নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৯

0
49

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৯]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“ওই রে’পি’স্টের পোস্টমর্টেম এইচআইভি পসিটিভ করলে আপনার বোনের দিকেও সমাজ আঙ্গুল তুলবে আদিত রায়।”

আদিত ভ্রু কুঁচকে ভাবুক হলো। কোথাও না কোথাও তার বোনটাকেও মানুষের অপবাদ বহন করতে হবে। আদিত কিছুক্ষন ভাবুক হয়ে রইলো। এরপর বলে উঠল,,

“বেশ কয়েকদিন মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো বাবার করা অন্যায় নিয়ে। এরপর ঝোকের বশে নিজের করা অন্যায় মানতে পারছিলোনা এবং এর জন্যই আ’ত্মহ’ত্যা করেছে। চ্যাপ্টার ক্লোজ।”

অফিসার এস কে আহাজীব হাসলেন। মাথা নাড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালেন। শেরহাম আদিতের দিকে তাকালো। আদিতের বাহুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

“এই র’ক্ত’মাখা শার্টে জেঠিমণির সামনে গেলে, জেঠিমণি তোমাকে সন্দেহ করতে পারে। কারণ অফিসার কিন্তু জেঠিমণিকে বলে দিয়েছেন যে এটা আ’ত্মহ’ত্যা নয় খু’ন।”

“ভাবলেও কি আর না ভাবলেও কি, আমার কিছুই এসে যাবেনা। আমার বোনকে ছুঁয়েছে, ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছি। এরবেশি আমি আর কিছু জানিনা বুঝিনা আর জানা বুঝার চেষ্টাও করিনা।”(শান্ত স্বরে)

বলেই আদিত কেবিনে ঢুকলো। শেরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আদিতের পিছু পিছু কেবিনে ঢুকলো। কল্যাণী আদিতকে দেখামাত্রই নিজের চোখ মুখ শক্ত করে স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে চেয়ে রইলেন। আদিত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো কল্যাণীর দিকে, পেছন থেকে কল্যাণীকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। ধীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“আমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও মা, কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবোনা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও, তোমার মিহি কণ্ঠের আদি ডাক শুনতে আমার ভারী ইচ্ছে হচ্ছে মা। কতগুলো দিন পেরিয়ে গিয়েছে তোমার মুখে আমার নাম শুনিনা। তোমাকে মন ভরে দেখতে পারিনা, মা বলে ডাকতে পারিনা। আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না মা? শেষবারের মতো?”(ধীর কণ্ঠস্বরে)

কল্যাণী সবসময় চাইতেন স্বামী, সন্তান সদা ওনার আশেপাশে থাকুক। তাদের খুনশুঁটি ভরা একটা সংসার হোক, কিন্তু সেটা আজও অস্পষ্ট স্বপ্ন হয়েই থেকে গেলো। কল্যাণী আদিতকে আদি বলে ডেকে জড়িয়ে, ভালোবাসার পরশ আদিতের কপালে এঁকে দিতে ব্যাকুল হয়ে আছেন। কিন্তু পারছেনা না, কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছেন তিনি। তাই মুখশ্রী ভঙ্গিমা শক্ত করেই রেখেছেন। কিন্তু আদিতের এমন আবদার শুনে বেশিক্ষন নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারলেন না তিনি। ছেলেকে জড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন।

“আদি!”

এতবছর পরে মায়ের স্নেহমাখা ডাক শুনে আদিতের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। চোখে ঝাঁপসা দেখতে লাগলো। ভরাট কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“ম.. মা! আমাকে ক্ষ.. ক্ষমা করে দাও।”(ভারী কণ্ঠস্বর)

কল্যাণী রায় নীরবে আদিতকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলেন। শেরহাম, সে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শেরহামেরq খুশি লাগছে আজ তার জেঠিমণির খুশিতে। জেঠিমণি এখন কান্না করলেও শেরহাম জানে জেঠিমণি আদিতকে আদি বলে ডাকতে পেরে অনেক খুশি হয়েছেন। শেরহাম শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো। নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।
মা ছেলে বহুদিন পর এঁকে অপরের সংস্পর্শে এসেছে, তাদেরকে এখন একা ছেড়ে দেয়াটাই উত্তম।


রাতে..

উস্কখুস্ক, একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে শেরহাম। ঘরে প্রবেশ করতেই শেরহামের ভ্রু কুঁচকে এলো, সারু বিছানায় এলোমেলো হয়ে ফোঁপাচ্ছে। সারু শেরহামের উপস্থিতি টের পেতেই কোনোরকম উঠে দাঁড়ালো, ধীর পায়ে হেঁটে বেলকনিতে চলে গেলো। শেরহাম সবে মাত্র কিছু বলতে নিয়েছিল, কিন্তু সারু সেই সুযোগ না দিয়েই চলে গিয়েছে। শেরহাম মুখ গম্ভীর করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
শেরহাম ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সারু ঘরে নেই, বেলকনি থেকে এখনো ঘরে আসেনি। শেরহামের গম্ভীর মুখে ভ্রু কুঁচকে এলো। বাহিরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, মেয়েটা কি বৃষ্টিতে ভিজছে নাকি!
শেরহাম দ্রুত পায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো। দেখতে পেলো সারু বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।

শেরহাম সারুর বাহু টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। সারুর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, ঠোঁট কাঁপছে। শেরহাম ধমকের স্বরে বলে উঠলো,,

“এই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেনো? জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে নাকি?”(ধমকের স্বরে)

সারু নিশ্চুপ হয়ে শেরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে সারুর। নিজেকে আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলো,,

“জ.. জ্বর? সেটা তো ক.. কত আগে থেকেই ব.. বেঁধে আছে!”(কাঁপা কাঁপা স্বরে)

নাহ, কান্নাদের আটকানোতে নিজের সাথে এতো যুদ্ধের পরেও নিজেকে জয়ী করতে পারলোনা সারু। ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। শেরহাম হতভম্ব হয়ে গেলো হঠাৎ সারু এমন ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠায়। সারুর এমন কান্নায় শেরহাম অনুভব করলো তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসছে। অনুভব হচ্ছে পাথর আটকা পরেছে। শেরহাম ধীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“কি হয়েছে? কান্না কেনো করছো?”(ধীর কণ্ঠস্বরে)

সারু আর পারলোনা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলে উঠলো,,

“আ.. আমাকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দ.. দিলেও তো পারেন। আমার সহ্যর স.. সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমি ক্লান্ত মানুষের কাছ থেকে আ.. আমার মাতৃত্ব নিয়ে কটু কথা শুনতে শুনতে। আ.. আজকে সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পরে গিয়েছিলাম দেখে আ.. আপনার মা আমার আমাকে বলেছে আমি,, আমি মা হওয়ার যোগ্য নই। হ.. হুটহাট পরে গিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে ফে.. ফেলবো বলেই আমার কোনো সন্তান হচ্ছেনা। আ.. আমার পক্ষে এসব সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছেনা, দয়া ক.. করে আমাকে মুক্তি দিন। দম বন্ধকর লাগছে।”(ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে)

সারুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলার কথা শুনে শেরহাম হতবাক। এতদিন তার মা মিতালি সারুকে কথা শুনিয়েছেন তবে আজকে যা বলেছেন তা অনেক বেশিই বলে ফেলেছেন। শেরহামের রাগ লাগলো ভীষণ, এতোই রাগ লাগলো যে কি করবে দিক দিশা পেলোনা। সারুর ও তার মাঝের দূরত্ব গুচিয়ে সারুর অধরে অধর মিলিয়ে দিলো। নিজের রাগ ঝাড়তে লাগলো সারুর অধরের উপর।
সারুর কান্না থেমে গেছে, শেরহামের এহেন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে পরলো। কিয়ক্ষন অতিবাহিত হলো, হঠাৎ ভারী বজ্রপাতে সারু কেঁপে উঠলো। ঠোঁটে জ্বলুনি অনুভব হতেই শেরহামকে ধাক্কা দিতে শুরু করলো, তবুও শেরহাম ছাড়লনা। নিজের রাগকে ক্ষান্ত করেই সারুকে ছাড়লো শেরহাম। সারুর দম প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সারু। শেরহাম সারুকে হুট্ করেই কোলে তুলে নিলো, কঠোর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“মুক্তি? মুক্তি তো তুমি জীবনেও পাবেনা শেরহামের কাছ থেকে। বাচ্চা তাইনা.. বাচ্চার জন্যই ডিভোর্স, মুক্তির কথা তুলেছো, ঠিক আছে এখন থেকে প্রতিবছর মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য নিজেকে তৈরী করো।”(কঠোর স্বরে)

এদিকে সারুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো। কি থেকে কি হচ্ছে বোধগম্য হচ্ছেনা সারুর। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সারু নড়াচড়া শুরু করলো নিচে নামার জন্য। শেরহাম সারুকে শক্ত করে চেপে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। মুহূর্তেই সারুর গায়ের জলে বিছানা ভিজে উঠলো। শেরহাম একপ্রকার রাগের বশবর্তী হয়ে সারুকে বিছানায় চেপে ধরলো। নিজের অধর সারুর অধরের সাথে পুনরায় মিশিয়ে দিলো। সারু শেরহামকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে তবু পারছেনা।
ঠোঁটের তীব্র ব্যথায় সারুর আঁখি ভিজে উঠল। কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
শেরহাম সারুকে ছেড়ে দিলো। সারু ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। শেরহাম সারুর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে উঠলো,,

“কান্না থামাও, কান্না করছো কেনো? তুমিও তো এটাই চাও তাহলে কান্না করছো কেনো? ভুলে গেছো আমাকে সিডিউজ করতে? আজ যখন নিজ কাছে এসেছি তাহলে কান্না কেন করছো?”

সারু উত্তর করলোনা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। ক্রমশই কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে সারুর। শেরহাম মুখ তুললো, সারু চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শেরহাম মুখ এগিয়ে সারুর চোখের পাতায় গভীর ভাবে চুমু খেলো। সারু কিছুটা শান্ত হয়ে এলো তবুও কান্না থামালো না। শেরহাম ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,,

“তোমার আমার বয়সের পার্থক্য কত জানো? প্রায় নয় বছরের মতো। যখন তোমার সাথে আমার বিয়ে হয় তখন সবেমাত্র ষোড়শী অঙ্গনা ছিলে, সবেমাত্র দশম শ্রেণীতে পড়। তখন আমার বয়স সবে পঁচিশ ছিল, ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার কিন্তু বাবার কথামতো বাবার বিজনেসে যুক্ত হতে হলো। এখানে মনে একটা চাপা রাগ ছিল বাবার প্রতি, এরপর হুট্ করেই একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। অনেক জোড়াজুড়িতে সেই বিয়েটাও আমাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হলো মায়ের জন্য। সেদিন ফুলসজ্জা ঘরে অনেকটা রাগ নিয়েই প্রবেশ করেছিলাম। ভেবেছিলাম বাবা মায়ের উপর সব রাগ তোমার উপর খাটাবো, কিন্তু আমি আটকে গেলাম তোমার ঘুমন্ত ফোলা ফোলা মায়াবী মুখশ্রীতে। এক অদ্ভুত মোহে পরে তোমার মুখশ্রী পানে চেয়ে রয়েছিলাম, নিজের অজান্তে তোমার গাল স্পর্শ করতেই তুমি ঠোঁট উল্টে অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠেছিলে তুমি বিয়ে করতে চাওনা, তোমার স্বপ্ন পড়ালেখা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা। বলেই ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠেছিলে ঘুমের মাঝে, মায়া ও অপরাধবোধ কাজ করছিলো আমার। নিজের সব রাগ তোমার উপর খাটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমিতো নিষ্পাপ ছিলে। সেই মুহূর্তে ঠিক করেছিলাম তোমাকে পড়ালেখায় সাহায্যে করবো। তোমার পড়ালেখায় নিজেকে বাঁধা হিসেবে দাঁড় করবোনা। সেদিন থেকে তোমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছি। কিন্তু ভাবিনি তোমার স্বপ্ন পূরণ করার মাঝে তুমি একটা বাচ্চার জের ধরে ডিভোর্সের বিষয় উঠাবে। অবশ্য তোমার দোষটাই বা কোথায়, দোষটাতো আমারই।”(শান্ত স্বরে)

শেরহামের বলা প্রতিটা কথা শুনে সারু থমকালো। সারুর স্বপ্ন পূরণ করতেই শেরহাম এতদিন তার কাছে আসেনি। সারুর স্বপ্ন পূরণের পথে নিজেকে বাঁধা হিসেবে দাঁড় করায়নি।
সারু অনুভব করলো সারু কাঁপছে, কান্নারা আবারো বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। সারু নিজেকে এবার আটকানোর চেষ্টা করলোনা। শেরহামের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। শেরহাম সারুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সারুর চুলে মুখ ডুবালো।

চলবে..?