নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১৫+১৬

0
69

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১৫]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
“প্রথমত আমি কোনো বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি আর দ্বিতীয়ত বেহায়া? বেহায়া কাকে বলছেন হ্যা? আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এত্ত বড় ধা’ম’রা হয়েও বেহায়ার মতো আমার পিছু পরে ছিলেন আমাকে পটাতে। নেহাত আমি ভদ্র সভ্য মেয়েমানুষ বলে আপনি আমাকে পটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এখন আপনি আমায় বেহায়া বলছেন।”(তেজমাখা স্বরে)

ইলার তেজমাখা স্বর শুনে আদিত ভ্রু কুঁচকে চেয়েই রইলো ইলার দিকে কিছুক্ষন। চেয়ে থাকার মাঝেই ইলা আবারো বলে উঠলো,,

“আমার থেকে আপনার পিছু ছাড়ানোর জন্য বাবা মিথ্যা বলেছিলো আপনাকে ভালোই বুঝতে পারছি। এর জন্য তো বাবাকে জবাবদিহি করতেই হবে, সে পরের হিসাব আগে আপনার সাথে আমি হিসেব মিলিয়ে নেই। এখনই যাচ্ছি শাশুড়ি মাকে বলতে যে এখানে আমাদের বিয়ে হবে সেই সাথে হানিমুনও।”(নাক ফুলিয়ে)

ইলা নাক মুখ ফুলিয়ে আর কোনো কথা বললোনা, লাগেজ টানতে টানতে রিসোর্টের ভেতরে হনহন করতে করতে ছুটে গেলো। আদিত ইলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে আদিতের মনে পরে গেলো পুরোনো দিনের তাদের প্রেমের শুরুটার কথা। আদিত ইলাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো, এখনও বাসে তবে আগের মতো আর তা প্রকাশিত হয়না। আদিত ভাবনার মধ্যে পরে গেলো, ইলার বাবা তাকে আর ইলাকে আলাদা করতে এতো বড় একটা মিথ্যা বলেছে। ইলাকে তার সামনে স্বার্থপর প্রমাণ করেছে। এই ভাবনার মাঝে আদিতের রাগ হলো, সে এতটা বোকা কিভাবে হলো! একবার অন্তত সত্যটা যাচাই করতে পারতো, কিন্তু তা না করে সে তার বাবার সাথে কানাডা পাড়ি দিয়েছে। একাকিত্ব, বিষন্নতায় নিজেকে পাপের রাজ্যে প্রবেশ করিয়েছে। হিটম্যান, এক অর্থে খু’নি বানিয়েছে নিজেকে।
সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদিত। মুহূর্তের মাঝেই মনটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেলো আদিতের, চারদিকে কত মানুষের কোলাহল, সমুদ্র ঢেউয়ের কোলাহলে খারাপ লাগার কথা নয় তবুও আদিতের মন বিষন্ন হয়ে উঠলো।


“হ্যালো, জামাইর মা স্যরি শাশুড়িমা। শাশুড়িমা আপনার ছেলেকে ঠিক কোন কবিরাজের তাবিজ দিয়ে বশ করতে পারবো একটু বলবেন আমাকে? একসময় আমাকে বশ করে মন মতো নাচিয়ে এখন আমাকে ভেগে যেতে বলছে! এসবের মানে হয় কোনো?”(কান্নারত স্বরে)

স্নিগ্ধা কিছুক্ষন আগে বাথরুম থেকে ভিজে চুপচুপে হয়ে বেরিয়েছিল। আজকে তাকে সম্পূর্ণ নির্বাক, নিশ্চুপ লাগছিলো। কল্যাণী স্নিগ্ধার এমন চেহারা দেখে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি হয়েছে কিন্তু স্নিগ্ধাক নিরুত্তর ছিল। শেষে কল্যাণী মেয়েকে কাপড় পাল্টে আসতে বললেন, স্নিগ্ধা কাপড় পাল্টে আসলে কল্যাণী স্নিগ্ধাকে বিছানায় বসিয়ে চুলের জল তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে থাকেন, তখনই কারো কান্নারত কণ্ঠস্বরের বাণী শুনতে পান। নজর ঘুরিয়ে দরজার দিলে তাকালেন তিনি, দরজায় ইলাকে দেখে বেশ অবাক হলেন কল্যাণী। দু মাস পর ইলাকে পুনরায় স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি, শেষবারের কথা মনে পড়তে কল্যাণীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। মেয়েটাকে সবার সামনে টানতে টানতে আদিত বাড়ির বাহিরে বের করে দিয়েছিলো। ইলাকে কল্যাণীর পছন্দ হয়েছে, পছন্দ না হয়েও উপায় নেই কথাবার্তা ও চেহারায় সবসময় মিষ্টি আভাস ছড়িয়ে থাকে। মেয়েটার সাথে এমন করায় আদিতকে অনেক বকাঝকা করেছিলেন তিনি। ঐদিন মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো তাই আর ঐবাড়িতে আসেনি সে। এদিকে কল্যাণীর তাকানোতে ইলা কান্নার স্বর আরেকটু বাড়িয়ে বলে উঠলো,,

“দেখুন না শাশুড়ি মা আপনার ছেলে আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখছেনা। আমাকে আপনার ছেলে বলেছে তার বউ বানাবে, বেবির মাম্মি বানাবে। সেই আপনার ছেলে পল্টি খেয়ে যাচ্ছে, বলছে আমি নাকি বেহায়ার মতো তার পিছু পরে আছি! আপনিই বলুন আমি যদি আপনার ছেলেরে ভালো নাই বাসতাম তাহলে ওর জন্য কি ওর লেজ ধরে কক্সবাজার অব্দি এসে উঠতাম?”(কান্নারত স্বরে)

কল্যাণীর হুঁশ ফিরলো, ইলার কথা শুনে মৃদু হাসলেন। কল্যাণী ইলার মুখদর্শন করে যা বুঝেছেন মেয়েটা অতীব সরল মনের, নির্ভেজাল। ইলার চক্ষুতে কল্যাণীর দেখেছেন আদিতের প্রতি এক আকাশসম ভালোবাসা।
ছেলেটা জীবনে এতটা ভালোবাসার একটা মানুষ পেয়েও কেন যে মেয়েটাকে অবহেলা করছে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,

“তুমি আদিতকে বিয়ে করতে চাও?”

“বিয়ে করতে চাই মানে, এখনই করতে চাই। বিয়েটা একবার করে নিই আপনার ছেলেকে বুঝাবো আমাকে ফেলে কানাডা চলে যাওয়ার মজা।”(মুখ ভেঙিয়ে)

স্নিগ্ধা নির্বাক চেয়ে আছে ইলার দিকে। মেয়েটা সোজা সাপ্টা কথা বলে, কথাও সোজা ভাবে বলে ফেলে প্যাঁচবিহীন। স্নিগ্ধাও তো ইলার মতোই চটপটে ছিল, কিন্তু ভাগ্যর পরিহাসে আজ স্নিগ্ধা একেবারে নির্বাক ও নিঃশেষের দ্বারপ্রান্তে।
ইলার নজর পরলো স্নিগ্ধার মলিন মুখশ্রী পানে। স্নিগ্ধার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা শুনে ইলাও বেশ কষ্ট পেয়েছে। স্নিগ্ধা মেয়েটা বয়সে এখনো অনেক ছোট, আর এই বয়সেই এমন একটা ইন্সিডেন্ট এর শিকার হয়েছে।
ইলা মলিন হাসলো, পরক্ষনেই মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,,

“আরেহ স্নিগ্ধা, কেমন আছো? জানি নিশ্চয়ই বৌদিকে পেয়ে ভালো হয়ে গেছো। কি মলিন মুখে বসে আছো, হাসো একটু। আমি এই রিসোর্টেই উঠেছি, চল স্নিগ্ধা ঘুরে আসি বাহির থেকে, আমাদের সাথে সারু ও শেরহাম দাভাই ও যাবে। অনেক মজা করবো। শাশুড়িমা আমার লাগেজ আপাতত এখানেই রাখছি, ঘুরে আসলে আমার রুমে নিয়ে যাবো।”(উৎফুল্ল চিত্তে)

ইলা নিজ উদ্যোগে স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে ভেজা চুল আঁচড়ে দিয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে বাহিরে যেতে উদ্যোত হলো।


“তখন তো ভাগিয়ে দিয়েছিলে, এখন আবার গলা জড়িয়ে চু’মু কেনো খাচ্ছ?”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

শেরহামের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে কথাটা বলে উঠতেই সারু নাক ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,,

“বেলকনিতে যে প্রেম বিলাস করতে গিয়েছিলেন খেয়াল ছিল আপনার যে কেউ বেলকনিতে তাকালে আপনার প্রেম বিলাস দেখতে পেতো? এর উপর আপনি খালি গায়ে শুধু টাওয়াল পড়ে ছিলেন। তাই ভাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন রুমের মধ্যে আছি তাই চু’মু খেতে আসছি।”(অভিমানী স্বরে)

শেরহাম ভ্রু কুঁচকে সারুর দিকে চেয়ে রইলো। সারু কেনো জানি মুখ ফুলিয়ে রাখতে পারলোনা, ফিক করে হেসে দিলো। শেরহামের গালে চু’মু খেয়ে বলে উঠলো,,

“প্রেমবিলাস করতে এসেছি জনাব এখন কি মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর হয়েই থাকবেন?”

শেরহাম ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“হ্যা গম্ভীর হয়েই থাকবো, যখন চু’মু খেতে আর প্রেমবিলাস করতে গিয়েছিলাম তখন আমায় প্রত্যাখান করেছিলে। এখন আমি তোমাকে প্রত্যাখান করলাম, সরো।” (ভরাট কণ্ঠে)

সারু সরলোনা, দু হাতে শেরহামের গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। শেরহাম কিয়ক্ষন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তবু সারুকে জড়িয়ে ধরলোনা। সারু মুখ কালো করে বলে উঠলো,,

“এখন কি জড়িয়েও ধরবেন না? আজব, আমার কি লজ্জা শরম নেই নাকি যে বেলকনিতে সমুদ্র পাড়ের এতগুলো মানুষের সামনে আপনাকে জড়িয়ে ধরে প্রেমবিলাস করবো! আশ্চর্য! যান লাগবেনা আপনার জড়িয়ে ধরা।”(মুখ কালো করে)

সারু সরে যেতে উদ্যোত হলে শেরহাম সারুকে টান দিয়ে জড়িয়ে ধরলো বক্ষের সাথে। সারুর চুলে মুখ গুঁজে বলে উঠলো,,

“ভাবলাম কই রাগ ভাঙাবে শ’খানেক চু’মু দিয়ে। কই তা না, একটা চু’মু দিয়েই তুমিও ফুলে যাচ্ছ। আমার বিড়াল আমাকেই মেও করছো। এটা কিন্তু ঠিক নয়।”(ধীর কণ্ঠে)

“হইছে হইছে আর জড়িয়ে ধরে এসব বলা লাগবেনা, আসুন বাহিরে যাবো। আজকে তো প্ল্যান ছিল সবাই একসাথে ঘুরবো। সবাই হয়তো বেরিয়ে পরেছে আর আপনি এখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।”

শেরহাম সারুকে ছেড়ে দিলো। সারুর কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে উঠলো,,

“আচ্ছা ছেড়ে দিলাম মহারানী, এবার আসুন আমরাও বের হই।”


আদিত, শেরহাম ও সারু, ইলা ও স্নিগ্ধা, কল্যাণী, মিতালি ও নেহাল রায় সবাই সমুদ্র পাড়ে এসেছে সমুদ্র ঢেউ ও চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। সারু ও ইলা মিলে জল ছোড়াছুড়ি শুরু করলো এঁকে অপরকে। স্নিগ্ধা চুপচাপ আদিত ও শেরহামের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো। কল্যাণী, মিতালি ও নেহাল রায় ইলা ও স্নিগ্ধার জল ছোড়াছুড়ি দেখে মৃদু হাসলেন। চারদিকে মানুষজনের ভিড়, প্রত্যেক মানুষই উৎফুল্ল ও উল্লাসিতমুখর হয়ে আছে।

“উৎস চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি, আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। আই থিঙ্ক আপনার মেয়ের জন্য আমার চেয়ে বেটার হাসব্যান্ড আর পাবেন না।”

চলবে..?

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১৬]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
উৎসের মুখনিঃসৃত বাক্যবচন শুনে হতভম্ব হলেন কল্যাণী সেই সাথে বাকি সবাই। শেরহাম আর আদিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে উৎসর দিকে। স্নিগ্ধা নির্বাক হয়ে উৎসের দিকে চেয়ে আছে। সকালে উৎসর ওইরকম স্পর্শ মনে পড়তেই চিত্তে শূন্য অনুভব হলো স্নিগ্ধার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো স্নিগ্ধার।

“আপনার যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমি এখনই আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো, আর জীবনে যদি বিয়ে করি তাহলে আপনার মেয়েকেই করবো। কারণ আমি ‘ও’কে ভালোবাসি। সবার আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করতে চাইছি দেখে আপনাদের মতামত জিজ্ঞাসা করছি নয়তো জিজ্ঞাসা করতাম না। তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম।”(ভাবলেশহীন ভাবে)

কল্যাণী রায় অবাকের শেষ চূড়ায় পৌঁছালেন। চেনা নেই জানা নেই হুট করে একজন এসে স্নিগ্ধাকে ভালোবাসে বলছে আবার বিয়ে করতে চাইছে। ভাবতেই অবাক লাগছে অনেক সবার কাছে।
আদিত চুপ করে থাকলোনা, তেজমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“আপনার সাহস দেখে অবাকের শেষ চূড়ায় পদার্পন করছি। আমার বোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা বলছেন? আপনার সাহস হয় কি করে আমার বোনের দিকে তাকানোর? লিমিটে থাকুন নয়তো চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দিবো।”(রাগান্নিত স্বরে)

উৎস ভ্রু কুঁচকালো, বজ্রকণ্ঠ স্বরে বলে উঠলো,,

“আমি ওর উডবি হাসব্যান্ড হই, নজর দিতেই পারি আমার উডবি শা’লাবেবি। এতে আমার চোখ তুলে হাতে দেওয়ার কি আছে? বোনকে কি বিয়ের আগেই বিধবা বানাতে চাও নাকি?”(বজ্রকণ্ঠ স্বরে)

আদিত রেগে কিছু বলতে যাবে তখনই ইলার উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো,,

“ডাক্তার উৎস চৌধুরী, আপনি!”(উৎফুল্ল কণ্ঠস্বরে)

উৎস ইলার দিকে তাকালো, ইলা যে এখানে উৎস জানতোনা। জানবেও বা কি করে, ইলায় তো এখানে আসার কথা ছিলোনা তবুও এসেছে একমাত্র আদিতকে ভালোবাসে বলে। অনেকদিন পর উৎস ইলাকে স্বচক্ষে দেখছে। মেয়েটা তার বাবার মতোই হয়েছে, রঙে, মুখশ্রীর গড়নেও।
মেয়েটা তার মায়ের পেটের না হলেও বাবার রক্ত মেয়েটার শরীরে আছে যা উৎসর শরীরেও আছে। না চাইতেও উৎসর এই মেয়েটাকে নিজের মায়ের পেটের বোনের মতো মনে হয়। পঁচিশ বছর আগে যদি তার বাবা ওইরকম একটা ঘৃণ্য কাজ না করতো তাহলে আজকে হয়তো ইলা বা ইলার মতোই তার একটা মায়ের পেটের বোন থাকতো। সে যা হোক, ভাই বোন হতে মায়ের পেটের হওয়া লাগেনা, মন থেকে চাইলে মায়ের পেটের না হয়েও কাউকে নিজের আপন ভাই বোন অনুভব করা যায়।
সব ভেবে উৎস মৃদু হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বিদ্যমান রেখে বলে উঠলো,,

“হ্যা আমি, তা কেমন আছো ইলা? আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”(মৃদু হেসে)

ইলা মৃদু হাসলো, বললো,,

“বাবা ভালো আছেন। আর আমিও। কিন্তু আপনি এখানে? আর স্নিগ্ধাকে ভালোবাসেন, বিয়ে করতে চাইছেন এসবের মানে কি?”

“আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি, সহজে আমি কোনো কিছুকে ভালোবাসিনা এবার হোক সেটা কোনো জিনিস বা কোনো মানুষ। একবার যেটাকে ভালোবাসি ঐটা আমার চাই মানে চাই, আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি তাই ওকে আমার চাই। বিয়ে তো আমি স্নিগ্ধাকেই করবো এবার যেভাবেই হোক, সবার সম্মতিতে বা তুলে নিয়ে গিয়ে।”(ভাবলেশহীন ভাবে)

আদিত ভীষণ রেগে গেল, রেগে উৎসর দিকে এগিয়ে যেতে নিলে স্নিগ্ধা আদিতের হাত খাম’চে ধরলো।
কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,,

“আ.. আমার ভালো লাগছেনা দ.. দাভাই। রিসোর্টে ফ.. ফিরে চল।”(কাঁপা কাঁপা স্বরে)

আদিত স্নিগ্ধার হাত ধরলো। চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো দাভাইয়ের সাথে আছে মানে সব বিপদ থেকে সুরক্ষিত আছে। কল্যাণী গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“মশকরা করছো? ইলার কথায় যা বুঝলাম ভদ্র পরিবারের ছেলে ও ডাক্তার তুমি। ইলা তোমার পূর্ব পরিচিত হলেও আমরা নই, তাহলে অচেনা মানুষের সাথে কেনো এমন ব্যবহার করছো?”(গম্ভীর কণ্ঠে)

উৎস হাসলো, দারুন একটা হাসি উপহার দিলো। বললো,,

“আপনাদের কাছে উৎস চৌধুরী অচেনা হলেও উৎস চৌধুরীর কাছে আপনারা সম্পূর্ণ চেনা। আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই তাই আপনাদের থেকে সম্মতি নিচ্ছি, ধরতে গেলে প্রস্তাব দিচ্ছি। বয়স বিবেচনা করলে আমি স্নিগ্ধার জন্য পারফেক্ট। স্নিগ্ধার জন্য আমার কাছে সবকিছুই আছে। সবচে বেশি যেটা আছে সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। ভালো যখন ওকে বেসেছি বিয়েটাও ওকেই করবো।”

কল্যাণী রায়ের মুখো ভঙ্গি পরিবর্তন হলোনা। গম্ভীর হয়েই পর্যবেক্ষণ করলেন উৎসকে। শেরহাম এতক্ষন চুপচাপ থাকলেও এখন খানিকটা রাগী স্বরে বলে উঠল,,

“লিমিট ক্রস করে ফেলছেন বলে মনে হচ্ছেনা আপনার?”(রাগী স্বরে)

“উহু, একদমই না। ভালোবাসা অতঃপর বউ বানাতে চাওয়া অপরাধ নাকি? তাহলে তো ইলা আর আদিত এঁকে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখাটাও তো অপরাধ।”

আদিত ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো উৎসর দিকে, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“আমি ইলাকে ভালোবাসি বা ইলা যে আমাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে জানলেন আপনি? এতো কিছু জানার অধিকার আপনার নেই আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।”(ঝাঁঝালো কণ্ঠে)

উৎস মুখ বাকিয়ে আওড়ালো “এতো কিছু জানার অধিকার আপনার নেই হয়তো ভুলে গেছেন”। অতঃপর কনফিডেন্স মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,,

“অধিকার আছে কি নেই তা না হয় পরেই জানতে পারবে। আপাতত তোমার বোনের সাথে আমার বিয়ে দাও। আর কতকাল বউবিহীন থাকবো? আর ভালো লাগেনা বউ ছাড়া।”

আদিত রেগে দাঁতে দাঁতে চেপে কিছু বলে উঠবে এর আগেই স্নিগ্ধা হুট্ করে কান্না করে উঠলো। স্নিগ্ধায় কান্নায় চারদিকের প্রায় মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে হুট্ করে কান্না করায় সবাই বিচলিত, হতভম্ব হলো।
কল্যাণী রায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। স্নিগ্ধা এতদিনের নীরব কান্নাটা আজকে স্বশব্দেই কাঁদলো। চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। রায় পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন হলো। স্নিগ্ধা কিছুতেই কান্না থামাচ্ছেনা। উৎসর অস্বস্তি সেই সাথে বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে স্নিগ্ধার এই অসহায় কান্নায়। কল্যাণীর থেকে স্নিগ্ধাকে এক টানে ছাড়িয়ে উৎস দু হাতে আগলে নিলো স্নিগ্ধাকে নিজের বক্ষে।
আদিত, শেরহাম রাগান্নিত হয়ে এগিয়ে আসতে নিলে উৎস হাত দিয়ে ইশারা করে তাদেরকে থামতে ইশারা দিলো।

এই ঘটনায় স্নিগ্ধার কান্না থামলোনা বরংচ আরও বৃদ্ধি পেলো। মনে পরলো সেদিন, সেই ভয়ানক রাতের কথা। কি বিচ্ছিরি ভাবে ছুঁয়েছিল ওই পুষণ ভৌমিক। ভাবতেই স্নিগ্ধার বুক ফে’টে আরও জোরে কান্না বের হয়ে আসছে।
উৎস হাতের বন্ধন আরেকটু শক্ত করে, স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,,

“কাঁদছো কেনো? অতীত মনে পরছে আমার ছোঁয়ায়? হয়তো হ্যা, তবে সব ছোঁয়ায় খারাপ উদ্দেশ্য বা দৈহিক চাহিদা থাকেনা। মার্জিত ছোঁয়া ও উদ্দেশ্যও রয়েছে। আমি তোমায় ভালোবাসি, তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছেনা। আমি তোমায় তোমার ইচ্ছেমত ভালোবাসব যেভাবে তুমি চাও তবুও কান্না বন্ধ করো। তোমার অতীত জেনেই আমি তোমায় ভালোবেসেছি বাসছি বাসবো, অতঃপর নিজের অর্ধাঙ্গিনী করতে চাচ্ছি। আমাকে তোমার বিশ্বাস করা লাগবেনা, আমি নিজেই বিশ্বাস তোমার মনে জন্মাব। শুধু এই কান্না বন্ধ করো, এরপর থেকে আজীবনের জন্য কান্না কাকে বলে ভুলে যাবো। প্লিজ, কেঁদো না।”(মৃদু স্বরে)

উৎসের আদরমাখা কণ্ঠে না চাইতেও অনেকটা শান্ত হলো স্নিগ্ধা তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে সে। কল্যাণী উৎসের মুখোভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলেন। স্নিগ্ধার কান্নায় স্পষ্ট ছেলেটার মুখ মলিন ও ফ্যাকাসে হয়ে পরেছে মুহূর্তর মাঝেই। কল্যাণী মন দিয়ে উৎসের বলা প্রতিটা কথা শুনলেন, উৎস প্রতিটা কথা চিত্ত থেকে বলেছে তা স্পষ্ট কল্যাণীর কাছে।

পিঠে কারো শার্ট খামচে ধরার অনুভূতি অনুভব হতেই শেরহাম পিছু তাকালো দ্রুত, দেখলো সারু পরে যাচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে। দ্রুত শেরহাম সারুর বাহু ধরে বুকের সাথে মেশালো। এদিকে সারুর হুট্ করে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ায় আরেকদফা চমকালো সবাই।
চারদিকে মানুষের ভিড় দেখার মতো, সবাই উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে রায় পরিবার ও উৎসের দিকে।
শেরহাম সারুকে ধরে আলতো করে গাল স্পর্শ করে অনবরত ডেকে যাচ্ছে, তবে সারু নিঃশব্দ, নিস্তেজ হয়ে শেরহামের বুকের সাথে মিশে আছে।


হসপিটালে ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে শেরহাম। ডাক্তার অভীক মজুমদার গম্ভীর মুখশ্রী করে মৃদু হেসে বললেন,,

“অভিনন্দন আপনাকে, আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। তবে প্রেগন্যান্সি সময়ে আপনার ওয়াইফের ঠিকমতো যত্ন ও চেকাপ করাতে হবে। ওনার শারীরিক কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ওনার প্রতি।”(মৃদু হেসে)

শেরহাম যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। ডাক্তার অভীক মজুমদার কি বললেন বোধগম্য হয়েও বোধগম্য হলোনা শেরহামের। শেরহাম বাবা হতে যাচ্ছে এরচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পরেছে সারুর শারীরিক কন্ডিশন ভালো নয় শুনে। শেরহাম একরাশ টেনশন নিয়ে ডাক্তার অভীক মজুমদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওনার কক্ষ থেকে বের হলো। এদিকে শেরহামকে শুকনো মুখে বেরিয়ে আসতে দেখে সবার চোখে মুখেই টেনশনের ছোঁয়া দেখা গেলো। মিতালি এগিয়ে এসে শেরহামের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠলেন,,

“তোর মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন শেরহাম? সারু ঠিক আছে তো? ডাক্তার কি বললেন?”(চিন্তিত স্বরে)

শেরহাম কিছুক্ষন চুপ থাকলো অতঃপর হালকা হেসে বলে উঠলো,,

“সারু প্রেগন্যান্ট, আমি বাবা হতে যাচ্ছি।”(হালকা হেসে)

মিতালি চোখ বড় বড় করে তাকালেন। যেন ওনার বিশ্বাস হলোনা কথাটা, পরক্ষনেই খুশিতে গদ গদ হয়ে উঠলেন। হসপিটালে শেরহাম, আদিত, নেহাল রায়, মিতালি ও উৎস এসেছিলো। স্নিগ্ধার অবস্থা বেগতিক ছিল বলে স্নিগ্ধাকে হসপিটালে আনা হয়নি, কল্যাণী সেখানে থেকে গিয়েছেন মেয়ের সাথে।
সারু প্রেগন্যান্ট, মা হতে যাচ্ছে এটা শুনে উপস্থিত সবাই খুশি হলো। শেরহাম ধীর পায়ে সারুর কেবিনের দিকে রওনা হলো। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, সারুর শারীরিক কন্ডিশন ভালোনা তেমন একটা, প্রেগন্যান্সির সময়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। শেরহাম শুনে খুব খুশি হয়েছে যে সারু প্রেগন্যান্ট। কিন্তু শেরহাম ভাবছে এটা কি সঠিক সময় সারুর প্রেগন্যান্সির। মেয়েটা এখনো ওই ক্ষেত্রে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি, প্রেগন্যান্সির ব্যথা সহ্য কিভাবে করবে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে শেরহামের।
কেবিনে ঢুকে শেরহাম ধীর পায়ে হেঁটে গেলো সারুর কাছে। সারুর পাশে টুলের উপর বসে সারুর শান্ত মলিন মুখটার দিকে কিয়ক্ষন চেয়ে রইলো। শেরহাম সারুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অধর ছোঁয়ালো সারুর হাতে।
এদিকে হাতে কারো স্পর্শ পেতেই সারু চোখ জোড়া মেলে তাকালো। দেখলো শেরহাম তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অধর ছুঁইয়ে বসে আছে। সারু ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে?”
শেরহাম বদৌলতে মুচকি হাসলো, বলল,,

“খুব দ্রুতই আমাদের মাঝে লিটেল স্টার আসতে চলেছে। যে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত আমাদের গালে ছুঁইয়ে আমাদের মাম্মা পাপা ডাকবে।”(মুচকি হেসে)

সারু হতভম্ব হলো, কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে পেটে হাত স্পর্শ করে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো সারু। শেরহাম সারুর ঢুকে ঝুঁকে সারুর কপালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

চলবে..?