হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০৫

0
51

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৫.
“মেডিকেলে পড়ুয়া সাধারণ ছাত্রী,শান্তিপ্রিয় ত্রয়ীর উপর হামলা হতে পারে না তবে তার উপর এই প্রাণঘাতী হামলার হেতু স্বয়ং আমি?

অফিসে চেয়ারে আরামসে বসে রিসেন্ট আসা কেসের ফাইলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাচ্ছিল সুপ্ত।হঠাৎ করেই ভাবনার একপর্যায়ে কালকে রাতে চিন্তা করা কথাগুলো মনে ভেসে উঠে তার।ক্লায়েন্টের কেস সলভ করতে বসে সহধর্মিণীর উপর হামলার হিসেব মনে আসছে দেখে কপাল চুলকায় সুপ্ত।তারপরই একটা ভাবনা এসে মস্তিষ্কে এসে ঠোকর খায়।যদি তার বাড়ির আঙিনায় ত্রয়ীকে কেউ মারার প্ল্যান করতে পারে তবে বাহিরে সেটা তো দুধভাত!

হঠাৎ করে ফাইলটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে সুপ্ত।ডানহাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালে চাপ প্রয়োগ করে চোখ বুঁজে কপাল কুঁচকে ফেলে সে।শত্রু নিশ্চয়ই ঢাকা শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।এই মুহুর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ত্রয়ীকে তাদের হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া, যেখানের সন্ধান হামলাকারীদের নিকট থাকবে না।এমন একটা স্থানের কথা মাথায় আসতেই চোখ মেলে তাকায় সুপ্ত।তারপর সেই অজ্ঞাত হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে বাঁকা হাসি ফুটে তার ওষ্ঠপটে।
টেবিলে থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে ত্রয়ীকে ফোন করবে তার আগেই কেবিনের দরজায় নক করার আওয়াজ ভেসে আসে।একটা নারী কন্ঠ বলে চলছে,

-মে আই কান ইন স্যার।

গম্ভীর আওয়াজে কাম ইন উচ্চারণ করার সেকেন্ডের মাঝে সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা একজন মেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।সুপ্তের দিকে চেয়ে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলে উঠে,

-আ’ম নিঝুম স্যার।আপনার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।
.
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে একটা মাঝারি সাইজের বড় জারুল গাছের নিচে একাকী বসে আছে ত্রয়ী।পরনে সাদা সেলোয়ার কামিজ,এপ্রোন আর গলায় আকাশি রঙের ওড়না ঝোলানো।দীঘল কেশ বেনি করে রাখা।বসে থাকায় ওড়না আর চুল ঘাসের উপর পরে রয়েছে।ত্রয়ী হেলান দিয়ে থাকা গাছটার দিকে তাকিয়ে ভাবে এক সময় ফুলে ফুলে পূর্ণ থাকা গাছটায় এখন কেবল সবুজের সমোহর।বর্ষার সময়টাতে এই স্থানে বেগুনি-নীল রঙের অনেক ফুল পরে থাকে।গাছের দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রয়ী।আমাদের জীবনটাও এমন,এক প্রহর আনন্দে কাটলে পুরোদিন বিষন্নতায় ডুবে!

ঘাড় ঘুড়িয়ে বা পাশে তাকায় ত্রয়ী।তার চোখজোড়ায় অপেক্ষা বিদ্যমান।গেটের কাছে একটা মেয়েকে দেখতেই অপেক্ষার অবসান ঘটে তার।বহ্নি হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে এইদিকেই আসছে।
ত্রয়ীর কাছে এসে একটা আইসক্রিম ত্রয়ীকে দিয়ে বলে,

-কি বিবাহিত আফু,বাসর রাত কেমন কাটলো?

বহ্নির কন্ঠের দুষ্টুমির ছাপ।ত্রয়ী কিছু না বলে নিজমনে আইসক্রিম খাচ্ছে।ওকে কিছু বলতে না দেখে বহ্নি ফের বলে,

-বুঝেছি।লজ্জা পাচ্ছিস।

ত্রয়ী ফট করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি লজ্জা পাচ্ছি?

ত্রয়ীর স্বাভাবিক মুখশ্রী দেখে বহ্নি দুপাশে মাথা নাড়ায়।তারপর আফসোসের স্বরে বলে,

-বিয়ে করলি দাওয়াতও তো দিলি না!

-দাওয়াত দিইনি তোকে?বল তুই যাসনি।

-গ্রামের বাড়িতে বিয়ে করেছিস।যাওয়ার কোন জো আছে?

ত্রয়ী কিছু বলবে তার আগেই বহ্নি লজ্জা লজ্জা মুখে বলে উঠে,

– তুই দিসনি তো কি হয়েছে?আমার আর সুপ্তের বিয়েতে পুরো কলেজের স্টুডেন্টকে দাওয়াত দিবো!

ওর কথা শুনে ত্রয়ী অদ্ভুত চোখে তাকায়।তাকে এভাবে তাকাতে দেখে বহ্নি বলে উঠে,

-ভাবছিস দিবা স্বপ্ন দেখছি?জানিস আমি রোজ দোয়া করি যাতে ওনার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যায়,তাও ফিল্মিভাবে।এটা পূরন হবেই হবে দেখিস।

ত্রয়ী গোল গোল চোখে তাকিয়ে বহ্নির কথা শুনছে।এর আগে এমন কথা শুনেনি তা নয়।তবে তখন সুপ্ত ছিল পরপুরুষ আর এখন তার অর্ধাঙ্গ!

বহ্নি আরো অনেককিছুই বলছিলো তখনিই ত্রয়ীর ফোনে কল আসে।আইসক্রিম খাওয়া স্থগিত রেখে ফোনের দিকে তাকায় ত্রয়ী।স্কিনে ভেসে উঠা নাম্বারটা আনসেভ হলেও তা চিনে ত্রয়ী।ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই পুরুষালি ভরাট কন্ঠস্বরে ভেসে আসে,

-কোথায় তুৃমি?

-কোথায় থাকবো?কলেজ ক্যাম্পাসে আমি।

-ক্লাস শেষ?

-হ্যা।

-ওয়েট ১০ মিনিটস,ওকে।

এতটুকু কথোপকথনের পশ্চাতে ওপর পাশের ব্যাক্তিটি কল কাটে।ত্রয়ী এতশত না ভেবে ফের বহ্নি কথা শোনায় মনোযোগ দেয়।
সুপ্ত মেডিকেল ক্যাম্পাসে এসে দেখে ত্রয়ী একটা গাছে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।ব্যাগটা সামনে এনে রেখেছে।একটু পরপর ওষ্ঠ নাড়িয়ে কথা বলছে সামনে থাকা মানুষটির সাথে।ফের সুপ্ত ত্রয়ীর ফোনে কল দেয়।ফোন ত্রয়ীর সাথেই ছিল।কল আসার সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করে ত্রয়ী।

-বা দিকে তাকাও।আমাকে দেখতে পেলে দ্রুত চলে আসো।

ত্রয়ী তৎক্ষনাৎ বা দিকে ফিরে তাকায়।প্রথমে ঝাপসা দেখা মানবটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠে।পাশ থেকে ভেসে আসে বহ্নির উল্লাসিত কন্ঠ।সে ত্রয়ীর হাত ঝাঁকিয়ে বলে চলছে,

-হোয়াট এ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ ইয়ার!স্বয়ং সুপ্ত রেহনেওয়াজ এখানে!আমার ক্রাশটা!দেখ দেখ এদিকেই তাকিয়ে আছে।

বহ্নির কন্ঠে যেন আর আনন্দ ধরে না।এত উল্লাস!ত্রয়ীর কানে ফোন ধরে সুপ্তের দিকে তাকিয়ে। সুপ্তেরও একই দশা।সুপ্তের পরনে কফি কালারের শার্ট,কালো প্যান্ট।শার্ট ইন করা।হাতে কালো বেল্টের এক্সপেন্সিভ ওয়াচ।হি লুক ভেরি হ্যান্ডসাম!
বহ্নি গালে একহাত দিয়ে সুপ্তের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে।যতই হোক তার অষ্টমতম ক্রাশ!

ত্রয়ী কিছুক্ষণ নিরবতা বজায় রেখে আস্তে করে বলে উঠে,

-যাবো না।আপনি চলে যান।আমি একাই যেতে পারলো।

তারপরই কল কেটে দিয়ে সুপ্তের থেকে দৃষ্টি সড়ায় ত্রয়ী।বহ্নির দিকে তাকিয়ে অবশিষ্ট আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
তার এই আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সুপ্তের মন।অসন্তুষ্ট চোখে ত্রয়ীর পানে চেয়ে রয় সে।এই মেয়েকে নিয়ে কি করবে সে?

তারপর সে পকেটে মোবাইল ভরে নিয়ে ত্রয়ীর দিকে এগোয়।আশেপাশের মেয়েরা ওকেই উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছে।সুপ্ত বড় বড় পা ফেলে ত্রয়ীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখে বহ্নির চোখ বড়সড় হয়ে উঠে।
বহ্নি সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

-ইস উনি এমন কিলার লুক নিয়ে এদিকে এভাবে কেন এগিয়ে আসছেন?

ওর কথা শুনে ফট করে বামে তাকায় ত্রয়ী। যথারীতি ভ্রু কুঁচকে আসে তার।সুপ্ত এতক্ষণে এদের পাশেই চলে এসেছে।ত্রয়ী কিছু বলে উঠবে তার ত্রয়ীকে কোলে তুলে নেয় সুপ্ত।আকস্মিক ঘটনায় বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে সুপ্তের কাঁধে খামচে ধরে ত্রয়ী।
এদিকে বহ্নির চক্ষু চড়কগাছ!তার ক্রাশ তারই সামনে তার বিবাহিত বান্ধবীকে কোলে তুলে নিয়েছে!বেচারা এই দৃশ্য দেখার জন্যই বেঁচে ছিল?

সুপ্ত ত্রয়ীকে নিয়ে মেডিকেল কলেজের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করে।ত্রয়ী বড় বড় চোখে চেয়ে কন্ঠে প্রাণ রেখে বলে উঠে,

-এটা কি করছেন আপনি?সবার সামনে এভাবে কোলে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?নামান আমাকে!এক্ষুনি নামান বলছি।

সুপ্ত ওর দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠে,

-যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে তাকে কোলে করে নিয়ে আসো!

সুপ্ত ওর কথা শুনবে না বুঝতে পারার পর ত্রয়ী দুহাতে মুখ ঢেকে নেয়।ত্রয়ীর আইসক্রিম ওই গাছ তলায়ই পরে গেছে।ঘাড় কাত করে একবার সেদিকে তাকিয়ে ত্রয়ী বলে উঠে,

-আমার আইসক্রিম!আপনার জন্য সেটাও সম্পূর্ণ খেতে পারলাম না আমি।

বলেই অভিমানে গাল ফোলায় ত্রয়ী।এভাবে বাচ্চাদের মত গাল ফোলাতে এই প্রথম দেখলো সুপ্ত।চেহারায় অভিমানী ছাপ!
সুপ্ত ত্রয়ীকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছাড়ে।
ঠিক তক্ষুনি একটা বুলেট তাদের পাশ কাটিয়ে দেওয়ালে লাগে।সাথে সাথে আক্রোশে ফেটে পরে অজ্ঞাত ব্যাক্তি।
চলন্ত গাড়িতে কোন কথা বলে না দুজনে।বাড়িতে এসে রুমে আসতেই সুপ্ত ত্রয়ীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

-ব্যাগ প্যাক করুন বধূ সাহেবা।শশুরবাড়ি থেকে জামাই আদর খেয়ে আসি!

চলবে..