নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১৭

0
55

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১৭]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“বাবা, জেঠু হওয়ার উপলক্ষে আপনাদের বোনের সাথে আমার বিয়ে দিতেই পারেন। আমি মাইন্ড করবোনা আমার শা’লারা।”(হালকা হেসে)

উৎসের এহেন কথায় ভ্রু কুঁচকে উৎসর দিকে চাইলো শেরহাম আর আদিত। আদিত চোখ মুখে রাগের আভাস ছড়িয়ে বলে উঠলো,,

“আপনি আপনার লিমিটে থাকুন উৎস চৌধুরী। ম্যাচুয়ার পার্সন, একজন কার্ডিওলজিস্ট আশা করি ইমম্যাচুয়ারের মতো কাজ বা কথাবার্তা বলবেন না।(রাগী স্বরে)

উৎস ঠোঁট উল্টালো, দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে উঠলো,,

“কই ভাবলাম শা’লাদের সাথে একটু ফ্রি হবো তা আর হলো কই! শা’লারা তো ম্যাচুরিটি নিয়েই পড়ে আছে এখনো।”(দুঃখী দুঃখী মুখ করে)

আদিতের রাগ আকাশ ছোঁয়া হলো। চোখ মুখ শক্ত করে শেরহামের দিকে তাকালো। এদিকে শেরহাম ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখশ্রীতে উৎসর দিকে চেয়ে আছে। আদিত শেরহামের দিকে তাকানোতে শেরহাম বলে উঠলো,,

“বয়সের দিক দিয়ে আপনি আমাদের যথেষ্ট বড়। আশা করছি আপনি বিষয়টা বুঝবেন এবং এখন থেকেই আপনি আপনার এই ব্যবহার শুধরে নিবেন।”

উৎসর চেহারার ভাব পরিলক্ষিত হলো। আঁখিজোড়ায় ভর করলো গম্ভীরতা। গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“আমার বোঝাটা পরের হিসাব। তোমরা জাস্ট এটুকু বুঝে রাখো স্নিগ্ধা আমার ওয়াইফ হবে। আমি স্নিগ্ধাকে বিয়ে করবো।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

উৎস এই কথা বলে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালোনা। হসপিটাল থেকে প্রস্থান করতে উদ্যোত হলো।
এদিকে শেরহাম আর আদিত উৎসর বলা কথা শুনে রাগান্নিত হলো। এমনিতেও স্নিগ্ধা অনেক বাজে একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার উপর এই নতুন ঝামেলা।
শেরহাম আদিতের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,,

“তোমার কি মনে হয়?”

“মাথায় সমস্যা আছে। আমাদের উচিৎ দ্রুত কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফেরা।”

“তা বুঝলাম, তবে লোকটা আমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। এমনকি তুমি যে একজন হিটম্যান সেটাও জানে।”

আদিত ভাবনায় মত্ত হলো। আদিত যে একজন হিটম্যান সেটা শেরহাম, বিপুল রায় ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাহলে উৎস কিভাবে জানলো সে একজন হিটম্যান।
ভাবনায় মত্ত থাকা অবস্থায় আদিত বলে উঠলো,,

“ইলা উৎস চৌধুরীকে চেনে। ওকে জিজ্ঞাসা করবো। আপাতত হসপিটাল থেকে চল।”

শেরহাম আর আদিত স্নিগ্ধা, মিতালি আর নেহাল রায়কে নিয়ে বেরোলো হসপিটাল থেকে।


সারু প্রেগন্যান্ট শুনে ভারী খুশি হলেন কল্যাণী। সারুকে জড়িয়ে ধরে এক গাল হাসলেন। মিষ্টি হেসে বললেন,,

“অবশেষে তোমার মাতৃত্বের দিকে সবার আঙ্গুল তোলা ঘুচবে। অভিনন্দন সারু মা। তোমার জন্য অনেক অনেক আশীর্বাদ রইলো।”(মিষ্টি হেসে)

সারু হাসলো, সারুর নজরে তার শাশুড়ি এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। হুট্ করে দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে যাওয়ায় খানিকটা বিব্রত হলো সারু। তবুও মুখ হাসি বজায় রাখলো, তা দেখে মিতালি হাসলেন।

“মা, জেঠিমণি স্নিগ্ধার জন্য জায়গাটা এখন আর মোটেও সেফ নয়। তাই আমরা চাচ্ছি ফিরে যেতে।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

শেরহামের বলা কথায় মুখ ভার করে ফেললো সারু। মাত্র তো একদিনই হলো তারা সবাই মিলে কক্সবাজার এসেছে, ভেবেছিলো একটু ঘুরবে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিবে। তা না, একদিন যেতে না যেতেই যাওয়ার কথা উঠছে।
শেরহামের কথায় সবাই মত পোষণ করলো। উৎসর ওইরকম কথাবার্তা কারো কাছে মোটেও সুবিধার লাগেনি আর না লেগেছে ভালো। অযথা ঝামেলা বাড়বে এখানে থাকলে।
সবার কথার মাঝে কল্যাণী বলে উঠলেন,

“অনেক হয়েছে, এবার আমি আদিতের বিয়ে দিতে চাই। মেয়ে তো আমাদের কাছে আছেই। ইলা, আদিতের সাথে আমি ইলার বিয়ে দিতে চাই যেহেতু ইলা আর আদিত এঁকে অপরকে ভালোবাসে।”

কল্যাণীর এহেন কথা ভড়কে গেলো আদিত। হুট্ করে যে কল্যাণী বিয়ের কথা বলবেন তাও আবার ইলার সাথে ভাবেনি আদিত। দিক বেদিক চিন্তা না করে আদিত গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“মা, আমি ইলাকে ভালোবাসিনা আর না ওকে বিয়ে করতে চাই।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

দরজায় আওয়াজ হওয়াতে কক্ষে উপস্থিত সবাই কক্ষের দিকে তাকালো। ইলাকে দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো। ইলা শূন্য দৃষ্টিতে আদিতের দিকে চেয়ে আছে। আদিত ইলার ওই চোখের চাহনি একবার পর্যবেক্ষণ করে দ্বিতীয় বার তাকায়নি ইলার চোখের দিকে।
কল্যাণী, মিতালি আর নেহাল রায় এঁকে অপরের দিকে চেয়ে আদিত আর ইলার দিকে তাকাচ্ছে। ইলা আদিতের কথায় কষ্ট পেয়েছে তা ইলার মুখশ্রী দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
সারু শেরহামের হাত স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,,

“আপনি এদের দুইজনের মুখশ্রীটা একবার দেখুন। দাভাই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলেছে আর ইলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে যার ফলে আদিত দাভাই ইলাদির উপর রাগ করে আছে।”(ফিসফিস করে)

শেরহাম প্রতিউত্তর করলোনা। কল্যাণী পরিবেশ বেশ গম্ভীর বুঝে বলে উঠলেন,,

“বিয়ে করতে চাস না মানে? তোর কথা আমরা কেউ জানতে চেয়েছি? আমি ইলাকে আমার বৌমা করবো মানে ইলাকেই করবো। চোখ বন্ধ করে ইলাকে বিয়ে করতে হবে তোর।”

আদিত শান্ত নজরে তাকালো মায়ের পানে। অতঃপর স্নিগ্ধার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,,

“স্নিগ্ধা এখানে কমফোর্ট ফীল করছেনা, অসুস্থ হয়ে পরছে। আমাদের উচিৎ বাড়ি ফিরে যাওয়া। ঠিক এক ঘন্টা পর আমরা রওনা দিবো বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই তৈরী হতে শুরু করো।”(গম্ভীর কণ্ঠে)

আদিত কথাটা বলে আর দেরি করলোনা। কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো ইলাকে উপেক্ষা করে। ইলা স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর ধীর পায়ে আদিতের কক্ষের দিকে আগত হলো।

“আমাকে ভালোবাসেন না?”

আদিত ইলার দিকে না চেয়েই বলে উঠলো,,,

“কোনো সন্দেহ?”

“আপনি এটা ঠিক করছেন না। আপনি আপনাকে ভালোবাসি আদিত। জানিনা বাবা কেনো আপনাকে মিথ্যা বলেছে, তবে সত্য এটাই আমি কোনো বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক ভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিছুতেই পারিনি। আপনার বাড়ি অব্দি গিয়েছিলাম কিন্তু যখন গিয়েছিলাম তখন জানতে পারি আপনি এখানে আর নেই, কানাডা চলে গিয়েছেন আপনার বাবার সাথে। আন্টি আর স্নিগ্ধাও তখন ছিলোনা।”(কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে)

ইলার বাক্য বচনে আদিত রা করলোনা। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হতেই সোজাসাপ্টা বলে উঠলো,,

“ভালোবাসো আমায়?”

“আপনি,, আপনি হচ্ছেন আস্ত একটা ধামরা। একবার আপনাকে বিয়ে করে নেই, আমি আর আমার মেয়ে মিলে আপনার তেরোটা বাজাবো।”(হালকা রাগী স্বরে)

আদিত প্রতিক্রিয়া দেখালোনা, ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো,,

“চার বছর আগে যেমন সহজ আমিটা তোমায় ভালোবেসেছিলো সেই আমি আর আজকের আমির মধ্যে বিস্তর ফারাক। বিস্তর ফারাক এই জন্য আমি পাল্টেছি। এমন ভাবে পাল্টে গেছি যে আমি তোমায় ভালোবাসা ভুলে গিয়েছি।”

আদিতের বাক্য বচনে ইলা হুট্ করে রেগে গেলো। তেড়ে এসে আদিতের শার্টয়ের কলার চেপে ধরে রাগত স্বরে বলে উঠলো,,

“একটু মুটকাই তো হয়েছেন এতে বিস্তর ফারাক কোথায় হলো? একটু গম্ভীরই হয়েছেন এতে বিস্তর ফারাক কোথায় হলো? আমাকে বিয়ে না করার টালবাহানা সবই বুঝি। কিন্তু এসব টালবাহানা দিলে হবেনা, আমি মানবোনা।”(রাগত স্বরে)

আদিত শান্ত চোখে তাকালো ইলার চোখের দিকে। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“আমি চাইনা তুমি আমার মতো একজন খু’নির সাথে নিজেকে জড়াও। আমার পাপের রাজ্যে তুমিও ইনভল্ভ হও আমি চাইনা। কানাডায় যাওয়ার পর, আজ অব্দি টাকার বিনিময়ে অনেক মানুষকে খু’ন করেছি। এদের মধ্যে কেউ অপরাধী আর কেউ নিরপরাধ। তবে এসব প্রাধান্য দেইনি, টাকা নিয়েছি কথামতো খু’ন করেছি। যদিও আমি বর্তমানে এসবের সাথে জড়িত নই তবুও আমার হাতে বহু মানুষের র’ক্ত লেগে আছে। আমি চাইনা আমার এই র’ক্তমাখা হাত স্পর্শ করে তোমার হাত এক ফোঁটা রক্তে রাঙাক।”(শান্ত স্বরে)

আদিতের মুখোনিঃসৃত বাক্য বচনে বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো ইলা। তার ভাবতেও অবাক লাগছে টাকার জন্য আদিত কানাডা থাকাকালীন মানুষ খু’ন করেছে। ইলার এমন বিস্ফোরিত নয়ন, মুখোভঙ্গি দেখে মৃদু হাসলো আদিত। বলল,,

“টাকাটাকে বড় করে দেখোনা, টাকার অভাব ছিলোনা আমার। এক প্রকার বিষণ্ণতা, অপরাধবোধ আমাকে হিংস্র করে তুলেছিল। মায়ের আদর্শ, নিজের মন মস্তিস্ককে হারিয়ে নিজেকে হিটম্যান হিসেবে গড়ে তুলেছিলাম। ঘটনার প্রায় দুবছর পর ভাবলাম এসব কেনো করছি? প্রফেশনটা বিরক্তিকর লাগতে শুরু করেছিল তাই সরে এসেছি। আমার কথা খাপছাড়া লাগতে পারে তবে এরচে বেশি আর কিছুনা।”


শেরহাম সারুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। সারু চুপ করে শেরহামের বুকে লেপ্টে আছে। দৃষ্টি তার আয়নার মধ্যে থাকা শেরহামের দৃষ্টিতে। শেরহাম সারুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আলতো স্বরে বলে উঠলো,,

“ধন্যবাদ আর অফুরান্ত ভালোবাসা সারু আমাকে এই বাবা হওয়ার খুশিটা দেওয়ার জন্য।”(আলতো স্বরে)

সারু মৃদু হেসে শেরহামের গলা শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। শেরহাম সারুকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কণ্ঠে দুষ্টুমির ছোঁয়া রেখে বলে উঠলো,,

“শুরুটা তবে হয়েই গেলো, এবার থেকে প্রতিবছর আমি বাবা আর তুমি মা হতে পারবে। আমাদের ডাবল ডজন বাচ্চা হবে, তুমি চাইলে ট্রিপল ডজন বাচ্চাও নেওয়া যাবে। কি বলো? নিতে পারবেনা?”(দুষ্টুমি মাখা স্বরে)

সারু শেরহামের ঘাড় নখ গেঁথে দিলো। লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হতে হতে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে বললো,,

“অসভ্য লোক।”

চলবে,,,