হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-১৩+১৪

0
128

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৩.
-নিজেকে কি ভাবেন উনি?যখন ইচ্ছে প্রাণেশ্বরীর ন্যায় গুরুত্ব দিবে আর মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করবেন যেন উনার ঘরে আমার কোন অস্তিত্বই নেই!

বিরবির করতে করতে তন্দ্রার দরজায় নক করে ত্রয়ী।তন্দ্রা দরজা খুলে ত্রয়ীকে থমথমে মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু জিজ্ঞেস না করে প্রথমে ঘরে প্রবেশ করতে বলে।ত্রয়ী রুমে প্রবেশ করতেি প্রথমে তন্দ্রাকে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে,

-আজকে তোমার সাথে ঘুমালে তোমার কোন সমস্যা হবে তন্দ্রা?

-নাহ ভাবি সমস্যা কেন হবে।কিন্তু তুমি ভাইয়াকে রেখে আমার সাথে ঘুমাবে?

-তুমি ওই ধুরন্ধর মানুষটার কথা আমার সামনে বলবে না।

তন্দ্রা ত্রয়ীর রাগ্বানিত চেহারার দিকে চায়।মেয়েটা রাগে ফুঁসছে!নিশ্চয়ই বড়-ঝড় কেন ঝগড়া হয়েছে।তন্দ্রা মনের সন্দেহ দূর করার জন্য বলে,

-সুপ্ত ভাইয়ের সাথে তোমার কোন ঝগড়া হয়েছে?

-ঝগড়া কেন হবে?উনার তো আমার ফোন রিসিভ করার অবধি সময় নেই। আমার সাথে ঝগড়া করার সময় আদো আছে ওনার!কই আমি তো ওনাকে বলিনি যে আমাকে প্রতিদিন কলেজে দিয়ে আসুন,নিয়ে আসুন।এতদিন ঢং দেখিয়ে নিয়ে এসেছে আর এখন অন্য কারোর জন্য উনি সে সময় বের করতে পারে না।

তন্দ্রা নিষ্পাপ মুখে ত্রয়ীর সব অভিযোগ শুনে।তারপর ঠোঁট টিপে হাসে অগোচরে।বেচারি বড্ড রেগে আছে।ত্রয়ী বলতে বলতে বিছানায় বসে পরে।মুখশ্রীতে অভিমানের ছাপ লেপ্টে।বারবার ঠোঁট চেপে নিছক আসা কান্না রোধ করার চেষ্টা করছে সে।তন্দ্রা কি বলবে ভেবে পাই না।সে চুপচাপ বসে বসে সব অবলোকন করতে থাকে। বরাবরই সে চুপচাপ স্বভাবের।খুব একটা কথা সে বলে না।ত্রয়ী হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।পিংকুকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসছে বলে চলে যায়।তন্দ্রা ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নেয়।তারপর হোয়াটসঅ্যাপে ভাইয়াকে ফটাফট মেসেজ করে কয়েকটা।ঘুমে আছন্ন সুপ্তের নিকট সেই মেসেজগুলো পৌঁছায় না।মাথা ব্যথায় কাবু হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে সে।
ত্রয়ী থমথমে মেঘময় মুখশ্রীতে তাদের রুমে প্রবেশ করে।রুমে প্রবেশ করে ডানদিকে তাকাতেই বিশাল আরশি দৃষ্টিগোচর হয়।

তাতে প্রতিফলিত হয়েছে ঘুমন্ত এক সুদর্শন।কপালে হাত থেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে সেই সুদর্শন যুবক।ত্রয়ী কিছুক্ষন সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে পিংকু খুঁজে।পিংকুর জন্য নির্ধারিত বাক্স নেই।ত্রয়ীর বজর বিছানার দিকে যেতেই দেখতে পায় শুভ্র রঙের ছোট প্রানীটা সুপ্তের পায়ের নিকট শুয়ে আছে।ত্রয়ী অপ্রসন্ন মুখে বিছানার কাছে আসে।তারপর পিংকুকে ঘুম থেকে তুলে খাবার খেতে দিতে দিতে বিরবির করে বকা দেয়।সেই সুক্ষ্ম আওয়াজ কানে ঢ়েতেই সুপ্ত ঘুমের মাঝেই স্মিত হেসে নড়েচড়ে আবার ঘুমায়।খাওয়া শেষে পিংকু আবার সুপ্তের কাছে এসে গুটিশুটি মেরে পা ঘেঁষে শুয়ে চোখ বুঁজে।ত্রয়ী কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে,ভাবে অনেককিছু তারপর বলে,

-সকলের মনে প্রাপ্তির বাসনা জাগাতে যে পুরুষ সক্ষম,যে পুরুষকে পাওয়ার জন্য নারী হৃদয় উন্মুখ হয়ে থাকে তার স্ত্রী হওয়া কোন সহজ বিষয় নয়!

তারপর নিচমুখ হয়ে তাচ্ছিল্য হাসে সে।নিজের উপর!সে তো শুধু মানুষটার উপর মুগ্ধ হয়েছিল তবে কেন তাকে স্বয়ং স্বামীরুপে পাওয়ার পর এই যন্ত্রণা?কেন তার পাশে অন্য নারীর ছায়াও বিষময় মনে হয়?কেন?

ত্রয়ী দরজার কাছে পৌঁছে সুপ্তের পানে তাকায়।তারপর হঠাৎ শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-আপনি আর কখনে আমাকে স্পেশাল ফিল করাবেন না উকিল সাহেব।কেননা তারপরে অবহেলার পাহাড় আমার সহ্য হবে না।

অভিমানী রমনী দরজা আটকে চলে গেল।অথচ সে জানলোই না অপর পাশের পুরুষটির সাধনার কথা,তাকে পাওয়ার সাধনার কথা!
মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে ত্রয়ীর সন্ধানে ব্যস্ত সুপ্তের হস্ত।কিন্তু প্রতিদিনকার মতো পাশে অতি কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেহ সংস্পর্শে বনা পেতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে তার।উঠে বসে ডাক লাগায়,

-ত্রয়ী।

অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই কন্ঠ ভেসে আসে না।সুপ্ত কপাল কুঁচকায়।বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে তখনই পায়ের কাছে কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে সে।ভালো করে তাকালেই দেখতে পায় তার বধূর অতি আদরের বিড়াল ছানা।সুপ্ত আস্তে করে সেটাকে হাতে নিয়ে বাক্সের মধ্যে রেখে আসে।বিছানায় ত্রয়ী নেই।ডাকের কেন সাড়া নেই।সুপ্ত উঠে এসে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়ায়।সেখানেও নেই!কপালে বিস্তর ভাঁজ পরে সুপ্তের।চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে ফোন হাতে নিতেই তন্দ্রার মেসেজ দৃষ্টিগোচর হয় তার।ভ্রু কুঁচকে সেটা ওপেন করতেই ভেসে উঠে,

-শোন ভাইয়া,ভাবি রাগ করে আমার সাথে ঘুমিয়েছে।যাকে বিয়ে করার জন্য মায়ের কাছে বায়না করেছিস তাকে ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারবি না জানি।তাই আমার ঘরের দরজা খুলে রেখেছি।এসে নিয়ে যাস নিজের রাগিনীকে।

সুপ্ত মেসেজ দেখে ফোন বিছানায় আছড়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরে।
ঘুমের মাঝে হঠাৎ ত্রয়ীর মনে হয় কেউ তাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে।পেটে আর হাঁটুর উপরে পুরুষালী স্পর্শের ছোঁয়া।ত্রয়ীর নিকট এই স্পর্শ অতি পরিচিত না হলেও অপরিচিত নয়।ত্রয়ী অনুভব করে তাকে শূন্যে তুলে চলতে শুরু করে দিয়েছে যুবকটি।ত্রয়ী অতিকষ্টে টেনেটুনে চোখ খুলে।দোতলায় আবছা আবছা আলোয় সুপ্তের গম্ভীর মুখশ্রী দৃশ্যমান হতেই পাগলা কুকুরের ন্যায় ক্ষেপে যায় ত্রয়ীর মন।ঘুম ফুরুট করে প্রস্থান করে।ত্রয়ীর হাত অজান্তেই সুপ্তের গলা আঁকড়ে ছিল।সেখানে ইচ্ছাকৃত নখের সাহায্যে চাপ প্রয়োগ করে ত্রয়ী।তারপর বলে,

-রাত বিরোতে ঘুম থেকে তুলে ফাজলামো করছেন আপনি?ঘুমোচ্ছিলেন তো আপনি উঠলেন কেন?

ত্রয়ীর কন্ঠ যতটা উগ্র ততটায় শান্ত দৃষ্টিতে ত্রয়ীর চোখের দিকে তাকায় সুপ্ত।তার দুচোখে কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার বিরক্ততা।সুপ্তের ভেজা চুল থেকে একফোঁটা পানি টুপ করে ত্রয়ীর গালে পরে।আচমকা এমন হওয়ায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় ত্রয়ী।
সুপ্ত অতি শান্ত মেজাজে সুধায়,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড ত্রয়ী?লুক ইনটু মাই আইস এন্ড টেল মি!

ত্রয়ী চোখ মেলে তাকায়।সরাসরি দৃষ্টি রাখে সুপ্তের চোখে।কিছুটা রাগ,কিছুটা অভিমান মিশ্রিত সে চাহনি দেখে সুপ্তের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে।এভাবেি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয় ত্রয়ী।কত শত অভিযোগ যা শব্দে ব্যক্ত করা কঠিন তা নেত্র দ্বারা বলে ফেলে অর্ধাঙ্গের কাছে।
ত্রয়ী একসময় চোখ নামিয়ে কন্ঠ খাদে নিয়ে বলে,

-আমাকে নামান।

সুপ্ত ত্রয়ীকে বিছানার নরম গদিতে এসে বসিয়ে দেয়।তারপর নিজেই ফ্লোরে বসে ত্রয়ীর হাতের মুঠোয় হাত গুঁজে দেয়।ত্রয়ী নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে সুপ্তের দিকে তাকায়।সুপ্ত ত্রয়ীর পানে তাকিয়ে বলে,

-কি হয়েছে বলুন মহারানী?

ত্রয়ীর মুখে আপনা আপনি তাচ্ছিল্য ফুটে উঠে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

-মহারানী!অথচ তার ফোনের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না আপনি।

তারপর থামে ত্রয়ী।ফের বলে,

-আপনি নিজমুখে স্বীকার করুন বা না করুন।আপনার কাছে আমার কোন মূল্য নেই!

ত্রয়ীর কন্ঠে একরাশ কষ্ট ও অভিমান।এবার সুপ্তের নিকট ত্রয়ীর রাগের কারণ স্পষ্ট।সুপ্ত করুন চোখে অর্ধাঙ্গিনীর পানে তাকায়।এবার অভিমানী বধূকে কিভাবে বোঝাবে সে।প্রচন্ড জেদি যে তার বউ!উপরন্তু সুপ্তের একটা কথাও বিশ্বাস করতে নারাজ সে।

-ত্রয়ী আমি জানি তুমি আমার কোন কথায় বিশ্বাস করবে না বাট ট্রাস্ট মি,আজকে আমার ফোন আমার সাথে ছিল না।বালিশের নিচে ছিল সারাদিন!

ত্রয়ী সুপ্তের কথায় বোকা চোখে তাকায়।তারপর বলে,

-কিন্তু বেলাকে অনেক শপিং করিয়ে দিয়েছেন এটা তো মিথ্যে নয়!

-আমি ওকে শপিং করিয়ে দেইনি।জাস্ট ড্রপ করে বাড়িতে নিয়ে এসেছি।

ত্রয়ীর অভিমান কিছুটা গলে।তবুও পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না।সুপ্ত বসে বসে বউয়ের অভিমানী মুখশ্রী দেখে।ঘুম ঘুম চোখ,অভিমানে উল্টে রাখা ঠোঁট।সুপ্তের হঠাৎ কি হয়!
ত্রয়ীর কোমল ওষ্ঠ তার পুরুষালি ওষ্ঠ আঁকড়ে ধরে।আকস্মিক ঘটনায় ত্রয়ী ভড়কে সুপ্তের টিশার্ট খামচে ধরে।সুপ্ত তখন তার কেমল ঠোঁটে আছন্ন।ত্রয়ী চোখ বন্ধ করতেই গরম অশ্রু গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে।এই অশ্রু কিসের প্রতীক বোধগম্য হয় না রমনীর।

চলবে..

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
১৪.
-মিসেস ত্রয়ী মেহরোজ,ক্যান ইউ ফিল দ্যা হার্টবিট?

সুপ্তের বক্ষস্থলের নিকট ত্রয়ীর একহাত চেপে প্রশ্ন খানা করে সুপ্ত।ত্রয়ী নিচমুখ তাকিয়ে আছে।একটু আগে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত চুম্বনের দৃশ্য ভাসছে অক্ষিপটে।হাতের তালুতে সুপ্তের অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া হার্টবিটের অনুভব আর ঠোঁটে সুপ্তের আদুরে স্পর্শ লেগে থাকার কথা ভাবতেই স্বর্ণাভ কপোল লজ্জার রক্তিমায় ছেঁয়ে যায়।সুপ্তের দৃষ্টি ত্রয়ীর সুশ্রী মুখশ্রীতে বিচরণ করছে।গালে লজ্জার আভা অবলোকন করে মৃদু হাসে সে।তারপর ত্রয়ীর কানের কাছে মুখ এনে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

-আপনি কি জানেন বধু সাহেবা,আপনাকে সম্পূর্ণরুপে পাওয়ার জন্য কত আকুল এই হৃদয়?কতটা ব্যাকুল আমি আপনার লজ্জা মিশ্রিত সম্মতি পাওয়ার জন্য!ডু ইউ নো।

ত্রয়ীর কানে সুপ্তের বলা কথা ঝংকার তুলে।চোখ বন্ধ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে ত্রয়ী।তা দেখে দুষ্টু হাসে সুপ্ত।শুভ্র দাঁত উঁকি দেয় তাতে।সুদর্শন যুবকের চেহারায় আরো এক নতুন উজ্জ্বল্য দেখা দেয়।
ত্রয়ী শুকনো একটা ঢোক গিলে বলে,

-আমার খিদে পেয়েছে।আমি রাতে ডিনার করিনি।

রোমান্টিক কথাবার্তায় বউয়ের এমন কথায় করুন চোখে তাকায় সুপ্ত।ত্রয়ী ফের বলে,

-আপনি কি এখন আমাকে রান্না করে খাওয়াতে পারবেন,?

ত্রয়ী লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য প্রসঙ্গ বদলায়।নয়ত সুপ্তের লাগাম ছাড়া কথাবার্তায় সাহসী ত্রয়ী অক্কা যেত।তারপর সত্যিই ত্রয়ী অভুক্ত!সুপ্তও সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছে।

সুপ্ত খুব বেশি রান্না না জানলেও কিছু কিছু পারে।কিশোর বয়সে শখ করে মা-কাকিমার সাথে শিখেছে।
বউকে নিয়ে কিচেনের উদ্দেশ্য হাঁটে সুপ্ত। ত্রয়ী পেছন পেছন হেঁটে আসে।এত শক্তপোক্ত হৃদয়ের ত্রয়ী কেমন লজ্জায় মোমের ন্যায় গলে যাচ্ছে অথচ যে এমন নির্লজ্জ কথাবার্তা বললো তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই।মনে হচ্ছে সে একটু আগে ত্রয়ীকে বলেছে,

-তুমি কি রাতে ডিনার করেছো ত্রয়ী?

সুপ্ত নুডলস রাঁধছে আর ত্রয়ী বুকে হাত গুঁজে তা অবলোকন করছে।রান্না অবলোকন করছে বললে মস্ত বড় ভুল হবে কেননা ত্রয়ীর দৃষ্টি কেবল সুপ্তের চাপ দাঁড়ি ঘেরা মুখশ্রীতে বিচরণরত।পরম মুগ্ধতায় সুপ্তের অগোচরে তাকে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হাসছে ত্রয়ী।কিন্তু সুপ্ত যে আড়চোখে তার ঠোঁট লেগে থাকা হাসি থেকে পুরো ত্রয়ীটাকেই প্রতক্ষ করছে তা ত্রয়ীর অজানা।সুপ্ত রান্না শেষ করে ত্রয়ীর উদ্দেশ্য বলে,

-আপনার জন্য খাবার প্রস্তুত,বধূ সাহেবা!

ত্রয়ী এক ধ্যানে সুপ্তকে দেখায় মগ্ন থাকায় সুপ্তের কথায় চমকে থাকায়।সুপ্তের সামনে এভাবে চমকে উঠায় খানিক লজ্জা এসে গ্রাস করে তাকে।ত্রয়ী সুপ্তের হাত থেকে নুডলস ভর্তি বাটি নিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটে।সুপ্তও পিছন পিছন এসে রুমের দরজা লক করে।ত্রয়ী মুখে একটু নুডলস পুরে সুপ্তের উদ্দেশ্যে বলে,

-আপনিও তো ডিনার করেননি!অর্ধেকটা আপনি খান।

সুপ্ত কিছু না বলে দুষ্ট হাসে।ত্রয়ী সেই হাসি দেখে প্রস্তুত হয় আরেকটা বেশরম মার্কা কথা শেনার জন্য।সুপ্ত সময় নিয়ে বলে,
-এটা তুমি খাও।দ্যান..আই ওয়ানা ইট ইউ!
.
রাত্রির আঁধার শেষে সূর্যের কিরণ চোখে মুখে পড়তেই চোখ কুঁচকে ফেলে আরসালান।নিত্যদিনের মতো আজকে দিন আর রাতের পার্থক্য বুঝতে সমস্যা হয় না তার।বেলকনির রেলিং এ মাথা ঠেসে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে আরসালান তবে রৌদ্রের তীব্রতা আর উষ্ণতা প্রখর হওয়ায় ঘুমানো দায় হয়ে দাড়ায়।আরসালান বিরক্ত মুখে উঠে দাড়ায়।উঠতে গিয়ে পায়ের কাছে মদের বোতল ধাক্কা লাগে।আরসালান বিরক্ত মুখে পা দিয়ে মদের বোতল ছুঁড়ে মারে রেলিং এ।কাঁচের বোতল রেলিং এ বারি খেয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।আরসালান হেলেদুলে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বেরোয়।ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই নানান খাবারের গন্ধ নাকে এসে ঠেকে।আরসালান দ্রুত খাবার টেবিলে বসে পরে।আরসালানের মা কণা চৌধুরী ছেলেকে ডাইনিং এ বসতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসেন।খাবার বেড়ে দিয়ে পিপাসু চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে।কালকে থেকে আজকে আরসালানকে শতগুন ভালো দেখাচ্ছে।নয়ত কালকে দাড়ি-গোঁফ,চুলে কয়েকগুন বয়ষ্ক প্রতিলক্ষিত হচ্ছিল তাকে।
আরসালানের মায়ের দিকে খেয়াল নেই। সে বহুদিনের অভুক্তের ন্যায় গোগ্রাসে খাবার খেতে থাকে।বহুদিন পর ছেলেকে নিজের সামনে খেতে দেখে কণা চৌধুরীর হৃদয় মাতৃত্বের আবেগে প্রফুল্ল হয়ে উঠে।ছেলের খাওয়ায় তদারকি করতে থাকেন তিনি।

লম্বা,চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী আরসালান।উজ্জ্বল শ্যামলা দেহের অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকে রুপকথার রাজকুমারদের ন্যায় লাগে।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া ছেলেকে জেলের ঘানি টানতে হয়েছে শুধুমাত্র নিজের দুশ্চরিত্রের হেতু।নয়ত বাবার দৌলত আর পরিচিততে সম্মানের সাথে চলাফেরা করতে কি কেন বাধা ছিল?ছেলের ব্যবহার আর চালচলন নিয়ে বড্ড অসন্তুষ্ট কণা চৌধুরী।তার সাথে একটা চাপা রাগ তৈরি হয়েছে ফারহাদ চৌধুরীর প্রতি।উনার কারনেই ছেলের মধ্যে বেহায়াপনা ও দুশ্চরিত্রের ন্যায় স্বভাব তৈরি হয়েছে।যে কিনা মেয়েদের সম্মান লঙ্ঘন করতেও দুবার ভাবে না।

আরসালানের পর চৌধুরী সাহেবের আর কোন সন্তান হয়নি তাই ছেলের শত দোষ থাকা সত্বেও মাথায় তুলে রাখেন কণা চৌধুরী।
আরসালান খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়াতেই তাকে ডেকে উঠে।

-আরশ!কোথায় যাচ্ছো?

আরসালানের পরনে আকাশি রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি।হাতে দামি ঘড়ি।সবকিছু লক্ষ্য করে কণা চৌধুরী ছেলেকে প্রশ্ন করে।

-কাজ আছে মা।

-তুমি তো আমার মাথা চিরদিনের মত নিচু করে দিয়েছো।কিন্তু এখন চরিত্রে লাগাম টানো।এমন কিছু করো না যাতে পরবর্তীতে মাকে শেষবার কাফনে মোড়ানো অবস্থায় দেখতে হয়।

কণা চৌধুরী খুবই কঠোর ও সচেতন ধরনের মানুষ।যা এই চৌধুরী পরিবারকে একে হাতে সামলানোর জন্য উপযুক্ত।কিন্তু তারপরও তিনি ছেলেকে সঠিক পথে আনতে পারেনি।
আরসালান মায়ের কথা শুনে কোন জবাব না দিয়েই বেরিয়ে আসে।কণা চৌধুরী সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে ছেলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রয়।

-এতদিনেও একটা কাজ করতে পারিস নি।শা*লা কা*পুরষ!

আরসালানের পায়ের জোড় বাড়লে পায়ের নিচে থাকা লোকটি গুঙিয়ে উঠে।আরসালানের শক্ত চোখে মুখে তাকিয়ে রয় লোকটির দিকে।নাকের পাটা ফুলে উঠে তার।রোদ এসে পরায় তাতে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু গামের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়।আরসালান লাথি দিয়ে লোকটিকে ছুঁড়ে মারে দূরে।তারপর আলিশান একটা চেয়ারে এসে বসে পরে।ইশারা করলে পাশ থেকে একজন জ্বলন্ত সিগারেট এগিয়ে দেয়। আরসালান পরম রাজকীয় ভঙ্গিতে কালচে রাঙা ঠোঁটে গুঁজে দেয় সেটা।নিকোটিনসমৃদ্ধ কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আশেপাশে তাকায় সে।জায়গাটা তাদের বিশাল মহলের সামনের অংশ।বিভিন্ন গাছ আর ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে আছে এই অংশটি।জায়গা জুড়ে সৌন্দর্য বিরাজ করলেও এই স্থানে শোষনের কাজ চলে।বাড়ির মহিলাদের এই স্থানে আশা নিষেধ এমনকি কণা চৌধুরীর উপরও এই নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।

আরসালান আবার ওই লোকটির দিকে তাকায়।তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি।লোকটা এতক্ষণে ভূমি থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে।আরসালান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-তোকে আর একটা সুযোগ দিচ্ছি।হয় তুই ওকে মারবি নয় আমি তোকে মারবো!

লোকটি শুকনো ঢোক গিলে।তারপর আরসালানের উদ্দেশ্য বলে,

-হুজুর এইবার আর কোন ভুল হবে না।

আরসালানের সন্দেহের সহিত বাঁকা হাসে।তারপর বলে,

-তোর সাথে আমিও থাকব।সচক্ষে দেখবো তোর মত গাধার ব্যর্থতা।তারপর তোকে মারবো আমি।অনেকদিন হয় প্রাননাশ হয় না!

বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পরে আরসালান।সেই সাথে লোকটার ভয় দ্বিগুণ হয়।হাত পা কাঁপতে থাকে অনবরত!

.
-ভাবী!ত্রয়ী ভাবী!

পুরুষালী কন্ঠে দুই-তিন বার ভাবী ডাক শুনলেও সাড়া দেয় না ত্রয়ী।কিন্তু নিজের নাম শোনার পর চমকে পেছনে তাকায় ত্রয়ী।আধা পরিচিত একটি মুখ হেসে উঠে তাতে।ত্রয়ী চলা থেকে স্থির হয়।যুবকটি ততক্ষণে তার নিকটে এসে পৌঁছেছে।ত্রয়ী মনে করার চেষ্টা করা লোকটির নাম যেন কি ছিল?
রিক্ত দাড়িয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠে।তাকে দেখতে দেখতে ত্রয়ীর নামটা মনে পরে যায়।রিক্ত না কি যেন ছিল!
রিক্ত বলে,

-আপনার তো হাঁটার সেই স্পিড ভাবী!আমি তখন থেকে ফলো করছি তবুও নাগাল পাচ্ছি নাহ!

ত্রয়ী সামান্য হাসে।রিক্ত ফের বলে,

-আমাকে চিনতে পেরেছেন ভাবী?আমি সুপ্তর বেস্ট ফ্রেন্ড।

ত্রয়ী মাথা উপর নিচ করে হ্যা বোঝায়।তারপর বলে,

-চলুন হাঁটা যাক।কাজে গিয়েছিলেন আপনি?

রিক্তের ফর্মাল ড্রেসআপ দেখে প্রশ্ন করে ত্রয়ী।রিক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-বেকারের আবার কাজ!ইন্টারভিউ দিতে দিতেই জীবন শেষ।আরেকটু ভালোভাবে পড়লে আপনার মেডিকেল কিংবা সুপ্তের মতো ল্যায়ার হতে পারতাম!

ত্রয়ী রিক্তের আফসোস মিশ্রিত কন্ঠ শুনে পেছনে ঘুরে রিক্তের পানে তাকায়।রিক্তের হাতে ফাইল দেখে ত্রয়ী আশ্বাস মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,

-চিন্তা করবেন না।ইনশাআল্লাহ দ্রুতই একটা চাকরি পাবেন!

রিক্ত ত্রয়ীর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট করে একটা ইনশাআল্লাহ বলে ত্রয়ীর পেছন পেছন হাঁটতে থাকে।

-বেরিয়েছে?

-জ্বি হুজুর!

আরসালানের কথা শুনে ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয় সুটার লোকটি।তারপর তাক করে রাখা বন্দুকের নলে চোখ রেখে হেঁটে যাওয়া রমনীকে দেখতে থাকে।আরসালান লোকটির কোমড়ে গুঁজে রাখা দূরবীন নিয়ে চোখের সামনে ধরে।তারপর বলে,

-কোন মেয়েটা?

-ওইযে লাল জামা আর সাদা ওড়না দিয়ে পরা মাইয়াডা।

আরসালান দূরবীন দিয়ে রাস্তায় দৃষ্টি রাখে।বর্তমানে তারা মাঝারি উচু বিল্ডিং এর তিনতলায় অবস্থান করছে যেটা ত্রয়ীর মেডিকেল কলেজের কিছুটা সামনে অবস্থিত।এখান থেকে রাস্তাটা ভালো করে দেখা যায়।এই জায়গা থেকেই পূর্বে ত্রয়ীকে মারার চেষ্টা করেছিল লোকটি।কিন্তু সুপ্ত এসে ত্রয়ীকে নিয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।আজকে হেঁটে হেঁটে আসছে শিকার।মোক্ষম সুযোগ!

আরসালান দূরবীন দিয়ে তাকালে দেখতে পায় খয়েরি রঙের লং হাতা কামিজ ও সেলোয়ার পরিহিতা এক রমনী খুব দ্রুত হেঁটে আসছে।খয়েরী রঙকে লাল বলে সম্মোধন করেছে লোকটি।ত্রয়ী মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকালে পুরো মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়।ঘন পাপড়ি ঘেরা ডাগর ডাগর আঁখি,সরু নাক,নাকের মাথায় লালচে তিল আর সোজা সিঁথি করে লম্বা বেনি করায় তার সুশ্রী চেহারা ফুটে উঠেছে দারুণভাবে।

আরসালানের দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসে।পাপ মিশ্রিত জবান থেকে কল্পনাতীত বেরিয়ে আসে পবিত্র শব্দ।’মাশাল্লাহ’

তখনি সুটার লোকটি উল্লাসের সহিত বলে উঠে,

-আজকে এর খেল খতম হুজুর!

তৎক্ষনাৎ তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় আরসালান।কোমড়ে গুঁজে রাখা বন্দুক বের করে গুলি ছুঁড়তে উদ্ধত হয় লোকটির পানে।ঠিক সেই মুহুর্তে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ লাগায় লোকটি।সেই মুহুর্তে একটা গুলি এসে তার মস্তিষ্ক বরাবর লাগে।তবুও ঘটে যাওয়া অঘটন আটকানোর চেষ্টা বিফলে যায় আরসালানের।বন্দুক থেকে গুলি ততক্ষণে বেরিয়ে পরেছে রক্তমাংসের একটা শরীরকে ভেদ করবে বলে।বাইরে থেকে মেয়েলি আর্তচিৎকার ভেসে আসলে লোকটিকে ধাক্কা মেরে নিজে তার জায়গায় এসে দাঁড়ায় আরসালান।সচক্ষে দৃষ্টি রাখে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রোডে!

চলবে..