ে ফেলেছি শুধু দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়া। স্বামী, সন্তান সব হারিয়ে ফেলেছি। আর কত শক্ত হওয়ার ভান করে থাকবো? ভেতরটা একদম শূন্য অনুভূত হচ্ছে। নিঃস্বতার শেষ দ্বারপ্রান্তে পদার্পন করছি!”

পরদিন

সারুর এইচএসসি পরীক্ষার আজকে প্রথম দিন। শেরহাম কল্যাণীর সাথে হসপিটালে গিয়েছিলো গতকাল সন্ধ্যায়। রাতটা সেখানে থেকে গিয়েছে। সারু চেয়েছিলো শেরহাম তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে দিয়ে আসুক। কিন্তু স্নিগ্ধার কথা ভেবে নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ফেলেছে সে।
প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ফাইলে নিয়ে রান্না ঘরে পা রাখলো সারু। তার শাশুড়ি মা, ছোট পিসি শাশুড়ি নাস্তা তৈরী করছেন। আর বিষণ্ণ মুখ স্নিগ্ধার সুস্থতার কথা আলোচনা করছে।

সারু নীরবে তার শাশুড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“মা, আমি রুটি বেলে দিচ্ছি।”(ধীর কণ্ঠে)

সারুর শাশুড়ি মিতালি সারুকে দেখে গম্ভীর মুখশ্রী করে ফেললেন। ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“প্রয়োজন নেই, তোমার আজকে এইচএসসির প্রথম পরীক্ষা। কেন্দ্র দূরে পরেছে, দ্রুত বেরোতে হবে। টেবিলে গিয়ে বসো আমি নাস্তা দিচ্ছি।”(ভরাট কণ্ঠে)

সারু আর কিছু বললোনা, কিছুক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে নীরবে টেবিলে গিয়ে বসলো। তার শশুরমশাই নেহাল রায় খবরের কাগজ পড়ছেন। সারু ওনাকে লক্ষ্য করলো উনি ভ্রু কুঁচকে খবরের কাগজের পাতা দ্রুত উল্টাচ্ছেন। এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি টিভি ছাড়লেন, সারু টিভির দিকে তাকাতেই ভড়কে গেলো। চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো।

ব্রেকিং নিউজ: “কমিশনার নির্মল ভৌমিকের ফাঁ”সির রায়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আ’ত্মহ’ত্যা করলেন নির্মল ভৌমিকের ছেলে পুষণ ভৌমিক। তার কক্ষে পুলিশ তদন্ত করলে জানতে পারে পুষণ ভৌমিক একটি ডাইরিতে লিখে গিয়েছেন জনপ্রিয় উকিল কল্যাণী রায়ের কন্যা স্নিগ্ধা রায়কে তিনি রে’ই’প করেছেন যাতে কল্যাণী রায় কেসটা না লড়েন। এর বাদেও উনি নিজ মুখে স্বীকার করে একটি ভিডিও করেছেন যেখানে তিনি জানিয়েছেন তিনি স্নিগ্ধা রায়কে রে’ই’প করেছেন।”

চলবে,,?