হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-০৮

0
51

# হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৮.
-যদি সত্যিই আমাকে পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তবে আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করা বন্ধ করে দিন।কেননা এমনটা করলে আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে পরবো আর আমি নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষার দক্ষতা হারাবো।আমার মন এটাই মনে করবে যে আপনি আছেনই আমাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য।তবে বাস্তবিক সত্য এটাই যে আমি যখনই বিপদে পরবো তখনই আপনি থাকবেন না আমাকে বাঁচানোর জন্য।

সুপ্তের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে নিজের মতবাদ ব্যক্ত করে ত্রয়ী।সুপ্ত পকেটে একহাত পুরে তার দিকেই তাকিয়ে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে ত্রয়ীর মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ সে মনোযোগ দিয়ে শ্রবন করেছে।ঠোঁটের কোনে একটুকরো হাসি বজায় রেখে সুপ্ত ত্রয়ীর পানে তাকিয়ে রয়েছে সুপ্ত।সুপ্তের এরূপ তাকানো দেখে ত্রয়ী না চাইতেও বিভ্রান্তিতে পরে।সুপ্তকে পাশ কাটিয়ে সমানে এগোতে এগোতে বলে,

-আ..আসুন।

-আই ডোন্ট নো তুমি এটা খেয়াল করেছো কি না তবে এই প্রথম আমার সাথে কথা বলার সময় তোমার কথা আঁটকেছে।

চলতে চলতেই পেছনে ফিরে তাকায় ত্রয়ী।সুপ্ত এগোতে এগোতে উক্ত বাক্য বলেছে।ত্রয়ী মৌন হয়েই হাঁটতে থাকে তবে শব্দ ভেসে আসে পেছন থেকে।

-কেন এমনটা হয়েছে জানতে চাও ত্রয়ী?কেননা তুমি নিজের অজান্তেই একটা মিথ্যে কথা বলেছো।

মিথ্যে বলেছে?নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে ত্রয়ী।নিজের বলা কথাগুলো একবার মনে মনে আওড়ায় ত্রয়ী।কই না তো সে তো একদম মিথ্য বলেনি।তাহলে সুপ্ত কেন বললো সে মিথ্যে বলেছে?ত্রয়ী কঠিন চোখে পিছনে তাকিয়ে সুপ্তের পানে তাকায়।শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-আমি একদম মিথ্যা কথা বলিনি।শুধু আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না সুপ্ত।

-হোয়াট ইউ সে?তুমি যখনই বিপদে পরবে তখন সবসময় আমি থাকবো না বাঁচানোর জন্য?কিন্তু সত্য এটাই মেডাম,যখনই তুমি বিপদে পড়বে তোমাকে বিপদ স্পর্শ করার আগেই আমি সে স্থানে উপস্থিত হবো।তোমার বাহুতে হাত রেখে তোমাকে আগলে ধরে আমি তোমার দিকে আক্রমণাত্মক দৃষ্টিতে তাকানো মনুষ্যের নাশে উঠে পরে লাগব।শুধু বিপদে আপনার সমস্ত ইগো সাইডে রেখে আমায় ডাকবেন বধু সাহেবা।

ত্রয়ী হাত মুঠো করে দাঁড়ায়।ওড়নায় খামচে ধরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয়।কেননা সুপ্ত কথা বলতে বলতে তার নিকটে চলে এসেছে,অতি নিকটে!এতটা নিকটে চলে এসেছে যে লোকটার নিঃশ্বাস আঁচড়ে পরছে তার মুখশ্রীতে।সুপ্তের হাতে থাকা মশালের আগুন নিভতে চলেছে।নিভে যাওয়া আগুনের শেষ উজ্জ্বল্যে ত্রয়ী সুপ্তের গাঢ় চোখের মুগ্ধ চাহনি,তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা নেত্র যুগল অবলোকন করে নেয়।ত্রয়ীর হৃদয় বলে উঠে এই মুগ্ধতা বহুদিনের!

আচমকা বাতাসে সে আগুনটুকুও নিভে যায়।সুপ্ত চাঁদের আলোতে মায়াবী হয়ে উঠা মুখশ্রীতে তাকিয়ে বলে উঠে,

-আর তোমার মনও এটাই বলেছে কিন্তু তুমি সেটাকে উপেক্ষা করে বিবেকের বার্তা শুনেছো।এটাই তোমার কন্ঠস্বরে কম্পন সৃষ্টির কারণ।

ত্রয়ী সুপ্তের চোখ থেকে দৃষ্টি সরায়।নিচদিক তাকিয়ে বলে উঠে,

-যদি আপনাকে ইনফর্ম করার মতো পরিস্থিতিই না থাকে তবে?

-তবে হৃদয় দিয়ে ডেকো।কেননা তোমার হৃদয় আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে বহুআগেই।হৃদস্পর্শে প্রেম সমুদ্রে ডুবন্ত আমি আপনার ডাক শুনতে বাধ্য বধূ সাহেবা।

ত্রয়ী আর একটা শব্দ উচ্চারণ বা করে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।কিছুটা দূরত্বে স্থির সুপ্ত নিঃশব্দে হেসে উঠে তাতে।হাতের লাকড়ি ফেলে সেও দ্রুত গতিতে পা বাড়ায়।
.
জেলখানায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কুঠুরি।দু হাটুর মাঝে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে এক যুবক।অনেক উঁচুতে থাকা জানালা থেকে চাঁদের আলোয় আবছা আলোকিত হয়েছে কুঠুরিটি।কারাগারের কপাট খোলার আওয়াজে মাথা তুলে যায় যুবকটি।দাঁড়ি-গোফে তার পুরো মুখ ঢাকা। বহু চিরুনি না পরায় চুলগুলো অগোছালো হয়ে আছে।যুবকটি চোখ তুলে তাকালেই এক মধ্যবয়ষ্ক ব্যক্তিকে দেখতে পায়।সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত ব্যাক্তিটি যে বেশ প্রভাবশালী একজন তা তার ভাবসাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

মধ্যবয়স্ক লোকটি যুবকটির সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়।সোনার টুকরো ছেলের এই হাল দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে তার।যুবকটি চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে।লোকটি ছেলের এইভাবে তাকানো দেখে বলে উঠে
,
-তুই চিন্তা করিস না।যে তোর এই অবস্থার জন্য দায়ী আমি ওই ব্যারিস্টারকে ছাড়বো না।ওর মান-সম্মান আমি মাটিতে মিশিয়ে দিবো।

হঠাৎ যুবকটি হিংস্র হয়ে উঠে।বসা থেকে দাঁড়িয়ে লোকটি অর্থাৎ তার বাবার কলার ধরে বসে।আচমকা এমন হওয়ায় ঘাবড়ে যায় লোকটি।কলার থেকে ছেলের হিংস্র খাবা সরানোর চেষ্টা অনবরত চালায় সে।যুবকটি ক্ষিপ্ত আওয়াজে বলে উঠে,

-এই এক কথা এক মাস ধরে বলছিস তুই।এখনও কিছু করতে পারছিস না।শুনেছি ও নাকি বিয়েও করে নিয়েছে।বিয়ে করে বউ নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে, আর আমি!আমি এখানে শক্ত রুটি খাচ্ছি আর খেটে যাচ্ছি।

মধ্যবয়স্ক লোকটি তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠে,

-আমি ওর বউকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম কিন্তু..

-কিন্তু তাতে কারোর কিচ্ছু হয়নি।তোর মুরোদ আমার বোঝা হয়ে গেছে।তুই শুধু আমাকে এখান থেকে বের করার ব্যবস্থা কর।

কথাটুকু শেষ করে যুবকটি লোকটির কলার ছেড়ে দেয়।নিজের ছেলে তাকে এভাবে তুই-তুকারি করে কথা বলেছে এটা লোকটার জন্য বেশ অসম্মানজনক।কিন্তু গত দুমাস যাবত এই বদ্ধ কুঠুরিতে থেকে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে তার ছেলে।
তখনই জেলার সাহেবের আওয়াজ ভেসে আসে,

-স্যার আপনার সময় শেষ।বেরিয়ে আসুন।

লোকটি জেলারের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবে ছেলে তার কলার ধরেছে এটা দেখেনি তো?তার পর বসে নিচদিক তাকিয়ে থাকা ছেলের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে কুঠুরি থেকে বের হয় লোকটি।
লোকটি যাওয়ার দশমিনিট বাদেই খাবার দেওয়া হয়।যুবকটি একটুকরো রুটি ছিড়ে মুখে দিতেই চোখমুখ বিকৃত করে থালা সুদ্ধ রুটি ছুঁড়ে মারে দেওয়ালে।স্টিলের থালা শব্দ তুলে ঝংকার দিয়ে উঠে।যুবকটি মুখ দিয়ে বিরবিরয়ে বলে,

-শা*লা এক খাবার খেতে খেতে মুখ পচে গেছে।

পরক্ষণেই হাত শক্ত করে মুঠো করে ফেলে যুবকটি।যে করেই হোক তাকে এখান থেকে বেরোতে হবেই।
.
জানালা দিয়ে সূর্যের রশ্মি কক্ষে প্রবেশ করতেই ঘুম পাতলা হয়ে আসে সুপ্তের।তখন কানে স্পষ্ট কর্ণগোচর হয় পাখিদের কিচির মিচির।বাইরের শীতল বাতাস এসে সুপ্তের চোখেমুখে আঁচড়ে পরে। সুপ্ত চোখ মেলে ঘরের ভেতর ত্রয়ীকে খুঁজে।নেই,ত্রয়ী ঘরে নেই।কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থেকে সুপ্ত বিছানা থেকে উঠে পরে।আজকে সকাল আর বাকি সকালগুলোর মাঝে যেন আকাশকুসুম তফাৎ!

সুপ্ত ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে ফোন হাতে নিতেই বাইরে থেকে তোহার বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠ কানে আসে সুপ্তের।সে ভ্রু কুঁচকে কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে বাইরে কি হচ্ছে।

-মা তুমি দেখছো আপি কি রঙের শাড়ি পরছে?

রান্নাঘরে রাঁধছিলেন ত্রয়ীর মা।তোহার কথায় কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কি রঙ?

-বারান্দায় বসে আছে।তুমি নিজেই গিয়ে দেখো।

তোহার চোখমুখের অবস্থা দেখে তোহাকে রান্নাঘরে রেখে তিনি নিজেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান।বারান্দার এককোনায় ঝুঁড়ির পাশে সাদা রঙের বাঙালি ধরনে শাড়ি পরিহিতা রমনী যে ত্রয়ী এটা বুঝতে দেরি করেন না তিনি।রেগেমেগে একপ্রকার দৌড়ে মেয়ের কাছে এসে দাড়ান তিনি।খেঁকিয়ে বলে উঠে,

-তুই সাদা শাড়ি কেন পরছিস?ঘরে তোর স্বামী আছে কোন আক্কেলে তুই সাদা রঙের শাড়ি পড়ছস তুই?তোর কি আর কোন শাড়ি নাই।

ত্রয়ী যেন মায়ের এই কথার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল।ঝুঁড়িতে থাকা চারটে শাপলাফুলের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের পানে তাকায় ত্রয়ী।বেশ কিছুক্ষণ আগেই গোসল করার দরুন চুল এখনো ভেজা ত্রয়ীর।তাই চুল ছেড়ে রেখেছে।ক্ষন বাদে বাদে একফোঁটা-দুফোটা করে জলও পরছে চুল থেকে।বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিল ত্রয়ী উঠে দাড়িয়ে মার উদ্দেশ্য বলে,

-আছে।তবে আমার আজ এই রঙের শাড়িই পরতে ইচ্ছে করেছে।

ত্রয়ীর এই জবাবে ত্রয়ীর মার মেজাজ আরো চটে যায়।পাড়া-পড়শীরা দেখলে কি বলবে?সধবা মেয়ে বিধবাদের ন্যায় সাদা শাড়ি পরেছে।কিন্তু মায়ের এরূপ ভাবনাকে নিয়ে ত্রয়ী মাথায় ঘামায় না।ঝুড়ি থেকে একটা শাপলা ফুল হাত নিয়ে রুমের দিকে পা পাড়ায় সে।আজ ভোরবেলা উঠে পুকুরে নেমে ফুলগুলো তুলেছে ত্রয়ী।একহাত সমান ডাঁটা রেখে দিয়েছে ফুলগুলোর।
রুমে আসতেই দেখে সুপ্ত ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।চোখ মোবাইলে নিবদ্ধ।

নুপুরের আওয়াজ কানে আসতেই চোখ তুলে তাকায় সুপ্ত।হায়!চোখ তুলে তাকে একবার দেখায় বোধয় সবচেয়ে বড় ভুল ছিল?
সাদা শাড়ি পরিহিতা রমনীর একহাতে শুভ্র পুষ্প।কোন প্রসাধনী বিহীন মুখশ্রীতে সকালের শিশিরের ন্যায় স্নিগ্ধতা লেপ্টে।কপালের মধ্যস্থলে প্রথম দিনের মত ছোট লাল টিপ।চুলগুলো সোজা সিঁথি করে ছেড়ে রাখা,কানে সবুজ স্টনের দুল।সুপ্ত মুগ্ধ হয়ে দেখে ত্রয়ীকে।যেন সদ্য পুষ্পিত কোন শুভ্র ফুল!
ত্রয়ীর হাতের সাদা শাপলা লক্ষ্য করে সুপ্ত বলে উঠে,

-সাদা শাপলা তোমার প্রিয় ফুল?

ত্রয়ী হাতে থাকা ফুলের পানে তাকিয়ে স্মিত হাসে।তারপর বলে,

-প্রায় সব ফুলই আমার প্রিয়। বিশেষ করে সাদা ফুল।

ত্রয়ী চোখ তুলে সুপ্তের পানে চায়।সুপ্ত তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।কেমন মোহাচ্ছন্ন সেই দৃষ্টি!

ত্রয়ী স্বভাববশত সুপ্তকে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-আর আপনার প্রিয় ফুল?

সুপ্ত বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে ত্রয়ীর পানে এগোয়।কাছাকাছি এসে ত্রয়ীর হাতের পুষ্প নিজ হাতে নিয়ে নেয় সুপ্ত।এতে ভ্রু কুঁচকে সুপ্তের দিকে তাকায় ত্রয়ী।সুপ্ত ত্রয়ীর কানের পিঠে সরু ডাটার শাপলা গুঁজে দিতে দিতে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে উঠে,

-ত্রয়ী মেহরোজ!

চলবে…

ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।