হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০২

0
65

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)

প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উম্মুক্ত

২.
বাইরের ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস নিয়ে আসছে।কিছু সময় অন্তর অন্তর বিদ্যুৎ চমকানোতে সেকেন্ডের জন্য আলোকিত হয়ে উঠছে প্রকৃতি।বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে সেসবই লক্ষ্য করছে সুপ্ত।আচমকা সকল আগাম বার্তা সঠিক প্রমাণ করে বৃষ্টি এসেই গেল।বারান্দার রেলিং ঘেসে দাড়িয়ে থাকায় বৃষ্টি কণার ছিটায় একটু একটু করে পান্জাবি ভিজতে শুরু করে সুপ্তের।বাহিরের ঝড় ক্রমশ বাড়লেও তার ভেতরে ক্রোধের ঝড় শেষ হতে শুরু করেছে।আচমকা ঠোঁট একদিকে বাঁকিয়ে ক্ষীন হাসে সে।এরকম তেজস্বী,প্রতিবাদী রমনীর সন্ধানেই ছিল তার মন।যার কন্ঠ নিজের অধিকার আদায়ে স্বতন্ত্র,কথার পিঠে উপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম।

বেলা তাকে জড়িয়ে ধরেছে তার একঝলক হয়ত দেখেছে ত্রয়ী।তাই এরূপ প্রতিক্রিয়া।নয়ত সম্পূর্ণ ঘটনা সে দেখলে সুপ্তকে মিথ্যে দোষারোপ করতো না।সুপ্ত বুঝলো তার বউয়ের দোষ নেই।ইভেন ত্রয়ীর জায়গায় যদি সুপ্ত থাকতো তবে হয়ত ইতিমধ্যেই ত্রয়ীকে ক্রোধাগ্নিতে ভস্ম করেই দিত!
বৃষ্টির পানিতে যখন সুপ্ত প্রায় অর্ধ ভেজা তখন সে বারান্দা থেকে সরে তার নিজ কক্ষের দিকে প্রস্থান করে।বারান্দার কাছাকাছিই ডার রুম।তাই রাত বিরোতে যখনই মেজাজ ঘেটে থাকে তখনই এখানে এসে দাঁড়ায় সুপ্ত।এখানে আসা শীতল সতেজ বাতাস রাগী স্বভাবের সুপ্তের সমস্ত রাগ শুষে নেয়।
সুপ্ত রুমে এসে এবারেও ত্রয়ীকে বিছানায় দেখতে পায় না।পুনরায় কপাল কুঁচকে আসে তার।তবে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলাতেই ফোস করে একটা শ্বাস ফেলে সে।বিছানা বরাবর সোজা রুমের দেওয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ত্রয়ী।পরনে তখনো লেহেঙ্গায় রয়েছে।ধীর পায়ে হেঁটে ত্রয়ীর নিকট আসে সুপ্ত।
ঘুমে আছন্ন থাকায় ঘাড় একদিকে বেঁকে আছে ত্রয়ীর।হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে সুপ্ত।চোখ বুলায় ত্রয়ীর ঘুমন্ত মুখশ্রীতে।খুঁটিয়ে দেখতেই সুপ্ত অনুভব করে মেয়েটার মুখশ্রীতে মেকআপের কোন আস্তরণ নেই।কালো পাপড়িতে ঘেরা আঁখিপল্লবে কাজলের ছোঁয়া।হয়ত কান্নার জন্য লেপ্টেছে তা সামান্য।ওষ্ঠদুটোয় কালো খয়েরি রঙের লিপস্টিকের ছোঁয়া,কপালে ছোট লাল টিপ।ব্যাস এতেই নববধূ অপূর্ব রুপসী প্রতিলক্ষিত হচ্ছে।

সুপ্ত হঠাৎ করে ত্রয়ীকে কোলে তুলে নেয়।হাত ভর্তি চুড়ি ঝংকার দিয়ে আওয়াজ তুলে তাতে।ত্রয়ীর ঘোর লাগানো মুখশ্রী থেকে এবার দৃষ্টি সরিয়ে বিছানার দিকে এগোয় সুপ্ত।সন্তর্পনে ত্রয়ীকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।তারপর ত্রয়ীর মুখের উপর এসে থাকা এলোচুল গুঁজে দেয় কানের পিঠে।ভাগ্যিস ত্রয়ী ঘুমে!নয়ত সুপ্তের পবিত্র ছোঁয়াকে অপবিত্রের ট্যাগ লাগিয়ে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিত।

সুপ্ত ত্রয়ীকে রেখে কাবার্ড থেকে একটা টি-শার্ট বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।বেরিয়ে আসে দশ মিনিটের মাথায় বের হয়ে আসে সে।তারপর বিছানার কাছে এসে ত্রয়ীর বিপরীত পাশে একদম বিছানার কিনারা ঘেষে শুয়ে পরে।মিনিটের ব্যবধানে ত্রয়ীর দিকে ফিরে তাকায় সুপ্ত।ঘন্টাখানেক আগের তেজস্বী মুখশ্রী এখন নিষ্পাপ বাচ্চাদের ন্যায় দেখাচ্ছে।আরেকটু ভালো করে দেখতেই সুপ্ত খেয়াল করে ত্রয়ী সরু নাকের মাথায় ছোট লালচে একটা তিল!সে কিছু দেখে না।চট করে চেখ দুটি বন্ধ করে নিদ্রায় তলিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।নয়ত তার বধূ সাহেবার নিষ্পাপ সত্তা তার ঘুম হারাম করে দিবে চিরতরে।

“সারাজীবন অন্যের মামলা সলভ করলি আর শেষমেশ তোকেই মিথ্যা মামলার আসামি বানিয়ে দিল তোর বউ!”

কথাখানা বলেই সুপ্তের ফোনকলের ওপাশের ব্যাক্তিটি হাসতে লাগল।তার হাসির শব্দ কানে আসতেই যেন বিরক্ত হলো সুপ্ত।চোখেমুখে বিরক্তির রেশ বজায় রেখেই সুপ্ত বললো,

“তুই আজকে আসছিল তবে?”

“হ্যা।যাবো ভাবছি।বিয়েতে তো কোন অনুষ্ঠান করলি না।রেসিপশন করছিস এটাতেই গিয়ে মনকে শান্তনা দিতে হবে।”

কথা টুকু বলে ফোঁস করে আফসোসের শ্বাস ফেলে রিক্ত।সুপ্ত তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে রিক্তকে বিদায় জানিয়ে কল কেটে দেয়।তখনি নুপুরের ঝুনঝুন আওয়াজ কর্ণগোচর হয় তার।শব্দের উৎস অনুসরণ করে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকায় সুপ্ত।গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি বাঙ্গালি ধরনে পরে মাথায় তেয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসছে ত্রয়ী।সদ্য স্নান করায় একদম স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।সেদিকে তাকিয়ে সেকেন্ডের জন্য সুপ্তের দৃষ্টি আটকায়।সে বেলকনিতে থাকায় তাকে দেখেনি ত্রয়ী।সে আপন মনেই দর্পনের সামবে দাঁড়ায়।তারপর মাথা থেকে তোয়ালে খুলে পাশেই একটা চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখে।মাথা থেকে তোয়ালে খুলে রাখতেই তার দীঘল কেশ উন্মুক্ত হয়।ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল এসে কোমড় ছোঁয়।বাঙ্গালি ধরনে শাড়ি পড়ায় ত্রয়ীর পেটের বাঁপাশ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে আছে।ত্রয়ী সুটকেস থেকে সাদা রঙের চুড়ি বের করে হাতে পরে।রিনরিনে আওয়াজ ছড়িয়ে পরে তাতে।ছোট একটা লাল টিপ কপালে পরতেই সুপ্তের পায়ের আওয়াজ শুনে অল্প চমকে উঠে ত্রয়ী।সুপ্ত তার পাশে এসে দাড়াতে দাড়াতে বলে,

“সকাল সকাল গোসল করে কি বোঝাতে চাইছো?কালরাতে তোমার আমার তুমুল ভালোবাসা-বাসি হয়েছে?”

স্রান করে আসার পর ত্রয়ীর সতেজ হয়ে উঠা মন সুপ্তের কথায় বিষিয়ে উঠে।বিশাল ড্রেসিং আয়নায় তাদের দুজনের প্রতিবিম্বই বেশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে।ত্রয়ী আয়নার মধ্যে দিয়েই সুপ্তের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়।তারপর কটমট করে বলে উঠে,

“মানছি আপনি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।বাকস্বাধীনতা রয়েছে আপনার।তার মাবে এই না আপনি আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলবেন।”

ত্রয়ীর কথায় সুপ্ত নিষ্পাপ ভঙ্গিতে তাকায়।আরশিতে ত্রয়ীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সেও বলে উঠে,

-যদি তুমি সত্য মিথ্যা না জেনে আমাকে যাচ্ছে তাই বলতে পারো তাহলে আমিও তোমাকে বলতে পারি।

এতক্ষণ চুল আঁচড়াচ্ছিলো ত্রয়ী।সুপ্তের কথায় তার হস্ত থামে।এবার সে চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে সরাসরি সুপ্তের দিকে ফিরে চায়।সুপ্তের পরনে কালকে রাতের টি-শার্ট টিই রয়েছে।সুপ্ত গম্ভীর হয়ে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।ত্রয়ী সোজাসুজি সুপ্তের চোখের দিকে চায়।তারপর বলে,

-যখন নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন তখন প্রমাণ করেও দেখান।

-বেশ!তাই হবে।

তখনই দরজায় কেউ নক করে।সুপ্ত উচ্চস্বরে কে বলে রশ্ন করলে
তন্দ্রার কন্ঠ ভেসে আসে।

-“ব্রেকফাস্টের জন্য সবাই ডাইনিং এ অপেক্ষা করছে।জলদি আসো ভাইয়া।”

কথাটুকু বলে তন্দ্রা প্রস্থান করলে সুপ্ত ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,

-১০ মিনিটের মধ্যে আসছি।অপেক্ষা কর।দুজনে একসাথে নিচে যাবো।

কথাখান বলে সুপ্ত কাবার্ড থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।সে চোখের আড়াল হতেই ভেংচি কাটে ত্রয়ী।তারপর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাকে ফোন দেয়।
.
ব্রেকফাস্ট শেষ করতেই সাড়ে নটা বেজে গেছে।সুপ্ত রুমে এসে বিছানায় একটু বসেছে সবে তখনি ত্রয়ী অপ্রসন্ন মুখ নিয়ে রুমে হাজির হয়।এতক্ষণ সে সুপ্তের মায়ের রুমে ছিল।ত্রয়ী রুমে আসলে সুপ্ত একপলক তাকিয়ে দেখে কেবল।ফের তাকাতেই দেখে ত্রয়ীর হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট।গোল্ডেন রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে সে।সে মূলত অপ্রসন্ন তাকে পরনের শাড়ি পাল্টিয়ে আবারো এই শাড়ি পরতে হবে।তারউপর শাশুড়ী ভালো করে বলে দিয়েছেন গয়নাও পরতে হবে।ত্রয়ী এবার রাগান্বিত মুখ নিয়ে সুপ্তের দিকে তাকায়।সে যে রুমে এসেছে এতে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই তার।সে তার মত মোবাইলে মগ্ন হয়ে আছে।ত্রয়ী উঁচু গলায় বললো,

-মা আপনাকে কিছুক্ষণের মাঝেই রেডি হয়ে নিচে যেতে বলেছে।

সুপ্ত এবার ত্রয়ীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-শুনেছি।

ত্রয়ী তখনো সুপ্তের দিকে তাকিয়ে।সুপ্ত দৃষ্টি না সরিয়ে এবার ত্রয়ীকে ভালোভাবে দেখে।সাজসজ্জাহীন মুখে কপালে কেবল ছোট একটা লাল টিপ।মুখে কি কারনে রাগী ভাব ফুটে উঠেছে সুপ্ত জানে না।বাঙালি স্টাইলে পড়া শাড়িতে একদম আগেরকাল দিনের সিনেমার রুপসী নায়িকাদের মত লাগছে।দেহে গয়না বলতে কেবল নাকে ছোট পাথরের নাকফুল।এককথায় স্নিগ্ধ মায়াবি একখানা মুখশ্রী।
তার দেখার মাঝেই ত্রয়ী রেগেমেগে বলে উঠে,

-ধুর আমাকে আবার শাড়ি পাল্টাতে হবে।ভাল্লাগে না!

তারপর সুপ্তের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।
সুপ্তের মন হঠাৎ বলে উঠে,

-“আপনাকে নব নব রুপে দেখার জন্য সহস্র অগ্নিদৃষ্টিও সহনীয়,বঁধুসাহেবা!

চলবে…