নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১২

0
56

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১২]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]

বৃষ্টিস্নাত আঁধারে বেলকনিতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আঁধার অম্বরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে স্নিগ্ধা। কিছুদিন আগেও জীবনটা সাতরঙা রঙিন ছিল স্নিগ্ধার। অথচ আজ.. আজ দুঃখেরা ছাড়া আর কিছুই নেই।
বুক ফে’টে কান্না আসলো স্নিগ্ধার। একটা মেয়ের কাছে সবচে বড় মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে সম্মান। স্নিগ্ধা সেই সম্মানটাই হারিয়ে ফেলেছে। স্নিগ্ধা অনুভূতি শূন্য হলেও এর দায়ভার কল্যাণীর উপর দিচ্ছে। স্নিগ্ধার একাকাশ সম অভিমান জন্মেছে তার মায়ের প্রতি। যদি আজ তার মা উকিল না হয়ে সাধারণ গৃহিনী হতেন, তাহলে আজকে তার মূল্যবান সম্পদ এভাবে কেউ অবৈধ ভাবে কেড়ে নিতোনা।

প্রবল প্রভঞ্জনের সাথে বৃষ্টিরা ফোঁটা ফোঁটায় একত্রিত হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধার শরীর। আঁধার অম্বরে কিয়ক্ষন পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্যসময় হলে স্নিগ্ধা এতক্ষন ভয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে চুপ করে থাকতো, কিন্তু সময়টা অনেক তেঁতো স্নিগ্ধার কাছে। এই তেঁতো সময়ের কারণে বিদ্যুৎ জোরে চমকানোর পরেও ভয় হচ্ছে স্নিগ্ধার, সে একপ্রকার অনুভূতি শূন্য হয়ে নিজেকে গুটিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির প্রবল বেগে পুরোপুরি ভিজে গেলো স্নিগ্ধা। আঁখি বন্ধ করলো স্নিগ্ধা, মনে পরলো আজকে সকালের কথা।

স্নিগ্ধা ও কল্যাণী বাড়ি ফিরেছে সবেমাত্র আধা ঘন্টা হলো। ইতমধ্যে প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছে, তারা স্নিগ্ধাকে দেখতে এসেছে।
নিশ্চুপ হয়ে স্নিগ্ধা বসার ঘরে সোফায় বসে ছিল। পাশেই মিতালি ও পিসিমণিরা স্নিগ্ধাকে নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখশ্রী করে বসে ছিল। প্রতিবেশীরা স্নিগ্ধার মুখশ্রীর দাগ দেখে একেকজন আফসোস পোষণ করতে লাগলেন। এরই মাঝে হুট করে একজন বলে বসলেন,,

“বুঝলে কল্যাণী, মেয়ের সদ্য স’ম্ভ্র’মহানি হয়েছে। যেই ঘর থেকে বিয়ের সম্মন্ধ আসে বিয়ে দিয়ে বিদায় করুন। সমাজের বুলি থেকে বাঁচতে বিয়ে দিয়ে দূরে বিদায় করুন।”

এতটুকু কথা, অথচ স্নিগ্ধার বুক উথালপাতাল করে ফেলেছে। ডুকরে সবার সামনে কেঁদে উঠেছিল স্নিগ্ধা। এদিকে প্রতিবেশী সেই মহিলা হতচকিত হয়ে গেলেন। কল্যাণী উঠে গিয়ে স্নিগ্ধাকে আগলে নিলেন। হম্বিতম্বি স্বরে বলে উঠলো,,

“স্নিগ্ধা.. মা কাঁদেনা। নিজেকে.. নিজেকে সামলাও।”

স্নিগ্ধা থামলোনা উঠে ছুট লাগলো নিজের কক্ষের দিকে। কল্যাণী রাগত দৃষ্টিতে সেই মহিলার দিকে তাকালো।

“আমার থেকে বয়সে আপনি অনেক বড়। সম্মান ও শ্রদ্ধা করি আপনাকে, ভেবেছিলাম আপনার জ্ঞান আমার থেকেও বেশি হবে। তবে আমি ভুল, আপনি তো জ্ঞানহীন বের হলেন। আমার মেয়েটা এমনিই মানসিক অশান্তিতে আছে, আপনার কি বিবেকে বাঁধেনি এভাবে বলতে? যদি শান্তনা নাই দিতে পারেন তাহলে ঘরে বসে থাকবেন, আগ বাড়িয়ে একটা মেয়েকে মানসিক ভাবে অশান্তিতে ফেলবেন না নিজের বিবেকহীনতা দিয়ে। মেয়ে আপনারও আছে, নিজের মেয়ের দিকে নজর রাখুন।”(রাগত স্বরে)

কল্যাণী আর কিছু বললেন না, মেয়ের ঘরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুট লাগালেন। এদিকে কল্যাণীর করা অপমানে বেশ রাগী হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন মহিলাটি।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা আর কিছু ভাবতে চাইলোনা, নীরব ভাবে বসে রইলো এই বৃষ্টির মাঝে।


রাত প্রায় এগারোটা.. সারুর জ্বর অনেকটাই কমেছে। তবে সারা শরীর সারুর ব্যথা করছে। কিছু খেতেও মন চাচ্ছেনা সারুর। শেরহাম বেশ কিছুক্ষন ধরে সারুকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সারু কিছুতেই খেতে চাচ্ছেনা, জোর করে সারুর মুখে এক লোকমা দিতেই শেরহাম হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলো। সারু তার হাত কাম’ড়ে দিয়েছে। শেরহাম কপট রাগ দেখিয়ে রাগান্নিত স্বরে বলে উঠলো,,

“হয় পড়তে বসো আর নয়তো চুপচাপ খাও।”(রাগান্নিত স্বরে)

শেরহাম কি বললো কিছুই শুনতে পেলোনা সারু। কণ্ঠে ঘুমের রেশ বজায় রেখে বলে উঠলো,,

“খেলে একমাত্র চু’মু খাবো। এর বেশ কিচ্ছু খাবোনা, চু’মুও যদি খেতে ভালো না লাগে তাহলে ঘুম খাবো। সরুন তো, ভাল্লাগেনা।”(ঘুম ঘুম কণ্ঠে)

শেরহাম ভ্রু কুঁচকে সারুর দিকে চেয়ে রইলো। ধমকে বলে উঠলো,,

“এই মেয়ে এই, কিসের কি হ্যা? কিছু বলিনা দেখে মাথায় উঠে বসছো? এক থা’প্প’ড় দেবোনা সব ঘুম, চু’মু জানালা দিয়ে পালাবে।”(ধমকে)

আচমকা শেরহামের ধমকে উঠাতে কেঁপে সোজা হয়ে বসলো সারু। পিট পিট করে পলক ফেলল। শেরহামের রাগী মুখশ্রীর দিকে চেয়ে নাক ফুলিয়ে হা করলো খাওয়ার জন্য। শেরহাম সারুকে খাইয়ে দিলো, মাঝে নিজেও খেলো।

“স্নিগ্ধফুলকে আজকে বাড়িতে এসেছে। তোমার জ্বর হুশ ছিলোনা তাই বলিনি। আজকে তুমি ওর সাথেই ঘুমাবে, ওর সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করবে। একাকিত্ব কাটানোর চেষ্টা করবে। যেভাবেই হোক, স্নিগ্ধফুলকে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে।”(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

শেরহামের বলতে দেরি, সারুর উঠে দাঁড়াতে দেরি নেই। বালিশ হাতে নিয়ে শেরহামের চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,,

“আর জীবনেও আপনাকে চু’মু খাওয়ার কথা বলবোনা। আসিয়েন খালি, মজা দেখাবো হুহ।”(নাক ফুলিয়ে)

বলেই সারু দাঁড়ালোনা গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এদিকে শেরহাম ভ্রু কুঁচকে বসে রইলো। মনে মনে আওড়ালো..

“মেয়ে মানুষ দিনে এতবার চু’মুর কথা বলে কেমনে? আজকে জ্বরের ঘরে কতবার যে এই মেয়ে চু’মুর কথা বলেছে, উফ মাথা খারাপ মেয়ে!”


সারু স্নিগ্ধার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় কড়া নাড়লো কিন্তু স্নিগ্ধার কোনো রেসপন্স দেখতে পেলোনা সারু। এরপর একটু জোরেই দরজায় কড়া নাড়লো সারু, আওয়াজ করে ডাকলো স্নিগ্ধাকে। কিন্তু স্নিগ্ধার কোনো রেসপন্স পেলোনা। সারুর টেনশন হলো, মেয়েটা এখনো দরজা খুলছেনা। এতক্ষনে সারুর চেঁচামেচিতে কল্যাণী পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শুকনো মুখে। কল্যাণীকে দেখে সারু চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,,

“জেঠিমণি স্নিগ্ধা দরজা খুলছেনা এতো ডাকার পরেও। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”(চিন্তিত স্বরে)

“আরও অনেকক্ষন আগেই তো স্নিগ্ধাকে খাইয়ে দিয়ে আসলাম। ওর সাথে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও বললো ওর একা থাকতে মন চাচ্ছে। আমি পূর্ণ বিশ্বাস করি আমার মেয়ে সু’ইসা’ইড করবেনা। তাই নিজেকে গুছিয়ে নিতে ওকে একটু একা থাকতে দিয়েছি।”

“একা থাকতে চাইলেও জবাব তো দিবে! বাহির থেকে বুঝা যাচ্ছে ঘরের লাইট জ্বলছে, স্নিগ্ধা এখনো জেগে আছে। তাহলে আওয়াজ কেনো করছেনা? স্নিগ্ধা লাইট জ্বালিয়ে কখনো ঘুমাতে পারেনা, ওর মাথা ব্যথা করে। তাহলে?”

কল্যাণী চিন্তিত হলেন, আদিতের ঘরের সামনে গিয়ে আদিতকে ডাকলেন। সারাদিন ক্লান্তির অবশেষে সবেমাত্র শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আদিত। কিন্তু মায়ের ডাকে উঠে পড়তে হয় আদিতকে।

“আদি, স্নিগ্ধা দরজা খুলছেনা। ভেতরে লাইট জ্বালানো তবে সাড়াশব্দ করছেনা।”

কল্যাণীর কথায় আদিত ভ্রু কুঁচকালো, দ্রুত পদে হেটে গিয়ে স্নিগ্ধার রুমের দরজা ধাক্কাল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স করছেনা স্নিগ্ধা।
আদিত এবার রুমের দরজা জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। স্নিগ্ধাকে ডাকাডাকিতে সবাই এতক্ষনে নিজ নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
শেরহাম ভ্রুকুটি করে আদিতকে বলে উঠলো,,

“এতোরাতে স্নিগ্ধফুলের রুমের দরজা এভাবে ধাক্কাচ্ছ কেনো?”(ভ্রুকুটি করে)

আদিত দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে উঠলো,,

“বোনকে ডাকা হচ্ছে কিন্তু বোন কোনো সাড়াশব্দ করছেনা। এতবার ডাকার পরেও রেসপন্স করছেনা!”

কয়েকবার ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। আদিত সহ সবাই রুমে ঢুকে দেখলো স্নিগ্ধা কোথাও নেই। আদিত বেলকনিতে গেলো, দেখতে পেলো স্নিগ্ধা পরে আছে ভেজা অবস্থায়। বুকটা ধ্বক করে উঠলো আদিতের, দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে কোলে তুলে ঘরে এনে শোয়ালো বিছানায়। কল্যাণী মেয়ের জ্ঞানহীন নিষ্পাপ মুখশ্রী অবলোকন করতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন, মেয়ের এমন অবস্থার জন্য উনিই দায়ী। ওকালতি পেশার প্রভাব যে পরিবারের উপর লাগবে কখনো না কখনো উনি জানতেন, তবুও এই পেশা ছাড়েননি। সত্যর পাশে থাকতে গিয়ে নিজের ফুলের মতো মেয়েটাকে নরকের মতো অনুভূতির সম্মুখীন করিয়েছেন। মা হিসাবে ওনার নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
কল্যাণীর স্নিগ্ধার মুখে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন, সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।

চলবে..?