#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৫.
সুপ্তের আকাঙ্ক্ষিত চক্ষু ত্রয়ীর স্বাভাবিক চোখে মুখে বিচরণ করছে।রমনীর মুখশ্রী বেশ স্বাভাবিক অথচ হৃদয়?সেটাও কি স্বাভাবিক?কালকের ক্রন্দনের ছাপ কি একটুও লেপ্টে নেই মুখশ্রীতে?
ত্রয়ী সুপ্তের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা থেকে নিজের দৃষ্টি লুকাতে বলে উঠে,
-আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন,আমি খাবার নিয়ে আসি।
ত্রয়ী দরজার দিকে এগোতে নিলেই সুপ্তের বলিষ্ঠ হাত ত্রয়ীর বাহু চেপে ধরে।ত্রয়ী ফিরে তাকায় স্বল্প করুন চোখে।সুপ্ত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কিছু হয়েছে?বলো আমাকে।
ত্রয়ী হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সুপ্তের চোখের তীক্ষ্ণতা বাড়ে।সাথে বাড়ে কন্ঠের গাম্ভীর্যতা!
-নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।আমার চুল কেটে ফেলেছো!রহস্যময় কথাবার্তা!তুমি বলবে নাকি আমি জোর করবো?
ত্রয়ীর বাহুতে হাতের চাপ বাড়তেই চোখ দিয়ে জল গড়ায় ত্রয়ীর।সুপ্ত হকচকিয়ে উঠে সামান্য।দ্রুত বাহু ছেড়ে দিয়ে পুরো ত্রয়ীটাকেই আগলে নেয় বুকের মাঝে।মৃদু কন্ঠে সুধায়,
-বলো বউ কি হয়েছে?
সুপ্তের প্রেমময় বানীতে ত্রয়ীর নীরব কান্নার বেগ বাড়ে।ক্রমেই ভিজতে থাকে সুপ্তের প্রশস্ত বক্ষদেশ।সুপ্ত আরো যত্নে আগলে নেয় স্ত্রীকে।ত্রয়ী মিহি কন্ঠে অভিযোগের স্বরে বলে উঠে,
-আমি তো আহামরি সুন্দর নই।আর না আমার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা।এতটা আকর্ষণীয় তো নই যার জন্য আমাকে হ্যারেসমেন্টের শিকার হতে হবে!আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জোর চালানোর প্রচেষ্টা করা হবে।আমার জীবনটা এত কঠিন কিভাবে হয়ে গেল সুপ্ত?
ত্রয়ীর ভেজা কন্ঠ সুপ্তের হৃদয়ে দাগ কাটে।সে শান্ত কন্ঠে সুধায়,
-কাল আরসালান তোমায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল?
ত্রয়ী মাথা তুলে তাকায় সুপ্তের দিকে।মাথা উপর নিচ করে হ্যা বোঝায়।ত্রয়ী তড়িঘড়ি করে বলতে নেয়,
-কিন্তু বিশ্বাস করুন আমাকে টাচ করতেও পারিনি।আমার চুলে হাত দিয়েছিলো।কেটে ফেলেছি আমি ওখানেই!আপনি..
ত্রয়ীর ঠোঁটে আঙুল চেপে তাকে থামিয়ে দেয় সুপ্ত।তারপর বলে,
-কিছু বলার প্রয়োজন নেই।আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।তুমি খাবার নিয়ে এসো।
সুপ্ত ত্রয়ীর কপালে আলতো করে ওষ্ঠ ঠেকায়।তারপর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।ত্রয়ী কিছুক্ষণ ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে রুম থেকে বের হয়।
ওয়াশরুমে প্রবেশ করতেই সুপ্ত শান্ত মুখশ্রী বদলে কঠিন হয়ে উঠে।হাত আপনা আপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে।টিশার্ট ঝুলিয়ে শাওয়ারর নিচে দাঁড়ায় সে।দেহে পানি কনা পরতেই শুভ্র শার্ট ভিজে সুঠাম গড়নের দেহ ফুটে উঠে।কপাল অবধি এসে ঠেকা ভিজে চুল পেছনে ঠেলে দেয় সুপ্ত।দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠে,
-তুই নিজের সীমা ছাড়িয়ে আমাকেও সীমা ছাড়াতে বাধ্য করলি!এই হার তো ছিল আমার চালের এক অংশ মাত্র!তোর কি মনে হয় তোর পাঠানো সার্ভিস গার্লকে চিনতে আমার খুব বেশি সময় লেগেছিল?
নিজে নিজেই কথাখান বলে বাঁকা হাসে সুপ্ত।পরক্ষণেই সেই হাসি মিলিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠে মুখমন্ডল।
.
সকালের ব্রেকফাস্ট করে টিভির সামনে বসে আরসালান।উদ্দেশ্য আরেকবার নিউজে দেখানো সুপ্তের নামের সেই অপবাদ শ্রবণ করে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া।রিমোট চেপে টিভি অন করে কাঙ্ক্ষিত নিউজের অপেক্ষা করতেই অনাকাঙ্ক্ষিত খবর শুনে সে।মুহুর্তেই চোখ মুখ অনুভূতি শূন্য আসে আরসালানের।কিন্তু পরক্ষণেই কানে পুলিশের গাড়ির সেই চেনা পরিচিত আওয়াজে চোখ মুখ ভয়ে শুভ্র হয়ে উঠে তার।
পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন কনা চৌধুরী।ফারহাদ চৌধুরী বাড়ি নেই।বিজনেসের কারনে দেশের বাইরে অবস্থানরত সে।কনা চৌধুরী নিচে নেমে দেখেন ইনস্পেকটর এসেছেন।উদ্দেশ্য তার গুনধর ছেলেকে গ্রেফতার করা।অন্যসময় হলে তিনি হয়ত তাদেরকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে কিন্তু আজ তিনি সিঁড়ির নিকট ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন।আরসালানও যেন কোন প্রকার বাধা দিল না।শুধু মায়ের পানে একবার তাকিয়ে ইনস্পেকটরের সাথে সাথে চললো।এই একটা মানুষকেই আরসালান সামান্যতম পরোয়া করে।জন্মদাত্রী মা তো!
আরসালান চলে যাওয়ার পরও কনা চৌধুরী সেই একইভাবে বাইরের দিকল তাকিয়ে রইলেন।চোখে মুখে কোন অনুভূতির আস্তানা নেই!নেই আগের বারের মত সেই বিচলিত চেহারা!ভেজা গলার স্বরে ছেলের জন্য আহাজারি করার ছন্দময় ক্রন্দন!
ভদ্রমহিলা বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়।সময় যেতেই একফোঁটা উষ্ণ অশ্রু তার শুভ্র কপোল স্পর্শ করে।ভদ্রমহিলা শুকনো একটা ঢোক গিলে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠ যান।এইবার তিনি আর চাইছেন না ছেলে ঘরে ফিরুক!বরং তার মনুষ্য বিবেক বলছে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য!
বাড়ির বাইরে বেরোতেই জনগনের হামলার শিকার হয় আরসালান।বাড়ির বাইরে লোকেদের ভীড়!বুড়ো,জোয়ান,বাচ্চাদের ভীড় সেথায়।সেই জন সমোহর থেকে কেউ কেউ নিজের পায়ের জুতোর মোহ ত্যাগ করে সেটা ছুঁড়ে মারছে আরসালানের দিকে।কেউবা হাতে টমেটোর ন্যায় সবজি নিয়ে এসেছে নিক্ষেপ করার জন্য।আরসালান নিজের দিকে ধেয়ে আসা জিনিস এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু নিক্ষেপকৃত বস্তুুর সংখ্যার এতই যে তার কপালে জুতোর বাড়ি পরেই যাচ্ছে!
পরদিন দশ-টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।সুপ্ত ডিফেন্স লয়ারের জায়গায় দাড়িয়ে আরসালানের পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসে।মুহুর্তেই সেটা মিলিয়ে যায়।সেই ভাইরাল ভিডিও আদালতে প্লে করা হয়েছে।সেটা শেষ হতেই সুপ্ত বলে উঠে,
-ইউর অনার আমার প্রাক্তন এসিস্ট্যান্ট মিস নিঝুমকে কাঠগোড়ার আনার অনুমতি চাইছি।
-অনুমতি দেওয়া হলো।
জজ সাহেবের অনুমতি পাওয়ার পর বেশ সময় নিয়ে নিঝুম কাঠগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়।কাচুমাচু করে নিচ দিকে তাকিয়ে আছে সে।এটা লজ্জায় না কিসে বুঝতে পারছে না সুপ্ত।
সুপ্ত কাঠ গোড়া থেকে অনেকটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
-মিস নিঝুম আপনার আমার সাথে এমন করার কারনটা কি ছিল?আপনি কেন আমার সম্মানের আর এই কেসের পেছনে পরেছিলেন?
নিঝুম কাচুমাচু করে সুপ্তের দিকে তাকিয়ে একবার আরসালানের পানে তাকায়।নিঝুম চুপ করে আছে দেখে সুপ্ত নিজেই বলতে শুরু করে,
-ইউর অনার আমার সেইদিনই আমার এসিস্ট্যান্টের উপর সন্দেহ হয় যেদিন আমি ওনাকে সাথে নিয়ে ডক্টর কিরনের কাছ থেকে কেয়ার রিপোর্টটা দিতে আসি।সেইদিনই মিস নিঝুমের রিপোর্ট দেখে বিচলিত হয়ে পরা আমার চোখে বাজে!তারপরেও আমি কোন পদক্ষেপ নিইনি কেননা আমি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম।তারপর যখন আসল রিপোর্ট বদলে নকল রিপোর্ট রাখা হয় আমার সন্দেহ তখন স্পষ্ট হয়ে উঠে।যার ফলশ্রুতিতে কেসটা আমি হেরে যায় আর কেয়াকে বিনাদোষে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।যে এখন মৃত!
সুপ্ত থামার সাথে সাথে কোর্ট জুড়ে পিনপতন নিরবতা ছেঁয়ে যায়।
সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস আবার নিঝুমকে বলতে শুরু করে,
-আপনাকে সত্যতা স্বীকার করার সুযোগ দিচ্ছে আদালত।নয়ত গোপন ক্যামেরাটিতে সমস্ত কিছু ধরা পরেছে।সাথে সাথে স্পষ্ট করে শোনা যাচ্ছে আপনার উচ্চারিত সেই নাম।যার কথায় আপনি এসমস্ত কিছু করেছেন।আরসালান চৌধুরী!
-হ্যা আসলালান চৌধুরী ওনার কথাতেই এসব করেছি আমি।ওনার কথাতেই রিপোর্ট আমিই বদলে দিয়েছি!
আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই দেখে নিঝুম উর্ধশ্বাসে সবটুকু স্বীকার করে নেয়।তার চোখে মুখে অপরাধের ছাপ ফুটে উঠে সু্ক্ষভাবে।
সুপ্ত আলগোছে বলে,
-আপনি এমনটা না করলে একটা নিষ্পাপ প্রাণ বেঁচে থাকত আজ!
সুপ্ত থেমে ফের বলে,
-ইউর অনার ডক্টর কিরন কেন সেদিন মিথ্যা বলেছিলেন তা জানার জন্য উনাকে কাঠ গোড়ায় আনার অনুমতি চাইছি।
-অনুমতি দেওয়া হলো।
-আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল ইউর অনার।আমি সত্যি মিথ্যে না বলি তবে আমার বউ বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হবে!
চলবে…
#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২৬.
-*** ধারা(জানা নেই।গুগল করে পাইনি) অনুসারে আরসালান চৌধুরীকে পরপর দুটি ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদন্ডে এবং মিস নিঝুমকে মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হলো।দ্যা কেস ইস ক্লোজড!
জজ সাহেবের রায় ঘোষণার পর সুপ্ত নিচদিক তাকিয়ে ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মৃত্যুদন্ডের কথা শুনে স্তব্ধিত আরসালানকে পুলিশ আদালত থেকে নিয়ে যেতে থাকে।সুপ্ত আলগোছে এসে আরসালানের সামনে দাঁড়ায়।শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– প্রথমবার অসৎভাবে কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর তোর কাছে সুযোগ ছিল শুধরে যাওয়ার।অন্তত ধর্ষণের মত জগঘ্য অপরাধ থেকে দূরে থাকতে পারতি।কিন্তু না!তুই সেটা করিস নি।নাও ইউ ডিজার্ভ দিস পানিশমেন্ট।আলবিদা!
কথাখান বলেই সুপ্ত ঘুরে সামনে এগোতে থাকে।তার প্রতিটি পদক্ষেপে তার বিজয় গর্জে উঠে।গৌরবের নুর ফুটে উঠে সুপ্তের বাঁকা হাসির ভাঁজে।নিজের গাড়ির নিকট পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরনের কালো কোর্ট খুলে হাতে ঝুলিয়ে নেয় সে।এই মুহুর্তটাতে তাকে অসম্ভব সুদর্শন দেখায়।মুখে কেস জেতার মৃদু হাসি,চরিত্রে লাগা সমস্ত মিথ্যে কলঙ্ক ধুয়েমুছে সাফ করে গাড়িতে উঠে বসে সুপ্ত।
.
বাড়িতে এসে হাতের কোর্ট বিছানায় মাত্র রেখেছে সুপ্ত।তখনই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ত্রয়ী।ব্যস্ত কন্ঠে সুধায়,
-কেসটার কি সিদ্ধান্ত হলো?আপ..আপনি জিতেছেন তো?
আগের বার জেতা কেস হেরে যাওয়ায় ত্রয়ী মনে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্নখানা করে।সুপ্তের মনে হঠাৎ দুষ্টমি ভর করে।সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে,
-তুমি আমাকে পেয়ে জিতেছ কি না সেটা বল।
ত্রয়ী সুপ্তের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায়।আরশিতে সুপ্তের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে দেখে সুপ্তের অধর কোণে মিটিমিটি হাসি।ত্রয়ী ক্ষেপে উঠে মুহুর্তে।ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
-আমি চিন্তিত আর আপনি মশকরা করছেন আমার সাথে!
-হ্যা!
সুপ্ত সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে পেছনে ফিরে ত্রয়ীর দিকে তাকায়।তারপর বলে,
-কেস ইস ক্লোজড।অপরাধীরা তাদের প্রাপ্ত শাস্তি পেয়েছে।
তবুও ত্রয়ীর নাকের পাটা সামান্য ফুলে।সুপ্তকে কাবার্ড থেকে একটা স্কাই ব্লু রঙের শার্ট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন।মিনিকে আজকে আংটি পড়াতে আসবেন উনারা।
ত্রয়ী রুম থেকে বেরিয়ে গেলে সুপ্ত আলগোছে হাসে।বিরবিরয়ে বলে উঠে,
-রাগো রাগান্বিতা!রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো!
সুপ্ত বেরিয়ে এসেছে দশমিনিট সময় নিয়ে।তার কিছুক্ষণ পরেই ত্রয়ী রুমে এসে তাড়া দিয়ে নিচে পাঠায় ওনাকে।পাত্র পক্ষ এখনো আসেনি।কিছুক্ষণের মাঝেই এসে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে।তাই ত্রয়ী তাড়াতাড়ি তৈরি হতে এসেছে।
সুপ্তের সাথে ম্যাচিং করে হালকা আকাশি রঙের একটা শাড়ি পড়েছে ত্রয়ী।সাথে সাদা হাত খাটো ব্লাউজ।
কানে পাথরের ঝুমকো পরেছে।চোখে গাঢ় করে কাজল এঁকেছে।চোখে সামান্য লিপস্টিক লাগিয়ে চুলে হাত লাগিয়েছে ত্রয়ী।চুলে হাত দিতেই মনটা বিষিয়ে উঠে ত্রয়ী।তার এত শখের এত লম্বা চুল এখন কেবল পিঠ পর্যন্ত!মন খারাপ নিয়ে ধীরে সুষ্ঠে চুলে ফেঞ্চ বেনি করে ত্রয়ী।তারপর আরশিতে নিজেকে ভালোভাবে খেয়াল করে লক্ষ করে হাত দুটি বেশ খালি খালি লাগছে।ত্রয়ী তার ব্যাগ ঘেটে সাদা রঙের কাচের চুড়ি বের করে করে।তারপর সেটা হাত গলিয়ে পরে নেয়।ত্রয়ীর সকল অলংকার পর্যবেক্ষণ করে দেখে আজকে পরা সব অলংকারই সাদা বর্ণের।এমনকি ত্রয়ীর পায়ের নুপুরেও সাদা পাথর বিদ্যমান।তখনই রুমে প্রবেশ করে সুপ্ত।মোবাইল নিতে এসেছিল সে।তার হঠাৎ আগমনে আরশিতে নিজেকে একদৃষ্টে দেখতে থাকা ত্রয়ী চমকে উঠে খানিক।ঘাড় ঘুরিয়ে সুপ্তকে দেখতেই হঠাৎ করে লজ্জা এসে ভর করে ত্রয়ীর মনে।মাথা নিচু করে নিচ দিক তাকিয়ে রয় সে।
সুপ্ত দরজার কাছটায় এসে থমকে দাড়িয়েছে।চোখের পলক পরছে না।ত্রয়ী আড়চোখে সেটা লক্ষ্য করে আরো লজ্জায় ডুবে যায়।পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে উঠে সে কেন এত লজ্জা পাচ্ছে আশ্চর্য?এভাবে লজ্জা পাওয়ার মেয়ে তো সে নয়।
সুপ্ত ত্রয়ীতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ধীরে ধীরে এগোয়।ত্রয়ী এবার মাথা তুলে তাকায়।সুপ্তকে যখনই শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখে তখনই ত্রয়ীর হৃদয় ধক করে উঠে।সুঠাম দেহে শার্ট খুব ভালোভাবে মানায় কি না!সুপ্ত শুধু মাত্র তার পেশাদার ড্রেসে ফুল হাতা শার্ট পরে নয়ত সবসময় হাতা ফোল্ড করে রাখে সে।
ফর্সা হাতের লোম বেরিয়ে আরো আকর্ষনীয় লাগে তখন।ত্রয়ী গাঢ় চোখে তাকায়। তারপর সুপ্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে পা বাড়ায়।ওমনি নিজের হাতে সুপ্তের শক্তপোক্ত টান অনুভব করে সে।সুপ্ত তাকে এনে দাঁড় করায় নিজের সামনে।সারা মুখশ্রীতে চক্ষুদ্বয়ের বিচরণ ঘটিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-তাহার রাগিনী রুপ বড্ড সুন্দর হলেও তাহার মোহিনী রুপ প্রাননাশী!
ত্রয়ী থম মেরে সামনে তাকিয়ে রয়।সুপ্ত চুলের বেনি খুলতে খুলতে বলে,
-এই সাজে বেনি মানাচ্ছে না।খোঁপা করে নাও।
সম্পূর্ণ বেনি খুলে দিয়ে সুপ্ত ড্রেসিং টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।পেছনে ফেলে যায় তার বিস্ময় নিয়ে থম মেরে থাকা প্রানপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে।
সেদিন সয়নকে না দেখলেও আজ পাত্র অর্থাৎ নিজ ভাইয়ের পাশেই বসে আছে সে।আশেপাশে তেমন তাকাচ্ছে না।মাথাটা একদম নিচ দিক তাকিয়ে আছে।ত্রয়ীরা মিনিকে নিয়ে আসলে সয়ন উঠে দাড়িয়ে পাত্রের পাশে জায়গা করে দেয়।পাত্রের নাম অয়ন।মিনিকে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে ত্রয়ী সুপ্তের পাশে এসে দাড়ায়।তারপর দৃষ্টি রাখে হবু স্বামী-স্ত্রী হতে চলা দুজনের উপর।সুন্দর মানিয়েছে।সুপ্তের দিকে তাকিয়ে ত্রয়ী আস্তে করে বলে উঠে,
-দুজনকে খুব মানাবে তাই না?
সুপ্ত কিছু না বলে গম্ভীর হয়ে সামনে তাকিয়ে।ত্রয়ীর দিকে অব্দি তাকাচ্ছে না।ত্রয়ী অভিমানে ঠোঁট ফোলায়।তারপর সেখান সুপ্তের পাশ থেকে সরে এসে ননদের পাশে দাড়ায়।
তন্দ্রাকে খানিক চিন্তিত দেখাচ্ছে।ত্রয়ী কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জানায়,
-মা নাকি রিক্ত ভাইকে দাওয়াত দিয়েছিল আজকে।কই উনি আসছেন না তো!
ত্রয়ী আলগোছে দরজার দিকে তাকায়।রিক্ত এসে পৌঁছেছে মাত্র।মিসেস সুহৃদের সাথে কুশন বিনিময় করছে।ত্রয়ী মিথ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
-কে এলো না এলো সেটা এখন আর তোমার চোখে পরবে না ননদিনী!তোমার দৃষ্টি কেউ হরন করলো না তো?চোখের সামনে থাকা জলজ্যান্ত মানুষকে তুমি মনের ভেতর খুঁজে বেড়াচ্ছ!
তন্দ্রা চমকে আশেপাশে তাকায়।দূরেই দাড়িয়ে থাকা রিক্তকে দেখে ওষ্ঠকোণে আপনা আপনি হাসি ফুটে তার।পরপরই ভাবির কথা কানে বাজতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে তার কপোলদ্বয়।তা দেখে মিটমিটিয়ে হাসে ত্রয়ী।
সুপ্ত রিক্তকে লক্ষ করে তার দিকে আসতে বলে ইশারায়।এখনই আংটি পড়ানো হবে দেখে ত্রয়ীরাও সামনে এসে দাঁড়ায়।
অয়ন প্রথমে মিনির হাতে আংটি পরায়।তারপর মিনি।মেয়েটা কেমন চারপাশে চোখে বুলাচ্ছে খুশিতে।তা লক্ষ করে তন্দ্রা ত্রয়ীর কানে কানে বলে উঠে,
-দেখ মেয়েটার লজ্জা শরম একদমই নেই!কি রকম আশেপাশে স্বাভাবিক ভাবে তাকাচ্ছে!আমি হলে তো লজ্জায় মরে যেতাম!
ত্রয়ী তন্দ্রার কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে ভাবতে থাকে,আচ্ছা সে কি তাকে আংটি পড়ানোর সময় লজ্জা পেয়েছিল?নাকি পাইনি।
তারপর ত্রয়ী সুপ্তের পানে তাকায়।তাকে দেখেই তার দেখে দৃষ্টি সরায় লোকটা।ত্রয়ী মনে মনে বলে উঠে,
-অসভ্য পুরুষ!
আংটি পরানো শেষে খাওয়া দাওয়া সয়নরা গেছে।এখন রান্না ঘরে সব গোছগাছ করছে মিসেস সুহৃদ ও মিনির মা।ত্রয়ী আর তন্দ্রা হেল্প করছেন ওনাদের।কাজ শেষে একটু বাগানের এদিকটায় হাঁটতে বেরোয় ত্রয়ী।পেছন পেছন আসে তন্দ্রা আর মিনি।বেলা নেই।চড় খাওয়ার পরদিন সকালেই সে গায়েব হয়ে গেছে অর্থাৎ বাড়ি চলে গেছে।
বাগানের দক্ষিণ দিকটায় একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার পাতানো আছে।রেহনেওয়াজরা মাঝে মাঝে বিকাল বেলা সকলে মিলে নাস্তা করে এখানে।ত্রয়ী বাগানে এসে দাঁড়াতেই বিয়ের পরের দিনের স্মৃতি স্মরণে আসে তার।সুপ্তর সাথে তর্কাতর্কি আর তারপর গুলি তাকে পাশ কাটিয়ে ফুলদানিতে লাগা!কতটা লোমহর্ষক ছিল সেই মুহুর্ত!
বাগানে আগে থেকেই ছিল সুপ্ত,রিক্ত আর বর্ণ।খোশ গল্পে মজে ছিল তারা।কালো শার্টে মোড়ানো উজ্জ্বল শ্যামলা বরনের পুরুষটিকে দেখে হাঁটার গতি মন্থর হয় তন্দ্রার।কিন্তু তার খেয়ালে নেই তন্দ্রা।বর্ণের সাথে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে সে।মাঝে মাঝে শুভ্র দাঁত বের করে হেসে উঠছে।তন্দ্রার এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে মিনির মত লজ্জা কম থাকাই মনে হয় শ্রেয়!এইযে সে এখন রিক্তের নিকটে যেতে চাচ্ছে তার পাশে বসতে চাচ্ছে কিন্তু অজানা এক কারনে তার পা চলতে চাইছে না।
মিনি সবার আগে আগে যেয়ে একটা চেয়ার দখল করে বসে পরেছে।সাথে পাও ঢুকিয়ে দিয়েছে কথার মাঝে।আড্ডা নিতে মেয়েটা বড্ড পারদর্শী কি না!
রিক্ত হঠাৎ কিছুটা দূরত্বে থাকা শুভ্র রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা রমনীর দিকে খেয়াল করে।কাচুমাচু করে এদিকেই এগিয়ে আসছে।ওমনি ভ্রু জোঁড়া কুঁচকে আসে তার।এখানে আসতে এত লজ্জা কিসের?কই সেইদিন তো রাতেই কেমন চলে এসেছিল তার বাসায়।হঠাৎ চোখ তুলে তাকায় তন্দ্রা!তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরায় রিক্ত।বুকের বা পাশে কি যেন একটা লাফিয়ে উঠে।অস্থির হয় তার দৃষ্টি!
ত্রয়ী কিছু একটা ভেবে সকলের উদ্দেশ্য বলে,
-চা বানিয়ে আনব?চা খেতে খেতে গল্প আরো জমে উঠবে!
তার সাথে তাল মিলিয়ে বর্ণ বলে উঠে,
-মনের কথা বললে তুমি ভাবি।আমি এখনই তোমাকে চা বানিয়ে আনতে বলতাম।একদিন মাথা ব্যথায় আমাকে চা বানিয়ে খাইয়েছিলে।যা হয়েছিল চা টা।
বর্ণ আর মিনি দু ভাই বোনেই হাস্য রসিক আর তেমন লজ্জা পায় না।ত্রয়ী বর্ণের কথায় হেসে যেতে নিবে তখনই সুপ্তের পাশে খালি চেয়ারটায় বসে তন্দ্রা।রিক্তের পাশে চেয়ার খালি থাকলেও সখানে বসার সাহস তার হয়ে উঠেনি।ত্রয়ীর উদ্দেশ্যে সে মিনমিন কন্ঠে বলে উঠে,
-ভাবী ভাইয়া তো চা খায়না!ভাইয়ার জন্য কফি আনতে পারবে?
ত্রয়ী আলগোছে সুপ্তের পানে তাকায়।সে নিজেও তন্দ্রার দিকে তাকিয়েছে।ত্রয়ী মাথা নেড়ে চলে যায়।
চা বানিয়ে এনে সকলকে পরিবেশন করে ত্রয়ী।তারপর সুপ্তের জন্য এক্সট্রা করে আনা কফির মগটা সুপ্তের সামনে রেখে নিজে চায়ের কাপ নিয়ে সুপ্তের পাশে বসে পরে।সকলে ততক্ষণে চায়ে ফু দেওয়া শুরু করেছে।ত্রয়ীর হাতের চা খাওয়ার জন্য সকলে বেশ আগ্রহী।
ত্রয়ী নিজের সামনে থাকা চায়ের কাপ যেই নিতে যাবে ওমনি সুপ্ত নিজের কফির সাথে ত্রয়ী চা বদলে নেয়।ত্রয়ী অবাক হয়ে সুপ্তের পানে তাকায়।ভদ্রলোক বেশ স্বাভাবিক!অন্যরা আড়চোখে বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে।
ত্রয়ী চাপা স্বরে সুধায়,
-এটা কি হলো?
তখনই তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে সুপ্ত।সুপ্তের নিশ্বাস এসে বাড়ি খায় ত্রয়ীর কানের পিঠে।সুপ্ত ফিসফিসয়ে বলে উঠে,
-আমাকে জিজ্ঞেস না করে কফি এনেছো কেন?এবার খাও কফি।
ত্রয়ী রাগতভাবে তাকিয়ে বলে,
-যখন তন্দ্রা বলছিল তখন কি আপনার মুখে সুপার গ্লু লাগানো ছিল?
সুপ্ত চায়ে এক চুমুক দিয়ে বলে,
-নাহ!এক অপরূপাকে দেখছিলাম।তাই হঠাৎ করে কি বলব বুঝে উঠতে পারিনি।দোষ আমার নয়!সেই অপরূপার।
চলবে..